01/06/2024
#অর্বাচীন_দিন_রাত্রি (১)
মোতাহারের আজকে হুট করেই আবার হাঁটার রোগে ধরেছে।
কেন, কি জন্য, কোন কারণে, সেইটা সে বলতে পারবে না, নিজেও জানে বলে মনে হয়না। শুধু এইটুকু জানে যে তাকে আজকে হাটতে হবে। তবে এই জানা যে সে অনেক আগে থেকেই জানতো, ব্যাপারটা আবার সেইটাও না। দুপুরে মেসের নিচে সরফরাজের ভাতের হোটেলে আম ডাল দিয়ে ভরপুর খাওয়ার পর বিশাল একটা ভাত ঘুম দিয়ে সন্ধ্যা সন্ধ্যা নাগাদ বিশ্রী রকমের খারাপ মেজাজ নিয়ে ঘুম থেকে জেগে ওঠে সে। ঘুম থেকে উঠেই তার মাথায় হুট্ করে যেই ব্যাপারটা প্রথমে আসে তা হল এই সেপ্টেম্বারের ভরা বছরের মাঝে সরফরাজ মিয়া কাঁচা আম পাইলো কই থেকে? সেটা নিয়ে তার উথালপাথাল চিন্তা। নাহ, এইটার একটা বিহিত করতে হবে, আজকে সরফরাজকে ক্যাক করে ধরতে হবে, কি শোন্ হাবিজাবি খাওয়ায় টাকা নিয়ে যাচ্ছে। এক্কেবারে ছাই বালু হাতে লাগায় ধরতে হবে, যাতে সরফরাইজ্জা ফুড়ুৎ করে পালায় না যেতে পারে।
চিন্তা করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে হোটেলের সামনে আসতেই মোতাহারের মাথায় অন্য চিন্তা ঢুকলো, আচ্ছা সে না হয় সরফরাজের ধরলো, এরপর ওই ব্যাটা যদি তারে ধরে একটা মাইরটাইর দেয়, কিংবা হোটেলের সবাই মিলে যদি হালকা আচ্ছা মতন ডলাও দিয়ে দেয়, তাহলেতো সে কিছুই করতে পারবেনা না।
নাহ, এই চিন্তা বাদ। অন্য কিছু বাইর করতে হবে, যাতে সরফরাজের একটা শিক্ষা হয়, আর ও নিজেও মাইর না খায়। সাপও মরলো, লাঠিও না ভাঙলো। এখন অন্য কিছু করা দরকার। গায়ের ভিতর কেমন জানি কুট কুট করছে, একটা প্ল্যান করার পর ঐটা করা না গেলে কেমন জানি অস্থির অস্থির লাগে তার।
আচ্ছা যাই, লোকাল বসে করে ঘুরে আসি এদিক ওদিক। নিজে নিজেই বলে হাটা দেয় পুলিশ ফাঁড়ি বাস স্ট্যান্ড এর দিকে।
আচ্ছা ভালো কথা, এই পুলিশ ফাঁড়ি ব্যাপারটা আসলে কি? ও ভালো মতনই জানে এইখানে অনেক অনেক পুলিশ পাওয়া যায়। কিন্তু এই নাম দিছে কেন? এইখানে কি পুলিশ ফাঁড়া হয়? ধুর, তা কেমনে সম্ভব। নিজের মনেই হাসে মোতাহার।
হেমায়েতপুর যাওয়ার লোকাল বাস যখন গাবতলী এসে পুরা বাস খালি করে দিয়ে একই জায়গায় আগুপিছু শুরু করে যাত্রী টানার জন্য, তখন মোতাহারের কি মনে হতেই বাসের জানালা বেয়ে নেমে পড়লো। বাসে বসে থাকতে আর ইচ্ছা করতেছেনা না। বাসের ভাড়াও দেয়া হয়নাই। কন্ট্রাক্টর মামারে হেমায়েত যাওয়ার লোভ দেখায় বার বার ফেরত দিছে ভাড়া চাইতে আসার সময়।
ভাড়াটা মনে হয় দিয়ে আসা উচিত ছিল? নিজের মনেই বলতে থাকে মোতাহার। খচ খচ করতে থাকে নিজের ভিতর। তারপর আবার নিজেকেই বুঝ দেয় এই বলে যে জীবনে অনেক পাপ করছে, এই ভাড়া মেরে দেয়া তার কাছে কিচ্ছু না, তার নেট পাপের পরিমানে খুব একটা হেরফের হবে বলে মনে হয়না।
রাস্তা পার হয়ে এসেই মোতাহার শুরু করলো হাঁটা। তখন প্রায় সন্ধ্যা শেষ হয়ে রাত আস্তে আস্তে বাড়তি। প্রথমে মনে হলো মিরপুর বেড়িবাঁধ পর্যন্ত যাবে। বেড়িবাঁধ আসার পর আবার পরিকল্পনা বদলায় ও। নাহ, আশুলিয়া পর্যন্ত যাবে।
