03/08/2023
মৌ হেসে ভিড়ের দিকে এগোয়। হঠাৎ ওর হাতে টান পড়ে। চমকে উঠে পাশে তাকিয়ে দেখে, আর কেউ না, ওর প্রিয় বান্ধবী শিলাই ওকে টেনে ধরেছে। পাশে মিলা, শায়লা এবং আকাশী। সবাই ওর কলেজ জীবনের বান্ধবী।
একপাশে সরে আসতেই আকাশী বক্রদৃষ্টি হেনে বলে,
"কী রে মৌ? তোর হাবাগোবা বরটাকে আজ আবারও বাসায় রেখে এসেছিস? তা ভালোই করেছিস, সে তো বাংলাতেই ঠিকমতো কথা বলতে পারে না। এখানে এসে অযথা তোকে বিব্রত করতো।"
শিলা রেগে ওঠে। বিরক্ত হয়ে বলে,
"আ! থাম তো, আকাশী। আমরা জন্মগতভাবে বাঙালি। এসব পার্টিতে অযথা ব্রিটিশদের ভং ধরে ইংরেজিতে বোলচাল মারার দরকারটা কোথায়?"
মৌ ম্লান হেসে বলে,
"এজন্যই আজ ওকে আনিনি। আগে একদিন এনেছিলাম, সেদিন ও আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে আমাকে সবার সামনে বিব্রত করেছে। সেবার ফ্রেন্ড সার্কেলের কে হাসেনি বল? আমি তো লজ্জায় রীতিমতো মাটির সাথে মিশে যাচ্ছিলাম। আর না, ভাই!"
শিলা গম্ভীর হয়ে ওঠে। ও বলে,
"মানেটা কী? কেউ ইংরেজিতে গড়গড় করে কথা বলতে পারলেই সে যোগ্য, সে ভালো? বাকিরা অযোগ্য?"
মৌ বলে,
"বাদ দে। ওকে না এনে ভালোই করেছি। অন্তত ও তোদের বরের মতো স্মার্টলি সবার সাথে গল্পগুজব তো করতে পারতো না! অযথা বিরক্তি বাড়তো। চল কোথাও গিয়ে বসি।"
ওরা পাঁচ বান্ধবী হেঁটে একটা নিরিবিলি জায়গাতে এসে বসে। আজ ওরা সব বন্ধু-বান্ধবীরা এক হয়েছে। বছরে কয়েকবার ওরা একত্রিত হয়, আড্ডা দেয়। আজও তেমন একটা দিন। ওদের চারজনের কথায় বিঘ্ন ঘটিয়ে শিলা একটা কাশি দেয়। সবাই ওর দিকে তাকায়। ও বলে,
"আজ তোদের সাথে একটা ব্যক্তিগত ব্যাপারে কথা বলব। শুনবি?"
বাকি চার জন সোৎসাহে রাজি হয়। শিলা আঙুল তুলে খানিকটা দূরে দাঁড়ানো সুদর্শন কবিরকে দেখায়। কবির গড়গড় করে ইংরেজি বলছে। সবার সাথে হাসিমুখে পরিচিত হচ্ছে। প্রত্যেকেই তার দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে একবার হলেও তাকাচ্ছে। তাকাতে বাধ্য হচ্ছে বলা চলে। শিলা বলে,
"ওকে দেখে কেমন মানুষ মনে হয়? উচ্চ শিক্ষিত, সুদর্শন, মিশুক, নম্র এবং সুন্দর মনের একজন মানুষ। তাই তো?"
