20/06/2023
"" জগন্নাথ দেবের প্রাচীন পুরাণ কাহিনী ""
- আজ রথযাত্রা। সমস্ত বন্ধুদের জানাই রথযাত্রার অনেক শুভেচ্ছা। আজ সমস্ত দেশবাসীর কাছে এক পরম পুন্যতিথি। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে আজ লাখো লাখো ভক্তের সমাগম।
এই রথযাত্রা উৎসবটি প্রত্যেক বছর নির্দিষ্ট সময়ে উদযাপিত হয়ে থাকে। রথযাত্রার নানা কাহিনী প্রচলিত রয়েছে, যেগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের নাম। প্রথমেই জানিয়ে রাখি জগন্নাথ এবং বিষ্ণু, শ্রীকৃষ্ণেরই দুই রূপ। বলরাম বা বলভদ্র, শ্রীকৃষ্ণ বা জগন্নাথ এবং সুভদ্রাদেবী এই তিনজন একে অপরের ভাইবোন। পুরাণে এমনটা বর্ণিত যে, তাদের তিন ভাইবোনের ঘনিষ্ঠ এবং স্নেহপরায়ণ সম্পর্কের জন্যই তাঁরা পূজনীয়। রথযাত্রাও তাদেরকে কেন্দ্র করেই।
তবে রথযাত্রার পুরাণ নিয়ে অন্যকোনো দিন আলোচনা হবে। আজ আমরা জেনে নেব স্বয়ং জগন্নাথ দেবের পুরাণ কাহিনী। কিভাবে নির্মাণ হয়েছিল পুরীর জগন্নাথ মন্দির আর কিভাবেই বা জগন্নাথ দেবের বিগ্রহ সেই মন্দিরে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল!! আজ আমরা সেই পুরাণ কাহিনী নিয়েই কথা বলব:-
স্কন্দপুরাণ থেকে জানা যায়, প্রাচীন ভারতের মালব রাজ্যের অবন্তী নগরের রাজা ছিলেন ইন্দ্রদ্যুম্ন। তিনি প্রবল বিষ্ণুভক্ত ছিলেন। সেই সময় ইন্দ্রদ্যুম্নকে সমগ্র মালব রাজ্যের শ্রেষ্ঠ রাজা আখ্যা দেওয়া হত কারন তার মত ধীর, স্থিরমতি,ধার্মিক, প্রিয়ভাষী ও প্রজাবৎসল রাজা আর কেউ ছিল না। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের আমলে অবন্তী নগরও সুখ সম্পদে পরিপূর্ণ ছিল। কিন্তু এহেন অবস্থাতেও রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের মনে সুখ ছিল না। তিনি জগতের সমস্ত সুখ আহ্লাদের প্রতি মোহহীন ছিলেন। তার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা ছিল মাধব অর্থাৎ শ্রীবিষ্ণুর দর্শন লাভ করা। তিনি এই আশায় সমুদ্রের পূর্ব দিকে এক তীর্থক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা করেন যার নাম ছিল শ্রীক্ষেত্র (বর্তমানে যার নাম পুরী বা নীলাচল)। কিন্তু সেই তীর্থের মন্দিরে বিগ্রহ ছিল না কোনো।
শ্রী বিষ্ণুর দর্শন লাভের আশায় ইন্দ্রদ্যুম্ন এক বিশাল যজ্ঞের আয়োজন করেন। সেখানে হঠাত এসে উপস্থিত হন এক দিব্যকান্তি পন্ডিত। তিনি রাজার মনের ইচ্ছের কথা জানতে পেরে তাকে বলেন- ""হে রাজন , আমি শিশুকাল হতে বহু তীর্থ দর্শন করেছি। এই পৃথিবীর পূর্ব ভাগে পুরুষোত্তম ধাম নামে এক উত্তম ক্ষেত্র আছে। সেখানে নীল নামে এক পর্বত আছে যা এক সমৃদ্ধ বন দ্বারা পরিবেষ্টিত । তার মধ্যভাগে কল্পবৃক্ষ রূপ অক্ষয়বট আছে , প্রাজ্ঞেরা বলেন তার ছায়াতলে ব্রহ্ম হত্যা জনিত পাপ ক্ষয় হয়। তার পশ্চিমে রৌহিণ নামে এক কুন্ড আছে। তার সম্মুখে ভগবান বাসুদেবের নীলকান্তমণিময় এক অদ্ভুত চমৎকার বিগ্রহ অধিষ্ঠিত, যার নাম নীলমাধব। শোনা যায় , সেই বিগ্রহ দর্শনমাত্র কেউ যদি সেই কুণ্ডের জল স্পর্শ করে , তবে তিনি তৎক্ষণাৎ মুক্তি লাভ করেন।"" একথা বলেই সেই জ্ঞানী পুরুষ হঠাত অন্তর্ধান হয়ে যান।
