29/05/2023
স্মৃতির পাতা থেকে
৯ ই ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবসঃ-
দুর্নীতির দুষ্টচক্র ভাঙতে ব্যর্থ কেন দুদকঃ জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনে বাংলাদেশ গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ তারিখে স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তির মাধ্যমে কেউ যদি অন্য কোনও দেশে তার অবৈধ আয় স্থানান্তর করে তাহলে তা বাজেয়াপ্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা যাবে।(শান্তির স্বপ্নে -সময়ের স্মৃতিচারণ- জেনারেল মইন ইউ আহমেদ-৩৬২)
সম্প্রতি মাননীয় প্রধান বিচারপতি আইনজীবীদের এক অনুষ্ঠানে বলেন, রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গের প্রতি জনগণের আস্থা দৃঢ় করতে হলে দুর্নীতির সামান্যতম সংস্রব থেকে সবাইকে দূরে থাকতে হবে। তিনি বলেছেন, 'দুর্নীতি এমন একটি ক্যানসার, যা গণতন্ত্রকে নষ্ট করে, দেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়, রাষ্ট্রের ভিত্তি দুর্বল করে দেয়, জনগণকে বিক্ষুব্ধ করে, জন্ম দেয় ক্রোধের।' (প্রথম আলো, ২৮ নভেম্বর ২০২২)। এ বক্তব্য দেশ, জাতি ও সমাজের সবার প্রতি অতি জরুরি একটি সতর্কবার্তা, একটি উদাত্ত আহ্বান ও গভীর সমাজ পর্যবেক্ষণ। এ আহ্বান সর্বজনীনভাবে সরকারের সব অঙ্গ- আইন, নির্বাহী ও বিচার বিভাগ- সবাইকে স্পর্শ করেছে।
দুর্নীতি ও দুদকঃ-
বৈশ্বিক ও জাতীয় চিত্রঃ
অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ ধীরে ধীরে প্রতিকারবিহীন অপ্রতিরোধ্য একটি দুর্নীতিপ্রবণ দেশ ও সমাজের দিকে ধাবিত হচ্ছে। অনেক তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ পাস হয় এবং বিচারপতি সুলতান হোসেন খানকে চেয়ারম্যান করে প্রথম কমিশন গঠিত হয়। তাঁরা প্রায় নিষ্ক্রিয় থেকেই কর্মকাল শেষ করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে জেগে ওঠে দুদক ও চারদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গলি-ঘুপচিতে মালিকানাবিহীন অনেক গাড়ি পরিত্যক্ত অনেক নেতা ও সাবেক মন্ত্রীদের,আমলাদের বিরুদ্ধে মামলা,এবং তাঁদের গ্রেপ্তার হতে দেখা যায়। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের অনেকে অনেক রকমের বয়ান দেন। অনেকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যান এবং অনেকে প্রায় খাটিয়ায় শুয়ে চিকিৎসার্থে বিদেশে গমন করেন-পরবর্তীতে আর দেশে আসা খবর শোনা যায় নাই। ২০০৮এর নির্বাচনের পর এর অবসান ঘটে। নবগঠিত সরকার প্রায় সাত হাজার মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করে। আবার অনেকের মামলা চালু থাকে এবং নির্দিষ্ট ও নির্বাচিত কিছু মামলায় সাজাও হয়। এখানে রাজনীতির পটপরিবর্তনের সঙ্গে দুর্নীতি দমন ও দুদকের কার্যকারিতার একটি গভীর যোগসূত্র পাওয়া যায়।
বিভিন্ন চেয়ারম্যানের সময় দুদক নানা অভিধায় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়। গোলাম রহমানের সময় 'নখ-দাঁত' ও মেরুদণ্ড', ইকবাল মাহমুদের সময় 'দায়মুক্তি', তা ছাড়া সর্বসময়ে 'রাঘব বোয়াল ও চুনোপুঁটি' প্রসঙ্গ জোরেশোরে উঠতে থাকে। এখন চেয়ারম্যান বা কমিশনারদের আর জনসম্মুখে কথা বলতে দেখা যায় না। কথা যা বলার, দুদকের আইন উপদেষ্টারাই বলেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের যে নম্বর প্রাপ্তি, তাতে বড় ধরনের অগ্রগতি নেই। ২০০০/২০০১ সালে ছিল দশের (১০) মধ্যে ১.১। তা একটু একটু করে বাড়তে থাকে এবং ২০০৫ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত ২-এ এসে স্থির হয়। ২০১০ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ২.৫-এ উপনীত হয়েছে, কিন্তু ১৮০ দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান এখনো ১৪৭। প্রথম স্থানে থাকা নিউজিল্যান্ড ও ডেনমার্কের স্কোর ৮.৮-৯.৬-এর মধ্যে ওঠানামা করছে।
জাতীয়ভাবে দুর্নীতির উন্নতি-অবনতির কোনো নির্ভরযোগ্য মূল্যায়ন নেই। টিআইবি (বাংলাদেশ) কিছু বাছাইকৃত গবেষণা করে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর তা প্রত্যাখ্যান করে। একবার শুধু স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরকে (এলজিইডি) দেখেছিলাম, তারা টিআইবির সঙ্গে বৈঠক করে সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছিল। আন্তর্জাতিকভাবে আমরা আমাদের অবস্থানের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করতে পারিনি। এশিয়ার এ অঞ্চলে আমরা শুধু ধারাবাহিকভাবে আফগানিস্তানের ওপরে অবস্থায় পাওয়া যায়।
