03/07/2020
#গৌতম_বুদ্ধের_অতীত_জন্ম
১ম পর্ব
#সুমেধ_তাপস
, ®আজ হতে লক্ষাধিক চার অসংখ্য কল্পেরও আগের কথা। তখন অমরাবতী নামে এক দর্শনীয় মনোরম নগরী ছিল। সেই সৌভাগ্যবতী নগরী সর্বদা হাতির বৃংহতি ধ্বনিতে, ঘোড়ার হ্রেষা রবে, গাড়ির ঘর্ঘর শব্দে, ভেরীর লহরি ছন্দে, মৃদঙ্গের সুমধুর তালে এবং বীণা ও গানের মধুর সুরে ঝংকৃত হতো। এ ছাড়াও পরমাদরে বন্ধুসম্ভাষণে, বায়ু সঞ্চালিত তালপাতার মর্মর ধ্বনিতে এবং ‘স্নান করো’ ‘পান করো’ ও ‘ভোজন করো’—এই দশটি সুমিষ্ট শব্দের দ্বারা সব সময় মুখরিত থাকত। সেটি ছিল সব দিক দিয়ে সুশোভিত সপ্ত রত্নসম্পন্ন এবং জনাকীর্ণ এক সমৃদ্ধ নগরী, যেন মনে হতো কোনো দেবনগরী। সেখানে সুমেধ নামে এক ব্রাহ্মণ বাস করতেন যিনি ছিলেন বহু কোটি ধনে ধনী, অঢেল ধনধান্যসম্পন্ন, অধ্যাপক, মন্ত্রধারী, ঋক-সাম-যজুঃ—এই ত্রিবেদে পারদর্শী এবং লক্ষণশাস্ত্র, ইতিহাস ও স্বকীয় ধর্মে অতুলনীয় পণ্ডিত। মাতাপিতা উভয় কুলের সাত পূর্বপুরুষ পর্যন্ত জাতিতে তিনি সুপরিশুদ্ধ ছিলেন। বংশমর্যাদায় তিনি ছিলেন অনিন্দনীয় এবং অসাধারণ ছিল তাঁর রূপলাবণ্য। তিনি অন্য কোনো প্রকার শিল্পবিদ্যা শিক্ষা না করে ব্রাহ্মণবিদ্যাই শিক্ষা করেছিলেন। কিন্তু তিনি শৈশবেই মাতৃপিতৃহীন হয়ে পড়লেন। এরপর একদিন তাঁদের ধনরক্ষক মন্ত্রী-লিখিত লোহার পাত এনে মণিমুক্তা ও সোনারুপায় পরিপূর্ণ সিন্দুকের দরজা খুলে বালক সুমেধকে বললেন, ‘কুমার, এই ধনসম্পত্তি তোমার মাতৃকুল হতে প্রাপ্ত, এগুলো পিতৃকুলের, আর এগুলো হচ্ছে তোমার বাপ-দাদা থেকে শুরু করে সাত পুরুষের সঞ্চিত ধনসম্পদ; তুমি এই ধন সযত্নে রক্ষা করো এবং ইচ্ছানুরূপ পরিভোগ করো।’
তা শুনে ব্রাহ্মণপুত্র সুমেধ ভাবলেন, ‘আমার পূর্বপুরুষগণ পরলোকে যাবার সময় এই সঞ্চিত ধনসম্পত্তির এক টাকাও সঙ্গে নিতে পারেননি। আমি যেন এগুলো সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি, আমাকে তার উপায় বের করতে হবে।’—অপদান অর্থকথা
এরপর তিনি একসময় নির্জনে বসে বসে চিন্তা করলেন, ‘পুনরুৎপত্তি ও মরণ দুঃখজনক।’ যেহেতু তিনি জন্ম-জরা ও ব্যাধি ধর্মের (স্বভাবের) অধীন, তাই তিনি সংকল্প করলেন, ‘আমি জরা-মরণবিহীন নিরাপদ স্থান নির্বাণের অন্বেষণ করব।’ মলমূত্র ও অন্যান্য বহু অশুচিতে পরিপূর্ণ এই দুর্গন্ধময় শরীরের প্রতি অনাকাঙ্ক্ষী হয়ে, নিরালয় হয়ে তা ত্যাগ করে নির্বাণে চলে যাই না কেন? যে পথ ধরে নির্বাণ লাভ হবে, সেটা নিশ্চয়ই আছে এবং থাকবে। এমন একটা পথ না থেকে পারে না। আমি সংসার হতে মুক্তির জন্য সে পথের অনুসন্ধান করব। যেমন শারীরিক-মানসিক দুঃখ বর্তমান আছে বলে সুখও বর্তমান আছে, সেরূপ ভব বিদ্যমানে ভবমুক্তিও বিদ্যমান আছে বলে আশা করা উচিত। উষ্ণতা বিদ্যমান থাকলে যেমন তার বিপরীতে শীতলতাও বিদ্যমান থাকে, তেমনই রাগ-দ্বেষ-মোহ—এই ত্রিবিধ অগ্নির বিদ্যমানে এদের নির্বাণও আকাঙ্ক্ষা করা উচিত। পাপ বিদ্যমান থাকলে যেমন পুণ্যও বিদ্যমান থাকে, তদ্রূপ জন্মগ্রহণ থাকলে জন্মের হেতু বিনাশেরও কামনা করা উচিত।
