17/12/2024
স্বাধীনতা ঘোষনা বিতর্ক এবং জিয়াউর রহমান
ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী
১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নির্মমভাবে হত্যাকান্ডের রহস্যও অদ্যাবধি উন্মোচিত হয়নি। এমনকি রাষ্ট্রপতি জিয়ার সহধর্মিনী রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হবার পরেও।
অবশ্য জিয়া হত্যার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার দায়ে অভিযুক্তদের কয়েকজন ঘটনার পরবর্তীকালে ‘বিক্ষুব্ধ সিপাহী জনতার হাতে’ প্রাণ হারান, দু’জন বিদেশে পালিয়ে যান (তাদেরকে ফেরত এনে বিচার সোপর্দ করার কোন চেষ্টা কখনো হয়েছে বলে শোনা যায়নি এবং এদের একজন নাকি ইতিমধ্যে মারাও গেছেন), কয়েকজনকে বিশেষ ট্রাইবুনালে সোপর্দ করে ফাঁসিসহ বিভিন্ন মেয়াদের কারাদন্ড দেয়া হয়।
সেদিন যে ভাবে তড়িঘড়ি করে এই ফাঁসির দন্ডাদেশ করা হয়েছিল তা নিয়ে আজও জনমনে প্রশ্ন রয়ে গেছে। জিয়া হত্যার মূল নায়ক হিসেবে কথিত মেজর জেনারেল মঞ্জুর সে^চ্ছায় পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করার পরও কিভাবে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর হেফাজতে থাকা অবস্থায় ‘বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের হাতে’ প্রাণ হারালেন— সে প্রশ্নটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হয়েই বিরাজ করছে।
এতবড় একটি ঘটনা, যার জন্য ডজনাধিক সামরিক অফিসারকে ফাঁসিতে ঝোলানো হলো, সেই ঘটনাটি কি কেবল ওই কয়েকজন উচ্চাভিলাষী তরুণ অফিসারের হঠকারিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল? হত্যার সকল আলামত যেভাবে গোয়েন্দা কাহিনীর মতো একটি একটি করে সরিয়ে ফেলা হলো, মূল হত্যাকারী মতিউর রহমান, হত্যাকান্ডের মূল প্রত্যক্ষদর্শী লেঃ কর্নেল মাহফুজ এবং জেনারেল মঞ্জুরসহ যারা এই ঘটনার প্রেক্ষাপট উন্মোচিত করতে পারতেন, তাদের কাউকেই জীবিত রাখা হয়নি। এটাও কি মূল হত্যা পরিকল্পনারই অংশ ছিল? তবে তো মূল পরিকল্পনাকারীর এই বৃত্তের বাইরেই থাকার কথা।
রাষ্ট্রপতি জিয়া নিহত হবার পর ১৯৮১ সালের জুন মাসে বিএনপির একটি বিশেষ বর্ধিত সভা ডাকা হয় দলের পরবর্তী কার্যক্রম স্থির করার জন্য। তখনকার ‘পুরনো গণভবনে’ (আজ যার নাম ‘সুগন্ধা’) বিএনপির কেন্দ্রীয়, জেলা ও থানা পর্যায়ের প্রতিনিধিরা এতে যোগ দিয়েছিলেন বেদনা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে এতে সভাপতিত্ব করেন। সভার শুরুতে অভ্যাগতদের স্বাগত জানিয়ে বক্তব্যের এক পর্যায়ে আমি যখন নিহত নেতার হত্যাকান্ডের বিচার প্রসঙ্গে মন্তব্য করছিলাম, যখন বলছিলাম— হত্যাকান্ডের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইবুনালে টার্মস অফ রেফারেন্স থেকে এই হত্যার সাথে জড়িত অন্যদের খুঁজে বের করার বিষয়টি শেষ মুহূর্তে কোন অজ্ঞাত কারণে কার নির্দেশে এবং কোন যুক্তিতে বাদ দেয়া হয়েছে দেশবাসীকে তা জানানো দরকার— তখন পার্শ্বে উপবিষ্ট অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার আমাকে ইশারায় থামতে বলেন। আমি বক্তৃতা থামিয়ে তাঁর কথা শোনার জন্য পাশে ঝুঁকলাম। তিনি আমার কানে কানে বললেন, ‘এ নিয়ে আর কিছু বলবেন না।’
