17/09/2024
"মাস্টার কি সিস্টেম" আসলে এক ধরণের মানসিক এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানচর্চা যা আমাদের মন এবং চিন্তাধারার শক্তিকে সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগানোর পথ দেখায়। এই দর্শন অনুযায়ী, আমাদের মন আমাদের বাস্তবতার মূল চাবি। আমরা যেভাবে চিন্তা করি এবং অনুভব করি, সেটাই আমাদের চারপাশের পরিবেশ ও পরিস্থিতি গঠন করে। এটা বলে যে, আমাদের সচেতন মন (যা আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি) এবং অবচেতন মন (যা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিশ্বাস ও চিন্তার ভিত্তিতে কাজ করে) একে অপরের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে আমাদের জীবনকে পরিচালনা করে।
এই চিন্তার ধারা আমাদের বলে যে আমরা যদি ইতিবাচক চিন্তা, আত্মবিশ্বাস এবং সফলতার প্রতি মনোযোগ দেই, তবে সেই রকম বাস্তবতাই আমাদের জীবনে ফুটে উঠবে। অর্থাৎ, আমাদের চিন্তাধারা আমাদের কর্ম ও অভ্যাসে প্রভাব ফেলে, এবং সেই কর্ম আমাদের ভবিষ্যৎকে গড়ে তোলে। মনকে একটি বাগানের মতো বিবেচনা করা হয়েছে; যদি ভালো বীজ বপন করা হয়, তবে ভালো ফল পাওয়া যাবে, আর যদি নেতিবাচক বা ক্ষতিকর চিন্তা মাথায় রাখা হয়, তবে সেই রকম ফলই আসবে।
এই শিক্ষাবিধিতে বিশ্বাস করা হয় যে, বিশ্বের সমস্ত বড় অর্জন, সৃষ্টিশীলতা, ও সাফল্যের পেছনে মানসিক শক্তির ব্যবহারই মূল। মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারা মানে নিজের জীবনের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ করা।
এই দর্শন অনুযায়ী, আমাদের মন দুই ভাগে বিভক্ত: সচেতন মন এবং অবচেতন মন। সচেতন মন হচ্ছে সেই অংশ, যা আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি—যেখানে আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে চিন্তা করি, সিদ্ধান্ত নিই, এবং পরিকল্পনা করি। অন্যদিকে, অবচেতন মন হলো সেই অংশ, যা আমাদের অভ্যাস, বিশ্বাস এবং আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয়, যা সচেতন মন দ্বারা বারবার প্রভাবিত হয়ে গঠিত হয়।
এই পদ্ধতির মূল কাজের প্রক্রিয়াটি তিনটি ধাপে বিভক্ত:
১. চিন্তার ফোকাস
এখানে বলা হয়েছে যে, আমরা যেভাবে চিন্তা করি, সেটাই আমাদের বাস্তবতায় রূপ নেয়। যদি আমরা ইতিবাচক চিন্তা করি, আত্মবিশ্বাস ও সাফল্যের দিকে মনোযোগ দেই, তবে আমাদের অবচেতন মন সেই চিন্তাগুলোকে বাস্তবতায় রূপান্তর করতে কাজ শুরু করে। আমাদের মনকে নিয়মিতভাবে সেই চিন্তা বা উদ্দেশ্যের দিকে পরিচালিত করতে হয় যা আমরা অর্জন করতে চাই।
২. অনুভূতির শক্তি
চিন্তার সঙ্গে অনুভূতির গভীর সংযোগ রয়েছে। শুধুমাত্র চিন্তা করা যথেষ্ট নয়, সেই চিন্তার সঙ্গে অনুভূতিকে জুড়ে দিতে হবে। যখন আমরা আমাদের চিন্তাগুলোর সঙ্গে গভীর আবেগ এবং অনুভূতি যোগ করি, তখন সেগুলো অবচেতন মনে আরও দৃঢ়ভাবে প্রবেশ করে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ নিজের সফলতার চিন্তা করে এবং সেই সঙ্গে সেই সফলতার আনন্দ ও গর্ব অনুভব করে, তবে অবচেতন মন সেই অনুভূতিগুলোকে বাস্তবায়িত করার জন্য আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
৩. বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া
যখন আমাদের অবচেতন মন কোনও ধারণা বা চিন্তায় গভীরভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করে, তখন সেটা বাস্তবতায় রূপ নেওয়ার জন্য কাজ শুরু করে। অবচেতন মন আমাদের এমনভাবে পরিচালনা করে যেন আমরা এমন কর্ম এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি, যা আমাদের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সহায়ক হয়। এই প্রক্রিয়াটি ধীরে ধীরে ঘটলেও, ধারাবাহিকতা এবং ইতিবাচক মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে এটা কার্যকর হয়।
