14/12/2019
এক অনুপ্রেরণার নাম #জেসিকা
হাত নেই, পা দিয়েই বিমান চালান জেসিকা।
অসম্ভবকে সম্ভব করার মতো মানুষদের জন্যই পৃথিবীটা আরো সুন্দর হয়ে আছে। তাদের দেখেই বাকিরা অনুপ্রাণিত হন। এই মানুষগুলোর গল্প শুনলে পৃথিবীতে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার তাগিদ আরো বেড়ে যায়। বিশ্বজুড়ে অসংখ্য অনুপ্রেরণা জোগানদাতা আছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম জেসিকা কক্স। তিনি জন্মেছিলেন হাত ছাড়াই। তবে প্রতিবন্ধকতা জীবনের বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। নিজের চেষ্টায় ও নিষ্ঠায় বিশ্বের প্রথম প্রতিবন্ধী পাইলট হিসেবে লাইসেন্স পান জেসিকা। ২০০৮ সালে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস তাকে এ স্বীকৃতি দিয়েছে।
যুক্তরাজ্যের অ্যারিজোনা রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন জেসিকা কক্স। ১৯৮৩ সালে যখন তিনি পৃথিবীতে আসেন, তাকে দেখে পরিবারের কেউই খুশি হয়নি। এমনকি তার মা-বাবাও ছিল হতাশ ছিলেন। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলেন জেসিকার মা। কারণ তার মাতৃত্বকালীন কোনো জটিলতা ছিল না। ডাক্তাররা এটাকে বিরল জন্মগত ত্রুটি হিসেবে বিবেচনা করেন। তিন ভাইবোনের মধ্যে জেসিকা কক্স মেজো। হাত নেই বলে তাকে কখনো আলাদা করে দেখা হয়নি। হাত না থাকলেও জেসিকাকে স্বাভাবিক মানুষের মতোই করে বড় করেন তার বাবা-মা।
স্বাভাবিক একজন মানুষ একজীবনে যতটুকু করতে পারেন, তার চেয়ে কম নয়, বরং বেশিই করছেন জেসিকা। ছোটবেলা থেকে বিষয়টিকে পাত্তা না দিয়েই বেশ খেলোয়াড়সুলভ স্পৃহায় বেড়ে উঠেছেন জেসিকা। জিমন্যাস্টিকস, নাচ ও সার্ফিং শিখে ফেলেছেন অনায়াসে। বলে রাখা ভালো, জেসিকার মা-বাবা কৃত্রিম হাতও লাগিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু জেসিকার সেটা একেবারেই পছন্দের ছিল না। সবসময় তার ইচ্ছে হতো কৃত্রিম হাতগুলো পুড়িয়ে ফেলতে, তবুও কষ্ট করে সেগুলো পরে ছিলেন ১১ বছর। জেসিকার বয়স যখন ১৪, তখন তিনি হাত দুটো খুলে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর আর কখনো পরেননি।
এক সময় নাচ করতেন জেসিকা। এর বাইরে কুংফুতে ব্ল্যাক বেল্টও অর্জন করেছেন। নিজের অদম্য দৃঢ়বল সম্পর্কে জেসিকা বলেন, ‘আমি কখনো বলি না যে, আমি করতে পারবো না। আমি শুধু বলি, হয়তো আমি এখনো বিষয়টি নিয়ে সেভাবে কাজ করতে পারিনি। জন্মের পর যখন আমি বুঝতে শিখেছি যে আমার হাত নেই তখন থেকে নিজেকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেছি। জন্মের পর বাবা-মা খুবই হতাশ হয়েছিলেন। কিন্তু তারাও আমাকে কখনো বুঝতে দেননি যে, আমার দুটি হাত নেই। অন্যরা আমার দিকে একটু অন্যভাবে তাকাতো এবং তাদের কেউ কেউ কখনো কখনো নেতিবাচক মন্তব্যও করতো। কিন্তু আমি তাদের নেতিবাচক মন্তব্যকে সব সময় ভালো মন্তব্য হিসেবে দেখতাম। কখনো কষ্ট পেতাম না। এটাই আমাকে লড়াকু করে তুলেছে।’
জেসিকার জন্য কখনো বিশেষ স্কুলের কথা ভাবেননি তার বাবা-মা। সকলের সঙ্গে তিনি যেতেন স্বাভাবিক বাচ্চাদের স্কুলে। ক্যাম্পাসে দোলনায় দোল খেতে খেতে যখন অন্য বাচ্চাদের মাংকি বারে ঝুলতে দেখতেন, তখন তার প্রচণ্ড উড়তে ইচ্ছে হতো। তিনি স্বপ্ন দেখতেন ওড়ার। ভাবতেন, ‘আমি একদিন সুপার উইম্যান হবো। হাত ছাড়াই উড়ে যাব আকাশে!’ বাবার ইচ্ছে ও তার প্রচেষ্টায় শেষমেশ তিনি এই স্বপ্ন পূরণ করে দেখিয়েছেন।