চারজনই হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। তাদের কারোরই সন্দেহ নেই যে কবির একজন যোগ্য সঙ্গী, সেরা পুরুষ।
শিলা হাসে। হেসে ওর হাতের উপর থেকে শাড়ির আঁচল সরায়। হাতে ছোপছোপ রক্ত জমাট বাঁধার দাগ। ওর গলা, পেটের কিছু জায়গাতে কাপড় ঘষে প্রসাধনী তুলে ফেলে। সেখানেও কালশিটে পড়া দাগ। চার প্রিয় বান্ধবীর হতভম্ব মুখের দিকে একবার তাকিয়ে সে হু-হু করে কেঁদে ওঠে। মৌয়ের দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলে,
"ঐ যে গড়গড় করে ইংরেজি বলতে পারা সুদর্শন পুরুষটাকে দেখছিস না? ও বাসাতেও এমন ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে আমাকে জাত-পাত এক করে গালি দেয়। ও যখন আমাকে জন্তুর মতো মারে, তখনও ওর মুখ থেকে অধিকাংশ ইংরেজি শব্দ বেরোয়। তুই কি এমন ইংরেজি বলা স্বামী চাস? হ্যাঁ, আমি বলছি না যে সব শিক্ষিত, স্মার্ট পুরুষ এমন। কিন্তু যে কবিরের সাথে তোরা সর্বদা আফজাল ভাইয়ের তুলনা করিস, এই দুজনার ভেতর কে যোগ্য? আমি বাইরে লোকদেখানো হাসি হেসে থাকি। এখান থেকে বেরিয়ে বাসায় ঢুকতে আমার বুক কাঁপবে। মনে হবে হয়তো কোনো ভুলচুক করে ফেলেছি এখানে, যার শাস্তি ও দিবে। ও পুরো জগতের সামনে সেরা পুরুষ, কিন্তু ঘরে ঢুকলে ও অন্য পুরুষে পরিণত হয়। ওর মোবাইলে অন্তত কুড়িখানেক নারীকে পাবি। যাদের সবাই ওর প্রিয়তমা। আর আমি? তোরা সবসময় বলিস, শিলা এই বয়সেও কীভাবে এত স্মার্টনেস ধরে রেখেছে! অথচ এই মেয়েটাও তার চোখে খ্যাত, কুশ্রী!"
মৌ স্তব্ধ হয়ে যায়। ওর মানসপটে ভেসে ওঠে সাধাসিধা আফজালের মুখচ্ছবি। যে হয়তো এত স্মার্ট না, যে হয়তো গড়গড় করে ইংরেজি বলে সবার সামনে তার মুখ রাখতে পারে না, কিন্তু সে ঘরে তার স্ত্রীকে রানির মতো করে রাখে। সে জগতের সব বাধা বুক পেতে নিয়ে মৌকে প্রশান্তিতে রাখার চেষ্টা করে। সে পারুক না পারুক চেষ্টার ত্রুটি রাখে না। আর বিয়ের পর, এই দুবছরে সে মৌকে শারীরিক, মানসিক, মৌখিক কোনোভাবেই হেনস্তা করেনি। গালি, মারধোর, পরকীয়া তো দূরে থাক!
মিলা, আকাশী, শায়লা তিনজনের চোখে সমবেদনার ছায়া পড়ে। ওরা মুহূর্তের জন্য নিজের সংসারের ছবি কল্পনা করে। না, তারা কেউই পুরোপুরি সুখী না। সবার জীবনেই একটা না একটা বড়ো সমস্যা বা অপূর্ণতা আছে। বাইরে যতই ঠাট বজায় রাখুক, ভেতরে ভেতরে তারা সবাই ভুক্তভোগী।
মিলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
"কেউ মূলত জীবনে সবদিকে সমান পাবি না। কোথাও না কোথাও ঘাটতি থাকবেই। তাই ঘাটতির দিকটা মেনে নিয়েই চলতে হবে। শিলা চেষ্টা কর কবিরের সাথে কথা বলে ওর সমস্যাটা কোথায় তা জানতে। ও কী চায় তা জেনে নে। আর মৌ দয়া করে আফজাল ভাইয়ের মতো একজন সরল মানুষকে এত তুচ্ছ হিসেবে বিচার করিস না। উনার একটা দুর্বলতা আছে, তাকে তা শিখিয়ে পড়িয়ে নে। তুই পারবি। দয়া করে নিজে যেচে জীবনে ঠকতে যাস না। হ্যাঁ আমি এটাই বলছি যে সব ইংরেজি জানা পুরুষ কবিরের মতো না, আবার সব ইংরেজি না জানা পুরুষ আফজালের মতো না। কে কেমন মানুষ তার বিচার তার প্রকৃত রূপের আচরণে। বাইরের মেকি রূপের আচরণে মানুষকে তোরা বিচার করিস না।"
আকাশী লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে থাকে। তার ভেতর অপরাধবোধ কাজ করে। সত্যিই তো, তার নিজের স্বামীও তো সবদিকে সমান যোগ্য না!