আদালতের কড়া বার্তাঃ
ইসলামী ব্যাংকের কেলেঙ্কারির নতুন তথ্য আসার পর দেখা যায়, এখানেও দুদকের এক সাবেকের অধিষ্ঠান। 'জাতীয় শুদ্ধাচার' পুরস্কার দেওয়া হয়, কিন্তু দুরাচারের তিরস্কার করা হয় না। দুদকের মতো জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিচার বিভাগ ও পুলিশেরও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। বিচার বিভাগ মাঝেমধ্যে সোচ্চার হলেও বাকিদের ভূমিকায় জাতি হতাশ।
বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ যে রায় দিয়েছেন, তা দুদকের প্রতি কড়া বার্তাই বটে (প্রথম আলো, ০১ ডিসেম্বর ২২)। তিন মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ না হলে আদালত অবমাননার পাল্টা মামলা হতে পারে। মামলা তদন্তের আইনি সীমা ১২০ দিন, এর মধ্যে খুব কম তদন্তই শেষ হয়। অভিযুক্ত বা অভিযোগকারীরা তদবির করে তদন্ত কর্মকর্তা বদলায়। তদন্ত প্রতিবেদনও বদলিয়ে ফেলে। আমার জানামতে, একটি ক্ষুদ্র মামলা ২০০৭ / ৮ দায়ের হয়ে দু-তিন দফা তদন্ত হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়ে কিছুদিন জেলও খেটেছেন। কিন্তু এখনো মামলার চূড়ান্ত শুনানি হয়নি। যাঁরা মামলাটি করেছেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের হেনস্তাই চেয়েছেন,তা তাঁরা পেয়েছেন। দক্ষ, নিরপেক্ষ ও সময় মেনে তদন্ত সমাপ্ত এখানে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সেই দক্ষতা ও সদিচ্ছা দুদকের থাকতে হবে।
দুর্নীতির সংখ্যা ও অর্থের পরিমাণঃ
দুর্নীতির মামলা দায়ের, তদন্ত ও নিষ্পত্তির সংখ্যা, দুর্নীতির প্রকৃতি, দুর্নীতিগ্রস্তের অবস্থান ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থের পরিমাণ ভিন্ন ভিন্নভাবে মূল্যায়নযোগ্য।ভূমি অফিসের তহশিলদার, নিম্ন আদালতের পেশকার এবং ট্রাফিক কনস্টেবলের ঘুষ গর্হিত দুর্নীতির অপরাধ। কিন্তু লক্ষ-কোটি টাকার ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি, ওভার ইনভয়েসিং- আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে মুদ্রা পাচার ও সরাসরি মানি লন্ডারিং কর্মকাণ্ডে জড়িত দুর্নীতিবাজেরা সংখ্যায় কম, কিন্তু টাকার অংক বিশাল। টিআইবি বা অন্য কোনো সংস্থা একটি সমীক্ষা করে দেখতে পারেন ১৯৯০ থেকে ২০০১, ২০০১ থেকে ২০১০ ও ২০১০ থেকে ২০২০-এ ত্রিশ বছরের ব্যাংকের ঋণখেলাপি, আমদানি- রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা তছরুপ, সরাসরি মানি লন্ডারিং- -এসব মেগা দুর্নীতির অর্থ মূল্য কত? একই সময়ে দুদকে অভিযুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাই-বা কত এবং তারা কারা? এ সময়ে নিঃসন্দেহে অর্থের পরিমাণে দুর্নীতির একটি উল্লম্ফন ঘটেছে। তারা মূলত ক্ষুদ্র একটি পরিচিত গোষ্ঠী, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের দিক থেকে উঁচুতলার মানুষ।
শুধু দুদকই দুর্নীতির সর্বব্যাধি নিবারক নয়ঃ
দুর্নীতির টালমাটাল সাগরে ছোট্ট একটি তরি দুদক। সরকারের প্রতিটি দপ্তরপ্রধানের তাঁর নিজ দপ্তরের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব রয়েছে। মন্ত্রণালয়, দপ্তর, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ উদ্যোগে নিজ নিজ দপ্তরের দুর্নীতি কতটুকু হ্রাস করতে উদ্যোগী হয়েছে, তার বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন প্রয়োজন। প্রতিবছর প্রতিটি দপ্তরে 'জাতীয় শুদ্ধাচার পুরস্কার দেওয়া হয়, কিন্তু দুরাচারের তিরস্কার করা হয় না। দুদকের মতো জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিচার বিভাগ ও পুলিশেরও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। বিচার বিভাগ মাঝেমধ্যে সোচ্চার হলেও বাকিদের ভূমিকায় জাতি হতাশ।
দুর্নীতিতে মূলত জড়িত সব পক্ষের সুযোগ-সুবিধার (উইন-উইন অবস্থান) সম্মিলন। এখানে বহুজনের বহুবিদ প্রাপ্তি,ক্ষতি শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের। তাই সাধারণ মানুষকেও দুর্নীতি প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। জনবান্ধব সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের একইভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