তাহলে দেখা যাচ্ছে, হত্যাকান্ডের প্রকৃত রহস্য উদঘাটনের বিষয়টা যে চাপা পড়ে গেছে, সেটা মোটেই কাকতালীয় ব্যাপার ছিলনা। সুপরিকল্পিতভাবেই তা চাপা দেয়া হয়েছে।
ট্রাইবুনালের ‘টার্মস অফ রেফারেন্স’ এ এটা অন্তভুর্ক্ত ছিল এবং তা কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু একদিন পরেই তা ছেঁটে ফেলা হয়। তখন যারা ক্ষমতার শীর্ষে ছিলেন তাদের একটি অংশ সচেতনভাবেই এই কাজটি করেছেন। তাঁরা সম্ভবতঃ চাননি যে, কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের হয়ে আসুক।
৭৫ সালের ইনডেমনিটি বিল বাতিলের বিরোধিতাকারীরাও সম্ভবতঃ একই কারণে ভীত ছিলেন। কেউ কেউ বলেন, তাহলে যে প্যান্ডোরার বাক্স খুলে যাবে। কনস্টিটিউশনাল ক্রাইসিস দেখা দেবে। এদের উদ্দেশ্যে একবার লিখেছিলামঃ হোন না ক্রাইসিস, তাতে আপনি অত শঙ্কিত হচ্ছেন কেন? ক্রাইসিস যদি সত্যই দেখা দেয়, তার মোকাবেলার পথ সবাই মিলে বের করবে। আপনি কেন সব দায়—দায়িত্ব নিজের মাথায় নিতে চান?
সাপের ভয়ে কেঁচো খেঁাড়া থেকে বিরত থেকে আমরা আজ গোটা দেশটাকেই বহুবিধ সর্পের অভয়ারণ্য বানিয়ে ফেলেছি।
মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের সাথে আমার প্রথম পরিচয় তাঁর ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চের বেতার ভাষণের মধ্যদিয়ে।
২৫শে মার্চ পাক বাহিনীর হামলায় গোটা জাতি যখন দিশেহারা, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব যখন তাদের নেতার সুষ্পষ্ট নির্দেশের অভাবে পরবর্তী কর্মপন্থা দিতে পারছে না, সেই সময়টিতে লক্ষ লক্ষ দেশবাসীর মতো আমিও হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। বিশেষ করে, আমরা যারা স্বাধীনতার সপক্ষে প্রকাশ্য তৎপরতায় লিপ্ত ছিলাম, অথচ আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্ক ভালো ছিল না, তাদের জন্য ব্যাপারটা ছিল খুবই বিব্রতকর।
২৭ মার্চ, ১৯৭১। হাজার হাজার মানুষ, নর—নারী, আবালবৃদ্ধবণিতা কেউ শূন্য হাতে, কেউ সামান্য কিছু সম্বল নিয়ে ঢাকা ছেড়ে বাইরের দিকে ছুটছেন, আর আমি তখন পাকবাহিনীর নৃশংসতায় বিধ্বস্ত ঢাকা শহরের দিকেই ফিরছি। ২৫ মার্চ রাতের ট্রেনে আমি এবং মরহুম আতাউর রহমান খাঁন রওয়ানা হয়েছিলাম চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। লালদীঘির মাঠে স্বাধীনতার দাবিতে আয়োজিত এক জনসভায় যোগ দিতে। কিন্তু সে ট্রেন চট্টগ্রাম অবধি যেতে পারেনি। লাকসাম পর্যন্ত কোনক্রমে পেঁৗছলাম। অতঃপর চাঁদপুর—নারায়ণগঞ্জ হয়ে ঢাকা ফেরা। চাঁদপুর থেকে স্টীমারে চেপে ২৭ তারিখ সকালে আমরা নারায়ণগঞ্জ পেঁৗছাই। তখন পাক বাহিনী ঢাকা—নারায়ণগঞ্জ সড়কে ব্যারিকেড সরিয়ে থেমে থেমে এগুচ্ছে। আমরা নৌকায় নদী পার হয়ে বুড়িগঙ্গার অপর পারে গেলাম। সেখানে একটা বাড়ীতে খান সাহেবকে রেখে আমি পায়ে হেঁটে নদীর তীরে ঘেঁষে জিঞ্জিরার দিকে এগুতে থাকলাম।
পথে অনেক পরিচিত আতংকিত মুখ। জিঞ্জিরায় পেঁৗছাতে বিকেল গড়িয়ে এলো। আমাকে দেখে পরিচিত ছাত্র—কর্মীরা ঘিরে ধরলো। সবার প্রশ্ন, এখন কি হবে?
