21/11/2019
#নামাজের_মধুরতা
কিভাবে নামাজের মধুরতা আস্বাদন করা যায়? - পর্ব ১
পরম করুণাময় এবং অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে। সকল প্রশংসা ও শুকরিয়া আল্লাহ তায়ালার জন্যে, এবং অজস্র দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক সকল নবী রাসুলগণের উপর। বেশ কিছুদিন আগে, কুয়েতী দা’য়ী মিশারী আল-খারাজ এর উপস্থাপনায় ”كيف تتلذذ بالصلاة؟” নামে একটি আরবি প্রোগ্রাম প্রচারিত হয়েছিল যার মানে হলো: “কিভাবে নামাজের মধুরতা আস্বাদন করা যায়?” আমাদের প্রায় সবারই নামাজের ‘খুশু’ কম-বেশি হয়ে থাকে।
এবার আসি - খুশু কী? এটা আসলে অন্তরের বা মনের একটি অবস্থা যা নামাজে প্রশান্তি, গাম্ভীর্য ও বিনম্রতা বজায় রাখে; যা হৃদয় থেকে বর্ষিত হয়ে আমাদের আল্লাহর সামনে বিনম্র ও আত্মসমর্পিত করে।
কোনো কোনো সময় নামাজে আমাদের আরাধনা এমন হয় যেনো আমরা প্রতিটা শব্দকে ভেতর থেকে অনুভব করি; আবার অন্য সময় নামাজ শুধু নিয়ম মেনে উঠাবসা ছাড়া আর কিছুই হয় না। ইনশা-আল্লাহ, আমরা আগামী কিছুদিন নামাজের অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা করব।
■ এক আনসারী ও এক মুহাজির এর কাহিনী:
সুনানে আবু দাউদ থেকে হাসান সনদে বর্ণিত; কোনো একটি যুদ্ধের সময় নবী (সা:) দু'জন পাহারাদার নিয়োগ করেন, তাদের একজন ছিলেন মুহাজিরীন, আরেকজন ছিলেন আনসারী। একটা সময় আনসারী সাহাবী নামাজের জন্য উঠে পড়লেন অপরদিকে মুহাজিরীন সাহাবী তখন ক্লান্তিতে তন্দ্রা মতো এসেছিলেন। এই সময় প্রতিপক্ষের এক মুশরিক এই অবস্থা দেখে সুযোগ বুঝে আনসার সাহাবীর দিকে তীর ছুড়ে মারেন। এটা তাঁর গায়ে লাগে, কিন্তু তবুও কষ্ট করে তীর বের করে রক্তাক্ত অবস্থায় নামাজ চালিয়ে গেলেন। এটা দেখে ঐ মুশরিক আবার তীর নিক্ষেপ করলেন। আবারও আনসার সাহাবী তীরটি অপসারণ করে নামাজ চালিয়ে গেলেন। কিন্তু যখন তৃতীয় তীর আঘাত হানল; তিনি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না এবং তিনি রুকু এবং সেজদায় চলে গেলেন, এর মাঝে মুহাজিরীন সাহাবীর ঘুম ভেঙ্গে যায়(মুশরিক তা দেখে পালিয়ে যায়), এবং তাঁর সাথীর রক্তাক্ত অবস্থা দেখে চেঁচিয়ে উঠে বললেন “সুবহান-আল্লাহ! যখন প্রথম সে তোমাকে আঘাত করেছিলো আমাকে কেন ডাকলে না?” আনসারী সাহাবীর উত্তর ছিল, “আমি তখন এমন একটি সুরা তিলাওয়াত করছিলাম যা আমি ভালবাসি, আর আমি সেটা থামাতে চাচ্ছিলাম না।” আল্লাহ আকবার, আমাদের পক্ষে কী কল্পনা করা সম্ভব কী পরিমান আবেগ ও নিষ্ঠা ছিলো তাঁর নামাজে?
