11/12/2024
♟️ঢাকার সত্য ঘটনা
তারিখ: ১২.০৭.২০১৯
ঢাকার মিরপুরে আমাদের তিনতলা বাসা। আমি, ছোটবোন নিশি, আর মা একসঙ্গে থাকি। বাবা চাকরির কারণে বাইরে থাকেন। নিশি স্কুল থেকে ফেরার পরদিন সারাদিন টিভি দেখে আর আমি নিজের পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকি। মা আমাদের সবকিছু সামলে নেন। তবে ইদানীং মাকে খুব অদ্ভুত আর চুপচাপ লাগছে।
রাতে মা মাঝে মাঝে বলেন, "তানিয়া, ঘরে একটা অদ্ভুত আওয়াজ হয়। রান্নাঘরের বাসনপত্র নড়েচড়ে ওঠে। মনে হয় কেউ হাঁটছে। তোর কি মনে হয় না কিছু অস্বাভাবিক?"
আমি সবসময় যুক্তি দিয়ে মাকে বোঝাই, "মা, তুমি বেশি ভাবো। এটা তো ইঁদুরও করতে পারে। আর এসব আওয়াজ আমাদের কল্পনা। এই যুগে এসে এভাবে ভাবা উচিত না।"
মা আর কিছু বলেন না। শুধু মাথা নিচু করে চলে যান।
তারিখ: ১০.১২.২০১৯
আজ বাসায় আমি আর নিশি। মা কয়েক ঘণ্টার জন্য মিরপুরের অন্যপ্রান্তে খালার বাসায় গেছেন। নিশি কিছুক্ষণ আগে কিচেনে গেছে আম্মুর রেখে যাওয়া কাস্টার্ড আনতে। আমি আমার রুমে মোবাইলে গান শুনছিলাম।
হঠাৎ নিশি দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাঁপাতে শুরু করল। ওর কপাল ঘামে ভেজা, চোখে আতঙ্ক। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "কী হলো? এভাবে দৌড়ে এলি কেন?"
ও ফিসফিস করে বলল, "আপু, আমি কিচেনে গিয়ে দেখলাম আম্মু কাস্টার্ড কাটছেন!"
আমার ভ্রু কুঁচকে গেল। "তুই কী বলছিস? আম্মু তো খালার বাসায়। ও তো ঘণ্টাখানেক আগেই বেরিয়েছে। দরজা নিজে বন্ধ করেছি আমি।"
নিশি গলার স্বর কাঁপিয়ে বলল, "আমি ঠিক দেখেছি। আম্মু শাড়ি পরে কিচেনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাকে দেখে কিছু বললেন না, শুধু একভাবে তাকিয়ে থাকলেন।"
আমার পিঠে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। কিন্তু নিজের ভয় লুকিয়ে বললাম, "তুই হয়তো ভুল দেখেছিস। আম্মু আসার প্রশ্নই ওঠে না।"
ঠিক তখনই রান্নাঘর থেকে একরকম ঝনঝন শব্দ ভেসে এল। মনে হলো, কিছু একটা পড়ে গেল। নিশি ভয়ে কেঁদে উঠল। আমি সাহস সঞ্চয় করে বললাম, "চল, দেখি রান্নাঘরে কী হচ্ছে। যদি তুই মিথ্যে বলিস, তবে তোকে কিন্তু মার খাবি।"
আমরা দুজনে আস্তে পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগোলাম। রান্নাঘরের বাতি জ্বলছে। আমি সোজা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরে তাকালাম। যা দেখলাম, তাতে আমার শ্বাস আটকে গেল। রান্নাঘরে মা দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি গ্যাসের চুলায় চায়ের পানি গরম করছেন।
মা আমাদের দিকে ফিরে মিষ্টি হেসে বললেন, "তানিয়া, চা খাবি?"
আমার পা যেন জমে গেল। নিশি আমার হাত শক্ত করে ধরে আছে। আমি কোনো মতে বললাম, "না মা, লাগবে না।" তারপর নিশিকে নিয়ে সোজা রুমে চলে এলাম। দরজা বন্ধ করে দিলাম। নিশি এত ভয়ে কাঁপছিল যে কিছু বলার অবস্থায় ছিল না। আমি ফোন তুলে মাকে কল দিলাম।
তিনবার রিং হওয়ার পর মা ফোন ধরলেন।
"তুমি কোথায় মা?" আমি জিজ্ঞেস করতেই কেঁপে কেঁপে উঠলাম।
মা ধীর গলায় বললেন, "আমি তো খালার বাসায় যাচ্ছি, রাস্তায় আছি। কেন?"