(নিচের অংশটুকু নেওয়া হয়েছে, শান্তির স্বপ্নে -সময়ের স্মৃতিচারণ- জেনারেল মইন ইউ আহমেদ-৩৫৪)
ভয়াবহ দুর্নীতির খণ্ডচিত্রঃ
দুর্নীতির বিরুদ্ধে সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণের কারণে ‘ওয়ান ইলেভেন' সবচেয়ে বেশি, আলোচিত হয়েছে। প্রায় দু'বছর ধরে দেশের সংবাদপত্রসমূহ ভয়াবহ দুর্নীতির স্বরূপ উন্মোচন করেছে। দেশের সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রের চালক ও সেবকদের লোভ আর স্বেচ্ছাচারিতার নমুনা দেখে অবাক হয়েছে। তারা দেখেছে সমাজের একটি স্বার্থান্বেষী ক্ষুদ্র অংশ তাদের কষ্টার্জিত অর্থ আর দেশের সকল সম্ভাবনা লুটে নিয়ে নিজেদের বিলাসবহুল জীবন নিশ্চিত করেছে। তথাকথিত উচ্চশ্রেণীর এ সকল মানুষের পূতিগন্ধময় অন্ধকার জীবনের উপাখ্যান পড়ে সাধারণ মানুষ ঘৃণা ভরে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাদের বিচারের সম্মুখীন করার দাবি তুলেছে। ওয়ান ইলেভেনের পট-পরিবর্তনে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার জনগণের এই উচ্চকণ্ঠের দাবির সাথে একাত্ম হয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধে অঙ্গীকার করেছিলো। এই অঙ্গীকার পূরণে পুনর্গঠন করা হয় দুর্নীতি দমন কমিশন। বড় বড় দুর্নীতিবাজকে বিচারের সম্মুখীন করতে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘গুরুতর অপরাধ দমন অভিযান সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটি'।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সূচক জিডিপি ৬.৫%; আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে জিডিপি ৭-৮%; অথচ একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে শুধু দুর্নীতির কারণে দেশের জিডিপি প্রায় ২% কম অর্জিত হয়। তার মানে আমরা যদি সর্বগ্রাসী এ দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি তাহলে আমাদের জিডিপি ৮% থেকে ৮.৫% হবে যা এশিয়ার শক্তিশালী দেশ যেমন : মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও চায়নার সমান,অথচ বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির সূচক প্রদানকারী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-এর সমীক্ষায় ২০০১ সাল থেকে আমরা টানা পাঁচ বছর দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। অতীতে বিভিন্ন সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের অঙ্গীকার করলেও তারা তাদের সে অবস্থান ধরে রাখতে পারে নি। যার কারণে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন স্থাপিত হলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও রাজনৈতিক প্রভাবে স্বাধীনভাবে তাদের কাজ শুরুই করতে পারে নি। দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীন হলেও লোকবল, অর্থ বরাদ্দ ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক সহযোগিতার অভাব তাদের পরাধীন করে রেখেছিলো। যার কারণে প্রতিষ্ঠার দীর্ঘদিন পরও তারা বড় ধরনের কোনো দুর্নীতি উদ্ঘাটন করতে পারে নি। এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনে এমনও কর্মকর্তা ছিলো। যাদের চাকরি পাঁচ হতে ছয় বছর অতিবাহিত হলেও এ পর্যন্ত একটি দুর্নীতির মামলাও রুজু করতে সক্ষম হয় নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই অচলাবস্থা কাটিয়ে অতিঅল্প সময়ের ভেতরই বিভিন্ন বিধিমালা প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় অর্থ ও লোকবল প্রদান করে দুদককে কার্যক্ষম করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। মহামান্য প্রেসিডেন্টের আহ্বানে দুদকের চেয়ারম্যান পদত্যাগ করলে এর দায়িত্ব প্রাক্তন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হাসান মশহুদের হাতে তুলে দেয়া হয়। দায়িত্ব নিয়েই তিনি নিজের সম্পদ-বিবরণী সবার সম্মুখে তুলে ধরে দেশবাসীর অকুণ্ঠ প্রশংসা অর্জন করেন।