মলমূত্রে লিপ্ত পুরুষ জলপূর্ণ পুকুর বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও যদি পুকুরের খোঁজ না করে, তাতে যেমন পুকুরের দোষ হয় না, তেমনই ক্লেশমল ধোয়ার উপযোগী অমৃত পুকুর বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তার সন্ধান না করলে সেটা অমৃত পুকুরের দোষ হতে পারে না।
চারদিকে শত্রুপরিবেষ্টিত অবস্থায় পালানোর পথ থাকলেও কোনো ব্যক্তি যদি পালিয়ে না যায় তা যেমন পথের দোষ নয়, তেমনই ক্লেশ দ্বারা অবরুদ্ধ ব্যক্তি যদি নির্বাণের পথ বিদ্যমান থাকতেও তার অনুসন্ধান না করে, সেটাও নির্বাণপথের দোষ নয়।
কোনো ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তি যদি চিকিৎসক বিদ্যমান থাকতেও তার ব্যাধির চিকিৎসা না করায়, তা যেমন চিকিৎসকের দোষ নয়, তেমনই ক্লেশব্যাধির দ্বারা দুঃখিত পীড়িত ব্যক্তি যদি নির্বাণপথের নির্দেশকারী আচার্যের অন্বেষণ না করে, তা হলে সেটাও নির্বাণপথের নির্দেশক আচার্যের দোষ নয়।
কোনো সুখী ও স্বাধীন পুরুষের গলায় সাপ-কুকুর ইত্যাদির মৃতদেহ বেঁধে দিলে, সে যেমন তা ঘৃণার সঙ্গে ত্যাগ করে চলে যায়, তেমনই আমিও বহু পচাগলা জিনিসের আধার এই দুর্গন্ধময় শরীরের প্রতি নিরপেক্ষ ও অনাকাঙ্ক্ষী হয়ে তা ত্যাগ করে চলে যাব। ময়লা স্থানে স্ত্রী-পুরুষেরা যেমন মলত্যাগ করে অনাকাঙ্ক্ষী ও অপ্রত্যাশী হয়ে চলে যায়, সেরূপ আমিও নানা অশুচিপূর্ণ এই ভৌতিক দেহকে পায়খানাঘরে পায়খানা করে যাওয়ার মতো ত্যাগ করে চলে যাব। নৌকার মালিকগণ যেমন জীর্ণ, ছিন্নভিন্ন ও পানি ওঠে এমন নৌকার প্রতি নিরপেক্ষ ও অনাকাঙ্ক্ষী হয়ে সেটাকে ফেলে চলে যায়, সেরূপ আমিও চোখ-কান প্রভৃতি নয়টি ছিদ্রযুক্ত নিত্য গলিত অশুচিপূর্ণ এই পচা দেহকে জীর্ণ নৌকার মালিকের মতো ত্যাগ করে চলে যাব।
কোনো ব্যক্তি যদি সোনারুপার জিনিস সঙ্গে নিয়ে চোর-ডাকাতদের সঙ্গে যাবার সময় সেই জিনিসগুলো কেড়ে নেওয়ার ভয় দেখলে সেগুলো পরিত্যাগ করে চলে যায়, তেমনই এই দেহও হচ্ছে মহাচোরের মতো। তাই কুশলকর্মের ব্যাঘাতের ভয়ে আমিও এই চোরের মতো শরীর ত্যাগ করে চলে যাব।—বুদ্ধবংশ
এভাবে তিনি বহু কারণ চিন্তা করে, বহু শতকোটি ধন ধনী-গরিবদের দান দিয়ে হিমালয় পর্বতে চলে গেলেন। হিমালয় পর্বতের কিছু দূরে ধম্মক নামে একটি পর্বত ছিল। সেখানে তাঁর আশ্রম ও পর্ণশালা সুন্দরভাবে নির্মিত হয়েছিল। দেবরাজ ইন্দ্র সেই আশ্রমের মধ্যে পাঁচটি দোষমুক্ত চংক্রমণপথ বা পায়চারির পথ নির্মাণ করিয়েছিলেন। সুমেধ তাপস সেখানে নয় প্রকার দোষযুক্ত বস্ত্র ত্যাগ করে বারো প্রকার গুণযুক্ত চীবর পরেছিলেন। আটটি দোষযুক্ত পর্ণশালা পরিত্যাগ করে দশ প্রকার গুণসম্পন্ন গাছের নিচে অবস্থান করেছিলেন। বপিত ও রোপিত ধানের অন্ন একদম ত্যাগ করে অনেক প্রকার গুণযুক্ত ঝরে পড়া ফলমূল খেয়েছিলেন। সেই আশ্রমে বসে, দাঁড়িয়ে ও চংক্রমণ করতে করতে তিনি উৎসাহসহকারে ধ্যান করে সপ্তাহের মধ্যেই পঞ্চ অভিজ্ঞাবল ও অষ্ট সমাপত্তি লাভ করেছিলেন।
--------অপদান অর্থকথা।