04/22/2021
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
আজ ০৩ রমজান ১৪৪২ হিজরি:
নবি নন্দিনী খাতুন-ই জান্নাত মা ফাতিমাতুয্ যাহরা রাদ্বিআল্লাহু তা’আলা আনহা’র ওফাত দিবস।
নবি নন্দিনী খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমা (রা.):
নবি নন্দিনী খাতুনে জান্নাত হযরত মা ফাতিমাতুয্ যাহরা (রা.)- বিশ্বজগতে এক মহা বিস্ময়ের নাম। জগতপ্রভূ মহান রাব্বুল আলামিনের হাবিব হযরত আহমদ মোজতবা মোহাম্মদ মোস্তফা (দ.)’র আদরের; অতি আদরের কন্যা। তাঁর পরিচয় এখানেই শেষ নয়! তিনি ছিলেন হযরত আলী (রা.)’র স্ত্রী এবং নবি নাতি হাসনাইন তথা হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসাইন (রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা)’র জননী। সারকথায় তিনি এমন এক মহীয়সী নারী, যাঁর সাথে কারও তুলনার চিন্তা করা তো দূর, প্রশংসা করতে করতে ক্লান্তি আসলেও যেন তৃপ্তি আসেনা। এত প্রশংসায়ও যেন নিতান্তই কম! নবিবরের আদরের কন্যা; চোখের জ্যোতি। চাট্টিখানি কথা! একজন নীতিবান নারীর জন্য তিনি সর্বোত্তম আদর্শ। নবিবর তাঁকে তিলে তিলে সঞ্চিত ধনরাশির মতই গড়ে তুলেছেন। তাঁর ইলম (জ্ঞান), আমল (জ্ঞানের অনুশীলন), খোদাভীতি, পবিত্রতা ও ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছিল দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ আল্লাহর হাবিব (দ.) এবং দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নারী মা খাদিজাতুল কোবরা (রা.)’র প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। তাই তো তিনি শৈশব থেকেই গড়ে উঠেছিলেন খোদার একনিষ্ঠ ভক্ত এবং সমাজের জন্য এক আদর্শ নারী হিসেবে। তিনি তাঁর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের দেওয়া বিধান কুরআন মতে, বাবার দেখানো পথ অনুসারে কাজ করে গিয়েছেন।
তিনি তাঁর গুণাবলির জন্যে নানা উপাধিতে ভূষিত। যেমন- যাহরা (উজ্জ্বল দীপ্তশীলা), আস্ সিদ্দীকা (ন্যায়পরায়ণা), আল্ মোবারকা (মহিমান্বিতা), আত্ তাহেরা (নিষ্পাপ), আজ্ জাকিয়া (সতী), আর্ রাদ্বিয়া (সন্তুষ্ট), আল্ মারদ্বিয়া (আল্লাহকে সন্তুষ্টকারিনী), আল্ বাতুল (সতী ও পবিত্র), আল্ আদরা (চির কুমারী) এবং আল্ মোহাদ্দাতা (যিনি পয়গাম্বর না হয়েও ফেরেশতার সঙ্গে কথা বলতেন)। স্নেহময়ী জননীর মতো আল্লাহর হাবিব (দ.)’র সেবা-যত্ন করা এবং বিপদের সময় তাঁর সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য তাঁর অন্য একটি নাম হল, ‘উম্মে আবিহা বা পিতার জননী’।
মানব ইতিহাসে কিছু সংখ্যক মহীয়সী মহিলাকে দেখা যায়, যাঁরা অসংখ্য পুণ্যবান পুরুষদের চেয়েও উচ্চ মর্যাদাবান। যাঁদের ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহর হাবিব (দ.) সুস্পষ্টভাবে বলেছেন। তাঁরা হলেন, হযরত ফাতিমা (রা.), হযরত খাদিজা (রা.), হযরত মরিয়ম (আ.) ও হযরত আসিয়া (রা.) [তিরমিজি শরিফ]। হযরত মা ফাতিমা (রা.) ইহকাল ও পরকালের নারীকুলের সর্দার এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের মধ্যে তিনিই সর্বাগ্রে জান্নাতে প্রবেশ করবেন বলে হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে। আল্লাহর হাবিব (দ.) একবার তাঁকে বলেছিলেন- “হে ফাতিমা, আল্লাহ তোমাকে নির্বাচিত করেছেন, তোমাকে পরিপূর্ণ জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় সজ্জিত করেছেন এবং তোমাকে বিশ্বের নারীকুলের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।”