৮ মার্চ, ২০০৭ তারিখে দুর্নীতি ও গুরুতর অপরাধ দমন অভিযান পরিচালনার জন্য যোগাযোগ উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত)কে চেয়ারম্যান ও সাভার ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মাসুদ উদ্দিনকে প্রধান সমন্বয়কারী করে 'জাতীয় সমন্বয় কমিটি' গঠন করা হয়। সমন্বয় কমিটির অধীনে ঢাকা জেলার চল্লিশটি ও অন্যান্য জেলায় বাইশটি, সর্বমোট বাষট্টিটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। সেনাবাহিনী, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্সগুলোর কাজ ছিলো দুর্নীতি দমনে দুদক, এনবিআর এবং পুলিশকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করা। টাস্কফোর্স গঠন করার পর সারাদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয় এবং জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের সব গুরুতর অভিযোগ খতিয়ে দেখা হয়। ব্যক্তিগত দুর্নীতি থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিকেও তদন্তের আওতায় নিয়ে আসা হয়। ফলে দিনে দিনে দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র উন্মোচিত হতে থাকে ।
‘বাংলাদেশ বিমান’ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আমাদের গর্বের পতাকা নিয়ে উড়ে যায়। আমাদের প্রায় পঞ্চান্ন লক্ষ মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত। এতো বিপুল অভিবাসীর দেশের বিমান সংস্থা দিনে দিনে উন্নতি করার কথা, বিস্তৃত হওয়ার কথা। অথচ বিমানস্বল্পতা, নিম্নমানের যাত্রীসেবা, সিডিউল বিপর্যয়, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্ব্যবহার, স্বেচ্ছাচারিতা আর দুর্নীতির কারণে ‘বাংলাদেশ বিমান' আজ প্রায় এক অস্তায়মান সূর্য। এক সময় বাংলাদেশ বিমান সতেরোটি উড়োজাহাজ নিয়ে সাতাশটি রুটে যাত্রী পরিবহন করতো অথচ দিনে দিনে এর সংখ্যা কমে এখন মাত্র দশটি উড়োজাহাজ নিয়ে সতেরোটি রুটে যাত্রী পরিবহন করছে। বাংলাদেশের যাত্রী উপজীব্য করে যেখানে পৃথিবীর অন্যান্য বিমান সংস্থা তাদের ফ্লাইট সংখ্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে সেখানে বাংলাদেশ বিমান আজ প্রায় দেউলিয়া হওয়ার পথে। বিমানের অবস্থা একদিনে এরকম হয় নি। দুর্নীতি আর জবাবদিহিতার অভাব ধীরে ধীরে এ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত করেছে।
ভাবতে অবাক লাগে দেশের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে উড়োজাহাজ স্বল্পতা দেখিয়ে একক দরপত্রে দু'টি পুরাতন এফ-২৮ বিমান ক্রয় করে দুই মাস গ্রাউন্ডেড করে রাখা হয়েছিলো। এওজি (এয়ারক্রাফট অন গ্রাউন্ড) দেখিয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার যন্ত্রাংশ ক্রয় করে গুদামে ফেলে রাখা হয়েছে যা আর কখনোই ব্যবহার করা হয় নি। একটি ডিসি-১০ বিমান লিজের সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় লিজিং কোম্পানিকে ফেরত না দিয়ে বসিয়ে বসিয়ে প্রতি মাসে প্রায় দেড় কোটি টাকা জরিমানা গুণছে। বিমানের করাচি শাখায় টিকেট বিক্রির দশ কোটি টাকার কোনো হদিস নেই। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্বলতার সুযোগে একটি ট্রাভেল কোম্পানি ফেরত দেয় নি প্রায় আড়াই কোটি টাকা। মতিঝিলস্থ বলাকা ভবনে বিভিন্ন ফ্লোর বাণিজ্যিক সংস্থার কাছে ভাড়া দেয়া হয়েছে প্রতি বর্গফুট দশ থেকে বিশ টাকা হিসেবে যেখানে উক্ত এলাকার ভাড়া হওয়ার কথা প্রতি বর্গফুট পঞ্চাশ থেকে ষাট টাকা। রাষ্ট্রীয় সম্পদের এরকম যথেচ্ছ ব্যবহারের পরও যে সংস্থাটি দাঁড়িয়ে আছে এটাই আশ্চর্যের বিষয়।
আমি বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের সময় দেখেছি, এতো অনিয়ম আর অব্যবস্থার পরও অভিবাসীরা বাংলাদেশ বিমানেই ভ্রমণ করতে ইচ্ছুক। নিউইয়র্কের বাঙালিরা আমাকে অনুরোধ করেছিলো মানসম্পন্ন বিমানের স্বল্পতাহেতু বাতিল হওয়ার উপক্রম ঢাকা-নিউইয়র্ক স্লটটি ধরে রাখতে। তারা চায় তাদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশের কাজেই ব্যবহার হোক। তাদের এ নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমের কতটুকু প্রতিদান আমরা দিতে পেরেছি? তবে আশার কথা সেনাবাহিনীর একটি টাস্কফোর্স দীর্ঘ এক বছর বিমানের সম্ভাবনা ও সমস্যা যাচাই করে বাংলাদেশ বিমানকে এ হতাশাজনক অবস্থা থেকে বের করে নিয়ে আসার জন্য একটি সমন্বিত কর্ম- পরিকল্পনা সুপারিশ করেছে। বিমানকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ হিসেবে নতুন ব্যবস্থাপনা পরিষদ ইতোমধ্যেই আটটি আধুনিক বোয়িং কেনার জন্য বোয়িং কোম্পানির সাথে চুক্তি করেছে। বিমানের সর্বত্র জবাবদিহিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টিতে আরো অনেক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আমি আশাবাদী অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ‘বাংলাদেশ বিমান' প্রত্যাশিত উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে।
