29/12/2023
ঘটনা ১।
ফলের দোকানে ফল কিনতে গেলে ফলওয়ালা নিজের হাতে ফল প্যাকেটে দিয়ে দেয়। বাসায় নিয়ে এসে দেখি কিছু নষ্ট ফল কীভাবে জানি প্যাকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছে। সেজন্য চেষ্টা করি এখন নিজ হাতে ফল বেছে নিতে। একদিন টেলিভিশনে খবরে দেখলাম যেসব প্যাকেটে ফল দেওয়া
হয়, সেই প্যাকেটের তলায় ওজন বাড়ানোর জন্য মোটা কাগজ ব্যবহার করা হয়। শুধু তাই না মিষ্টির দোকানের মিষ্টির বাক্সের ওজন এত বেশি যে, এক কেজি মিষ্টি কিনতে গেলে মানুষ পুরোপুরি এক কেজি মিষ্টি পায় না।
ঘটনা ২।
আমার পরিচিত এক অনলাইন খাবারের ব্যবসায়ী এক কেজি গরুর গোশত ক্রেতাকে রান্না করে পাঠান। ক্রেতা সেই রান্না করা গরুর গোশত মেপে দেখেন যে, ওজন এক কেজির কম। তখন ভুল বোঝাবুঝি হয় ক্রেতা-বিক্রেতার মাঝে। অথচ দুজনই নিজেদের দিক থেকে ঠিক ছিলেন। কারণ রান্নার আগের এক কেজি কাঁচা গোশত রান্নার পরে কমে যায়। ক্রেতা ও বিক্রেতা আগে এ ব্যাপারে বলে নিলে ভুল বুঝাবুঝি হতো না।
ঘটনা ৩।
আমি বেশ কিছুদিন বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কাপড় বিক্রি করতাম। অনলাইনে বিক্রির সময় আমি ব্র্যান্ডের কামিজগুলোর ছবি দিয়ে দিতাম। কাপড়ের সাথে মাঝে মাঝে মডেলের ছবিসহ পুরো প্যাকেটের ছবি দিয়ে দিতাম। আমার এক শুভাকাঙ্ক্ষী আমাকে ম্যাসেজ দিয়ে জানালেন মডেলের বেপর্দা ছবিগুলো না দিতে। আমি উনার কথা শুনে বেপর্দা ছবি আর কখনো দিইনি।
ঘটনা ৪।
আমার এক আত্মীয় অনলাইনে এক নামকরা বার্গার বিক্রির দোকানের বিজ্ঞপ্তি দেখে বাসায় বার্গার অর্ডার দিয়েছে। বাসায় বার্গার আসার পর দেখা গেল, বিজ্ঞপ্তি হিসাবে ছবিতে যে বার্গার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেই বার্গারের সাথে বাসায় পাঠানোর বার্গারের কোনো মিল নেই। পরবর্তীতে সেই নামকরা দোকানে এই ব্যাপারে অভিযোগ করা হয়। তারা এই ব্যাপারটা মানতে নারাজ। এবং এরই প্রেক্ষিতে যখন ভোক্তা অধিকার দফতরে অভিযোগ করার কথা বলা হয়, তখন সেই বার্গার বিক্রির দোকান থেকে আরেকটি বার্গার পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এরকম আরো ঘটনা আছে। আমাদের সমাজের চারপাশের অবস্থা বোঝানোর জন্য কয়েকটা উদাহরণ দিলাম।
আল্লাহ্ ব্যবসাকে করেছেন হালাল, আর সুদকে করেছেন হারাম। শুধু সুদ খাওয়া, মদ খাওয়া, শূকর খাওয়া হারাম না। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হালাল-হারাম মেনে চলতে হবে। হালাল কাজ করতে গিয়ে মানুষ হারাম পন্থা অবলম্বন করে ফেলে, ফলে হালালটা তখন আর হালাল থাকে না, হারাম হয়ে যায়।
দৈনন্দিন জীবনে নিত্যপ্রয়োজনীয় হালাল জিনিস বিক্রি করা বৈধ। কিন্তু বিক্রির পন্থাটা কি হালাল? পন্থা যদি হালাল না হয়, তাহলে সেই পন্থায় অর্জিত সম্পদ কি হালাল হবে?