আল্লাহর হাবিব (দ.) তাঁকে সকল যুগের নারীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে উল্লেখ করেছেন এবং আল্লাহর দরবারে তাঁর বিশেষ মর্যাদার কারণে তাঁকে দেখলে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করতেন।
তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন এমন এক যুগে যখন আরবরা নারীকে মনে করতো কেবল ভোগের সামগ্রী। এমনকি জাত্যাভিমানী আরবদের ঘরে কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করলে তারা সেই সন্তানকে জীবন্ত কবর দিতো। এমন পরিস্থিতিতে মহান আল্লাহ্ সর্বশেষ রাসূল ও সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের ঘরে এমন একজন কন্যাসন্তান পাঠিয়ে নারী জাতির জন্য অশেষ সম্মান ও মুক্তির ব্যবস্থা করে দেন। মুফাস্সিরদের অনেকের মতে, পবিত্র কুরআনের ১০৮ নম্বর সূরা- সূরা কাউসারের অন্যতম উদ্দেশ্য হল, ‘হযরত ফাতিমা (রা.)’। কাউসার বলতে একই সঙ্গে হাশরের ময়দানে হাউজে কাউসার ও নবীনন্দিনী হযরত ফাতিমা (রা.)-কে বুঝানো হয়েছে। আল্লাহর হাবিব (দ.)’র কোনো জীবিত পুত্রসন্তান না থাকায় মক্কার কাফের ও মুশরিকরা তাঁকে আবতার বা নির্বংশ বলে উপহাস করতো এবং তাঁর ওফাতের পরই তাঁর ধর্ম শেষ হয়ে যাবে বলে প্রচার করতো। কারণ তৎকালীন আরব ভূমিতে কন্যাসন্তান দিয়েও যে বংশ রক্ষা হতে পারে তেমনটা কেউ ভাবতেই পারতো না। ঠিক এমনই সময় মক্কায় নাজিল হয় সূরা কাউসার। এ সূরায় বলা হয়, ‘আমিই তো আপনাকে কাউসার দান করেছি। সুতরাং আপনি নিজ পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামায পড়ুন এবং কুরবানি দিন। নিশ্চয়ই যারা আপনার দুশমন তারাই তো আঁটকুড়ে।’
অর্থাৎ আল্লাহ সূরাটির মাধ্যমে তাঁর প্রিয় রাসূলকে জানিয়ে দেন, কোনো জীবিত পুত্রসন্তান না থাকলেও আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন তাঁর হাবিব (দ.)-কে এমন এক কন্যাসন্তান দান করেছেন যিনি ‘কাউসার বা আধিক্যের প্রতিমূর্তি’। যাঁর মাধ্যমে সর্বাধিক সংখ্যক উত্তম পুরুষ পৃথিবীতে আসবেন মানবজাতির কল্যান সাধন করতে। এছাড়া আল্লাহ রোজ হাশরের ময়দানেও তাঁর প্রিয় রাসূলকে হাউজে কাউসার দান করবেন, যার রহমতের পানি রাসূল (দ.) নিজ হাত মোবারক দ্বারা তাঁর উম্মতদের পান করাবেন। প্রকৃতপক্ষে আমরা দেখতে পাই, হযরত ফাতিমা (রা.)’র মাধ্যমে রাসূলে পাক (দঃ)’র পবিত্র বংশধারা আজও অব্যাহত রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। অন্যদিকে নির্মূল হয়ে গেছে আবু লাহাব ও আবু জাহেলদের বংশধর।
