21/09/2022
কৃতজ্ঞতার উত্তম প্রতিদান (তিন ব্যক্তির ঘটনা)
আপনি যখন আপনার অবস্থান থেকে আল্লাহর নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন তখন আল্লাহ খুশি হয়ে আপনাকে আরও নিয়ামত বাড়িয়ে দিবেন। আর যদি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তাহলে মহান আল্লাহ আপনার থেকে তাঁর নেয়ামত সমূহ উঠিয়ে নিবেন। যেমন নবী মূসা (আঃ)-এর যুগের তিন ব্যক্তির ঘটনা গল্পাকারে পড়ুন যারা কৃতজ্ঞতার উত্তম প্রতিদান ও অকৃতজ্ঞতার প্রতিফল পেয়েছিলেন।
কৃতজ্ঞতার উত্তম প্রতিদান (মূসা নবীর তিন উম্মতের গল্প)
বিস্তৃত বালুকাময় বেলাভূমি। মাঝে মাঝে ছোট ছোট টিলা আর ঝোপঝাড়। একটু দূরেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কয়েকখানা পাহাড় সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে মাথা উচু করে।
হযরত মূসা (আ.)-এর জামানা। তিনি আল্লাহর প্রিয় নবী। প্রায়ই আল্লাহর সাথে তাঁর কথাবার্তা হয়, বাক্য বিনিময় হয়। এ জন্যে তিনি দূরে বহু দূরে অবস্থিত তূর পাহাড়ে চলে যান। সেখানেই তাঁর আলাপ আলোচনা চলে।
একদিন মূসা (আ.)-কে আল্লাহর সাথে কথা বলার জন্য তূর পাহাড়ে চললেন। সম্পূর্ণ একা। ভক্তবৃন্দের কেউ সাথে নেই। পথিমধ্যে তিনজন লোকের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তন্মধ্যে দু’জন পুরুষ একজন মহিলা।
প্রথম ব্যক্তি বিশাল ধন-ঐশ্বর্যের মালিক। কোনো অভাব নেই তাঁর। সে হযরত মূসা (আ.) দেখে বলল, হযরত! কোথায় যাচ্ছেন?
: মূসা (আঃ) বললেন, তূর পাহাড়ে আল্লাহ পাকের সাথে কথা বলতে যাচ্ছি।
সে বলল, আজ বহুদিন যাবৎ একটি কথা মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এ জন্য আপনাকে আমি মনে মনে তালাশ করছি। আপনি যেহেতু আল্লাহ পাকের সাথে আলাপ করতে যাচ্ছেন, তাই আসার পথে আমার মনের কথাটুকু আল্লাহর নিকট খুলে বলবেন। কথাটি হলো, আল্লাহ পাক আমাকে বিপুল ধন-সম্পদ দিয়েছেন। আমার টাকা-পয়সা ও সম্পদের পরিমাণ এতই বেশি যে, এগুলো সামলে রাখা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এমনকি এ বিশাল পরিমাণ ধন-দৌলতের হিসেব রাখতে গিয়ে আমি ঠিকমত আল্লাহ তাআলার জিকিরও করতে পারি না। অনেক সময় ইবাদতেও কমতি এসে যায়। তাই আপনি অনুগ্রহ করে আল্লাহ তাআলাকে বলবেন, তিনি যেন আমাকে এমন কোনো উপায় বাতলে দেন, যা করলে আমার সম্পদ কমে এমন পর্যায়ে চলে আসে যা নিয়ন্ত্রণে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব হয়।
হযরত মূসা (আ.) ‘ঠিক আছে বলব’ বলে সামনের দিকে অগ্রসর হলেন।
কিছু দূর যাওয়ার পর এক দরিদ্র মহিলা তাকে বলল, হুজুর! মনে হয় তূর পাহাড়ে যাচ্ছেন। সেখানে নিশ্চয়ই আল্লাহর সাথে আপনার কথা হবে।
হযরত মূসা (আ.) বললেন, হ্যাঁ, এ জন্যেই যাচ্ছি।
কৃতজ্ঞতার প্রতিদান