একটা গায়ে দেওয়ার সাবান বিক্রি হবে। পণ্যের উপাদান থেকে উৎপাদন সব কিছুই হালাল। কিন্তু সেই পণ্য বিক্রি করার সময় অর্ধউলঙ্গ এক নারীর গায়ে সেই সাবানের ফেনা দিয়ে গোসল করানো হচ্ছে, এমন
বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। বিক্রি করার পন্থাটা একদমই হালাল না।
ওজন দিয়ে কিছু হালাল বস্তু বিক্রি করা হচ্ছে। অথচ সেই ওজনে হেরফের করা হচ্ছে। বড় বড় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ফুটপাতের ব্যবসায়ীরাও ওজন মাপার যন্ত্রে কারচুপি করে। শুয়াইব আলাইহিসসালামের সময় মাদইয়ানবাসীকে আল্লাহ্ ওজনে কম দেওয়ার জন্য, মজুতদারি করার জন্য, লুটপাট করার জন্য ধ্বংস করে দিয়েছিলেন।
বিক্রির সময় বলা হচ্ছে বিদেশি জিনিস, অথচ দেওয়া হচ্ছে দেশি জিনিস। বলা হচ্ছে পাকিস্তানি কাপড়, দেওয়া হচ্ছে ভারতীয় কাপড়। বিক্রির সময় বলা হচ্ছে আমার কোনো লাভ হবে না, অথচ ঠিকই লাভ করছে। মিথ্যা কথার জন্য হালাল উপার্জন তখন ভেজালে পরিণত হয়। জিনিসের দোষত্রুটি লুকিয়ে বিক্রির জন্য আয় হারাম হয়।
ইদানীং ইউটিউব বা ফেইসবুকে কোনো একটা ইসলামিক লেকচার বা কুরআন তেলাওয়াত শুনতে যাবেন, দেখবেন ভিডিওর মাঝখানে বিজ্ঞপ্তি চলে আসে। কিছু কিছু বিজ্ঞপ্তি খুবই আপত্তিজনক। মাঝে মাঝে এমন অবস্থা হয় যে, সেই বিজ্ঞাপন শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনার ভিডিওর বাকি অংশ শুরু হবে না। স্কিপ করার বা বাদ দেওয়ার কোনো অপশন থাকে না। অর্থাৎ আপনাকে দেখতে বাধ্য করা হচ্ছে। কয়জন মানুষ নিজেকে তখন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে?
অথবা দেখা যাচ্ছে যে, আপনার ইউটিউব চ্যানেলের বিজ্ঞাপন থেকে আপনি ইনকাম করছেন। আপনি সবসময় আপনার চ্যানেলে ইসলামিক
বা শিক্ষণীয় কোনো ভিডিও আপলোড করে থাকেন। যেহেতু আপনি বিজ্ঞাপন থেকে ইনকাম করেন, আপনার চ্যানেলে আপত্তিকর বিজ্ঞাপন চলে আসলো। তার মানে সেই আপত্তিকর বিজ্ঞাপন থেকেও কিন্তু আপনি ইনকাম করে ফেলছেন। ইনকাম তখন হয়ে যাচ্ছে হারাম।
আর এখন অনলাইনে কেনাবেচার যুগে আমরা কতটুকু ইসলামি শরিয়া মেনে চলার চেষ্টা করি? আপনি হিজাব বিক্রি করছেন, এটা অবশ্যই হালাল। কিন্তু সেই হিজাব লাখ লাখ মানুষের সামনে পরিধান করে দেখাচ্ছেন। সেটা কি হালাল? আপনি অনলাইনে ভিডিও আর ছবি দেখে অর্ডার দিলেন হিমসাগর আম, পেলেন ল্যাংড়া আম। সেটা কি বিক্রেতার জন্য হালাল হবে? ভিডিও দেখে গাছে আমের ফুল আসার আগেই আম গাছ কিনে নিলেন। সেই গাছের আম বিক্রি করে কি আপনার হালাল টাকা উপার্জন হবে? হবে না। বিক্রি করার সময় বলছেন, নিজস্ব কারখানার মাল, অথচ নিয়ে এসেছেন চকবাজার পাইকারি দোকান থেকে। এমন অনেক অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়।