সর্বোপরি, এই দর্শনের মূল কথাটি হলো, আমরা যেভাবে নিজের মানসিকতাকে গঠন করি, সেটাই আমাদের জীবনের গতি নির্ধারণ করে। নিজেকে নিয়মিত ইতিবাচকভাবে চিন্তা করতে শেখানো এবং সঠিক অনুভূতি জাগিয়ে তোলাই সফলতার প্রধান চাবিকাঠি।
এই পদ্ধতিটি শুরু করার জন্য আপনাকে প্রথমে আপনার মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং চিন্তাধারাকে ইতিবাচক এবং স্পষ্ট করতে হবে। নিচে কয়েকটি ধাপ দেওয়া হলো, যা আপনাকে এই যাত্রা শুরু করতে সাহায্য করবে:
১. উদ্দেশ্য নির্ধারণ
প্রথমেই আপনাকে স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করতে হবে যে আপনি কী চান। এটি হতে পারে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য, যেমন আর্থিক সাফল্য, শারীরিক সুস্থতা, ব্যক্তিগত উন্নতি, বা কোনও সম্পর্কের ক্ষেত্রে সুখ। যতটা সম্ভব বিস্তারিতভাবে সেই লক্ষ্যটি নির্ধারণ করুন। উদাহরণস্বরূপ, শুধু "আমি সফল হতে চাই" না বলে বলুন, "আমি আমার ক্যারিয়ারে আগামী ৬ মাসের মধ্যে একটি বড় উন্নতি চাই।"
২. ইতিবাচক চিন্তা অনুশীলন
প্রতিদিন আপনার চিন্তাগুলোকে ইতিবাচক রাখার চেষ্টা করুন। আপনার মনের মধ্যে যে নেতিবাচক চিন্তা বা সংশয় আসে, সেগুলোকে চিনতে এবং পরিবর্তন করতে সচেতন থাকুন। যদি কখনও মনে হয় যে "আমি এটা করতে পারব না," তাহলে সেই চিন্তাকে ইতিবাচকভাবে পুনরায় সাজিয়ে বলুন, "আমি এটি করতে সক্ষম এবং আমি সফল হব।"
৩. ভিজ্যুয়ালাইজেশন বা কল্পনা করা
আপনার লক্ষ্য পূরণের দৃশ্য কল্পনা করুন। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে চোখ বন্ধ করে কল্পনা করুন যে আপনি ইতিমধ্যে আপনার লক্ষ্য অর্জন করেছেন। এই প্রক্রিয়ায় আপনার অনুভূতিগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করুন—সাফল্যের আনন্দ, গর্ব বা তৃপ্তি অনুভব করুন। ভিজ্যুয়ালাইজেশন হল অবচেতন মনে সেই ভাবনাকে গভীরভাবে প্রোথিত করার একটি শক্তিশালী মাধ্যম।
৪. ধ্যান ও মনোসংযোগ
প্রতিদিন কিছু সময় ধরে ধ্যান বা মনোসংযোগের চর্চা করুন। এটি আপনাকে আপনার চিন্তাধারা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করবে এবং মনকে স্থির করবে। ধ্যানের মাধ্যমে আপনি আপনার অবচেতন মনকে শান্ত করতে এবং নিজের অভ্যন্তরীণ শক্তিকে জাগ্রত করতে পারবেন। প্রতিদিন সকালে বা রাতে ১০-১৫ মিনিটের জন্য ধ্যান করতে পারেন।
৫. ইতিবাচক অভ্যাস গঠন
চিন্তা এবং অনুভূতির পাশাপাশি, আপনার দৈনন্দিন কাজকর্ম এবং অভ্যাসও গুরুত্বপূর্ণ। আপনার লক্ষ্যে পৌঁছাতে সহায়ক এমন ইতিবাচক অভ্যাস গড়ে তুলুন। যেমন, যদি আপনার লক্ষ্য স্বাস্থ্য ভালো রাখা হয়, তবে নিয়মিত ব্যায়াম এবং সুষম খাবার গ্রহণের অভ্যাস তৈরি করুন। সফলতা ধীরে ধীরে আসে, তবে এটি অভ্যাসের মাধ্যমে নিশ্চিত করা সম্ভব।
৬. ধৈর্য ও বিশ্বাস
এই পদ্ধতিতে ধৈর্য ধরতে হবে এবং নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে। পরিবর্তন রাতারাতি আসবে না, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনি লক্ষ করবেন যে আপনার চিন্তাভাবনা, অনুভূতি এবং কর্মের মধ্যে সমন্বয় ঘটতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে আপনার বাস্তবতায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে থাকবে।
সারাংশ: শুরু করার জন্য আপনাকে স্পষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে, ইতিবাচক চিন্তা এবং অভ্যাস তৈরি করতে হবে, প্রতিদিন ভিজ্যুয়ালাইজেশন এবং ধ্যানের মাধ্যমে আপনার মনকে প্রশিক্ষিত করতে হবে, এবং সর্বোপরি ধৈর্য ধরে নিজের শক্তির উপর বিশ্বাস রাখতে হবে।