কি হবে তা কি আমিও জানি?
আর ঠিক সেই সময় পাশে একটি পান দোকানের সামনে প্রচন্ড শোরগোল। চট্টগ্রাম বেতার থেকে ভেসে আসছে দুর্বল ট্রান্সমিশনে কিছু শব্দতরঙ্গ।
মূহূর্তের মধ্যেই যেন গর্জে উঠলো গোটা জনপদ। অখ্যাত ‘এক মেজর’ জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে একটি ঘোষণায় হতোদ্যয় মুক্তিকামী জনতা যেন বিদ্যুৎ স্পৃষ্টের মত জেগে উঠেছে। রেডিওতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করা হয়েছে ....... বাঙালী সৈনিকরা ব্যারাক ছেড়ে অস্ত্র হাতে সংগ্রামে শরিক হয়েছে। এই সংবাদ সেদিন হত—বিহ্বল মানুষকে নতুন করে আশায় বুক বাঁধতে কি প্রচন্ড প্রেরণা যুগিয়েছে— আজকের প্রজন্মের পথে তা অনুধাবন করা কঠিন।
আজ কতদিন পরেও কানে বাজে ‘আমি মেজর জিয়া বলছি ...... বাঙালী সৈনিক, ইপিআর, পুলিশ অস্ত্র হাতে প্রতিরোধ গড়েছে ...... স্বাধীন বাংলাদেশের প্রভিশনাল সরকার গঠিত হয়েছে ..... বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের প্রতি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার আহ্বান জানাচ্ছি, ..... ইত্যাদি। কে এই মেজর, সে প্রশ্ন তখন অবান্তর। যে—ই হোক না কেন, এই অখ্যাত মেজর সমগ্র জাতির মনের আকুতিকে ইথারে ছড়িয়ে দিয়েছে।
শুধুমাত্র একটি বেতার ঘোষণা দিয়েই দেশ স্বাধীন করা যায় না। কিন্তু সঠিক সময়ে একটি সঠিক ও সাহসী পদক্ষেপ যুগান্তকারী ঘটনা প্রবাহের সূচনা ঘটাতে পারে। সেদিন দলমত নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষই সেই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে। আওয়ামী লীগ কর্মীরাও সেদিন এই ঘোষণাতেই নতুন করে বুক বেঁধেছে। ‘অখ্যাত’ জিয়াউর রহমান হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের ‘জোয়ান অভ আর্ক’।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস এই ঘোষণা নিয়ে কোন বির্তক হয়নি। হয়নি শেখ সাহেবের জীবদ্দশাতেও। কিন্তু আজ এ নিয়ে নানা বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে। স্বাধীনতার প্রথম অনুষ্ঠানটি ঘোষণার কৃতিত্বটুকু জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে কেড়ে নেয়ার জন্য প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চলছে।
আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব ক্ষমতায় এসেই জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের নাম বলে ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর’ করেছিলেন। সর্ব মহলের প্রতিবাদের মুখে সেই উদ্যোগ আপাততঃ চাপা পড়ে থাকলেও বিষয়টির সম্ভবতঃ এখনও চূড়ান্ত নিষ্পত্তিত হয়নি।
প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগ কেন এটা করতে চায়? অন্য সব কিছু বাদ দিলেও জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডর ছিলেন, তিনি একদা এদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। রাষ্ট্রপতি হিসাবে তিনি এতই জনপ্রিয় ছিলেন যে, তাঁর মৃত্যুর পরে সেই জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে তাঁর দল নির্বাচনে জয়ী হয়েছে এবং এত বছর পরেও দেশ জুড়ে একটি বিশাল দল হিসাবে বিরাজ করছে।
এমন একজন রাষ্ট্রনেতার নামে একটি বিমান বন্দরের নামকরণে আওয়ামী লীগের এত আপত্তি; কিন্তু সেই আওয়ামী লীগই চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের নামকরণ করেছে, ‘এম এ হান্নান আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর।’ পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন এম এ আজিজ এবং জহুর আহমদ চৌধুরী। নেতৃত্বের পরিমাপে, ত্যাগ তিতিক্ষায় তাঁরা দুজনেই ছিলেন অতুলনীয়। তাঁদের কারো নামে চট্টগ্রাম বিমান বন্দরের নামকরণ হলো না; হলো এম এ হান্নানের নামে!