■ নামাজের মধুরতা:
নামাজ হলো সর্বোত্তম ইবাদত। যখন কেউ নামাজ শেষ করার উদ্দেশ্যে সালাম ফেরায় (তাসলিম) তখন সে নিশ্চিতভাবেই এক প্রশান্তি লাভ করে। ইবনে আল জাওজী নামাজের ব্যাপারে বলেন: “আমরা এমন এক উদ্যানে অবস্থান করি যেখানে আমাদের খাদ্য হলো খুশু আর পানীয় হলো অশ্রু” যে নামাজে পূর্ণভাবে আরাধনা করে তার আত্মা তার কাছে আর থাকে না; যেমন ইবনে তায়মিয়্যাহ বলেন, তার রুহ আসলে আল্লাহর আরশের তাওয়াফ করতে থাকে।
কেউ এ কথা বলতে পারেন যে, এরাতো আগের জামানার মানুষ, এখন কেউ এ রকম অনুভব করেন না। কিন্তু এ কথা মোটেও সত্য নয়; যে কেউ নামাজের এই অমৃতসুধার সন্ধান পেতে পারে, আর এ জন্য দরকার নামাজের গুরুত্ব অনুধাবন করা এবং খুশু অর্জনের রহস্য উন্মোচন করা। আর এর মাধ্যমেই নামাজ হতে পারে আমাদের সব কিছুর সমাধান; সব দুঃখ, কষ্ট, গ্লানি ও হতাশার ঔষুধ, এমন কিছু যার মাঝে আমরা পরম প্রশান্তি লাভ করি; এমন কিছু যা আমরা চাই কখনও শেষ না হোক।
● চলুন তাহলে শুরু করি রহস্য উন্মোচন এবং আল্লাহর সাথে কথোপকথন।
১) প্রথমত আমাদের যে কাজটি করতে হবে সেটা হলো খুশু সম্পর্কে আমাদের ধারণা পরিবর্তন করতে হবে। খুশু মানে শুধু এই না যে আপনি খুবই কষ্ট করে এমন মনোনিবেশ করেছেন যে আপনাকে আর ভিন্নমুখী করা সম্ভবই নয়। একাগ্র হৃদয় বা মন হলো খুশুর প্রথম স্তর। অনেকটা এ রকম যে আপনি কেবল একটি বাড়ির দরজা খুলেছেন, এখনো পুরো বাড়িটা দেখা বাকি আছে। খুশুর গভীরতা অসীম। অনেকেরই এটা মনে হয় যে, মনকে একাগ্রত করা, নিজের চিন্তা চেতনাকে কেন্দ্রীভূত করা খুবই কঠিন কাজ। এই ধারণাকে নির্মূল করতে নামাজে আসার সময়ই আমাদের নামাজের ব্যাপারে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে আসতে হবে। ধরা যাক, আমাদের প্রতি নামাজে ১০ মিনিট সময় লাগে। মানে দিনে ৫০ মিনিট; এক ঘণ্টাও না। বাকি তেইশ ঘন্টা আমার দুনিয়ার জন্য। এই পঞ্চাশটা মিনিটও কী আমরা শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালার জন্য দিতে পারিনা? এইটুকু সময়েও কী আমরা দুনিয়ার জিনিস নিয়ে ভাববো?
নামাজ শুরুর আগে এই কথা গুলো মনে মনে ভাববেন, যাতে আমাদের নফস আমাদের এই বলে ধোঁকা দিতে না পারে যে “নামাজে মনোযোগ দেয়া খুবই কঠিন”-কারণ এটা অসম্ভব কোনো কাজ নয়; মনে রাখা উচিত আল্লাহর সামনে দাড়ানোর আনন্দ/মিষ্টতা দুনিয়ার যেকোনো প্রলোভনের চেয়ে অনেক অনেক আকাঙ্ক্ষিত, অনেক সুখের শুধু একবার তা অনুভব করলে আর কিছুতেই মন উদাস হবে না।
■ নামাজের গভীরতা:
নামাজের আসল স্বাদ আস্বাদনের অন্যতম একটি উপায় হলো; নামাজ বুঝে বুঝে পড়া। কী তিলাওয়াত করা হছে তা বোঝা ও তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা। ঐ প্রোগ্রামটিতে, মিশারী আল-খারাজি বলছিলেন: “চলুন পরিচয় করিয়ে দেই নামাজে আপনার সবচেয়ে বড় প্রতিযোগীকে।” জানেন কাকে তিনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন?
