10/21/2020
সন্তানের প্রতি মাতা পিতার কর্তব্য ও করণীয়।
সমুদয় প্রশংসা, বন্দনা ও স্তুতির মালিক মহাপরাক্রমশালী সর্বশক্তিমান আল্লাহ, যিনি সৃষ্টিজগতকে অস্তিত্বদানে অনুগৃহীত করেছেন। অভিনব পদ্ধতিতে ক্ষুদ্র থেকে মহাবিশ্ব সৃজনে যাঁর কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হয় না। এক সৃষ্টি থেকে অসংখ্য সৃষ্টির মেলা সাজাতে যাঁর বিশ্ময়কর নৈপুণ্য। সৃষ্টিজগতের এ মজলিস সাজানোর অন্যতম ধারা মানবজন্ম। জন্মের পর ধীরেধীরে বর্ধনশীল।
মানবজাতির এ ক্রমবর্ধমান ধারার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সন্তানসন্ততি। এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা মানব জীবনকে ভারসাম্যপূর্ণ এবং আকর্ষণীয় করেছেন। যাদেরকে আল্লাহ রাববুল আলামীন সন্তান দান করেছেন তাদের উপর এক মহান দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে।
মা-বাবাই সন্তানের সবচেয়ে আপন। সুসন্তান পার্থিক জীবনে সুখ-শান্তির এবং পরকালে মুক্তির অন্যতম মাধ্যম। রসুলে আরবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরমান, মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করে তখন থেকে তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তিনটি আমল অবশিষ্ট থাকে। (এসবের সওয়াব সে মৃত্যুর পরেও প্রাপ্ত হবে।) ১. সদকায়ে জারিয়ার সাওয়াব, ২. মানবের উপকৃত জ্ঞানের পুণ্য এবং ৩. নেক সন্তানের দোয়া (মুসলিম, মিশকাত পৃষ্ঠা ৩২)।
আল্লাহ আলুসি (রহ.) বলেছেন, ধনসম্পদ প্রাণরক্ষার মাধ্যম, আর সন্তান বংশরক্ষার মাধ্যম। সন্তান আল্লাহ তাআলার বিশেষ নেয়ামত। বৃদ্ধকালে সন্তানই হয় মা-বাবার আল্লাহ ছাড়া একমাত্র ভরসা। সন্তানের প্রতি মা-বাবার কী করণীয় তার কতিপয় নিচে তুলে ধরা হলো :
** জন্মের পূর্বে :
মায়ের জন্য একজন সৎ ও চরিত্রবান বাবা, আর বাবা হলে একজন নেক্কার মা নির্বাচন করা। উভয়ের পারস্পরিক সৌহার্দ-সম্প্রীতির মিলবিন্যাসে থাকবে ধর্মীয় আচার-ব্যবহারের পূর্ণ প্রয়োগ। স্বামী হিসেবে স্ত্রীর অধিকার এবং স্ত্রী হিসবে স্বামীর অধিকারগুলো গুরুত্বের সাথে আদায় করা একান্ত কর্তব্য। এর মধ্যদিয়ে মহান আল্লাহ দয়া-অনুকম্পায় সন্তান দান করলে, যথাযথ মর্যাদায় বরণ করে তার জন্য নির্ণয় করতে হবে ভবিষ্যৎ পন্থা।
** জন্মের পর :
আযান দেয়া: সন্তান দুনিয়াতে আসার পর গোসল দিয়ে পরিষ্কার করে তার ডান কানে আযান দেয়া, তা ছেলে হোক বা মেয়ে হোক। এটি মা-বাবার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। শিশুর কানে সর্বপ্রথম আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের আওয়াজ পৌঁছে দেয়া এবং ওত পেতে থাকা শয়তান যাতে তার কোন ক্ষতি না করতে পারে। হাদিসে এসেছে, সাইয়িদুনা হযরত আবূ রাফে রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত-তিনি বলেন, “আমি রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হাসান ইবনে আলীর কানে আযান দিতে দেখেছি।” [সুনান আবূ দাউদ:৫১০৫]
**সুন্দর নাম নির্ণয়:
নামের মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে। দুনিয়ার এ নামেই পরকালে তাকে ডাকা হবে। এ নামের প্রভাব পড়ে বংশের মধ্যে। ফলে মাতা-পিতার কর্তব্য হলো তার সন্তানের একটি অর্থবহ নাম রাখা। মহানবী (সা.) অর্থবহ নয় এমন অনেক নাম পরিবর্তন করেছেন। [সহিহ বুখারি, মিশকাত পৃষ্ঠা-৪০৯।]
***আক্বিকা করা:
ইসলামি সংস্কৃতির অন্যতম বিষয় হলো সন্তানের আকীকা করা। ছেলের পক্ষ থেকে ২টি ছাগল এবং মেয়ের পক্ষ থেকে ১টি ছাগল আল্লাহর নামে যবেহ করা।