কে এই হান্নান? হঠাৎ করে কেনই বা তাঁকে এভাবে তুলে ধরা?
এম এ হান্নান চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক ছিলেন। তাঁর বাড়ি ছিল ফরিদপুর, থাকতেন চট্টগ্রামে। বস্তুতঃপক্ষে তিনি ছিলেন এম এ আজিজ সাহেবের রাজনৈতিক সহকারী এবং সেই সুবাদে আওয়ামী লীগের দাপ্তরিক কাজ—কর্ম করতেন। জননেতা বলতে যা বোঝায় চট্টগ্রামে তাঁর তেমন অবস্থান কখনই ছিল না।
এম এ হান্নান আওয়ামী লীগের নিষ্ঠাবান কর্মী ছিলেন। আওয়ামী লীগের শাসনামলে (সম্ভবতঃ ১৯৭৪ সালে) তিনি এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর পর সেদিনের আওয়ামী লীগ সরকার তাঁর নামে চট্টগ্রামের একটি কানাগলির নামকরণ করেছিল বলেও শুনিনি। আজ এতদনি পর কেন তাঁর নামে চট্টগ্রামের একমাত্র বিমান বন্দরের নামকরণ করার প্রয়োজন দেখা দিল?
বস্তুতঃপক্ষে এম এ হান্নানকে সম্মানিত করার জন্য নয়, একটা বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যই বর্তমান আওয়ামী লীগ এই পদক্ষেপ নিয়েছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলার চেষ্টা হচ্ছে যে, জিয়াউর রহমান নয়, হান্নানই প্রথম স্বাধীনতার ঘোষনা করেন চট্টগ্রাম বেতার থেকে। স্পষ্টতঃই আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষক হিসাবে জিয়াউর রহমানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার একটি সুচতুর কৌশল হিসাবেই এম এ হান্নানকে সামনে টেনে আনার চেষ্টা হচ্ছে।
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ এবং তার পর কয়েকদিন পর্যন্ত চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রটি পাকিস্তানীদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। ঐ বেতারকেন্দ্রের কর্মীরা সাহসিকতার সাথে পাকিস্তানী শাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সেদিনের গণ আন্দোলনের পক্ষে বলিষ্ঠ প্রচারণা চালিয়ে স্মরণীয় হয়েছেন। ২৫শে মার্চ পাক বাহিনীর অপারেশন সার্চ লাইট শুরু হবার পর কালুরঘাটের বেতারকেন্দ্র থেকে পাঞ্জাবী শাসনের নিগড়মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের আহবান জানিয়ে অনেকগুলো কথিকা প্রচার হয়। মরহুম হান্নাও এ সময় ঐ বেতার বক্তব্য রাখেন। সে বক্তব্যে স্বাধীনতার আহবান থাকবে তাতে সন্দেহ নেই। কারণ, তখন সারা দেশেই স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ছে।
এটাই বা কম কিসে? মরহুম হান্নান অবশ্যই সেই কৃতিত্বের দাবীদার। কিন্তু বেতারে কথিক প্রচার আর স্বাধীনতা ঘোষনা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন এদেশের মানুষের দানা বেঁধেছে একাত্তরের অনেক আগে। পঞ্চাশের ও ষাটের দশকে এদেশের রাজনৈতিক কর্মী ও রাজনীতি সচেতন নাগরিকদের অনেকেই প্রকাশ্যে—অপ্রকাশ্যে স্বাধীনতার কথা বলেছেন, পশ্চিম পাকিস্তানী শাসনের নিগড়মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক অর্থে একটি দেশের ‘স্বাধীনতা ঘোষণা’ তখনই তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে যখন এমন কারো মুখ থেকে কথাটি উচ্চারিত হয়, যিনি ঐ বিশেষ সময়ে ঘটনাপ্রবাহের কেন্দ্র বিন্দুতে স্থাপিত হয়েছেন। তিনি কে, কারা তাঁর পেছনে, এ ঘোষণা দেবার জন্য প্রয়োজনীয় ‘অধিকার’ তিনি অর্জন করেছেন কি—না, সর্বোপরি তাঁর ঘোষণা ঘটনা প্রবাহকে কিভাবে ও কতটা প্রভাবিত করেছে এবং তাঁর ঘোষণার জের ধরেই ‘স্বাধীনতা’ অর্জিত হয়েছে কি—না ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় চলে আসে।
