12/08/2020
সুফীদের অন্তরে থাকে আধ্যাত্মিক ভাব, ভাবের বহিঃপ্রকাশ সূর, সূরের প্রকাশ কাছিদা, কালাম, গান। ভাবুক তার ভাবের কথা কালামে গানে প্রকাশ করেন। ছন্দ প্রকরণে মাজাজের আশ্রয় নেয়া হয় বেশী। যিনি কালাম গান লিখেছেন তার বক্তব্য উদ্দেশ্য না জেনে ফতোয়া দেয়া যায় না। আর এধরণের কালাম হাটে মাঠে ঘাটে ওয়াজে বলা যায় না। খাস কথা খাস জাগায় সীমাবদ্ধ রাখতে হয়। যিনি কালাম লিখেছেন তার মাকাম বা হালত ও শ্রুতাদের মাকাম হালত এক নয়। আর গাউছুল আযম মাইজভাণ্ডারী'র কোন আওলাদ বা এ ত্বরিকার কোন স্বনামধন্য বক্তা বা আলেম এ ধরণের কালাম বা গান কখনো ওয়াজে মাহফিলে গাইতে বলতে শুনি নি।
ওয়ায়েস করণী রাঃ ৩২ দাত শহীদ করা শরীয়ত বিরুধী কিন্তু ইশকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বহিঃপ্রকাশ। মাওলানা রুমী রহঃ মসনবীতে বলেন "ছদ কিতাব ছদ ওরকে দর নারে নারে কুন, রুয়ে খোদ রা জানেবে দিল দারে কুন' শত শত কিতাবের পাতা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দাও অতঃপর মাশুকের প্রেমে নিজেকে বিলিয়ে দাও। এখানে রুপকভাবে কিতাবের পাতা জ্বলিয়ে দিতে বলা হয়েছে।
হাফেজ সিরাজী রহঃ বলেন 'সেজদায়ে রংগীন কুন পীরে মগা গুইয়াদ' তুমার পীর যদি বলে জায়নামাযকে শরাব দিয়ে রাংগিয়ে দাও...../ এগুলো ফানাফিশ শায়খের কালাম, যা ধর্তব্য নহে।
কবি নজরুল ইসলাম বলেন 'খোদায়ী প্রেমের শরাব পিয়ে বেহুশ হয়ে রই পরি হায়....../ এতে তিনিও ফতোয়া খেয়েছেন।
--------------------------------------------------------------------------
মুহাম্মদ সৈয়দুল হক এর লিখাটি নীচে শেয়ার করলাম।
আমার মরণকালে ঢোল বেলা বাজাইও
লাইনটা খেয়াল করুন। প্রথম শব্দটা ‘আমার’। আমার মানে নিজের। যে বলছে বা লিখছে তার। শব্দটা আমাদের ছিল না। তাই এ লাইন দ্বারা রচয়িতা ব্যতীত অন্যকেউ অন্তর্ভুক্ত হয় না৷ তিনি কাউকে অন্তর্ভুক্ত করেননি৷ তিনি তাঁর জন্য খাস করে বলেছেন। সবার জন্য পালনীয় বিধান(শরিয়ত) বলে সাব্যস্ত করেননি। মাইজভান্ডারি তরিকার কোনো পিরও কারো জন্যে কখনো করেননি।
এবার আসি তিনি কে? হ্যাঁ, রচয়িতার নামটা বজলুল করিম মন্দাকিনী। মাইজভান্ডারের প্রাণপুরুষ হযরত কেবলায়ে আলমের অন্যতম খলিফা। আপন পিরের নামের সাথে মিলিয়ে নিজে নাম রেখেছেন ‘আহমদিউল কাদেরি’। আশপাশের এলাকায় পরিচিত ‘করিম বক্স রহ.’ নামে।
গানে আসি। এটা তাঁর রচিত গানসমূহের শেষ গান। ইনতেকালের কিছুকাল আগে লিখেছিলেন। গানটা তাঁর ভক্ত-আশেকদের অসিয়ত করে লেখা। প্রথম লাইনের পু্রোটা এমন—‘আমার মরণকালে ঢোল বেলা(বাঁশি নয়) বাজাইও দরবারীগণরে’। হ্যাঁ, তিনি দরবারীদের বলেছেন। এ দরবারি কারা? তাঁর আশেক, ভক্ত, কাছের মানুষ৷ তাঁকে যারা চেনে-জানে কেবলই তারা। আরো খাস করে বললে যারা তাঁর ইনতেকালের পর কাফন-দাফনে যুক্ত হবেন তারা।
এবার তারা বাজাবে-কি-বাজাবে না, সেটা একান্তই তাদের আর রচয়িতার বোঝাপড়া। আপনাদের এতে এত মাথাব্যথা হওয়ার কারণ তো দেখছি না। তিনি ইনতেকাল করেছেন আজ প্রায় শতবর্ষ পেরিয়ে গেছে। এতদিন বাদে এসে তার গান নিয়ে ফাসাদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যও বোঝা দায়!
দ্বিতীয় লাইন আরো ডেঞ্জারাস! “কলেমা কালাম ভাই, কিছুই দরকার নাই।” কিন্তু এর পরের লাইন কী? সে-খবর আপনারা রাখেননি৷ জানেন না৷ দুলাইন পাইছেন, তা নিয়েই ‘মার গোল্লা লে ছুট’। ফেসবুকীয় জগত। লাফ তো দেবেনই৷ পরের লাইনটা “গাউছে ধনের গুণগীতি গাইও”। এর পরের লাইন আরো আকর্ষণীয়।
“শমনে হরিতে প্রাণ, মাওলাধনের গুপ্তদান,
ইসমে আজম পড়াইয়া শুনাইও...।”
ইসমে আজম বুঝেন তো? প্রচলিত অজিফার ইসমে আজম না। অলিদের প্রত্যেকের স্বতন্ত্র ‘ইসমে আজম’ আছে। সাধনার এক পর্যায়ে এসে এটা অর্জিত হয়। হ্যাঁ, মাওলানা বজলুল করিম মন্দাকিনী সেই লেভেলের অলিআল্লাহ৷ ইসমে আজম প্রাপ্ত। চলুন, তাঁর ভাষায় তাঁর কামালিয়্যত দেখি—
“আমি মনিপুরের স্বাধীন রাজা, কর দি না কাউরে
ভূত প্রেত যত আছে ডরে আমারে।
প্রবল প্রতাপে মোর, শত্রু কাঁপে থর্ থর্
ত্রিজগত জয় করিব অল্প দিন পরে।”
কালামটির শেষে যাওয়া যাক—
বাপ ডাকিলাম, ভাই ডাকিলাম, মওলাধনের দোহাই দিলাম
করিমেরে এইভাবে চালাইও...”
হ্যাঁ, করিমেরে। সবারে না। সবার জন্য এসব না। কেউ এটাকে তার জন্য টেনে নিলে সেটা একান্তই তার ব্যাপার। সমপর্যায়ের কেউ এ আমল নিজের জন্য করে নিলেও সেখানে অন্য কারো কিছু বলার থাকতে পারে না।
ভিডিয়োর ঐ মাওলানা সাহেব ‘আগেকার দিনে এমন হতো’ বলে দাবি করেছেন। এসব বানোয়াট তথ্য। আন্দাজে বলে দেওয়া আঁধারে ঢিল ছোড়া কথা। এ মওলানা এই গানের আগামাথা কিছু বুঝে কি না আমি জানি না৷ গানটা পুরো জানে কি না তাও জানি না; তবে এ গানের প্রেক্ষাপট যে মোটেও জানে না—তা তার বক্তব্যে স্পষ্ট। কেননা যে দুলাইন পড়েছেন তাও ঠিকঠাক পড়তে পারেননি। ভুলভাল-ভাবে পড়ে জট লাগিয়েছেন কেবল। এ টাইপের মোল্লারা ভেদ না-জেনে ভেদের সুর তুলে মানুষের আবেগ বেচে দুচার পয়সা কামানোর ধান্দা করে কেবল। তারা আদতে স্টাডি করা মোল্লা নয়। তাদের ব্যাপারে মন্দাকিনী (রহ.)’র কালাম—
“এমন ফকির দেখছি কত, হাতে মালা ধ্যানে রত
মনে সদা এই ভাবনা, কে তারে কী কয়।”
কালামের কথা—“মাওলাধনের দোহাই।” এই মওলাধন তাঁর আপন পির। হজরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারি। তাঁর নামের দোহাই দিয়েছেন। বুঝতে পারছেন—ঘটনা কী? না বুঝলে বুঝে নিন। তিনি ফানাফিশ শায়েখ ছিলেন। ফানাফিশ শায়েখ পরিভাষাটি না-বুঝলে বুঝে আসুন। এসব না-বুঝে বিরোধিতা করতে আসলে আপনি নখদন্তহীন দুর্বল, অন্ধ, খোঁড়া, বধির।
তিনি তার দায়ভার সব আপন পিরের কদমে কুরবান দিয়েছেন। বলেছেন—
“স্বর্গে কি নরকে যাই, তারি জন্য চিন্তা নাই
করিমে তোমাকে পেলে দুকুল ত্বরণ।”
আরো বলেছেন—
“ক্ষমা কর অপরাধ, পূর্ণ করো মন সাধ
তুমি বিনা কেবা আছে করিমেরে লয় উদ্ধারি
রক্ষা করো মাইজভান্ডারি, রক্ষা করো মাইজভান্ডারি...”