আমার হাত থেকে ফোনটা প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। "কিন্তু আমরা তো এইমাত্র রান্নাঘরে দেখলাম তুমি চা বানাচ্ছ।"
ফোনের ওপাশে কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর মা বললেন, "তানিয়া, দরজা বন্ধ করে দোয়া পড়। খবরদার বাইরে যাস না। আমি এখনই আসছি।"
আমি নিশিকে বললাম, "আয়াতুল কুরসি পড়তে থাক। ভয় পাস না। মা আসছেন।"
আমরা দুজন কোরআনের আয়াত পড়তে লাগলাম। কিন্তু ভয় কিছুতেই কাটছিল না। নিশি কেঁদেই চলেছে।
ঠিক তখন দরজায় টোকা পড়ল।
"তানিয়া, দরজা খোল তো। আমি মা।"
মায়ের গলা!
কিন্তু মা তো খালার বাসায়! তাহলে এই দরজার বাইরে কে?
আমি নিশিকে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে লাগলাম। নিশি ফিসফিস করে বলল, "আপু, এটা মা না।"
আমিও ভেতরে ভেতরে জানি, নিশি যা বলছে তা-ই সত্যি। আমার হাত-পা অবশ হয়ে আসছিল। আমি আবার মাকে ফোন দিলাম। কিন্তু ফোন কেটে গেল। বারবার চেষ্টা করেও একই অদ্ভুত বার্তা শুনতে পেলাম:
"আপনার কাঙ্ক্ষিত নম্বরে এই মুহূর্তে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না।"
দরজার বাইরে থেকে মায়ের গলা আরও জোরালো হতে লাগল। "তানিয়া, দরজা খোল। আমি তোকে ভয় পাওয়াচ্ছি না। দরজা খোল।"
আমি নিশিকে ইশারায় বোঝালাম চুপ থাকতে। কিন্তু নিশি এত ভয়ে ভেঙে পড়েছিল যে ওর কাঁপুনি থামছিল না। দরজায় আঘাত বাড়তে থাকল।
আমরা প্রায় ঘণ্টাখানেক বন্ধ দরজার পেছনে আতঙ্কে কাটালাম।
একসময় পুরো বাসাটা একদম নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কোনো শব্দ নেই।
আমি জানলার ফাঁক দিয়ে নিচে তাকালাম। তখন রাত সাড়ে দশটা। হঠাৎ দেখি মা গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকছেন। ওনার হাতে ব্যাগ।
আমি চিৎকার করে বললাম, "মা!"
মা দ্রুত দৌড়ে উপরে এলেন। দরজা খুলে মাকে জড়িয়ে ধরলাম।
মা হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "কী হয়েছে তোদের? তোরা এত ভয়ে কাঁপছিস কেন?"