মরহুম হান্নান কিংবা সেদিনের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের কর্মীদের ঘোষনা যদি স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করার জন্য যথেষ্ট হতো, তাহলে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাদের সেদিন জিয়াউর রহমানকে মাথায় তুলে নেবার প্রয়োজন হতো না।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয় এবং সেভাবে বেশ কিছু দলিল পত্রও দাঁড় করানো হয়েছে যে, শেখ সাহেবে ২৬ মার্চ ভোররাতে গ্রেপ্তার হবার আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে গেছেন। যদি তাই হয়, তাহলে এত কষ্ট করে হান্নান সাহেবকে খুঁজে বের করার প্রয়োজন হচ্ছে কেন?
শেখ সাহেব ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষনা করেছেন, এই কথাটির ভেতর কি কোন বড় রকমের ফাঁক রয়েছে? আর সে ফাঁক পূরণ করা যাচ্ছে না বলেই কি আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এমন হন্যে হয়ে জিয়াউর রহমানের ঘোষণাকে পাশ কাটাবার পথ খুঁজছেন?
এবার শেখ সাহেবের ২৬ মার্চ তারিখের কথিত ঘোষনাটি সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা যাক। শেখ সাহেবে কিভাবে স্বাধীনতা ঘোষনা করেছেন? এ ব্যাপারে এ যাবৎ যেসব ভাষ্য পাওয়া গেছে তা নিম্নরুপ:
১। শেখ সাহেব গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে পিলখানার বিডিআর—এর ওয়ারলেস অপারেটরের মাধ্যমে তাঁর স্বাধীনতার আহবান দেশবাসীর উদ্দেশ্যে প্রচার করেন।
২। শেখ সাহেব চট্টগ্রামের জহুর আহমদ চৌধুরীকে টেলিফোনে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে বলেন।
৩। শেখ সাহেব চট্টগ্রামের হান্নান সাহেবকে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে বলেন। (জহুর আহমদ চৌধুরী এবং হান্নান সাহেবদের সম্পর্কে তখন এমনই ছিল যে, একজনের কাছে সংবাদ পাঠালে অন্য জনের তা জানার সম্ভাবনা ছিল খুবই কম।)
৪। শেখ সাহেব ঢাকার টেলিফোন ভবনের অপারেটরের মাধ্যমে স্বাধীনতার বাণী প্রচার করেন।
৫। শেখ সাহেবের স্বাধীনতার ঘোষণাটি বহিঃসমুদ্রে নোঙর করা একটি বিদেশী জাহাজের মাধ্যমে প্রচারিত হয়। চট্টগ্রামে রেলওয়ে বিল্ডিং এর ওয়ারলেস অপারেটর তাঁর যন্ত্রে এই ঘেষণা ধরতে পারেন এবং চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাদের পেঁৗছে দেন।
৬। সিলেটের মরহুম কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী এই লেখককে ১৯৭৩ সালে একটি টেলিগ্রামের কপি দেখিয়ে বলেছিলেন, শেখ সাহেব ২৫ তারিখে তাকে টেলিগ্রামে স্বাধীনতা ঘোষণার কথা জানিয়েছিলেন।
এই ছয়টি বক্তব্যের মধ্যে কোনটিকে আমরা সঠিক মনে করবো?