হাদীসে এসেছে, সাইয়িদুনা হযরত সামুরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “সকল নবজাতক তার আক্বিকার সাথে আবদ্ধ। জন্মের সপ্তম দিন তার পক্ষ থেকে জবেহ করা হবে। ঐ দিন তার নাম রাখা হবে। আর তার মাথার চুল কামানো হবে।” [সুনান আবূ দাউদ: ২৮৩৮]
**সদকাহ করা:
সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে হোক সপ্তম দিবসে চুল কাটা এবং চুল পরিমাণ রৌপ্য সদকাহ করা সুন্নাত। সাইয়িদুনা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, “রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহুর পক্ষ থেকে ১টি বকরী আকীকা দিয়েছেন এবং বলেছেন, হে ফাতেমা ! তার মাথা মু-ন কর এবং চুল পরিমাণ রৌপ্য সদকাহ কর।” [সুনান আত-তিরমিযী, হদিস নং-১৫১৯] এছাড়া রসুলে আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম “শিশুদেরকে খেজুর দিয়ে তাহনীক এবং বরকতের জন্য দো‘আ করতেন।” [সহিহ বুখারি, হদিস নং-৩৯০৯ ; মুসলিম, হদিস নং-২১৪৬]
**খাতনা করা:
ছেলেদের খাতনা করানো একটি অন্যতম সুন্নাত। হাদীসে এসেছে, জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান এবং হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুমার সপ্তম দিবসে আকীকা এবং খাতনা করিয়েছেন।” [আল-মু‘জামুল আওসাত, হদিস নং-৬৭০৮]
***কুরআন শিক্ষা দান:
ছোট বেলা থেকেই সন্তানকে কুরআন শিক্ষা দিতে হবে। কুরআন শিক্ষা দেয়ার চেয়ে উত্তম কাজ আর নেই। সাইয়িদুনা হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ, “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়।’’ [সহিহ বুখারি, হদিস নং-৫০২৭]
হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “তোমরা তোমাদের সন্তানদের তিনটি বিষয় শিক্ষা দাও। তন্মধ্যে রয়েছে তাদেরকে কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা ও কুরআনের জ্ঞান দাও।” [জামিউল কাবীর]
শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া: সন্তানদের আচরণ শিক্ষা দেয়া পিতামাতার উপর দায়িত্ব ও কর্তব্যের অন্তর্ভূক্ত। লুকমান আলাইহিস সালাম তার সন্তানকে বললেন, ‘আর তুমি মানুষের দিক থেকে তোমার মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। আর ভূ-পৃষ্ঠে দম্ভভরে চলাফেরা করো না; নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক, অহংকারীকে পছন্দ করেন না। আর তোমার চলার ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর, তোমার আওয়াজ নীচু কর; নিশ্চয় সবচাইতে নিকৃষ্ট আওয়াজ হল গাধার আওয়াজ।” [সূরা লুকমান, ১৮-১৯।]
***ইবাদতের প্রশিক্ষণ:
মাতা-পিতার অন্যতম দায়িত্ব হলো সন্তানকে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নামাজ, রোজা, কোরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল ইত্যাদি ইবাদতে অভ্যস্ত করা। তাছাড়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, অপরকে সালাম দেওয়া এবং সুন্নত তরিকা মোতাবেক চলার প্রশিক্ষণ দেওয়া।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, “যখন তোমাদের সন্তানের বয়স সাত বছর হয়, তখন নামাজ পড়ার তাগিদ দাও এবং যখন দশ বছর বয়সে উপনীত হয় তখন নামাজ পড়ার জন্য মৃদু প্রহার কর এবং তাদের বিছানায় ভিন্নতা আনো।” [আবু দাউদ, মিশকাত পৃ. ৫৮।]