তাঁর প্রতি তাঁর পিতা আল্লাহর হাবিব (দ.)’র স্নেহ এতো অধিক ছিল যে, তিনি তাঁকে জীবনের অন্যতম বিষয় হিসেবে গণ্য করতেন। আল্লাহর হাবিব (দ.) বলেন, “যে ফাতিমাকে চেনে সে তো চিনেছেই। আর যে তাঁকে চেনে না তার জেনে রাখা উচিত, সে ফাতিমা মোহাম্মদের কন্যা। সে আমার দেহের অংশ, আমার হৃদয়, আমার অন্তরাত্মা। সুতরাং যে তাঁকে সন্তুষ্ট করে সে আমাকে সন্তুষ্ট করে এবং যে আমাকে সন্তুষ্ট করে সে (বস্তুত) আল্লাহকেও সন্তুষ্ট করে। আর যে ফাতিমাকে কষ্ট দিয়েছে সে আমাকেই কষ্ট দিয়েছে। আর যে আমাকে কষ্ট দিয়েছে সে (বস্তুত) আল্লাহকেও কষ্ট দিয়েছে।” [কাশফুল গুম্মাহ্, খ- ২য়, পৃ: ২৪]
হযরত মা ফাতিমা (রা.)-কে পবিত্র এবং স্বর্গীয় ব্যক্তিদের মধ্যে গণ্য করে আল্লাহর হাবিব (দ.) বলেন, “ফাতিমাই সর্বপ্রথম বেহেশতে প্রবেশ করবেন।” তিনি আরও বলেন, “যখন ফাতিমা ইবাদতে দণ্ডায়মান হয় তখন পৃথিবীর বুকে নক্ষত্রসমূহের মতো তাঁর জ্যোতি আসমানের ফেরেশতাদের জন্য প্রজ্বলিত হয়ে উঠে। আর তখন মহান স্রষ্টা তাঁর ফেরেশতাদের বলেন, ‘হে আমার ফেরেশতাকুল, আমার বান্দা ফাতিমা আমার অন্যান্য বান্দাদের নেত্রী। তাঁর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ কর, দেখ সে আমার ইবাদতে দণ্ডায়মান এবং আমার ভয়ে তাঁর দেহ কম্পিত। সে মন দিয়ে আমার ইবাদতে মশগুল। তোমরা সাক্ষী থাক, আমি তাঁর অনুসারীদের জাহান্নামের অগ্নি থেকে রক্ষা করব’।”
এভাবে নবি নন্দিনী মা ফাতিমা (রা.)-এর প্রতি নবিবর (দ.) স্বীয় ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন এবং সাহাবায়ে কেরাম (রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম)’র সামনে এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপন করেছেন।
আল্লাহর হাবিব (দ.)’র সুন্নত অর্থাৎ তাঁর কথা ও কাজ এমনকি তাঁর নীরবতাও দীন ও শরিয়তের সনদ হিসেবে পরিগণিত। যা আল্লাহর কিতাবের পাশাপাশি কেয়ামত পর্যন্ত উম্মতের প্রতিটি কাজে কর্মে আদর্শ হিসেবে গণ্য হবে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলে হযরত মা ফাতিমা (রা.)’র আধ্যাত্মিক মকাম ও সুমহান মর্যাদা এবং তাঁর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের জীবন ইসলামের চলনরীতির সঙ্গে সংযুক্ত, সেই বিষয়টিও উপলব্ধি করা যায়।
এমতাবস্থায় ধীমান মাত্রই বুঝতে সক্ষম যে, আল্লাহর হাবিব (দ.)’র সঙ্গে হযরত মা ফাতিমা (রা.)’র সম্পর্ক শুধুই পিতা-কন্যার সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলনা বরং তা ছিল মুসলিম উম্মাহর ভবিষ্যৎ ইমামত বা নেতৃত্ব প্রদান বিষয়ে আল্লাহর নির্দেশাবলির সঙ্গে সম্পর্কিত।
আখেরি নবী (দ.)’র ওফাতে মুসলিম জাহানে এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সেই সময় ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও বাণীকে জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে অসম-সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন নবি নন্দিনী। তিনি তাঁর ওফাতের আগ পর্যন্ত আল্লাহর হাবিব (দ.)’র অসিয়ত প্রচার ও কীভাবে মুসলমানরা বিচ্যুতি ও বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা পাবে সে বাণী প্রচারে রত ছিলেন। মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ ও মুক্তির জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন তিনি।