স্বাধীনতা ঘোষণা বলতেই বা আমরা কি বুঝবো? একটি দেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করতে হলে সেই ঘোষণার আইনগত ও বাস্তবসম্মত ভিত্তি থাকা অত্যাবশ্যক। তাছাড়া স্বাধীনতা ঘোষণার একটি বিশ্বজনীন ফরম্যাট আছে। শেখ মুজিব তাঁর সেইদিনের অবস্থানে থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করলে সেভাবেই করতেন।
উপরের ছয়টি বিভিন্নমূখী দাবীর কোনটাই তা পূরণ করে না। স্পষ্টতঃ এর সবই ২৫ শে মার্চের কালরাত্রির পর যে লক্ষ্যহীনতা ও দিশাহীন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তার প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিবের নাম ব্যবহার করে কিছু একটা করে পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বিভিন্ন অংশের প্রাণবন্ত প্রয়াসের বহিঃপ্রকাশ।
এখন দেখা যাক, ২৫ শে মার্চ সন্ধ্যা থেকে ২৬ মার্চ রাত ১.৩০ মিনিটে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত শেখ সাহেব কি করেছেন এবং ঐ সময়ে তাঁর তরফ থেকে কোথায়ও কোন বাণী আদৌ প্রচার করা হয়েছিল কি না।
২৫ শে মার্চ সন্ধ্যার পূর্বেই ঢাকা শহরের সর্বত্র রটে যায়, আজ রাতে ভয়ানক কিছু একটা ঘটবে। সন্ধ্যার পর থেকে শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ছাত্ররা ব্যারিকেড তৈরী করতে থাকে। সারা শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নেতারা বারংবার ধর্ণা দিয়েছেন শেখ সাহেবের ধানমন্ডির বাসভবনে। তাজউদ্দিন, জেনারেল ওসমানী সবাই তাঁকে অনুরোধ করেছেন ঢাকার বাইরে চলে যেতে। কিন্তু তিনি তাতে রাজী হননি। তিনি পাকিস্তানীদের হাতে ধরা দিয়ে কারাবরণের সিদ্ধান্ত নিলেন।
রাতে দশটা পর্যন্ত শীর্ষ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার তাঁর সাথে কথা বলেছেন। তার প্রশান রয়েছে শেখ মুজিবের নিজের ভাষায়—‘আমি বাড়িতেই ছিলাম। আমার সন্দেহ ছিল না যে, ইয়াহিয়া আমাকে গ্রেপ্তার করতে চাইছেন ..... আমার গ্রেপ্তারের পূর্বে সকল রাজনৈতিক নেতাদের আমার বাড়ি থেকে চলে যেতে বলি।’— (ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া সাক্ষাৎকার।)
শেখ মুজিব রাত ১০টা পর্যন্ত দলীয় শীর্ষ নেতাদের সাথে কথা বলেছেন। তাদের কাউকেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষনা করতে বলেন নি। স্বাধীনতার কোন ঘোষণাপত্রের মুসাবিদাও তৈরী করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয় ২৬ শে মার্চ। বলা হয়, ২৬ শে মার্চ রাত দেড়টায় গ্রেপ্তার হবার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘোষনা করেন। অর্থাৎ ২৫ শে মার্চ রাত বারোটার পর এবং ২৬ শে মার্চ রাত দেড়টার পূর্বে এই দেড়ঘন্টা সময়ের কোন এক সময় শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘোষণা করতে মনস্থির করলেন এবং হাতের কাছে কাউকে না পেয়ে ইপিআর—এর ওয়ারলেস অপারেটরকে টেলিফোনে তাঁর ইচ্ছাটা জানালেন এবং তা দেশবাসীকে জানাতে বললেন।
এখানেও একটি মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন, ঐ সময় কি ঢাকার টেলিফোন এক্সচেঞ্জ চালু ছিল?
