05/10/2022
বিশনবী সা: ঘোষণা করেছেন, যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে, সে তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য হবে।
(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৪০৩১)
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে, কিছু বুদ্ধিজীবী বলছেন, ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার।’ বাক্যটি যেহেতু ধর্মকেন্দ্রিক তাই এর বিচার-বিশ্লেষণও ধর্মীয় চিন্তার আলোকেই করতে হবে। তবে এই বাক্যটির প্রয়োগ লক্ষ করা যায় দুর্গাপূজার সময়। এ যাবত আমরা কখনো মুসলমানদের ঈদুল আজহার সময় এ বাক্য কোনো হিন্দু ভাইকে ব্যবহার করতে দেখি না। বরং এ বছরও ঈদুল আজহার সময়, ভারতসহ বাংলাদেশের হিন্দুত্ববাদী দলগুলো আওয়াজ তুলেছিল যে, মুসলমানদের জন্য গরু কোরবানি নিষিদ্ধ করা হোক। এতে একটি ধারণা হতে পারে যে, এ বাক্য শুধু মুসলমানদের হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসবে যুক্ত করার জন্য ব্যবহার হয়, অন্য ধর্মের মানুষকে ইসলামের উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য নয়। আর ইসলাম এ অনুমতিও দেয়নি যে, মুসলমানদের কোনো ধর্মীয় উৎসব সব ধর্মের মানুষকে নিয়ে পালন করা যাবে। বিশ্বনবী সা: বলেন, যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করল না সে যেন ঈদগাহে না আসে। (মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ, হাকেম)
উক্ত হাদিস থেকে আমরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি যে, মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব তাদের জন্য, যারা আল্লাহর হুকুম মান্য করবেন এবং রাসূলুল্লাহর আদর্শ মতো চলবেন। অর্থাৎ মুসলমানদের কোনো ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান নিছক আনন্দ উৎসব নয়, এর মধ্যে লুকিয়ে থাকে মহান আল্লাহর ইবাদত। সুতরাং ইবাদতে তারাই শরিক হবে যারা আল্লাহর হুকুমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। যে ব্যক্তি মহান আল্লাহকেই মানেন না সে তো দূরের কথা যে ব্যক্তি আল্লাহকে মানেন কিন্তু হুকুমের প্রতি অমনোযোগী সেও এই আনন্দে শরিক হতে পারবেন না।
এখানেই শেষ নয়, মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব স্বতন্ত্র ধারার অধিকারী। যার প্রমাণ মেলে বিশ^নবী সা:-এর ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত থেকে। যা তিনি দিয়েছিলেন হিজরতের পরে, সাহাবারা ইহুদিদের দুটি বড় উৎসব নওরোজ এবং মেহেরজান দেখে যখন তাতে শরিক হতে চাইলেন তখন রাসূল সা: বললেন, না আমি চাই মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব হবে স্বতন্ত্র। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা দুই ঈদ মুসলমানদের উৎসব হিসেবে দান করেন। যেখানে আনন্দ এবং আখিরাতের কল্যাণ উভয়টি নিহিত রয়েছে। (মিশকাত : ১৪৩৯)
অন্য ধর্মের সাথে সাদৃশ্যে নিষেধাজ্ঞা : মুসলমানদের কাজ অন্য ধর্মের লোকদের কর্মের সাথে যেন না মেলে, সে জন্য বিশ^নবী সা: কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। মদিনায় আগমনের পরে, যখন দেখলেন ঈহুদিরা মহররমের ১০ তারিখে রোজা রাখেন, তাদের জিজ্ঞাসা করলে তারা বলেন, আমরা আমাদের নবী মূসা আ:-এর মুক্তির দিনকে স্মরণ করে রোজা রাখি। বিশ^নবী সা: বললেন, আমরা তাদের থেকে এ রোজার ব্যাপারে বেশি হকদার। কেননা মূসা আ: আমার ভাই। সেই থেকে রাসূলুল্লাহ সা: ঘোষণা করলেন, তোমরা আশুরার দিনে রোজা রাখো। তবে আগে অথবা পরে একদিন মিলিয়ে নাও যেন ঈহুদিদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ না হয়। (ইবনে খুজায়মা) অন্য হাদিসে বিশ^নবী সা: ঘোষণা করেন, যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে আখিরাতে তাদের দলভুক্ত হবে। (আবু দাউদ)
এছাড়া পবিত্র কুরআন এবং বিভিন্ন হাদিসে এ ব্যাপারে ব্যাপকভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত আমরা বুঝতে পারলাম যে, মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবে অন্য কারো কোনো অংশ নেই। এখন আলোচনা করব অন্য ধর্মের অনুষ্ঠানে মুসলমানদের অংশগ্রহণের ব্যাপারে।