এদিকে একথা শোনামাত্র চঞ্চল হয়ে ওঠেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন। তিনি তৎক্ষনাৎ ডেকে পাঠান তার পুরোহিতের ভাই পন্ডিত বিদ্যাপতিকে। এবং তাকে বলেন তুমি এক্ষুনি পূর্ব দিকে যাও, এবং খুঁজে বার করো সেই নীলমাধবের মন্দির। আমি তোমার আগমনের প্রতীক্ষায় থাকব। যেভাবে হোক সেই বিগ্রহ নিয়ে এসো, আমার শ্রীক্ষেত্রে আমি ধুমধাম করে তা প্রতিষ্ঠা করব। বিদ্যাপতি রাজার আদেশ মাথায় নিয়ে মাধবকে স্মরন করে লোকজন সহ পূর্বদিকে যাত্রা শুরু করেন।
কিন্তু স্বয়ং বিষ্ণু কি এত সহজে দেখা দেন!!নীলমাধবকে খুজতে খুজতে ক্লান্ত হয়ে সব লোকজন আস্তে আস্তে হাল ছেড়ে ফিরে গেল। কিন্তু হতাশ হননি একমাত্র বিদ্যাপতি। তিনি পূর্বের সব অঞ্চলগুলিতে খোঁজ করতে করতে অবশেষে এক জঙ্গলে পথ হারান। এরপর এই কাহিনীতে প্রেমের ছোঁয়া লাগে। জঙ্গলে দিকভ্রান্ত ও পরিশ্রান্ত বিদ্যাপতিকে উদ্ধার করলেন সেই অঞ্চলে রাজত্ব করা শবর প্রজাতির রাজা বিশ্ববসুর কন্যা ললিতা। ললিতার সেবায় সুস্থ হয়ে ওঠেন বিদ্যাপতি। এরপর আস্তে আস্তে দুজনের ভাব গড়ে ওঠে যা প্রেমে পরিনত হয় একসময়। ললিতা বিদ্যাপতির সাথে তার পিতা শবররাজ বিশ্ববসুর সাথে পরিচয় করান। বিশ্ববসুর কাছ থেকেই বিদ্যাপতি জানতে পারেন শবররা বহু যুগ ধরেই তাদের আরাধ্য নীলমাধবের পুজো করে আসছে। এরপর দিন গড়াতে থাকে। ললিতা ও বিদ্যাপতির বিবাহ হয়। বিয়ের পরে বিদ্যাপতি দেখে তার শ্বশুর বিশ্ববসু রোজ সকালে স্নান করে একা কোথাও বেড়িয়ে যান। বিদ্যাপতি বুঝতে পারে বিশ্ববসু নীলমাধবের পুজো দিতে যান রোজ। তিনি শবররাজাকে একদিন বলেন তাকেও সাথে করে নিয়ে যেতে। কিন্তু বিশ্ববসু রাজী হয়না। এদিকে বিদ্যাপতিও নাছোড়বান্দা, রাজাকে কথা দিয়ে এসেছেন নীলমাধবের খোঁজ আনবেন। অনেক জোরাজুরির পর একদিন অবশেষে শবররাজা রাজী হয় তার জামাই বিদ্যাপতিকে নীলমাধবের মন্দিরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।
মন্দিরে এসে নীলমাধবকে দেখে ভক্তিতে মাথা নীচু হয়ে যায় বিদ্যাপতির। সাথে সাথেই নিষ্ঠাভরে পুজো করা শুরু করেন তিনি নীলমাধবের। ঠিক তখনই আকাশ থেকে দৈববানী ভেসে আসে- "এতদিন আমি দীন-দুঃখীর পূজো নিয়েছি, এবার আমি মহা-উপাচারে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পূজো নিতে চাই।’’