এই রহস্যের চূড়ান্ত সমাধান দিতে পারতেন শেখ সাহেব নিজেই। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত কখনও তিনি কাউকেই এ ব্যাপারে কিছু বলেন নি। এমনকি রবার্ট ফ্রাষ্টকে দেয়া সাক্ষাৎকারে, যেখানে তিনি তাঁর গ্রেপ্তারের পূর্ব পর্যন্ত সব কিছু খুঁটিনাটি বর্ণনা করেছেন, তার কোথাও তিনি এ ব্যাপারে একটি কথাও বলেন নি। তিনি যদি এ সময় ‘স্বাধীনতা ঘোষনা’ করার মত কোন পদক্ষেপ নিয়ে থাকতেন, তাহলে ১৯৭২ সালে মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে বসে বিদেশী সংবাদ মাধ্যমের জন্য ঐ কথাটাই তিনি সব চাইতে বেশী শুরুত্বের সাথে তুলে ধরতেন।
উপরের বর্ণনা থেকে এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ সন্ধ্যা থেকে রাত বারোটার পূর্ব পর্যন্ত শেখ সাহেব আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের কাউকেই স্বাধীনতা ঘোষণা করার কোন নির্দেশ বলেননি এবং ২৬ শে মার্চ রাত দেড়টায় গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বেও তিনি স্বাধীনতা ঘোষনা করার কোন নির্দেশ কাউকে দেননি বা দিয়ে যেতে পারেননি।
এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, মুজিব নগরে ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ২৬ শে মার্চ শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষনা করেছেন, এই মর্মে যে তথ্য দেয়া হয়েছে তার উৎস কি?
এই বিষয়টি নিয়ে মাসুদুল হক তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ‘বাঙালি হত্যা এবং পাকিস্তানের ভাঙন’—এ তথ্য প্রমাণসহ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। পাকিস্তানী সামরিক অফিসার সিদ্দিক সালিক তাঁর গ্রন্থে ডেইলী টেলিগ্রাফের দক্ষিণ এশীয় সংবাদদাতা ডেভিড লোসাকের ‘পাকিস্তান ক্রাইসিস’ পুস্তকের বরাত দিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ পাকিস্তানের সরকারী তরঙ্গের কাছাকাছি একটি বেতার শেখ মুজিবের ক্ষীণ কন্ঠ ভেসে আসছে এবং সে কণ্ঠে স্বাধীনতা ঘোষিত হয়।
ডেভিড লোসাক ঘোষণাটি স্বকর্ণে শোনেননি। পাকিস্তানের জাঁদরেল গোয়েন্দা কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিকও স্বকর্ণে শোনেন নি। কে শুনেছে?
শুনেছেন ভারতীয় সংবাদ সংস্থা ইউএনআই ও পিটিআই।
এই দুই সংবাদ সংস্থার বরাত দিয়ে ভারতের ইংরেজী দৈনিক দি ষ্ট্যাটসমস্যান পত্রিকা ২৭ শে মার্চ তারিখে শেখ মুজিবের কথিত স্বাধীনতা ঘোষনার বিশদ ‘বিবরণ’ ছাপে। এতে বলা হয়:
‘একটি গোপন রেডিও থেকে শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলকে বাংলাদেশ নামে পুনঃনামকরণ করেছেন। ............’
মিঃ রহমান এবং অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতারা আত্মগোপন করেছেন।
পরে স্বাধীন বাঙলা (ফ্রী বেঙ্গল) বেতার কেন্দ্র থেকে ভাষণ দান কালে মিঃ রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের ঘোষনা দেন।
মুজিবুর রহমান তার প্রদত্ত বেতার ঘোষণায় সুনির্দিষ্টভাবে বলেন, আমরা কুকুর বেড়ালের মত মরবো না, বাংলা মায়ের (মাদার বেঙ্গল) সুযোগ্য সন্তানের মত মরবো।’
রিপোর্টে আরো যোগ করা হয়, ‘স্পষ্টতঃই পূর্ব বাংলার উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত গোপন বেতার কেন্দ্রের এক ঘোষক বলেন, শেখ ঘোষণা করেছেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের সাত কোটি জনগণ স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক। ..............