মসজিদের একটি স্তম্ভ (pillar) কে! জি হ্যাঁ, মসজিদের মাঝে দাড়িয়ে থাকা স্তম্ভ। যেকোনো স্তম্ভ; তা সে বাড়িতেই হোক, অফিসে হোক আর মসজিদেই হোক তা আপনার প্রতিযোগী কেন?
কারণ যদি আপনি নামাজে দাড়িয়ে থাকেন, স্তম্ভ আপনার চেয়ে বেশি সময় দাড়িয়ে থাকে। যখন সিজদা করেন, আপনার চেয়ে বেশি সময় ধরে সিজদাহ করে সেই স্তম্ভ। যখন তাসবীহ পরেন, এটা আপনার চেয়ে অনেক বেসি তাসবীহ পড়ে। কিভাবে? আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন:
“তাঁর পবিত্রতা তো বর্ণনা করছে সাত আকাশ ও পৃথিবী এবং তাদের মধ্যে যা কিছু আছে সব জিনিসই৷ এমন কোনো জিনিস নেই যা তাঁর প্রশংসা সহকারে তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছে না, কিন্তু তোমরা তাদের পবিত্রতা ও মহিমা কীর্তন বুঝতে পারো না৷” [সুরা বাণী ইসরাইল ১৭:৪৪]
এবং “তুমি কি দেখো না আল্লাহর সামনে সিজদানত, সবকিছুই যা আছে আকাশে ও পৃথিবীতে- সূর্য, চন্দ্র, তারকা, পাহাড়, গাছপালা, জীবজন্তু এবং বহু মানুষ ও এমন বহু লোক যাদের প্রতি আযাব অবধারিত হয়ে গেছে? আর যাকে আল্লাহ লাঞ্ছিত ও হেয় করেন তার সম্মানদাতা কেউ নেই আল্লাহ যা কিছু চান তাই করেন৷” [সুরা হাজ্জ ২২:১৮]
যদি আমরা পিলারকে জিজ্ঞেস করি, তোমরা কী বুঝো? তা কখনই উত্তর দিতে পারবে না৷ এখন যদি আমরা আমাদের জিজ্ঞেস করি- আমরা তাদের চেয়ে কতটা বেশি ভালো? যখন আমরা বলি “সামি’আল্লাহু লিমান হামিদা” এর মানে কী? কিংবা তাহিয়্যাত (আত্তাহিয়াতু)-ই বা কী বোঝায়? শুধু শাব্দিক অর্থই নয়; এগুলোর সুনিদৃষ্ট অর্থ কী? এগুলো বলার কারণ ও উদ্দেশ্যই বা কী?
ইনশা-আল্লাহ আগামী পর্বগুলোতে আমরা নামাজের প্রতিটি বিষয় নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনা করব যাতে আমরা খুশু অর্জন করতে পারি৷
■ শেষ কথা….
এ কথা বলা ঠিক হবে না যে “কিন্তু…আমি পারিনা!” আল্লাহ কিভাবে আমাদের খুশু অর্জনের কথা বলতে পারেন যদি তা অসম্ভবই হবে? আল্লাহ তায়ালা উদার; তাঁর উদারতার সীমা নেই, আমাদের কল্পনার বাইরে; আমরা যদি তাঁর দিকে এক পা অগ্রসর হই, তিনি আমাদের দিকে ছুটে আসবেন৷ আল্লাহ বলেন:
“যারা আমার জন্য সংগ্রাম-সাধনা করবে তাদেরকে আমি আমার পথ দেখাবো। আর অবশ্যই আল্লাহ সৎকর্মশালীদেরই সাথে আছেন৷” [সুরা আনকাবুত ২৯:৬৯]
তাই বিসমিল্লাহ (আল্লাহর নামে) ও ইনশা-আল্লাহ, চলুন পরিশেষে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যেন আল্লাহ আমাদের সবার খুশু বাড়িয়ে দেন এবং নামাজের প্রশ্নটিকে উপলব্ধি করার তৌফিক দেন৷
আমীন!!
চলবে…ইনশাআল্লাহ