অন্যদের ধর্মীয় কাজে মুসলিমদের অংশগ্রহণের বিধান : মুসলমানদের জন্য অন্য ধর্মের লোকদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার ব্যাপারে হজরত উমর রা: এক বর্ণনায় বলেন, তোমরা আল্লাহর দুশমনদের উৎসবগুলোতে অংশগ্রহণ থেকে বেঁচে থাকো।
(আসসুনানুল কুবরা ১৮৮৬২)
এর ব্যাখ্যায় ভিন্ন হাদিসে তিনি বলেন, কেননা এক্ষেত্রে আল্লাহর অসন্তুষ্টি নাজিল হয়। অন্য বর্ণনায় হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর বিশ^নবী হজরত মুহাম্মদ সা: থেকে বলেন, যারা অন্য ধর্মীদের মতো উৎসব করবে, কিয়ামত দিবসে তাদের হাশর ওই লোকদের সাথেই হবে। (আসসুনানুল কুবরা, হাদিস ১৫৫৬৩)
এছাড়া আমরা যদি অন্যদের ধর্মীয় উৎসবের প্রতি লক্ষ করি তাহলে দেখতে পারি যে, সেসব উৎসবে এমন কর্মকাণ্ড হয়, যা মহান আল্লাহর সাথে সরাসরি শিরক। যেমন দুর্গাপূজার বিষয়টিই আলোচনা করা যাক, যেহেতু এ বিষয়টি আমাদের সমাজে পরিচিত। দুর্গাপূজা অর্থই হলো দুর্গা একটি প্রতিমা যার উপাসনা করাকে দুর্গাপূজা বলা হয়। এখন আমি মুসলিম হয়ে কিভাবে দুর্গাপূজার আচার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারি? আমি মুসলমান মানে হলো আমি বিশ্বাস করি আল্লাহ এক, তার কোনো শরিক নেই। আর আমার চোখের সামনে আল্লাহ ভিন্ন কোনো খোদার ইবাদত করা হচ্ছে আর আমি সেখানে একাত্মতা ঘোষণা করছি তাহলে কিভাবে আমি মুসলমান থাকলাম? অন্য দিকে, এটি এমন একটি পূজা যার বিরোধিতায় আমাদের প্রিয়নবী নিজের জিন্দেগি উৎসর্গ করে দিয়েছেন। আমি সেই নবীর উম্মত হয়ে যদি দুর্গাপূজাতে অংশগ্রহণ করি তাহলে আমি কিভাবে নবীজীর উম্মত পরিচয় দেই? মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করো না। কেননা শিরক হলো বড় জুলুম। (সূরা লুকমান, আয়াত ১৩)
আল্লাহ তায়ালা কোনো অমুসলিমকে বন্ধু বানানোর ব্যাপারে বলেন, হে ঈমানদারগণ তোমরা আমার শত্রু এবং তোমাদের শত্রুকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না।
( সূরা মুমতাহানাহ, আয়াত ১)
পূজার প্রসাদ খাওয়ার হুকুম : আরো একটি বিষয় আমরা লক্ষ করে থাকি যে, কিছু মুসলিম অমুসলিমদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তো যায়ই, আবার তাদের পূজার প্রসাদও খায়। এ ব্যাপারে স্পষ্ট বক্তব্য হলো, যাওয়া ও একাত্মতা ঘোষণা করা যেমন শিরক। তেমনি তাদের প্রসাদ খাওয়াও হারাম। মহান আল্লাহ বলেন, তিনি তোমাদের ওপর হারাম করেছেন, মৃত জীব, রক্ত, শূকরের মাংস এবং সেসব জীবজন্তু যা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে উৎসর্গ করা হয়। অবশ্য যে লোক অনন্যোপায় হয়ে পড়ে এবং নাফরমানি ও সীমালঙ্ঘনকারী না হয় তার জন্য কোনো পাপ নেই। নিঃসন্দেহে আল্লাহ মহান ক্ষমাশীল, অত্যন্ত দয়ালু।
(সূরা আল বাকারা, আয়াত ১৭৩)।
সুতরাং কোনো মুসলিমের জন্য পূজার অনুষ্ঠানে সাহায্য করা, অংশগ্রহণ করা, মেলায় যাওয়া, মেলা থেকে কোনো কিছু কেনাকাটা করা সবই অগ্রহণযোগ্য।
তবে কোনো মুসলিম যদি রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীল হন তাহলে তার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে এর সঠিকভাবে পালনের ব্যবস্থা করা, কারো পাহারাদারির দায়িত্ব পানলে তার জন্য তা পালন করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে তার কোনো গুনাহ হবে না। কেননা ভিন্ন ধর্মের মানুষদের জন্য তাদের নিজস্ব পরিধির মধ্যে ধর্মীয় অনুষ্ঠান করা তাদের অধিকার। আর এ অধিকার ইসলাম অবশ্যই সমর্থন করে। বিভিন্ন সময় ইসলামী খেলাফতে এটি লক্ষ করা যায়। কিন্তু কোনো মুসলমানের জন্য এটির অনুমোদন নেই যে, অন্য ধর্মের আচার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে এবং একাত্মতা ঘোষণাকে বৈধ করার জন্য বলবে যে, ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার।’ আর সেই সুযোগে মুসলিম যুবকরা দুর্গাপূজায় গিয়ে হিন্দু মেয়েদের রোমাঞ্চকর নাচ দেখবে আর উল্লাস করবে তা কখনো ইসলাম সমর্থন করে না। বরং তা মুসলিম সমাজ এবং যুবসমাজের চরিত্র নষ্টের একটি কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই আসুন আমরা বলি, ‘ধর্ম যার উৎসবও তার, সব উৎসব সবার নয়।’ আমীন।