মহিলা বলল, হুজুর! আমি আপনার মাধ্যমে আল্লাহর নিকট একটি কথা জিজ্ঞেস করতে চাই। কথাটি হলো, আমার জন্য এমন কোনো পন্থা আছে কি, যা অবলম্বন করলে আমার এ গরীবি হালত পরিবর্তন হয়ে যাবে? হুজুর! আমি নিতান্ত অসহায়। একেবারে নিঃস্ব। ধন সম্পদ বলতে কিছুই নেই আমার। এই যে জীর্ণ-শীর্ণ ছোট্ট কুঁড়ের ঘরটি দেখতে যাচ্ছেন, এ-ই আমার নিবাস, একমাত্র সম্বল। আমার মনে হয়, আমার মতো অসহায় ও দরিদ্র নারী দুনিয়াতে আর কেউ নেই। আমি আশা করি আপনি এ ব্যাপারে আল্লাহর নিকট অবশ্যই জিজ্ঞেস করবেন।
হযরত মূসা (আ.) মহিলার কথাগুলো মনযোগ দিয়ে শুনলেন। তারপর আল্লাহর নিকট তাঁর আবেদনটি পৌঁছবার আশ্বাস দিয়ে সামনে চলতে লাগলেন।
আরো কিছুদূর চলার পর হাত-পা কাটা আরেকজন লোকের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হলো। বেচারার অবস্থা দরিদ্র মহিলাটির চাইতে অনেক বেশি করুণ। তাঁর দূরবস্থার দিকে তাকালে চোখে পানি এসে যায়। মনের অজান্তেই দু’গণ্ড বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু ঝরতে থাকে। কেননা, লোকটির হাত-পা যেমন নেই তেমনি দেহে গোশতও নেই। দেখলে মনে হবে, কতগুলো হাড্ডি যেন চামড়া দিয়ে পেঁচিয়ে রাখা হয়েছে। তাঁর মাথায় চুল নেই। চোখগুলো গর্তের ভিতর ঢুকে গেছে।
সে হযরত মূসা (আ.)- কে দেখতে পেয়ে কাতর স্বরে বলল, হে আল্লাহর নবী! আমার কোনো আবেদন নেই। নেই কোনো চাওয়া পাওয়াও। উপরন্ত এ করুণ অবস্থার জন্য মহান আল্লাহর বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগও নেই। তবে তুর পাহাড়ে গিয়ে আপনি শুধু পরম দয়ালু মহান আল্লাহ তা’আলাকে জিজ্ঞেস করবেন, দুনিয়ায় আমাকে এভাবে রাখায় তাঁর উদ্দেশ্য কি? কেন তিনি আমাকে এভাবে রেখেছেন? তিনি আমাকে কি উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন। এর জবাবে আল্লাহ পাক কি বলেন, মেহেরবানী করে ফেরার পথে আমাকে একটু জানিয়ে যাবেন, এই আমার অনুরোধ।
হযরত মূসা (আঃ) তাকেও পূর্বোক্ত ব্যক্তির ন্যায় আশ্বাস দিলেন। তারপর পুনরায় চলতে চলতে এক সময় গিয়ে তুর পাহাড়ে হাজির হলেন।
তুর পাহাড়ে এসে অন্যান্য দিনের মতো আজও হযরত মূসা (আঃ) আল্লাহর সাথে কথাবার্তা বললেন। তারপর ফেরার পুর্বে এক এক করে তিন ব্যক্তির আবেদনের কথাও জানালেন।
আল্লাহ তাআলা ধনী ব্যক্তির আবেদনের প্রেক্ষিতে বললেন, তুমি লোকটাকে বলে দিও, আমি তাকে সহায়-সম্পত্তি ও ধন-ঐশ্বর্যের যে নিয়ামত দান করেছি সে যেন উহার নাশুকরী করে; অকৃতজ্ঞ হয়। এতেই তাঁর সম্পদ কমে যাবে।
আর গরীব মহিলাকে বলিও, তাকে আমি যে অবস্থায় রেখেছি, সে যেন এ অবস্থায় থেকেও আমার শুকরিয়া আদায় করে। তাহলে অল্প দিনের মধ্যেই তাঁর অবস্থার উন্নতি ঘটবে। দূর হয়ে যাবে তাঁর ফকীরি অবস্থা।
সর্বশেষে হাত-পা কাটা পঙ্গু লোকটির ব্যাপারে বললেন—তাকে বলিও, জাহান্নামের দেয়ালে একটি ছিদ্র আছে। আমি তাকে দিয়ে ওই ছিদ্র বন্ধ করব। এ কাজের জন্যই আমি তাকে সৃষ্টি করেছি।