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা বা সক্রিয় থাকার মধ্যেই তিনি খুঁজে পেতেন আনন্দ। তিনি তাঁর প্রদত্ত খুতবায় বলেছেন, “আল্লাহর সেবায় মশগুল হয়ে যে সন্তুষ্টি পাই তা আমাকে অন্য সব সন্তুষ্টি বা আনন্দ থেকে বিরত রাখে এবং সবসময় মহান আল্লাহর সুন্দর দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ রাখার প্রার্থনা ছাড়া আমার অন্য কোনো প্রত্যাশা নেই।”
তিনি তাঁর এক খুতবায় মানুষকে কুরআন আঁকড়ে ধরার কথা বলেছেন, “যখন রাতের অন্ধকারের মত তোমাদের দিকে ফিৎনা এগিয়ে আসবে। তখন তোমরা কুরআনকে আঁকড়ে ধরবে। যে ব্যক্তি কুরআনকে আঁকড়ে ধরবে (কুরআনকে অনুসরণ করবে) সে বেহেশতে গমন করবে, আর যে ব্যক্তি কুরআনকে বর্জন করবে, সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।”
তিনি মানুষকে কুরআনের বাণী স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, “যদি কেউ পবিত্র ইসলামের বিধান ব্যতিরেকে অন্য কোনো বিধানের অনুসরণ করে, তবে তা কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না এবং পরকালে তারা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” [সুরা আলে ইমরান: ৮৫]
মসজিদে নববীতে দেওয়া তাঁর ভাষণে তিনি মহান আল্লাহ্ তায়ালার অনন্ত ও অসীম নেয়ামত যা আমাদের সমগ্র অস্তিত্বকে পরিব্যাপ্ত করে রেখেছে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন এভাবে- “মহান আল্লাহর প্রদত্ত অফুরন্ত নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। তার প্রদত্ত করুণার শোকর গুজার করছি, যে অপরিসীম করুণা প্রারম্ভে দান করেছেন, আর সে সমস্ত ধারাবাহিক দয়া ও অনুগ্রহ যা সার্বক্ষণিকভাবে আমাদের ওপর বর্ষিত হচ্ছে, সে সমস্ত নেয়ামত যা গণনার ঊর্ধ্বে এবং যে নেয়ামতের ব্যাপকতা ও পরিধি এতোই অধিক যে, তার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা মানুষের সাধ্যাতীত।এ সমস্ত নেয়ামতের প্রান্তসীমা অনুধাবন করা মানুষের পক্ষে আদৌ সম্ভবপর নয়।”
তাঁর এই বক্তব্য আমাদের মাঝে আল্লাহর প্রতি শোকর গুজার হতে, আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করার অনুভূতিকে জাগ্রত করে এবং আল্লাহর পবিত্র সত্তার সামনে মাথা নত হতে শেখায়।
তিনি খুতবায় আরও বলেছিলেন, “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই এবং তাঁর কোন অংশীদার ও সমকক্ষ নেই। এটা এমনই এক সাক্ষ্য, যার অভ্যন্তরকে আল্লাহ্ ইখলাস নির্ধারণ করেছেন। (মুমিনদের) অন্তরসমূহ তাতে সম্পৃক্ত হয়েছে এবং তার প্রভাব চিন্তা ও চেতনায় প্রস্ফুটিত হয়।”
খাতুনে জান্নাত আরও বলেন, “পৃথিবীতে তিনটি জিনিস আমার খুবই প্রিয়। আল্লাহর পথে ব্যয়, রাসূলে খোদা (দ.)