২০০৬ সালে জেসিকা কক্স এক যুদ্ধ-বিমানের পাইলটের সংস্পর্শে আসলেন। নাম রবিন স্টোড্ডার্ড। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান রাইট ফ্লাইটের প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। রবিন জেসিকাকে সরাসরিই জিজ্ঞেস করেছিলেন, বিমান চালাতে চান কি-না। সত্যি বলতে, বিমানে চড়ার ব্যাপারেও ছোটকাল থেকে তার মধ্যে ভীতি কাজ করত। সেজন্য রবিন স্টোড্ডার্ডকে প্রথমে সরাসরি না করে দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে অনুধাবন করলেন যে, ভীতিকে জয় করতে হবে। ফলশ্রুতিতে তিনি তার সঙ্গে যোগ দিলেন।
২০০৮ সালে পাইলট হন জেসিকা। শুধু পাইলট হিসেবে বিমান চালিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি। ধুমসে চালান গাড়ি, বাজান পিয়ানো। সবই করেন পা দিয়ে। এই বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সিএনএনকে এক সাক্ষাৎকারে জেসিকা বলেন, ‘সমস্যা হবে কেন! অন্য পাইলটরা হাত দিয়ে যে কাজগুলো করে, আমি দুই পা দিয়ে সেগুলো করি। আমি ছোটবেলায় প্লেনে উঠতে ভীষণ ভয় পেতাম। প্লেনে উঠলেই প্রার্থনা করতাম, যেন কেউ আমাকে এখান থেকে নামিয়ে দেয়। তবে একটা ডুয়েল ফ্লাইট আমার জীবনটা বদলে দিয়েছে। আমার পাশে বসা পাইলট হঠাৎ প্লেনের কন্ট্রোল ছেড়ে দিয়ে আমাকে বললেন, কন্ট্রোল করতে। আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম, তবে ভয়ের চেয়ে বেশি আনন্দ লাগছিল।’
জেসিকা ৩৫ বছর বয়সে হয়ে উঠেন একজন পরিপূর্ণ যুদ্ধ বিমানচালক। এবং হাতহীন প্রথম পাইলট হিসেবে আবার গিনেস বুক অব ওয়াল্ড রেকর্ডে নাম লেখান। জেসিকার ‘পাইলট জেসিকা কক্স' হতে এত দীর্ঘ সময় লেগেছিল, কারণ তিনি এমন কোনো প্রশিক্ষক পাননি, যিনি তাকে প্রচণ্ড শ্রম ও ধৈর্য নিয়ে প্লেন চালানো শেখাবেন। কিন্তু নিজের শ্রম ও ধৈর্যের বলে তিনি শেষ করতে পেরেছেন এই বন্ধুর সফর।
জেসিকা ২০১২ সালে প্যাট্রিককে বিয়ে করেন। তিনি তার সাবেক তায়কোয়ান্দো প্রশিক্ষক। জেসিকার কিন্তু দুটো ব্ল্যাক বেল্টও আছে। স্বামীকে নিয়ে অ্যারিজোনার তুকসনে তার বসবাস। জেসিকা Disarm Your Limits বইয়ে তার জীবনী লেখেন। তাকে নিয়ে বেশ কিছু তথ্যচিত্র বানানো হয়েছে, যেগুলো ২০১৫ সালে রোমের ভ্যাটিকান সিটিতে অনুষ্ঠিত মিরাবাইল ডিকটো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল বা ইন্টারন্যাশনাল ক্যাথোলিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা ডকুমেন্টরি হিসেবে ও হলিউড ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল'১৫ তে সোশ্যাল ইম্প্যাক্ট ফিল্ম হিসেবে পুরস্কার পায়। এছাড়াও জেসিকা কক্সের তথ্যচিত্রের ঝুলিতে রয়েছে আরো অনেক পুরষ্কার।
হাতছাড়া প্রথম ব্যক্তি হিসেবে এয়ারপ্লেন চালানোর সার্টিফিকেটটি জোটে তার কপালে। জেসিকা কক্স মনে করেন, পাইলট হয়ে শূন্যে ভাসলে হতবিহবল হওয়ার কিছুই নেই। তার ভাষায়, ‘দৃঢ় থেকে মনে রাখতে হবে, তোমার ভাগ্য তোমার হাতে। যেটি আমার ক্ষেত্রে পায়ে।’
Source : Daily Bangladesh