আমি সব খুলে বললাম। মা মুখে কোনো কথা না বলে রান্নাঘরের দিকে গেলেন। আমরা তিনজন রান্নাঘরে ঢুকলাম। সেখানে আর কেউ নেই। শুধু গ্যাসের চুলায় অল্প আগুন জ্বলছিল, যেন কেউ চা বানিয়ে রেখে গেছে।
আম্মু দ্রুত পানি নিয়ে দরজার চারপাশে ছিটিয়ে দিলেন। তারপর নিচু গলায় বললেন, "তানিয়া, নিশি, তোদের ভয় পাওয়ার কারণ নেই। যা আছে, সেটা চুপচাপ চলে যাবে।"
কিন্তু মায়ের চোখের গভীরে আমি যে আতঙ্ক দেখেছিলাম, তা কোনোভাবেই চুপচাপ চলে যাওয়ার মতো কিছু মনে হচ্ছিল না।
তারিখ: ১৫.১২.২০১৯
এরপর থেকে রাতে রান্নাঘরে আর যাই না। নিশিও না। মা খুব অল্প কথা বলেন। আর আমরা তিনজনই বুঝতে পারি, আমাদের বাসায় "কিছু" আছে। কিন্তু সেই কিছুটা আসলে কী—তা কেউই জানি না।
শুধু জানি, অন্ধকার নামলেই রান্নাঘর থেকে আসা সেই "চায়ের গন্ধ" আমাদের বুকের ভেতর জমে থাকা ভয়কে আরও গভীর করে তোলে।
তারিখ: ২২.১২.২০১৯
এই ক'দিনে আমাদের বাসায় অদ্ভুত ঘটনার মাত্রা আরও বেড়ে গেছে। নিশি এখন প্রায়ই রাতে ঘুম থেকে চিৎকার করে ওঠে। কখনো বলে, কেউ নাকি তার রুমে দাঁড়িয়ে ছিল। কখনো বলে, অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়া তার দিকে হাত বাড়িয়েছিল। মা নিশিকে সান্ত্বনা দিতে চাইলেও আম্মুর চোখেও স্পষ্ট ভয়। আমি নিশিকে বোঝাই যে ও হয়তো স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু নিশির দৃঢ়তা আর তার ভয়ে কাঁপতে থাকা শরীর আমাকে ভুল প্রমাণ করে।
আমার নিজের ঘরেও রাতগুলো আর স্বাভাবিক নেই। কয়েকদিন ধরে মনে হচ্ছে, কেউ যেন আমার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গভীরভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একরাতে আমি স্পষ্ট শুনলাম, দরজার ওপাশ থেকে কেউ ফিসফিস করে আমার নাম ধরে ডাকছে, "তানিয়া... দরজা খোল।"
ভয়ে পুরো শরীর অবশ হয়ে গিয়েছিল। নিশিকে ডাকার সাহসও হয়নি। সারা রাত ঘুমাতে পারিনি।
মাঝে মাঝে রান্নাঘরের বাতি জ্বলতে দেখি। আবার কখনো বাতি নিভে যায়। মা প্রতিদিন কিছু না কিছু দোয়া পড়ে পানিতে ফুঁ দিয়ে পুরো বাসায় ছিটান। কিন্তু কোনো কিছুতেই পরিস্থিতি বদলাচ্ছে না।
তারিখ: ৩১.১২.২০১৯
নতুন বছরের সন্ধ্যা। চারদিকে আনন্দ-উল্লাস। কিন্তু আমাদের বাসায় এক ভৌতিক নীরবতা। মা রাতে আমাদের ডেকে বললেন, "তানিয়া, নিশি, তোদের বলার অনেক কিছু ছিল। কিন্তু তোরা ভয় পেয়ে যাস বলে বলিনি। আমাদের বাসাটা আসলে অনেক পুরোনো। আর পুরোনো বাড়িতে অনেক সময় পুরোনো স্মৃতিও থেকে যায়।"
আম্মুর গলা কাঁপছিল। আমরা অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মা বললেন, "আমাদের বাসাটা যেখানে তৈরি হয়েছে, সেখানে আগে একটা বাড়ি ছিল। সেই বাড়ির কর্তা ছিলেন খুব খিটখিটে স্বভাবের একজন মানুষ। তাঁর স্ত্রী খুব অল্প বয়সে মারা গিয়েছিলেন। লোকটা নাকি রান্নাঘরেই একটা অদ্ভুত মৃত্যুর শিকার হয়েছিলেন। কেউ বলে হার্ট অ্যাটাক, কেউ বলে আত্মহত্যা। তার পর থেকে এই জায়গায় কেউ শান্তিতে থাকেনি।"
মায়ের কথায় আমাদের শরীর হিম হয়ে গেল। নিশি বলল, "তাহলে কী করব আমরা?"