-এর চেহারা মোবারকের দিকে তাকানো এবং পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত। পবিত্র কুরআনের আয়াত শ্রবণ মুসলমানদের মুক্তির তীরে পৌঁছে দেয়।” তিনি তাঁর খুতবায় আরও বলেন, “রাসুল (দ.) যা কিছু উম্মতের জন্য রেখে গেছেন, তা হচ্ছে কুরআনে নাতিক ও কুরআনে সাদিক এবং সেটার অত্যুজ্জ্বল নূর ও জ্যোতি। এটা এমনই এক গ্রন্থ যেটার দলিলসমূহ হচ্ছে অকাট্য, অভ্যন্তর হচ্ছে সুস্পষ্ট, বহির্ভাগ হচ্ছে আলোকিত এবং সেটার অনুসারীরা হচ্ছে সম্মানিত। এটা এমনই এক মহাগ্রন্থ, যা তার বাহকদের বেহেশতের প্রতি আহ্বান এবং শ্রোতাদের মুক্তির পথে দিক নির্দেশনা প্রদান করে। এটা এমনই এক মহাগ্রন্থ, যা আল্লাহর অকাট্য দলিলাদির বাহক, এ গ্রন্থে আল্লাহর উপদেশাবলী পুনরাবৃত্তি এবং ওয়াজিবসমূহ তাফসিরের সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে। হারাম ঘোষণাকৃত বস্তু থেকে বিরত থাকার আদেশ দেয়া হয়েছে। এ পবিত্র গ্রন্থে আল্লাহর বিধান ও আহকাম সুস্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গরূপে বর্ণিত হয়েছে। এতে শিষ্টাচারের বিধান ও আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে বৈধ ঘোষিত বিষয়াবলী অত্যন্ত সুনিপুণভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে।”
নবি নন্দিনী হযরত ফাতিমাতুয্ যাহরা (রা.) প্রদত্ত খুতবায় প্রকাশ পায় ইসলামি আহকামের অন্তর্নিহিত রহস্য ও দর্শন। বিশেষত সর্বাপেক্ষা জটিল ও সূক্ষ্ম বিষয়সমূহ তথা তাওহিদ (আল্লাহর একত্ববাদ), মাবদা (উৎসমূল) ও মা‘য়াদ (পরকাল) সম্পর্কে তাঁর সুগভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার পরিচয় বহন করে। যা সত্য পথের অনুসারীদের জন্য মাইলফলক স্বরূপ।
তিনি যেরূপে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনকে ভালবাসতেন, অনুসরণ করতেন- তিনি চাইতেন আল্লাহর হাবিব (দ.)’র অনুসারীরাও যেন ঠিক একইভাবে অনুসরণ করেন। আল্লাহর হাবিব (দ.)’র ওফাতের পরও আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত না হন। মানুষের জন্য আল্লাহ্ প্রদত্ত জীবনবিধান সম্পর্কে জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, “আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন ইমানকে শিরক থেকে তোমাদের পরিশুদ্ধ থাকার জন্য নির্ধারণ করেছেন। ঔদ্ধত্য ও অহঙ্কার থেকে বিরত থাকার জন্য নামাযকে ওয়াজিব করেছেন। আত্মার পরিশুদ্ধি ও সম্পদের বরকতের জন্য যাকাত নির্ধারণ করেছেন। ইখলাস সুদৃঢ়করণের লক্ষ্যে রোযাকে ওয়াজিব করেছেন। ইসলামি বিধানকে শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে হজকে ওয়াজিব করেছেন। পরস্পরের মাঝে সংহতি বজায় রাখার জন্য ন্যায়পরায়ণতাকে নির্ধারণ করেছেন। মুসলিম উম্মাহর মাঝে সংহতি সৃষ্টির লক্ষ্যে আমাদের [আহলে বাইত (রা.)] অনুসরণকে আবশ্যক করেছেন। ইমামত ও আমাদের নেতৃত্বকে অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে নির্ধারণ করেছেন। ধৈর্য ও সংযতকে আল্লাহর পুরস্কারের মাধ্যম হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। সাধারণ মানুষের সংশোধনের জন্য সৎ কাজের প্রতি আদেশকে আবশ্যকীয় করেছেন। পিতামাতার প্রতি সদাচরণকে আল্লাহর ক্রোধ থেকে মুক্তির মাধ্যম হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। আয়ু ও সামর্থ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে আত্মীয়দের মাঝে সুসম্পর্ক বজায় রাখার বিধানকে আবশ্যক করেছেন। গুনাহ থেকে মুক্তির মাধ্যম হিসেবে মানত বা নজর পালনকে নির্ধারণ করেছেন। বেচাকেনায় ওজনে কম দেয়ার প্রবণতা