দেশের বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্নীতি অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা স্তম্ভিত হয়েছি। ডেসা, তিতাস ও ওয়াসার সম্মিলিত দুর্নীতির পরিমাণ বাংলাদেশের এক বছরের বাজেটের সমান। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা- কর্মচারীদের বিত্ত-বৈভব রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। ডেসার মামুলি এক মিটার রিডারের সম্পদ শতশত কোটি টাকার উপর, তেমনি তিতাসের এক কর্মচারীর সম্পদের পরিমাণ সে নিজেও বলতে পারে নি। ডেসার সাত/আট পর্যায়ে ট্রান্সফরমারের কারণে যেখানে বিদ্যুতের ১০% সিস্টেম লস হওয়ার কথা সেখানে সিস্টেম লস দেখানো হয় ২০ থেকে ৩০%। তিতাসের সিস্টেম লস যেখানে ১ থেকে ২% সেখানে দেখানো হয় ৬ থেকে ৭%। বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে মিটারকে বাইপাস করে সংযোগ দেয়া হয়। টাস্কফোর্সের তথ্যানুযায়ী ডেসার ষাট ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী দুর্নীতিগ্রস্ত, পঞ্চাশ ভাগ টেন্ডারেই নিয়ম মানা হয় নি, আশি ভাগ প্রকল্প অকল্পনীয় দুর্নীতির দোষে দুষ্ট। ডেসার বেতনভুক্ত অডিটর থাকলেও বছরের পর বছর অডিট করানো হয় না। ডেসার অতিরিক্ত গাড়ি ও জনবল থাকলেও জরুরি অবস্থায় লোকস্বল্পতার অজুহাতে কাজ এড়িয়ে যাওয়া, কোটি কোটি টাকার অপ্রয়োজনীয় মালামাল ক্রয় করে গুদামে ফেলে রেখে নষ্ট করা ইত্যাদি হাজারো রকমের অনিয়মই এখানে নিয়মে পরিণত হয়েছে। তারপরও শুধু সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানের কারণেই ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠার পর ২০০৬-২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো ডেসা একশত তিন কোটি টাকা আয় করতে সক্ষম হয়।
তিতাসের অবস্থাও প্রায় একইরকম। দেশ যেখানে গ্যাস সংকটে ভুগছে সেখানে অবৈধ সংযোগ, পর্যাপ্তসংখ্যক মিটার মজুদ থাকা সত্ত্বেও অর্থের বিনিময়ে মিটার ছাড়াই সংযোগ প্রদান, কম বিল প্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধির জন্য রাষ্ট্রকে তার প্রাপ্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তিতাসেই সাধারণ রিসিপশনিস্টকে পদোন্নতি দিয়ে কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টের সংবেদনশীল শাখার ডিজিএম হিসেবে পদোন্নতির দৃষ্টান্ত আমাদের সবাইকে অবাক করেছে। আরো দেখা গেছে, পাঁচটি কার্য দিবসের মধ্যে ছয়টি ওভার টাইমের অদ্ভুত উদাহরণ। একজন কর্মচারীর মূল বেতন সাত হাজার চারশত টাকা অথচ সে দশ মাসে আয় করেছে এক লক্ষ চল্লিশ হাজার টাকা। একই উৎপাদন ক্ষমতার দু'টি পাওয়ার প্লান্টে এক মাসের গ্যাসের বিল সাতষট্টি লক্ষ অন্যটিতে এক কোটি চল্লিশ লক্ষ টাকা। এতো অনিয়ম, কিন্তু দেখার কেউ নেই। মাঠ-পর্যায়ে জনগণকে আমরা পেয়েছি এ দুর্নীতির ব্যাপারে সোচ্চার। তারা রাষ্ট্রকে তার প্রাপ্য দিতে ইচ্ছুক যদি তেমন কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। একটি সমীক্ষায় আমরা পেয়েছি পঁচাত্তর ভাগ গ্রাহকই প্রি-পেইড ব্যবস্থায় গ্যাস নিতে আগ্রহী। আমরা দেখেছি সাধারণ মানুষ নিয়মিত বিল প্রদান করে গেলেও তারা লাইনম্যান কিংবা মিটার রিডারের বিভিন্ন কারসাজির কারণে হয়রানির শিকার হচ্ছে, অথচ বাণিজ্যিকভাবে যারা গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি ব্যবহার করছে, বছরের পর বছর তারা বিল পরিশোধ করছে না। সেনাবাহিনীর তৎপরতায় গত দু'বছরে বিদ্যুৎ ৮,০২৪ কোটি টাকা, পানি ৬২৯ কোটি টাকা ও গ্যাসের ৭,২০১ কোটি টাকার খেলাপি বিল আদায় করা সম্ভব হয়।