মা বললেন, "আমরা কালই অন্য বাসা খুঁজব। এই জায়গায় আর থাকা ঠিক হবে না।"
আমরা তিনজন সারারাত একসঙ্গে কাটালাম। ঘরে প্রতিটি শব্দে মনে হচ্ছিল, কেউ যেন আমাদের ওপর নজর রাখছে। রান্নাঘর থেকে মাঝরাতে কাঁচের বাসন পড়ার শব্দ পেলাম। নিশি আমার বুকে মাথা গুঁজে কাঁদছিল। আমিও ভয় পেয়ে ছিলাম।
তারিখ: ০৫.০১.২০২০
আমরা আজ বাসা বদলে ফেললাম। মিরপুর ছেড়ে মোহাম্মদপুরে চলে এসেছি। ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট। পুরোনো বাসার তুলনায় ছোট, কিন্তু এখানে আসার পর একটা স্বস্তি পাচ্ছি। নিশিও বলল, "এখানে আর সেই ভয়ানক অনুভূতি নেই।"
মা আমাদের নতুন বাসায় নামাজ পড়ে দোয়া করলেন। আমরা শান্তিতে থাকার আশা করছিলাম।
কিন্তু সেই শান্তি খুব বেশিদিন টিকল না।
তারিখ: ১৫.০১.২০২০
আজ রাতে আমি আর নিশি মায়ের সঙ্গে ডাইনিং টেবিলে রাতের খাবার খাচ্ছিলাম। হঠাৎ রান্নাঘর থেকে একটা ধাতব টুংটাং শব্দ ভেসে এল। আমরা তিনজন থমকে গেলাম। মা দ্রুত রান্নাঘরে গেলেন। আমরা পেছন পেছন গেলাম।
কোনো কিছু পড়ে ছিল না। কিন্তু গ্যাসের চুলার সামনে একটা চায়ের কেটলি রাখা। আর তার চারপাশে পানির ফোঁটা ছড়িয়ে আছে।
মা ফিসফিস করে বললেন, "তানিয়া, নিশি, বের হও এখান থেকে।"
আমরা ভয় পেয়ে রুমে ফিরে এলাম। মা কিছুক্ষণ পর এসে বললেন, "তোদের বলেছিলাম, এসব থেকে পালানো যায় না। এরা জায়গার সঙ্গে নয়, আমাদের সঙ্গে থাকে।"
মায়ের কথায় কাঁপতে শুরু করলাম। নিশি বলল, "আমরা কী করব এখন?"
মা বললেন, "একটাই উপায় আছে। দোয়া পড়ে যেতে হবে। আর কখনোই ভয় পাবে না। ভয় দেখানোই এদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র।"
তারিখ: ২০.০১.২০২০
আমাদের বাসায় প্রতিদিন কিছু না কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে। রান্নাঘরে কিছু রেখে গেলে তা অন্য জায়গায় পাওয়া যায়। নিশি প্রায়ই ঘুম থেকে উঠে দেখছে, দরজা কেউ খুলে রেখেছে। আম্মুর ওপর একটা চাপা বিষণ্ণতা নেমে এসেছে। যেন তিনি আমাদের আড়ালে কিছু লুকাচ্ছেন।
তবে আজ রাতে একটা ঘটনা ঘটল যা আমাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।
আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। নিশি পাশে। হঠাৎ অনুভব করলাম, ঘরের বাতি জ্বলে উঠল। চোখ খুলে দেখি, দরজার সামনে একটা ছায়া। একজন লম্বা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। আমি গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। নিশিকে জাগাতে গিয়ে দেখলাম, নিশি শক্ত করে ঘুমাচ্ছে।
ছায়াটি আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমি তখন আয়াতুল কুরসি পড়া শুরু করলাম। ধীরে ধীরে ছায়াটি মিলিয়ে গেল।
পরদিন সকালে মা বললেন, "তানিয়া, তোকে একটা কথা বলি। ভয়কে শক্তি দিস না। যতবার ভয় পাবে, ততবার ওরা শক্তি পাবে। সাহস রাখ।"
তারিখ: ১৫.০২.২০২০
এখনো আমরা এই বাসাতেই আছি। ভয়ের অনুভূতিগুলো কেটে গেছে। মা প্রতিদিন দোয়া পড়ে বাসায় ছিটান। নিশিও এখন ভয় পায় না।
আমার বিশ্বাস, সব অশরীরী শক্তি হয়তো আমাদের দুর্বলতাগুলো খোঁজে। সাহস আর দৃঢ়তাই তাদের দূরে রাখতে পারে।
তবে মাঝেমাঝে রাতে রান্নাঘর থেকে চায়ের গন্ধ ভেসে আসলে আমি আর নিশি শুধু মায়ের দিকে তাকাই। তিনজন একসঙ্গে দোয়া পড়ি। হয়তো এটাই আমাদের একমাত্র রক্ষা।
⛔ অদ্ভুত রান্না ঘরের রহস্য
🖊️ white shadow