03/07/2024
মার্শাল ম্যাকলুহান সম্পর্কে যে কথাটি বলা হয়, তা প্যারাফেইজ করলে দাঁড়ায়, ‘মার্শাল ম্যাকলুহানকে বমি করাও যায় না, গেলাও যায় না।’
মানে, যোগাযোগ কিংবা যোগাযোগ প্রযুক্তি আলোচনায় তাঁর আলোচনা সাম্যবাদী তথা সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে যেমন অস্বস্তিকর, আবার তাঁকে ‘ইগ্নোর’ করাও যায় না। ‘অস্বস্তিকর’ কারণ, প্রযুক্তিকে তিনি বানিয়েছেন ‘ঈশ্বর’। যা ঘটছে, হচ্ছে-সব দোষ বা আশির্বাদ প্রযুক্তির।
এখানে মানুষের শোষণ, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ণ ইত্যাদি সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত। ‘ইগ্নোর’ করা যায় না প্রযুক্তি নিয়ে তাঁর তত্ত্ব ও তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে। এ তত্ত্ব আবার বেশ কিছুটা জটিল, যতটা না পড়তে, ততটা বুঝতে।
শিক্ষক, কবি ও লেখক আফরোজা সোমা ‘বাহবা’র দাবিদার। ‘জটিল’ ম্যাকলুহানকে ‘সহজ’ করার তাঁর এই উদ্যোগ তথা বই প্রকাশ এক প্রশংসনীয় ও সাহসী কাজ। ম্যাকলুহান নিয়ে আফরোজা সোমার এই লেগে থাকা আমাকে মুগ্ধ করে। এই বই পড়ে ম্যাকলুহানের তত্ত্ব নিয়ে আমার নিজের কিছু ভুল ধারণা ছিল, তা দূর হয়েছে। সোমাকে ধন্যবাদ।
বইয়ের নামকরণ, ম্যাকলুহানের ‘আন্ডারস্ট্যাডিং মিডিয়া...’র অনুকরণে ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং ম্যাকলুহান’। নামকরণ কতটা সফল? ‘জটিল’কে সহজ করার দৃষ্টিকোণ থেকে বেশ সফল বলা যায়। তবে, পূর্ণাঙ্গ ‘ম্যাকলুহান’কে বোঝার ক্ষেত্রে ততটা নয়। কেন?
বইটিতে আছে ম্যাকলুহানের আলোচিত তত্ত্ব ও তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ তথা মানব ইতিহাস, মিডিয়াম ইজ দ্যা ম্যাসেজ, হট মিডিয়া-কুল মিডিয়া, গ্লোবাল ভিলেজ, নয়া প্রযুক্তির প্রভাব প্রভৃতি নিয়ে আলাপ। আছে দুইটি সাক্ষাৎকার। তত্ত্ব ও তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গী বোঝা ও বোঝানোর ক্ষেত্রে স্বয়ং ম্যাকলুহানের ভাষ্যকে সহজীকরণ, বর্তমান নয়া প্রযুক্তি তথা বাস্তব জীবন থেকে উদাহরণ টানা প্রভৃতি প্রচেষ্টা এক কথায় অসাধারণ। পড়তে পড়তে ম্যাকলুহানকে ‘কনসেপচুয়ালাইজ’ করা যায় সহজে।
এক্ষেত্রে লেখক সফল। কিন্তু ‘ম্যাকলুহানকে’ ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ করার মওকা তথা সমালোচনার ক্ষেত্র বইতেই আছে, তবে বিশদ নয়, ক্রিটিকাল নয়। হওয়াটা বাঞ্চনীয় ছিল বইয়ের নামকরণের স্বার্থে।
পাঠক হিসেবে আমার অভিমত, বইতে তত্ত্ব নিয়ে বেশ সহজ ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু সাক্ষাৎকারের ভাষা বেশ জটিল। দোষ, অনুবাদকের নয়, ম্যাকলুহানের। লোকটা জটিল করেই বলেন সবকিছু। তবে সোমার ভাষার দখল এতটা বিস্তৃত যে, আরো সহজ করা যেত কি না, ভাবছি।
তত্ত্বের আলাপ আগে ‘যোগাযোগ’ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল, যা লেখক ও মূখবন্ধে শ্রদ্ধেয় ফাহমিদুল হক স্যার উল্লেখ করেছেন। আমার জানা মতে, আফরোজ সোমা ম্যাকলুহান নিয়েই ছিলেন, আছেন। তাই, ম্যাকলুহান নিয়ে তার লেখা আমাকে বেশ আকৃষ্ট করে। অন্টারিও টিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারটি ‘ঐতিহ্য’ প্রকাশিত সাম্প্রতিক ঈদ সংখ্যা ‘চানরাত’-এ প্রকাশিত হয়েছিল। আমার পরামর্শ, পরবর্তী সংস্করণে এর উল্লেখ থাকলে ‘সেলফ প্ল্যাজিয়ারিজম’ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কয়েকটি বানান বিভ্রাট আছে, যা স্বাভাবিক, পরবর্তী সংস্করণে ঠিক হবে আশা রাখি।