পরম আনন্দে মন ভরে যায় বিদ্যাপতির। নীলমাধব যখন স্বয়ং রাজা ইন্দ্রদুম্ন্যের পূজো নিতে চান, তখন কি আর দেরি করা যায়? চটজলদি খবর পাঠানো হলো রাজা ইন্দ্র্যদ্যুম্নের কাছে। রাজা বিস্ময়ে মহানন্দে সব ব্যবস্থা করে হাজির হলেন জঙ্গলের মাঝে নীলমাধবকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু জঙ্গলে পৌঁছনো মাত্রই আর কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো না নীলমাধবের। নীলমাধবের এহেন আকস্মিক অন্তর্ধানের ঘটনায় রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন একবারে ভেঙে পড়লেন। তিনি শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। তিনি ভাবলেন প্রভু মাধবের দর্শনই যখন পেলাম না এ জীবন রেখে কি লাভ আর। এইসময় দেবর্ষি নারদ রাজার সামনে প্রকট হলেন ও বললেন- " হে রাজন তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। প্রভু মাধব দারুব্রহ্ম রুপে তোমার পুজো নেবেন ও তোমায় দেখা দেবেন"। এই কথা শুনে রাজা একটু স্বাভাবিক হলেন। এরপর একদিন রাজার স্বপ্নে এলেন শ্রী বিষ্ণু, তিনি রাজাকে বললেন- "তুমি আমার পরম ভক্ত আর দেবতা কি ভক্তকে ছাড়া থাকতে পারে। তাই আমি সমুদ্রে দারুব্রহ্ম রুপে ভাসতে ভাসতে তোমার নিকট আসছি, তুমি শ্রীক্ষেত্রে এক দিব্যমন্দির প্রতিষ্ঠা করো"।
রাজা একথা শুনে তাড়াতাড়ি সমুদ্রতীরে যান ও দেখেন সত্যিই দারুব্রহ্ম নামক কাঠ ভেসে এসছে। রাজা তখন হাতি দিয়ে সেই কাঠ ওঠানোর ব্যবস্থা করেন। কিন্তু সেই কাঠ একচুলও নড়ানো যায়না। দুঃখী মনে ফিরে আসেন রাজা। সেই রাতে ভগবান আবার তাকে স্বপ্ন দিয়ে বলেন- " শবররাজ বিশ্ববসু পারবেন এই দারুব্রহ্ম তুলতে। তুমি শবররাজাকে নিয়ে এবং একটি স্বর্ণরথ নিয়ে আসো"। যথারীতি রাজা এক সোনার রথ ও শবররাজাকে নিয়ে সমুদ্রতীরে আবার এলেন। এবার রাজা, বিশ্ববসু ও বিদ্যাপতি তিনজন মিলে সেই দারুব্রহ্ম সোনার রথে চাপিয়ে সংকীর্তন করতে করতে গুন্ডিচ্চা মন্দিরের দিকে যাত্রা শুরু করলেন। সেখানে তিনি এক দিব্যমন্দির বানান। এবার নারদমুনির আদেশ মত তিনি সেই দারুব্রহ্ম দিয়ে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি বানানোর জন্যে কাঠ কাটার লোকদের ডেকে পাঠান। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে কুড়াল, ছেনি বা হাতুড়ি কোনটাই কাঠটিকে কাটতে পারেনা। উল্টে সেগুলি ভেঙ্গে যায়। রাজা আবার চিন্তায় পড়ে যায়।
সেই সময় মন্দিরে এক সাধারন মানুষ আসে। আসলে তিনি ছিলেন দেবতা বিশ্বকর্মা। বিষ্ণুর আদেশে তিনি মনুষ্য রুপে এসেছিলেন। তো তারপর বিশ্বকর্মা এসে রাজাকে বলে যে তার নাম অনন্ত মহারানা। এবং সে একজন মূর্তি কারিগর। এবং সে রাজাকে এও বলে যে সে এই কাঠ দিয়ে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি বানাতে পারবে। তবে তার একটি বিশাল ঘর ও ২১ দিন সময় লাগবে। তবে শর্ত একটাই এই ২১ দিন তাকে বিরক্ত করা যাবেনা ও সেই ঘরে কেউ প্রবেশ করতে পারবেনা। রাজা মেনে নেয় তার কথা।