এখনকার পৃথিবীতে নিজের ঈমান নিয়ে চলা খুব কঠিন। হালাল-হারামের ক্লিয়ার কনসেপ্ট যদি না থাকে, তাহলে চোখের পলকে আপনি হালাল থেকে হারামে ঢুকে যেতে পারেন। আর শয়তান তো মানুষের সামনে নেক সুরতে খারাপ জিনিসটা উপস্থাপন করে থাকে।
একটা কথা সব সময় মনে রাখা দরকার, সেটা হচ্ছে, হালাল পন্থা মেনে চলা যেমন ইবাদত, হারাম থেকে বেঁচে থাকাটাও ইবাদত। আমরা ছোটোখাটো ব্যাপারগুলোকে খুব তুচ্ছ করে দেখি। আমাদের মনে রাখা দরকার, আমরা যেটাকে তুচ্ছ ভাবছি, সেটা আল্লাহ্র কাছে মূল্যবান হতে
পারে।
আমরা এখন এমন ফিতনার মাঝে বসবাস করি, বুঝতেই পারি না যে কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক। মনে হয়, ভালো কাজটাই তো করছি। কিন্তু ভালোর মাঝেই যে খারাপটা মিশে যাচ্ছে বুঝতে পারছি না। তাই চোখকান খোলা রেখে, প্রতিটা কাজ করার আগে আমাদের ভাবা উচিত, যেই কাজটা করছি, সেটাতে কি আল্লাহ্ সন্তুষ্ট হবেন? যদি না হন, তাহলে সেই পথ যত লোভনীয় থাকুক, সেখান থেকে ফিরে আসি। ব্যবসায় বরকত চান? তাহলে বিক্রির সময় সত্য বলে বিক্রি করুন। বরকত আসবে। না হলে বরকত মুছে ফেলা হবে। বুখারীর ২০৭৯ নাম্বার হাদিসে এই ব্যাপারে উল্লেখ করা আছে।
ইদানীং আমার রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর দুটো কথা খুব মনে হয়। তিনি একবার বলেছিলেন যে, এমন এক যুগ আসবে, যখন মানুষ পরোয়া করবে না যে, সে কোথা হতে সম্পদ উপার্জন করল, হালাল হতে না হারাম হতে।
[সহীহ বুখারী ২০৫৯]
আরেকবার বলেছিলেন, অন্ধকার রাতের মত ফিতনা আসার আগেই তোমরা নেক আমলের প্রতি অগ্রসর হও। সে সময় সকালে একজন মুমিন হলে বিকালে কাফির হয়ে যাবে। বিকালে মুমিন হলে সকালে কাফির হয়ে যাবে। দুনিয়ার সামগ্রীর বিনিময়ে সে তার দ্বীন বিক্রি করে বসবে। [সহীহ মুসলিম ২১৪]
আল্লাহ্ আমাদেরকে সকল ফিতনা থেকে বাঁচিয়ে, আমাদেরকে দিয়ে নেক আমল করিয়ে নিয়ে, ঈমানের সাথে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার তৌফিক দিন এবং দুনিয়া, কবর ও আখিরাতে চূড়ান্ত সফলতা দান করুন। আমিন।
___________________
| হালাল ভেবে হারাম কাজ |
তাহ্নিয়া ইসলাম খান
#রৌদ্রময়ী