হযরত মূসা (আঃ) এর সব কাজ শেষ। এবার ফেরার পালা। তিনি আপন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। পথিমধ্যে সর্বপ্রথম দেখা হলো, পঙ্গু লোকটির সাথে। তিনি তাকে বললেন, ভাই! আমি তোমার ব্যাপারে আল্লাহর নিকট জিজ্ঞেস করেছি। তোমার সম্পর্কে তিনি যে কথা বলেছেন, তা মোটেও আনন্দদায়ক নয়। তিনি বলেছেন, দোযখের দেয়ালে নাকি একটি ছিদ্র আছে। আর ওই ছিদ্র বন্ধ করার জন্যই তিনি তোমাকে সৃজন করেছেন।
হযরত মূসা (আ.)-এর কথা শেষ হওয়া মাত্রই লোকটি উচ্ছ্বসিত আনন্দে লাফিয়ে উঠতে চাইল। অন্তরে বয়ে চলল খুশির ঝড়। তাঁর ভাব দেখে মনে হলো, সে যেন এমন একটি শুভ সংবাদ শুনার জন্যই যুগ যুগ অপেক্ষা করে আসছে। সে দু’ফোটা আনন্দাশ্রু চোখ টিপে ফেলে দিয়ে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। আমি আজ পরমভাবে পুলকিত এ জন্য যে, আল্লাহ তা’আলা আমাকে অনর্থক সৃষ্টি করেননি। আমাকেও তিনি একটি কাজে ব্যবহার করবেন। আমার জন্য এর চেয়ে খুশির কথা আর কি হতে পারে যে, সকল বাদশাহের বাদশাহ মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তাআলা আমার মতো একজন নাখান্দাকেও একটি কাজের জন্য নির্ধারণ করে রেখেছেন। যাক আমার জীবন তাহলে সার্থক।
লোকটির কথা শুনে আল্লাহ তাআলা অত্যন্ত খুশি হলেন। খুশি হলেন হযরত মূসা (আ.)ও। তাইতো তাঁর এ কৃতজ্ঞতার উত্তম প্রতিদান হিসেবে আল্লাহ তাআলা সাথে সাথে তাকে পূর্ণ সুস্থ করে দিলেন। তাঁর হাত-পা ঠিক হয়ে গেল। । চেহারার উজ্জ্বলতা ফিরে এল। ক্ষণিকের মধ্যে পরিণত হলো প্রশস্ত ললাট বিশিষ্ট সুন্দর সুদর্শন এক যুবকে। সুবহানাল্লাহ!
সেখান থেকে বিদায় নিয়ে হযরত মূসা (আ.) মহিলার কাছে এলেন। বললেন, মা! আল্লাহ পাক আপনাকে বর্তমান অবস্থায় থেকেই তাঁর শুকরিয়া আদায় করতে বলেছেন। এতেই নাকি আপনার বেদনাদায়ক জীবনের অবসান ঘটবে। ফিরে আসবে সুখের জীবন। কোনো অভাবই থাকবে না আপনার। একথা শুনামাত্র মহিলা মুহূর্তকাল বিলম্ব না করে চট করে বলে উঠল, এটা আল্লাহ কি বললেন! এটা কি কোনো কথা হলো? এত কষ্ট করে আল্লাহর শুকরিয়া আসায় করব কেন? তিনি আমাকে এমন কি নিয়ামত দিয়েছেন, যার জন্য আমি তাঁর শুকরিয়া আদায় করতে পারি? যান, আপনার কথা আমি আর শুনতে চাইনা। দয়া করে আপনি যেতে পারেন।
মহিলার মুখ থেকে এ দৃষ্টতাপূর্ণ কথাগুলো শুনে হযরত মূসা (আ.) মনে খুব কষ্ট পেলেন। মনে মনে বললেন, কেন? আল্লাহ তাআলা কি তাকে বসবাসের জন্য ছোট্ট হলেও একটি কুঁড়ে ঘর দেননি। তাকে দেখার জন্য চোখ, চলার জন্য পা, ধরার জন্য হস্তদ্বয় দেননি? সে কি নিয়মিত ঠাণ্ডা পানি পান করে না? স্বাভাবিকভাবে প্রস্রাব করতে পারে না? তাকে কি তিনি বাকশক্তি দান করেননি? এগুলো কি আল্লাহর নেয়ামত নয়? তবে কেন এই ধৃষ্টতা? কেন এই উদ্ধতপূর্ণ আচরণ?