বলছিলাম তিনি ফানা-ফিশ-শায়েখ ছিলেন। তাই তাঁর এই হালত৷ কিন্তু মশাই, ফানা-ফিশ-শায়েখের সাথে ঢোল-তবলার সম্পর্ক কী? হ্যাঁ, এই প্রশ্নটা ইন্টারেস্টিং। উত্তরটা আরো ইন্টারেস্টিং। শুনুন তবে—
মাইজভান্ডারি তরিকায় কাউয়ালি/সামা মাহফিলের সংস্কৃতি সেই গাউছুল আজম মাইজভান্ডারির আমল থেকে। হ্যাঁ, গানের এ অংশের ‘ঢোল বেলা’ দ্বারা মূলত সামা মাহফিলই উদ্দেশ্য। তৎকালিন সময়ে এই সামাতে মজেই হযরতের আশেক/খলিফাবৃন্দ আত্মিক উন্নতির বেলা ভাসাতেন৷ তাঁদের মকাম উন্নিত হতো উঁচু থেকে উঁচু স্তরে। এসব গালগল্প না; নিরেট বাস্তবতা। মাইজভান্ডারের ইতিহাস, ভাবাদর্শ অধ্যয়ন করুন একবার। দুধ-কা দুধ পানি-কা পানি হু জায়েগা, ইন-শা-আল্লাহ!
এই সামাতে কী হয় আসলে? শুরুটা আল্লাহর প্রশংসা দিয়ে৷ এরপর নাতে মুস্তফা। এরপর অলিআল্লাহদের শানে গজল। হ্যাঁ, এটাই কাউয়ালি, এটাই সামা।
মজাদার বিষয়—সামার মাধ্যমে কলেমা কালাম অটোমেটিক আদায় হয়ে যাচ্ছে। তাহলে ‘কলেমা কালাম ভাই, কিছুই দরকার নাই’ এর হেতু কী? হেতু ঐ নিয়ম পালনে। আপনাদের প্রচলিত সাধারণ নিয়মে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না৷ তাঁর লক্ষ ছিল—কাজ একই হবে; তবে একটু ডিফারেন্ট অ্যাঙ্গেলে। আপন পিরের সেই মারফতি সামার ঢঙে। দোলতে দোলতে, গাইতে গাইতে তিনি মওলার সান্নিধ্যে যাবেন দোলার সাজে। বুঝেননাই ব্যাপাট্টা?
তিনি কি কলেমা কালামের বিরোধী ছিলেন? এটা আরো ইন্টারেস্টিং! আপনাদের সমালোচিত সেই কালামটি যে বইয়ে সংকলিক আছে, ঠিক সেই বইয়ের শুরুর কালাম—
“এয়্যা রব্বানা এলাহীনা, সল্লে আলা মোহাম্মাদীন্
ছল্লেম আলা নবিয়েনা, ছল্লে আলা মোহাম্মাদীন্
ছল্লে আলা ছৈয়দেনা, নবীয়েনা শফিয়েনা
ছল্লে আলা মোহাম্মাদীন্।”
এবার ফতোয়া লাগায় দেন। ইচ্ছেমতো ফতোয়া মারতে থাকেন। ভেদ বোঝা এত সহজ নারে ভাই, ভেদ বোঝা এত সহজ না। শব্দ দেখে মন্তব্য করা খুবই সহজ কাজ; শব্দের ভেতরের তত্ত্ব বোঝা নয়। বুঝলে সবাই অলিআল্লাহ হয়ে যেত। দেখামাত্র, শোনামাত্র, পাওয়া মাত্র যা খুশি মন্তব্য করা সহজ। কঠিন হচ্ছে হাকিকতটা বোঝা। আরেকটা কথা—সবকিছুতে, সবক্ষেত্রে ফতোয়া চলে না। চালাতে গেলে অলিআল্লাহদের একজনও ফতোয়ার বাইরে থাকবে না। সবাইকে যে কোনো ছুঁতো ধরে, যে কোনো লাইনে গিয়ে কাফের মুশরিক প্রমাণ করে দেয়া যাবে। বড়োপির থেকে শুরু করে ইবনে আরবি, তাবরিজ, রুমি কেউ এ ফতোয়া থেকে মুক্ত না। অতীতে এমন অনেককে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিতও করা হয়েছিল৷ ইতিহাস ঘাটুন, উত্তর পেয়ে যাবেন।
আর যারা রহস্যে পৌঁছেছেন, তারা ফতোয়ার পরোয়াও করেন না। ফকির বজলুল করিমও করেননি। কঠিনভাবে নিজের স্থান জানিয়ে দিয়েছেন—
“আমি বেচারা প্রেমেরি মরা, প্রেম শরাবে হই আত্মহারা
না করি পরোয়া তোদেরি ফতওয়ার, নীতি বিধানের নিয়ম পালন।
আমি শরাবি চলেছি পন্থে, সরে দাঁড়াও হে যত সুফিগণ
লাগিবে গন্ধ হইবে মন্দ, নাপাক হইবে তোমার সূফীতন...”