সেই রাত সাত-আট এর দিকে শুরু করা হাটা ধৌরের কাছে আসতে আসতে প্রায় দু-তিনটে বাজিয়ে ফেলে মোতাহার। পথে অদ্ভুত তেমন কিছুই হয়নি। হওয়ার কথাও না। মহাসড়ক। কিছু আন্তঃজেলা বাস, আর মালবাহী ট্রাক কিছুক্ষন পর পর সা সা করে মোতাহারের মুখে গাদা খানেক বালি ছিটিয়ে তাদের নিজের গন্তব্যে চলে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই হয়নি তেমন। গভীর রাত, আর কিছু হওয়ার ও কথা না।
একটা ব্যাপার বাদে।
মোতাহারের পিছু নিয়েছে একটা কুকুর। লাল রংয়ের পিঠে ঘাঁ হয়ে রোম ওঠা একটা হাড় জিরজিরে কুকুর। মোতাহার ও হাঁটে, সেও হাঁটে। মোতাহার অনেকবার থেমে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছে কুকুরটা আসলে চায়কি তার কাছে।এই ব্যাটা কিছুই বলেনা। খালি দাঁড়িয়ে থেকে লেজ নাড়ে। লেজে আবার তার লোম নাই। লোমহীন টিংটিংয়ে লেজ এইভাবে নড়তে দেখলে মোতাহারের অদ্ভুত লাগে। আসার পথে একটা দোকান থেকে বিশাল সাইজের একটা কুত্তা বন কিনে খেতে দিয়েছিলো তাকে মোতাহার। কুকুরটা খেলো, খেয়ে লেজ নাড়তে নাড়তে কই জানি গেলো। মোতাহার ভাবলো যাক আপদ বিদায় হইসে। মোতাহার খানিক হাঁটা শুরু করতেই পিছন থেকে কিছু একটা দ্রুত বেগে ছুটে আসতে শুনে তাকিয়ে দেখে সেই কুকুর আবার কই থেকে জানি হাজির হয়ে গেছে। এসে জিভ একহাত বার করে লেজ নাড়াচ্ছে সমানে। কি বিপদে পড়া গেলোরে ভাই। তাড়াইতেও ইচ্ছা করছে না মোতাহারের, কেমন জানি মায়া মায়া লাগছে তার।
থাকুক, কতক্ষণই বা থাকবে। একটু পর এমনিতেই চলে যাবে। সবাই যেভাবে চলে যায়।
ধৌর আর আশুলিয়া মাঝামাঝি আসতেই মোতাহারের শরীর ছেড়ে দেয়া শুরু করে। আর হাটতে পারেনা সে। এদিক সেদিক তাকিয়ে একটা বন্ধ হয়ে থাকা চায়ের দোকানের পিছনের বেঞ্চিতে ধপ করে বসে পরে ও। এই রাস্তাটা অদ্ভুত। ঠিক বিশাল একটা বিলের মাঝ দিয়ে সোজা চলে গিয়ে এক করেছে আশুলিয়া আর ধৌর। বৃষ্টির পানি রাস্তার দুপাশে জমে পুরো অদৃশ করে দিয়েছে দুপাশের ধানী চরাঞ্চল। একটা দুইটা ডাট কলমি পানি ভেদ করে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের অস্তিত্ব জানিয়ে দিচ্ছে তার মাঝে। বিলের জোলো হাওয়ায় সমানে যখন এদিক ওদিক নড়তে থাকে তখন মনে হয় মাঝ দরিয়ায় একটা মানুষ যেন তাকে হাত নেড়ে নেড়ে কাছে ডাকছে। ডেকে ডেকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে কোন এক অকুল পাথারে।
মোতাহারের চিন্তা এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে, প্রচণ্ড ঘুমে চোখের পাতা ভারী হয়ে পাথরের মতন লেগে যেতে থাকে একে অন্যের সাথে। এক একটা চোখের পাতা যেন সারা বাংলাদেশ পাঁচ টন। নাহ, আর পারেনা মোতাহার। বেঞ্চির সাথে লাগোয়া বাঁশের খুঁটির সাথে মাথা ঠেকিয়ে অতল এক অন্ধকারের ভিতর হারিয়ে যেতে থাকে সে। বিলের জোলো হাওয়ায় একটা মিষ্টি ঘাসফুলের গন্ধ। কেমন জানি নেশা নেশা। কানের কাছের এক রাস মশার দল যাত্রা পালা শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু মোতাহারের হাতটা তুলে তাদের তাড়িয়ে দিতেও ইচ্ছে করছে না। কিংবা হয়তো পারছেনা।
ঘুমের সেই অতল গহবরে যেতে যেতেই মোতাহার বুঝতে পারে কুই কুই শব্দ করে সেই কুকুটাও তার কাছে চলে এসেছে। পায়ের সাথে মাথা ঘষছে আস্তে আস্তে। ঠিক ঘুমিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে মোতাহার বুঝতে পারলো কুকুরটা বেঞ্চিতে উঠে তার গা ঘেঁষে শুয়ে পড়লো।