বিআইডব্লিউটিএ'তে (বাংলাদেশ ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথরিটি) চলেছে হরিলুট। দেশের নদীগুলো নৌ চলাচলের জন্য উপযুক্ত রাখতে সারাদেশে ড্রেজিং কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। দিনে ষোল ঘণ্টা ড্রেজিং চালানোর কথা থাকলেও মাত্র চার ঘণ্টা চালিয়েই ষোল ঘণ্টার তেল খরচ দেখানো হয়। বিআইডব্লিউটিএ-এর ফুয়েল বার্জার থাকলেও শুধু দুর্নীতি করার উদ্দেশ্যেই ঠিকাদারের কাছ থেকে তেল নেয়া হয়। নিজস্ব নৌ-কারখানা ও ভাসমান ওয়ার্কশপ থাকলেও বেসামরিক ঠিকাদারের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় মেরামত করা হয়। শুধু ২০০৬-২০০৭ সালে ড্রেজার মেরামত খাতে ব্যয় হয়েছে এক কোটিরও বেশি। টাকা। সাড়ে চার কোটি টাকা ব্যয়ে দু'টি ড্রেজার সহায়ক নৌযান কিনলেও কোনো ব্যবহার ছাড়াই নৌযান দু'টিকে অকেজো ঘোষণা করে ফেলে রাখা হয়েছে। একটি চক্র মেরামতযোগ্য ড্রেজার অকেজো ঘোষণা করে কম মূল্যে নিলামে ক্রয় করে আবার কর্মক্ষম করে বিআইডব্লিউটিএ-এর কাছেই ভাড়া দিচ্ছে। কী অদ্ভুত ব্যবস্থা? শুধু নিয়ম করে আর শাস্তির ব্যবস্থা করে এই অনিয়ম ঠেকানো সম্ভব নয়; নির্দিষ্ট তাই আমি মনে করি অবিলম্বে বিআইডব্লিউটিএ'কে বেসরকারিকরণ করা উচিত।বাংলাদেশ টেলিফোন কোম্পানি লিমিটেডের (ভূতপূর্ব টি অ্যান্ড টি) সেবামূলক কর্মকাণ্ডের সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। ভুতুড়ে বিল, লাইনম্যানের দৌরাত্ম্য, টাকা জমা দিয়েও সংযোগ না পাওয়া ইত্যাদি আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। যা জানা ছিলো না তা হলো এ সংস্থার শুধু গাড়ি মেরামত ও পানি বাবদ ব্যয় হয়েছে বছরে নয় কোটি টাকা। লক্ষ লক্ষ ভুয়া শ্রমিকের নিয়োগ দেখিয়ে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকা। চেষ্টা করেও সংস্থাটির অডিট করানো যায় নি, উদ্ধার করা যায় নি বকেয়া বিলের মোট পরিমাণ। সংস্থার টেলিগ্রাফ বিভাগে সারাদেশে মোট জনবল চার হাজার জন অথচ মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেটের যুগে প্রতি মাসে মাত্র দশ থেকে পনেরোটি টেলিগ্রাম আদান- প্রদান হয়। সংস্থাটির কর্তব্যরত ব্যক্তিদের নতুন সরঞ্জামাদি ক্রয়ে যতো আগ্রহ মতোই অনাগ্রহ মাঠ পর্যায়ে তা ব্যবহারের। ক্ষমতাশালী লোকদের বিল দেয়ার কোনো দায়বদ্ধতা নেই। শুধু আইন প্রণেতাদের কাছেই বকেয়া বিল পড়েছিলো কয়েক কোটি টাকা। সেনাবাহিনী মাঠ পর্যায়ে সম্পৃক্ত থেকে ৩,৩৪০ কোটি টাকা বকেয়া টেলিফোন বিল আদায় করেছে।
জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ ও রাজউকের অবস্থা প্রায় একইরকম। জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত ৮,০৫৩ একর জায়গা অধিগ্রহণ করে প্লট বরাদ্দ করেছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো তাদের প্লট বরাদ্দের সুস্পষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। যখন যেভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে ঠিক সেভাবেই প্লট বরাদ্দ করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে প্লট বরাদ্দের অনিয়ম হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ভুয়া ব্যক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত দেখিয়ে প্লট বরাদ্দ করে আত্মসাৎ করা হয়েছে, আবার একই পরিবারের পাঁচজনকে ক্ষতিগ্রস্ত দেখিয়ে প্লট বরাদ্দ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রকল্পের মাস্টার প্ল্যান পরিবর্তন করে মসজিদ, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত পার্ক ইত্যাদি জায়গায় প্লট বানিয়ে অবৈধভাবে বিক্রি, উৎকোচের বিনিময়ে বেশি জমি বরাদ্দ, ভুয়া স্বত্ত্বাধিকারীদের পুনর্বাসন প্রকল্পের প্লট বরাদ্দ এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের কোটার জমি সাধারণ মানুষের নামে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যারা নিজের সর্বস্ব বিকিয়ে দিয়ে আমাদেরকে স্বাধীন এ দেশ উপহার দিলো তাদের প্রতি আমাদের কী সুবিচার!
রাজউক বন্দি একদল সংঘবদ্ধ দালাল চক্রের হাতে। এখানে ভুয়া কর্মকর্তা সেজে বিল্ডিং-এর ডিজাইন পাস, উৎকোচের বিনিময়ে বিল্ডিং কোডের ব্যত্যয় ঘটানো ইত্যাদি অনিয়ম নিত্যনৈমিত্তিক। রাজউকের ৩৩% ফাইল নিরীক্ষার জন্য পাওয়া যায় নি। হারিয়ে গেছে প্লট বরাদ্দের ফাইল। জরুরি অবস্থার কারণে রাজউক কর্তৃপক্ষ ঢাকা শহরের একশত এগারোটি বিল্ডিং উচ্চতার জন্য অবৈধ স্থাপনা হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয় যার অনুমতি তারাই দিয়েছিলো। বিজয় সরণীতে র্যাংগস বিল্ডিং এর উজ্জ্বল উদাহরণ। যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার সুযোগে বিমানবন্দরের পাশেই গড়ে উঠেছিলো একুশ তলা সুউচ্চ বিল্ডিং। এ দুর্নীতির প্রতিকার করতে পারাটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি দৃশ্যমান সাফল্য।
ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের দুর্নীতির তালিকা এ বইয়ের ক্ষুদ্র পরিসরে শেষ করা সম্ভব নয়। সিটি কর্পোরেশনের প্রায় দুই হাজার ক্লিনার আছে যারা বেতন পায়। কিন্তু কোনো কাজ করে না, অথচ পাড়ায় পাড়ায় সাধারণ মানুষ কমিউনিটি মাধ্যমে ক্লিনার রেখে এলাকা পরিষ্কার রাখে, যদিও তারা নিয়মিত ট্যাক্স পরিশোধ করছে। সিটি কর্পোরেশনের পাঁচটি লাইব্রেরিতে তেউশ জন লাইব্রেরিয়ান আছে যারা লাইব্রেরিতে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। উৎকোচ নিয়ে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তাকে প্রথম শ্রেণীর প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। টাকার বিনিময়ে আটাশি জন টাইপিস্ট টাইপ করা না জেনেও টাইপিস্ট হিসেবে চাকরি পেয়েছে। একই ঘটনা ঘটেছে বায়ান্ন জন পাম্প অপারেটরের ক্ষেত্রে যাদের পাম্প পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের কোনো ধারণাই নেই। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বিদেশ গমন করে ট্যাক্সের টাকার অপচয় করা হয়েছে। একজন বাজার সুপারভাইজার কর্মচারী পরিষদের নেতা হওয়ার সুবাদে মোট পনেরোবার বিদেশ ভ্রমণ করেছে। বিদেশ ভ্রমণ করেছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা তত্ত্বাবধানের কর্মকর্তারা। সিন্ডিকেটেড টেন্ডার কর্পোরেশনের কোনো উপকারে আসে নি, দোকান বরাদ্দ করা হয়েছে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়। যাত্রাবাড়ি-গুলিস্তান ফ্লাই ওভারের নামে কোটি কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচের পরিকল্পনা ভেস্তে যায় জরুরি অবস্থার কারণে। এমনি অজস্র অনিয়ম সিটি কর্পোরেশনের নগর ভবনকে পরিচিত করে তোলে দুর্নীতির আখড়া হিসেবে। টাস্কফোর্স ডিসিসি'তে নিয়মানুবর্তিতা আনয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম চালু করে। যেমন : ওয়ান স্টপ সার্ভিস, সিটিজেন চার্টার, অভিযোগ রেজিস্টার, এক সপ্তাহের মধ্যে ফাইলে সিদ্ধান্ত দেয়ার নিয়ম ইত্যাদি। সেনাবাহিনী চলে আসার পর এসব নিয়মকানুন অব্যাহত থাকবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
বাংলাদেশ বন বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্বেচ্ছাচারিতা আর ব্যক্তিগত লোভের কারণে দেশের বনজ সম্পদ উজাড় হওয়ার পথে। বন বিভাগের কিছু কিছু এলাকার পোস্টিং এতোটাই লোভনীয় যে, সেসব পোস্টিং পেতে তারা অকল্পনীয় অঙ্কের টাকা উৎকোচ দিতে প্রস্তুত থাকে। এ টাকার ভাগ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে পৌঁছে যায় মন্ত্রণালয় পর্যন্ত। বন বিভাগের এসব দুর্নীতির কথা মুখে মুখে প্রচলিত হলেও এর প্রধান বন কর্মকর্তা (‘বনের রাজা' নামে কুখ্যাত) বনরক্ষক মোঃ ওসমান গনিকে তার বাড়ির চাল রাখার ড্রাম ও বস্তায় লুকানো দেড় কোটি টাকাসহ গ্রেফতার করা হলে পুরো দেশ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্মকর্তা যদি এরকম দুর্নীতিগ্রস্ত হয় তাহলে প্রতিষ্ঠানটির কী অবস্থা হতে পারে তা ভেবে শিউরে উঠতে হয়। এমন আরো ওসমান গনির অস্তিত্ব বন বিভাগে থাকা অস্বাভাবিক নয়। আমরা হয় তো সময়ের কারণে তাদের সনাক্ত করতে সমর্থ হই নি তবে জনগণ এ বিষয়ে যে কতটুকু সচেতন তা প্রমাণ করেছে ওসমান গনিকে বনরক্ষকের বদলে 'বনভক্ষক' নামকরণ করে।
দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে কাগজে কলমে পর্যাপ্ত ডাক্তার পোস্টিং থাকলেও কর্মক্ষেত্রে তাদের বেশিরভাগই অনুপস্থিত থাকতো। বিশেষ করে ঢাকা
শহরের বাইরের হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার না থাকাটাই নিয়মে পরিণত হয়েছিলো। সরকারি চাকরি করে সরকারি সময়ে কর্মস্থলে উপস্থিত না থেকে প্রাইভেট চাকরি কিংবা প্রাইভেট প্র্যাকটিসের এমন উদাহরণ শুধু বাংলাদেশেই সব। আবার হাসপাতালগুলোতে অস্বাভাবিক হারে রোগী ভর্তি দেখিয়ে আত্মসাৎ করা হতো ওষুধ ও খাবারের অর্থ। অথচ যেসব দরিদ্র রোগী ভর্তি থাকতো তাদের ওষুধ ও খাবার মিলতো না। দেশে বিত্তহীন দরিদ্র জনসাধারণের জন্য যেন কোনো চিকিৎসা নেই। একই অবস্থা বিরাজ করছিলো দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। বিশেষ করে এমপিওভুক্ত স্কুলগুলোতে শিক্ষকরা স্কুলে পড়ানোকে বোঝা মনে করতো। সেনাবাহিনী হাসপাতাল ও স্কুলগুলোতে বেতনভুক্ত ডাক্তার ও শিক্ষকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে। এ ব্যবস্থা হয় তো সাময়িক। কিন্তু এ সাময়িক ব্যবস্থার মাধ্যমেই জনগণের ভেতর সর্বত্র জবাবদিহিতামূলক একটা ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা আমরা করেছি ।