মাসুদুল হকের ‘বাঙালী হত্যা ও পাকিস্তানের ভাঙন’ পুস্তকের ১৭৪ পৃষ্টায় এই রিপোর্টটি বিস্তারিত উদ্বৃত হয়েছে। রিপোর্টটি ছাপা হয়েছে ভারত সরকারের তথ্য ও প্রচার মন্ত্রণালয় প্রকাশি ‘বাংলাদেশ ডকুমেন্টস’ গ্রন্থের প্রথম খন্ডে।
আমরা এখন ১৯৭১ এর ২৫ শে ও ২৬ শে মার্চ শেখ সাহেবের অবস্থান সম্পর্কে যা জানি তার আলোকে নির্দ্বিধায় বলা যায়, ভারতীয় সংবাদ সংস্থার রিপোর্টার সম্পূর্ণরুপে গুজবের উপর নির্ভর করে এই কাহিনী খাড়া করেছেন। ২৫ শে মার্চের পর বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত লোকমুখে এটাই প্রচারিত ছিল যে, শেখ মুজিব আত্মগোপন করেছেন। অতএব, সেই অবস্থায় তাঁর স্বাধীনতা ঘোষণাই ছিল স্বাভাবিক। সেজন্যে একটি গোপন বেতার কেন্দ্রের প্রয়োজন ছিল, ভারতীয় সংবাদ সংস্থা তার ব্যবস্থা করেছে ‘উত্তরবঙ্গের কোন এক স্থানে’।
আশ্চর্যের বিষয়, ১৯৭১ সালের ১১ই এপ্রিল ‘মুজিবনগর’ স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠনকালে প্রকাশিত ‘ঘোষণাপত্রে’ স্বাধীনতার এই বানোয়াট বেতার ঘাষণার উল্লেখ করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাপত্রে এমন একটি কল্প—কাহিনী সংযোজন না করলেই বোধ হয় ভালো হতো।
এটা যে কল্পকাহিনী, ইতিহাসের অংশ নয়, সে ব্যাপারে তৎকালীন লীগ নেতারা অন্যদের চাইতে বেশী ওয়াকেবহাল ছিলেন। কারণ তারা শেখ সাহেবের অবস্থান সম্পর্কে অবগত ছিলেন।
মাসুদুল হক এ ব্যাপারে তৎকালীণ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর দুটো বক্তব্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, জনাব আহমদ ও মিসেস গান্ধী নিশ্চিত ছিলেন যে, শেখ সাহেব ঐ ধরনের কোন বেতার ঘোষনা দেননি।
১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে মিসেস গান্ধী যুক্তরাষ্টের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ভাষণে স্পষ্ট ও জোরালো ভাষায় বলেন, ‘............ (বাংলাদেশের) স্বাধীনতার ডাক উচ্চারিত হয়ে ওঠে শেখ মুজিবের গ্রেপ্তারের পরই, তার আগে নয়। আমার জানা মতে, এমন কি এখন পর্যন্ত তিনি (শেখ মুজিব) স্বাধীনতার কথা বলেন নি।’ (সূত্র: বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, তথ্য ও প্রচার দফতর, ভারত সরকার)।
১৯৭১ সালের ১১ই এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণের পরদিন তিনি স্বাধীন বাংলা বেতারে জাতির এবং বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে তাঁর প্রথম ভাষণে বলেন: The brilliant success of our fighting forces and the daily additions to their strength in manpower and captured weapons has enabled the Government of the People’s Republic of Bangladesh, first announced through Major Ziaur Rahman, to set up full fledged operational base from which it is administrating the liberated areas. (Source: Bangladesh Documents Govt. of India)
‘লড়াইরত আমাদের বাহিনীর চমৎকার সাফল্য এবং প্রতিদিন তাদের শক্তির সঙ্গে জনবলের বৃদ্ধি এবং দখলকৃত অস্ত্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে যা মেজার জিয়াউর রহমানের মাধ্যমে প্রথম ঘোষিত হয়, সক্ষম করেছে পূর্ণাঙ্গ অপরেশনাল বেস প্রতিষ্ঠান করতে, যেখান থেকে মুক্তাঞ্চলের প্রশাসনিক কর্মকান্ড পরিচালিত হচ্ছে। (অনুবাদ: মাসুদুল হক)।
দেখা যাচ্ছে, ১৯৭১ সালের রক্তঝরা দিনে তাজউদ্দিন আহমদ স্বয়ং দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে জিয়াউর রহমানকেই আমাদের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষক হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
জিয়াউর রহমানের সেই ঘোষনা কিভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের নিজস্ব প্রশাসন গড়ে তোলার ভিত্তি নির্মাণ করেছে তাজউদ্দিন আহমদের এই বক্তব্যের এটাও স্পষ্ট হয়েছে। সংকলন— প্রথম বাংলাদেশ