‘ম্যাকলুহান পাঠ’ আমার পছন্দ। তবে তাঁকে আমি ‘ভবিষ্যৎদ্রষ্টা’ কিংবা ‘অলঙ্ঘনীয়’ মানতে নারাজ, যেমনটা বলা হয় তাঁর ব্যাপারে, যদিও একসময় আমি তা মানতাম। যে সময়ে ম্যাকলুহান এ তত্ত্ব দিচ্ছেন, সে সময় ইন্টারনেট আসেনি, দিয়েছেন গ্লোবাল ভিলেজের ধারণা। কিন্তু একটা বিষয় ভুলে গেলে চলবে না, যে সময়ে তিনি এ তত্ত্ব দিচ্ছেন, সে সময় তিনি প্রযুক্তির বিবর্তনের ‘যৌবন কাল’ কিংবা এর প্রায় শেষের দিকে অবস্থান করছিলেন। প্রিন্টিং প্রেস, রেডিও, টেলিগ্রাফ, টেলিফোন এসে গেছে, বাতি এসে গেছে। সুতরাং আন্দাজ করার যথেষ্ট উপাদান ও কাল-সময় তাঁর ছিল। সুতরাং ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নয় বরং ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ তত্ত্বের জন্য তাঁকে প্রশংসা করা যায়।
মূখবন্ধে ফাহমিদুল হক স্যার বর্তমান নজরদারির অর্থনীতির ব্যাপারে ‘ম্যাকলুহান আগেই বলে গেছেন’ বলে যে কথা বলেছেন, এতেও আমার ঘোর আপত্তি। ম্যাকলুহানের অনেক আগেও ভবিষ্যতের ‘নজরদারির’ বিষয়ে বই আছে, উপন্যাস আছে। জর্জ অরওয়েলের ‘নাইন্টিন এইটি ফোর’ উপন্যাস, যার প্রকাশ ১৯৪৮ সালে এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ম্যাকলুহানের সমসাময়িক ফরাসি দার্শনিক গাই দিবোর্দ -এর কাজেরও উদাহরণ দেওয়া যায়, যার প্রসঙ্গ ‘নব্য উদারবাদ’ নিয়ে ফাহমিদুল হক স্যার নিজের লেখায় এনেছেন।
মার্শাল ম্যাকলুহানের সঙ্গে লেখকের যখন পরিচয়, তখন আমারও পরিচয়। আর এ পরিচয়ের সূত্রপাত খুব সম্ভবত শাওন্তী হায়দার ম্যামের লেকচার ও শ্রদ্ধেয় আলী রিয়াজ স্যারের এক লেখার মাধ্যমে, তারপর ম্যাকলুহানের মূল বইয়ে প্রবেশ, সবগুলোতে নয়।
ম্যাকলুহানকে বাংলায় অত্যন্ত গোছালো ও সহজভাবে আলী রিয়াজ স্যার উপস্থাপন করেছেন এবং তাঁর সমালোচনার ক্ষেত্রটি পরিষ্কার করেছেন। ওই লেখার শিরোনাম ও প্রকাশ কোথায় হয়েছে, এ মুহূর্তে বলতে পারছি না যদিও, তবে আমার ব্যক্তিগত অভিমত, আফরোজা সোমার বইতে ওই লেখার রেফারেন্স রাখা যায়। ঢাবি’র এমসিজে বিভাগের সেমিনারে লেখাটি পাওয়া যাবে। আলী রিয়াজ স্যারের ম্যাকলুহানের আলাপ আফরোজা সোমার বইটিকে আরো সমৃদ্ধ করবে বলে মনে করি।
ম্যাকলুহানের সাথে ও ম্যাকলুহান নিয়ে ম্যাকলুহানের ছেলে এরিক ম্যাকলুহান ও নাতি এন্ড্রিউ ম্যাকলুহানের বেশ কিছু বই ও লেখা আছে। নিশ্চয় সোমা তা জানেন। পরবর্তী সংস্করণে তাঁদেরকেও সম্পৃক্ত করা হবে বলে আশা রাখি।
আমার পরামর্শ, বইয়ের রেফারেন্স অংশটুকুতে একটা স্টাইল অনুসরণ করা আবশ্যক। ম্যাকলুহানের উক্তিগুলো এসেছে দুইবার, মাঝে ও শেষে। মানে রিডানডেন্সি। বাদ দেওয়া আবশ্যক। উক্তিগুলোর রেফারেন্স বাঞ্চনীয়। কোথাও ইংরেজিকে বাংলিশ করে কোথাও ইংরেজি লেখা হয়েছে। আমার পরামর্শ, এখানে একটি ভারসাম্য আনা দরকার। ইংরেজিকে ইংরেজি ভাষাতেই রাখা উচিত।
পাঠক হিসেবে এসব আমার মন্তব্য।
সত্য কথাটি হলো, বাংলায় ম্যাকলুহান নিয়ে লেখা আলী রিয়াজ স্যারের পর ম্যাকলুহানকে আরো বৃহৎ আকারে আরো সহজে বর্তমানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তুলে ধরার যে প্রচেষ্টা ও সাহস আফরোজা সোমা দেখিয়েছেন, তা অনবদ্য।
আমি বইটির ও বইয়ের লেখকের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি।