15/12/2023
নানা প্রতিবন্ধকতায় ভোটে আগ্রহ হারাচ্ছে নারীরা-:
নারীবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতের তাগিদ
আমেজে আস্থা ফেরাতে হবে ভোটকেন্দ্রে
মাকসুদ রহমান :
বাড়ি থেকে পা বাড়ালেই ভোটকেন্দ্র। তারপরও খুলনা নগরীর অভিজাত নিরালা আবাসিক এলাকার দুইটি কেন্দ্রের প্রায় ৮২ শতাংশ নারী পরপর তিনটি নির্বাচনে ভোট দেননি। উচ্চ শিক্ষিত পরিবারের এসব ভোটারদের পারিবারিকভাবেই ভোট প্রদানে নিরুৎসাহিত করা হয়।
২০০৮ ও ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন ও চলতি বছরের ১২ জুন সিটি নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণে এমন ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে।
নির্বাচন কমিশনের গেজেট অনুযায়ী, সিটি নির্বাচনে ২০৭ নম্বর ভোটকেন্দ্র নিরালা আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয় (৩য় ও ৪র্থ তলা) ও ২০৮ নম্বর ভোটকেন্দ্র নিরালা আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে (২য় ও ৩য় তলা) মোট নারী ভোটার ছিল ৫৪৯৬ জন। এর মধ্যে ৪৫২০ জন ভোট ভোট প্রদানে বিরত থেকেছেন।
২০৭ নম্বর ভোটকেন্দ্রে ৮০.৬০ ও ২০৮ নম্বর ভোটকেন্দ্রে মাত্র ৮৩.৮৮ শতাংশ নারীরা ভোট দেননি।
একইভাবে ২০৬ নম্বর ভোটকেন্দ্র সোনাপোতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৭৯.৬৫ শতাংশ, ২০৪ নম্বর ভোটকেন্দ্র বাংলাদেশ ব্যাংক স্টাফ কোয়ার্টার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৭৭.৬১ শতাংশ, ২৪০ নম্বর ভোটকেন্দ্র পিটিআই একাডেমিক ভবন (নিচতলা) ৭৬.৩১ শতাংশ, ২৩৮ নম্বর ভোটকেন্দ্র ডি আলী ইসলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৭৬.১৩ শতাংশ নারীরা ভোটকেন্দ্রে যাননি।
জানা যায়, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ২৮৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ১০০টি ছিল নারী ভোটকেন্দ্র। এর মধ্যে গড়ে ৪০ শতাংশের নিচে ভোট পড়া ৩৪টি কেন্দ্রে নারী ভোটার ছিল ৬০ হাজার ৮০২ জন। যার প্রায় ৭৪.৩১ শতাংশ নারী ভোট দেননি।
নির্বাচন বিশ্লেষকদের মতে, বহুদলীয় অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়া, ভোটে সহিংসতার শঙ্কা, জাল ভোট, মতামতের প্রতিফলন না হওয়া, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও সচেতনতা-দায়িত্ববোধের অভাবে ভোট দিতে আগ্রহী হয় না নারীরা।
নির্বাচন বিশ্লেষক ও বাংলাদেশের কমিউনিটি পার্টির (সিপিবি) খুলনা জেলা সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য সুতপা বেদজ্ঞ বলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিন বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে দেখেছি। অধিকাংশ কেন্দ্রই ছিল ভোটার শূন্য। তার মধ্যে পুরুষের তুলনায় নারীরা এসেছেন আরও কম। ভোটকেন্দ্রে এসে ভোট প্রদানে নারীদের মধ্যে আগ্রহ দেখা যায়নি।
নিরালা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা স্কুলশিক্ষিকা সামছুন্নাহার শিরিন জানান, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে সহিংসতা ও ২০১৮ সালে ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেয়ায় অনেকে ১২ জুনের সিটি নির্বাচনেও ভোট দেয়ার আগ্রহ হারিয়েছেন। সব দলের অংশগ্রহণ না থাকায় ভোটের গুরুত্বও কমেছে।
নারী আন্দোলনের নেত্রী ও উইমেন চেম্বার অব কমার্স, খুলনা বিভাগের প্রেসিডেন্ট শামীমা সুলতানা শিলু বলেন, ‘আগের মতো ভোটে উৎসব নেই, আছে উৎকণ্ঠা। একটা সময় ভোটকে ঘিরে আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা হতো। বিবাহিত মেয়েরা বাপের বাড়ি বেড়াতে আসতো। এখন ভোটে সেই উৎসবমুখর পরিবেশ না থাকায় দায় এড়াতে চায় সকলেই।’
নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে রাজনৈতিক দলেরই উদাসীনতাকে দায়ি করছেন বিশ্লেষকরা। ২০০৮-২০২৩ সাল পর্যন্ত জাতীয় সংসদে জনগণের ভোটে নির্বাচিত খুলনার নারী প্রতিনিধি ছিলেন আওয়ামী লীগের শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ায় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব হারালো খুলনা। এর আগে ১৯৮৬ সালে জাতীয় নির্বাচনে খুলনা-৩ আসনে জাতীয় পার্টির হাসিনা বানু শিরিন নির্বাচিত হয়ে সংসদে হুইপের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালে তার মৃত্যুর পর জাতীয় পর্যায়ে অবদান রাখার মতো নারী নেত্রী খুলনার রাজনীতিতে আসেনি।
এছাড়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) আইন ৯০ এর খ (২) ধারা অনুযায়ী রাজনৈতিক দলের সকল স্তরের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও খুলনায় সেই অনুপাতে নারী প্রতিনিধিত্ব নেই।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)’র জেলা সাধারণ সম্পাদক অ্যাডঃ কুদরত-ই খুদা বলেন, নারীরা এখনও পুরুষ শাষিত সমাজে বাস করেন। ফলে পরিবারের পুরুষ সদস্যদের বাইরে গিয়ে নারীরা ভোট প্রদানের সিদ্ধান্তও কম নেয়। নারীদের রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণও নিশ্চিত করা যায়নি। যদিও বড় রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির কথা বলেন কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। দলে নারী প্রতিনিধিত্ব থাকলে তার পেছনে আরও নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়, সেই জায়গাটাও আমাদের সীমিত।
অপরদিকে নারীদের ভোটে উদ্বুদ্ধ করতে ভোটকেন্দ্রে পরিবেশ ‘নারীবান্ধব’ করার তাগিদ দেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. তুহিন রায়। তিনি বলেন, নারীর রাজনীতিতে আসার পেছনে বড় বাধা পেশী শক্তি ও নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকা। আস্তাহীনতার মনস্তাত্ত্বিক একটা বিষয়ও থাকে। এই সঙ্কট দূর করতে রাজনৈতিক দলগুলোকেই ভূমিকা নিতে হবে। প্রান্তিক নারীরা যাতে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন সেই পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।