এইভাবে ১৪ দিন কেটে যায়। সেই ঘরটি থেকে কোন শব্দ না পেয়ে রাণীর মনে কৌতুহল জাগে। থাকতে না পেরে তিনি দরজা খুলে ঘরে ঢুকে পড়েন। কিন্তু ভিতরে ঢুকে তিনি যা দেখলেন তা দেখে তিনি ভিরমি খেয়ে পড়ে গেলেন। তিনি দেখলেন ঘরে কারিগর উধাও এবং সাথে তিনটি অর্ধসমাপ্ত মূর্তি বানানো রয়েছে। রাজার কাছে খবর যায়। রাজা এসে দেখলেন হ্যা সত্যিই মূর্তি তিনটি অসমাপ্ত। মূর্তিগুলোর গোল গোল চোখ, না আছে হাত না আছে পা, সাথে গায়ের রং হলুদ। এই ঘটনার পর রাজা রানী দুজনেই অনুশোচনা আর শোকে বিহবল হয়ে পড়লেন। তারা ভাবলেন, শর্ত খণ্ডনের ফলেই বুঝি এত বড় শাস্তি পেলেন তারা। সেই রাতেই ভগবান বিষ্ণুর স্বপ্ন পেলেন রাজা। ভগবান তাকে বললেন- "আমার আদেশেই দেবশিল্পী মূর্তি বানাচ্ছিলেন, তবে কাজে বিঘ্ন ঘটায় আমার রুপ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তবে তাতে অসুবিধে নেই। আমি এই রুপেই তোমার পুজা নিতে চাই ও পূজিত হতে চাই। তবে শবররাজা বিশ্ববসু আমার পরম ভক্ত। বহু বছর ধরে আমার পুজো করছেন তিনি। তাই বংশ পরম্পরা ধরে বিশ্ববসুই আমার পুজো করবে এবং বিদ্যাপতি ও ললিতার সন্তান ও তাদের বংশধররা আমার ভোগ রান্না করবে।"
এভাবেই জগন্নাথ দেবের আবির্ভাব হয় শ্রীক্ষেত্র বা পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে। যুগে যুগে জগন্নাথদেবের মূর্তির রূপ নিয়ে মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন জাগে। কেন হস্তপদবিহীন দেহ তাঁর, কেন এমন অদ্ভুত তাঁর অবতার? এই প্রসঙ্গে স্বয়ং দেবতার কিছু বিশ্লেষণ দেখা যায়। কঠোপনিষদে বলা হয়েছে, “না আত্মানং রথিনংবিদ্ধি শরীরং রথমেবতু”। অর্থাৎ, এই দেহই রথ আর আত্মা দেহরূপ রথের রথী। ঈশ্বর থাকেন অন্তরে। তার কোনো রূপ নেই। তিনি সর্বত্র বিরাজমান। বেদ বলছে, “অবাঙমানসগোচর”। অর্থাৎ, মানুষ বাক্য এবং মনের অতীত। মানুষ তাই তাকে মানবভাবে সাজায়। এ বিষয়ে কৃষ্ণ যজুর্বেদিয় শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে-
‘‘অপাণিপাদো জাবানো গ্রহীতা
পশ্যত্যচক্ষুঃ স শৃণোত্যকর্নঃ ।
স বেত্তি বেদ্যং ন চ তস্যাস্তি বেত্তা
তমাহুরগ্র্যং পুরুষং মহান্তম্’’ ।।
অর্থাৎ, তার লৌকিক হস্ত নাই, অথচ তিনি সকল দ্রব্য গ্রহণ করেন। তার পদ নাই, অথচ সর্বত্রই চলেন। তার চোখ নাই, অথচ সবই দেখেন। কান নাই, কিন্তু সবই শোনেন। তাকে জানা কঠিন, তিনি জগতের আদিপুরুষ। এই জগন্নাথ দেবই বিশ্বাত্মা, তার রূপ নেই, আকার নেই। উপনিষদের এই বর্ণনার প্রতীক রূপই হলো পুরীর জগন্নাথদেব। তার পুরো বিগ্রহ তৈরি করা সম্ভব হয়নি, কারণ তার রূপ তৈরিতে মানুষ অক্ষম। শুধু প্রতীককে দেখানো হয়েছে মাত্র।
**** এই ছিল জগন্নাথ দেবের অলৌকিক পুরাণ কাহিনী ও ইতিহাস। আশা করি আপনাদের ভাল লাগবে। যদি ভালো লাগে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন।
জয় জগন্নাথ....🙏🙏
বিঃদ্রঃ- বিদ্যাপতি/ললিতা/শবররাজ এই কাহিনীগুলি স্কন্দপুরাণে পাওয়া যায়নি। এগুলি উড়িষ্যার প্রাচীন লোকগাথাতে পাওয়া গেছে। এই পুরো লেখাটি স্কন্দপুরাণ ও প্রাচীন লোকগাথাকে মিশ্রণ করেই লেখা হয়েছে।