পাসপোর্ট অফিসে পাসপোর্ট করার বিড়ম্বনা আমাকে ব্যথিত করতো। এই অফিসগুলো পুরোপুরি দালালদের দখলে ছিলো, টাকা ছাড়া সেখানে কোনো নিয়ম কাজ করতো না। বিদেশগামী সহজ সরল লোকজন এ দালাল চক্রের মাধ্যমে নির্মমভাবে প্রতারিত হতো। আমরা পাসপোর্ট অফিসগুলোতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেছি। শুধু তাই নয়, সরকারের সাথে কথা বলে ওয়ান স্টপ পাসপোর্ট সার্ভিসের ব্যবস্থা করা হয়েছে যার সুফল ইতোমধ্যেই জনগণ পেতে শুরু করেছে। পাসপোর্টের আবেদন ও বিতরণ ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণও একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য যার মাধ্যমে পাসপোর্ট সংক্রান্ত দুর্নীতি উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে বলে আশা করা যায়।
সম্পদ ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে দেশ বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছিলো। মুন্সীগঞ্জের বালুমহাল ইজারার ঘটনা এমনই একটি উদাহরণ। পূর্বে যে বালুমহাল মাত্র ত্রিশ লক্ষ টাকায় ইজারা দেয়া হয়েছে সে একই বালুমহাল ২০০৭ সালে সাত কোটি টাকায় ইজারা দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন ফেরিঘাট ও পাহাড় ইজারার ক্ষেত্রে একইরকম দুর্নীতি হয়েছে। ভেবে আশ্চর্য হই, যারা এর জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত তারাই অল্প টাকা উৎকোচের মাধ্যমে দেশের সম্পদ এরকমভাবেই বিকিয়ে দিয়েছে।
২০০৭ সালে আমি যখন হজ্বব্রত পালন করতে যাই তখন বাংলাদেশি হাজিদের দুঃখ-দুর্দশা দেখে আমার মন ভারাক্রান্ত হয়েছিলো। কোনো হাজিক্যাম্প যদি অনেক দূরে হয়, বসবাসের অযোগ্য কোনো বিল্ডিং হয় কিংবা কোথাও যদি নিশ্চিত করে বলা যায় এটা বাংলাদেশি হাজিক্যাম্প। কারণ হজ এজেন্সিগুলো পানি এবং জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য সুবিধাদি অনুপস্থিত থাকে তবে হাজিদের মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে পর্যাপ্ত টাকা নিলেও সৌদি আরবে তারা সবচেয়ে কমমূল্যের বাসস্থান পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে থাকে; যে বাসাগুলো কেউ ভাড়া করে নি তারা সেগুলো ভাড়া নেয়। তারপরও বাংলাদেশি হাজিদের দুর্দশার শেষ হয় না। কখনো কখনো বাড়িভাড়া পরিশোধের ব্যর্থতার কারণে বাড়িওয়ালা পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, কোরবানির ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দিলেও কোরবানির সময় তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। সৌদি আরবে এরকম বাংলাদেশি : পরিদর্শনে যেয়ে হাজিদের হাজারো আক্ষেপ শুনে আমার মন বেশ খারাপ হয়েছিলো। ইসলামের নামে, পবিত্র হজের নামে এমন প্রতারণা হয়তো আমাদের পক্ষেই সম্ভব। বাংলাদেশে প্রায় দুইশত ত্রিশটি হজ এজেন্সি আছে। এসব এজেন্সির মধ্যে ২০০৭ সালে বিভিন্ন অনিয়মের জন্য পঁচাশিটি হজ এজেন্সির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপিত হয়। এসব অভিযোগ তদন্তের পর পঁয়ষট্টিটি এজেন্সি অভিযুক্ত হয়ে শাস্তির মুখোমুখি হয়েছিলো। কিন্তু আমাদের খুবই দুর্ভাগ্য যে, অভিযুক্ত এজেন্সিগুলোকে বাঁচাতে হ্যাব (হজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) শাস্তি প্রত্যাহারে সরকারকে বাধ্য করতে ২০০৮ সালে হজ বয়কট করার হুমকি দেয়। হাজিদের দুর্দশা লাঘবে তারা কোনো ভূমিকা রাখে নি কিন্তু নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ঠিকই তারা একত্রিত হয়েছিলো। অর্থলিপ্সা আমাদের এমনই যে, এজন্য আমরা আমাদের ধর্মবিশ্বাসকে ব্যবহার করতেও কুণ্ঠাবোধ করি না। ক্যাম্প
কুয়েত, দুবাই ও সৌদি আরব সফরের সময় আমি অভিবাসী মানুষের কষ্ট দেখে ভীষণভাবে আলোড়িত হয়েছি। দেশের জমিজমা বিক্রি করে এক একজন তিন-চার লক্ষ টাকা খরচ করে এজেন্সির মিথ্যে আশ্বাসে বিশ্বাস করে বিদেশে বিশ কুয়েতি দিনার কিংবা তিনশত সৌদি রিয়াল বেতন পাচ্ছে যা বাংলাদেশ টাকায় প্রায় ছয় হাজার টাকার সমান। এ টাকায় সে কী খাবে আর কী দেশে পাঠাবে? অথচ সরকারের বেঁধে দেয়া নিয়মানুযায়ী কুয়েতে ন্যূনতম বেতন হওয়ার কথা ষাট কুয়েতি দিনার এবং সৌদি আরবে ছয়শত সৌদি রিয়াল। ক