কথাগুলো তিনি তন্ময় হয়ে ভাবছিলেন। সাথে সাথে তিনি মহিলার পরিণতির কথা ভেবে উদ্বিগ্নও হচ্ছিলেন। তাঁর ললাটে ফুটে উঠেছে গভীর চিন্তার রেখা।
নবীর চিন্তা এখনো শেষ হয়নি। ঠিক এমন সময় একটি দমকা হাওয়া এসে মহিলার কুঁড়ে ঘরটি উড়িয়ে নিয়ে গেল। নাশুকরীর শাস্তি সে ভোগ করল কড়ায় গণ্ডায়। এবার তাঁর বুঝে এল। আফসোস করে বলল, হায়! আমি যদি কৃতজ্ঞ হতাম, তাহলে আমাকে শেষ সম্বলটুকুএ হারাতে হতো না।
মহিলার কাছ থেকে চলে এসে হযরত মূসা (আ.) প্রথম ব্যক্তি অর্থাৎ ধনী লোকটির কাছে এসে বললেন, আল্লাহ পাক তোমাকে যে ধন-সম্পদের নিয়ামত দিয়েছেন তুমি যদি এর নাশুকরী কর তবেই তোমার সম্পদ কমে যাবে।
হযরত মূসা (আ.)-এর মুখ থেকে নাশুকরী তথা অকৃতজ্ঞতার কথা শুনা মাত্র সে আৎকে উঠে বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলল, এ তো কিছুতেই হতে পারে না। যে খোদা আমাকে এত ধন-সম্পদের অধিকারী করেছেন, যার অপরিসীম দয়ায় এত বেশি ঐশ্বর্যের মালিক হয়েছি, কি করে আমি তাঁর নাশুকরী করব? কি করে আমি তাঁর প্রতি অকৃতজ্ঞ হব!! এ যে আমার কল্পনারও অতীত। এ কথা বলার পর তাঁর সম্পদ আরো বেড়ে গেল।
আলোচ্য ঘটনার শিক্ষণীয় বিষয়টি দিবসের আলোর মতোই স্পষ্ট। আসলে চিন্তা করলে দেখা যাবে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে প্রতিটি পদে পদে আমরা আল্লাহ তাআলার অসংখ্য নিয়ামত ভোগ করছি। তাঁর নিয়ামত ছাড়া ক্ষণকাল বেঁচে থাকাও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে নিজেই ঘোষণা করেছেন—তোমরা যদি আমার নিয়ামতসমূহকে গণনা করতে থাক, তবে কখনোই তা গুনে শেষ করতে পারবে না।
অন্য আয়াতে তিনি বলেন, তোমরা যদি আমার নিয়ামত পেয়ে শুকরিয়া আদায় কর, তবে আমি তোমাদের নিয়ামতকে আরো বাড়িয়ে দেব। আর যদি নাশুকরী কর, তবে আমি নিয়ামত ছিনিয়ে নিব। আর মনে রেখো আমার শাস্তি অত্যন্ত কঠিন।
আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে তাঁর প্রদত্ত অসংখ্য নিয়ামত যেমন- ধন-সম্পদ, জ্ঞান-বুদ্ধি, আলো-বাতাস, আগুন-পানি, চোখ-নাক, হাত-পা ইত্যাদির শুকরিয়া আদায় করার তৌফিক দিন । আমীন। ছুম্মা আমীন!!