মৌ উঠে দাঁড়ায়। সে একবার সামনে বসা শিলাকে টিস্যু দিয়ে চোখ মুছতে দেখে। তারপর খানিক দূরে দাঁড়িয়ে আন্তরিক ভঙ্গিতে কথা বলা সুদর্শন কবিরকে দেখে। তারপর ভিড় এড়িয়ে রেস্তোরা থেকে বেরিয়ে আসে।
মোবাইলটা বের করে আফজালকে কল করে। রিসিভ করতেই বলে,
"আমার এত ভিড়ের ভেতর মাথা ধরেছে। একটু এসে নিয়ে যেতে পারবে? আশেপাশে আছো?"
ওপ্রান্ত থেকে "আসছি" বলেই মানুষটা কল কেটে দেয়।
বেলা পড়ে এসেছে। তপ্ত রোদের ঝাঁঝ কমে এসেছে। খানিকটা দূরেই একটা ফাঁকা জায়গাতে ঝাঁকে ঝাঁকে পায়রা এসে বসেছে। মৌ সেদিকে এগিয়ে যায়। ওর মনটা বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। মিনিটখানেক পরে আফজালের ডাকে ওর ভাবনায় ছেদ পড়ে। ও এসে ব্যস্ত হয়ে বলে,
"এখন কেমন লাগছে? দ্রুত বাসায় চলো। তোমার বিশ্রাম দরকার।"
জবাবে মৌ একটুকরো ম্লান হাসি উপহার দিয়ে বলে,
"এক মিনিটের ভেতর কোথা থেকে এলে? নিশ্চয়ই আশেপাশে কোথাও ছিলে?"
আফজাল ভীষণ লজ্জা পায়। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে,
"কাল তুমি পার্টির কথা বলায় অফিস থেকে ঘুরতে বেরোবো বলে ছুটি নিয়েছিলাম। তাই কাজ ছিল না। ভাবলাম তোমার আশেপাশে থাকি, যাতে রাত হলেও তোমাকে নিয়ে দ্রুত বাসায় পৌঁছাতে পারি।"
মৌ একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলে,
"আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি তোমাকে ছোটো ভাবতে গিয়ে কবে-কবে যে নিজেই এত ছোটো মনের মানুষে পরিণত হয়েছিলাম বুঝতেই পারিনি। তুমি আমার যোগ্য, আমিই বরং তোমার অযোগ্য।"
অফজাল প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে মৌয়ের মুখের দিকে তাকায়। তারপর মৌয়ের একটা হাত ওর একহাতের মুঠোয় চেপে ধরে বলে,
"ক্ষমা এবং ভালোবাসা, দুটোই আমৃত্যু তোমার জন্য থাকবে। এসব আর ভেবো না। যেদিন তুমি আমাকে ভালোবেসেছো, সেদিনই আমি আঘাত করার অধিকারও তোমাকে দিয়ে দিয়েছি। সব তোমার হাতে। তুমি যা চাও!"
মৌ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
"মাথায় ব্যথা হয়নি, আমার মাথায় সমস্যা হয়েছিল। আজ সেসব সমস্যা চিরতরে কেটে গেছে। একটু ফুসকা খাওয়াতে নিয়ে যেতে পারবে?"
আফজাল ভীষণ খুশি হয়ে ওঠে। বহুদিন পর ফুটপাত দিয়ে স্ত্রীর হাত ধরে হাঁটতে-হাঁটতে বলে,
"সেই বিয়ের পর প্রথমদিকে যেখানে ফুসকা খেতাম সেখানে যাবে?"
মৌ উৎসাহের সাথে হ্যাঁ বলে।
শহরের বুকে সন্ধ্যা নেমেছে। শান্ত রাজপথের বুক দিয়ে ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। রাস্তাটা নির্জন। খানিকটা দূরে গাঢ় অন্ধকার। মৌ শক্ত করে আফজালের হাতটা আঁকড়ে ধরে। তারপর বিড়বিড় করে বলে,
"তুমি আমার সেরা বন্ধু। আজ থেকে তোমার হাত আর কখনও ছাড়বো না। তুমি ছাড়বে?"
আফজাল অন্ধকারে হেসে ওঠে। ওর হাসি দেখতে না পেলেও মৌ অনুভব করে। আফজাল হাসিমুখে বলে,
"মরলে ছাড়বো।"
মৌ রাগ করে ফেলে...
মায়াবন্ধন
মাহমুদা মিনি