মমতা ও স্নেহ-ভালবাসার চর্চা: সন্তানদেরকে স্নেহ করা এবং তাদেরকে আন্তরিকভাবে ভালবাসতে হবে। সাইয়িদুনা হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান ইবনে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে চুম্বন দিলেন এবং আদর করলেন। সে সময় আকরা ইবনে হাবিস রাদিয়াল্লাহু আনহুও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলতে লাগলেন, আমারতো দশটি সন্তান কিন্তু আমিতো কখনো আমার সন্তানদেরকে আদর স্নেহ করিনি। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে তাকালেন এবং বললেন, যে অন্যের প্রতি রহম করে না আল্লাহও তার প্রতি রহম করেন না।” [সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৫৯৯৭]
**সক্ষম করে তোলা:
সন্তানদেরকে প্রাপ্ত বয়স্ক পর্যন্ত লালন-পালন করতে হবে এবং তাদের জন্য প্রয়োজনীয় খরচ করতে হবে। উম্মে সালামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম আবূ সালামার সন্তানদের জন্য আমি যদি খরচ করি এতে কি আমার জন্য প্রতিদান রয়েছে? নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ যতদিন তুমি খরচ করবে ততদিন তোমার জন্য প্রতিদান থাকবে। [সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৫৩৬৯।] তাদেরকে এমনভাবে সক্ষম করে গড়ে তোলা, তারা যেন উপার্জন করার মত যোগ্যতা অর্জন করতে পারে।
সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে এভাবে বলেছেন- “তোমাদের সন্তান সন্ততিদেরকে সক্ষম ও সাবলম্বি রেখে যাওয়া, তাদেরকে অভাবী ও মানুষের কাছে হাত পাতা অবস্থায় রেখে যাওয়ার চেয়ে উত্তম।” [সহিহ বুখারি, হাদিস নং-১২৯৫।]
মা-বাবাকে নিজেদের আচার ব্যবহার, চাল-চলন, কথা-বার্তা ইত্যাদির প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ, শিশুর জন্য মাতৃক্রোড় পাঠশালাতুল্য। সে মাতা-পিতার অনেক কিছু অনুকরণ ও অনুসরণ করে। সন্তানের সঙ্গে রাগ করা, চেঁচামেচি করা, গালমন্দ করা ইত্যাদি বৈধ নয়। আল্লাহর প্রিয় হাবিব সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বালক সাহাবি হযরত আবদুল্লাহ (রা.)’র সাথে খানা খাওয়ার সময় শিক্ষা দিয়েছেন, হে বালক! বিসমিল্লাহ পড়ো, কাছের থেকে খাও এবং ডান হাতে খাও।
**সন্তানের জন্য দোয়া:
মা-বাবা সন্তানকে আদব-কায়দা ও সুশিক্ষা দিলেই যথেষ্ট হবে না, তাদের জন্য মহান প্রভুর দরবারে দোয়াও করতে হবে। অনুরূপ সন্তান লাভের জন্য দোয়া করতে হবে। জাকারিয়া আলাইহিস সালাম এভাবে দোয়া করেছেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আপনার পক্ষ থেকে আমাকে সৎ বংশধর দান করুন, অবশ্যই আপনি দোয়া শ্রবণকারী।’ [সুরা আলে ইমরান, আয়াত-৩৮।]
বিয়ের ব্যবস্থা করা: সন্তানসন্ততির মা-বাবার আরেকটি করণীয় হলো- তাদের উপযুক্ত সময়ে সুন্নাহ পদ্ধতিতে বিয়ের ব্যবস্থা করা। নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনটি কাজ দ্রুত করতে বলেছেন ১. ওয়াক্ত হলে নামাজ পড়া, ২. ছেলে-মেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হলে বিয়ের ব্যবস্থা করা, ৩. জানাজা উপস্থিত হলে জানাজা পড়া। [তিরমিজি ও মিশকাত]
আমাদের ইহজগত অত্যন্ত ক্ষীণ। কেউ স্থায়ী নই। তাই, আমাদের অবর্তমানে মহান আল্লাহর সাজানো অপরূপ এ বসুধার সৌন্দর্য ধরে রেখে আমাদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব এবং পরপারে আমাদের চিরশান্তির বুনিয়াদ গড়তে সন্তানসন্ততির প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখা প্রয়োজন।
মুফতি বিলাল আহমদ চৌধুরী
সভাপতি
হানাফী ফিকহী পরিষদ হবিগঞ্জ।