প্রতিরোধের লক্ষ্যে ওজনে কম দেয়াকে হারাম ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ্ শিরককে হারাম ঘোষণা করেছেন, যাতে করে বান্দারা ইখলাসের সঙ্গে তার বন্দেগি করতে পারে। অতএব, তিনি যে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী সে অনুযায়ী তাকওয়া অবলম্বন কর। কখনো তার আদেশের অমান্য করবে না এবং চেষ্টা করবে যাতে মুসলমান অবস্থাতে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পার। ‘আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পূর্ণাঙ্গরূপে মেনে চল এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞার পথ অনুসরণ কর’ [সুরা আলে ইমরান: ১০২]। কেননা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই বান্দাদের মাঝে কেবলমাত্র জ্ঞানীরাই আল্লাহকে ভয় করে’ [সুরা ফাতির: ২৮]।”
আদর্শ সন্তান গঠনে মায়ের ভূমিকায়ও তিনি ছিলেন অনন্য। তিনি নিজ সন্তান, মুসলমানদের সর্দার ও বেহেশতি যুবকদের সর্দার হযরত ইমাম হাসান (রা.) ও হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)-কে যথাযোগ্য প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। উদাহরণ স্বরূপ একটি ছোট্ট ঘটনার অবতারণা হোক- হযরত ইমাম হাসান (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, “একবার শুক্রবার রাতে দেখলাম, আম্মাজান [মা ফাতিমা (রা.)] ইবাদতে মগ্ন। একটানা রুকু ও সেজদায় থাকতে থাকতে ভোরের আলো ফুটে উঠে। আমি শুনতে পেলাম তিনি মুমিন নারী ও পুরুষের জন্য অনেক দোয়া করলেন, কিন্তু নিজের জন্য কোনো দোয়াই করলেন না। আমি প্রশ্ন করলাম- আম্মাজান, আপনি কেন নিজের জন্য দোয়া করলেন না, যেভাবে অন্যরা দোয়া করে? তিনি জবাবে বললেন- ‘হে আমার পুত্র, আগে প্রতিবেশীর কথা ভাবতে হয়, এরপর নিজের ঘরের কথা’।”
নবিবর, রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত আহমদ মোজতবা মোহাম্মদ মোস্তফা (দ.)’র পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী তাঁর ওফাতের ছয় মাসের মধ্যেই ৩রা রমজান (প্রসিদ্ধ মত) তথা আজকের দিনে পবিত্র মক্কা নগরীতে বিশ্বজগতকে অনন্ত মাতমে ভরিয়ে রেখে ইসলামরূপ গগনের নারী রূপী এই অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র, নবি নন্দিনী খাতুনে জান্নাত হযরত মা ফাতিমাতুয্ যাহরা (রা.) ওফাত লাভ করেন। তাঁকে সমাহিত করা হয় পবিত্র জান্নাতুল বাকিতে।
সুপ্রিয় পাঠক, আমরা নিবন্ধের সীমান্তে উপনীত। উপরিউক্ত আলোকপাত যেমন চিরন্তন সত্য তেমনই আরেকটি তিক্ত সত্য-বাস্তবতা হল, মেরুদন্ডহীন বিধ্বস্ত একটা নারী সমাজকে; সমাজকে একটি বাসোপযোগী আদর্শিক সমাজে রূপদান করার মত একটি খোদা প্রদত্ত মডেল-আদর্শ তথা নবি নন্দিনীর সেই আদর্শ আমাদের সমাজে আজ অনুপস্থিত; চরম অবহেলিত! এমনকি নবি নন্দিনীর সেই নাম মোবারকও যেন আমরা আজ ভুলে যেতে বসেছি! তাঁর জীবন-দর্শন নিয়ে আলোচনা, চর্চা আজ হয়না বললেও বোধহয় অত্যুক্তি হবেনা। চলুন আজকের এই মহিমান্বিত দিনে সংকল্প করি, আমরা আমাদের এই ভগ্নপ্রায় সমাজে নবি নন্দিনীর জীবন-দর্শন আবারও জিইয়ে তুলব। নিজেদের মা-বোনদের সেই শিক্ষায় শিক্ষিত করে পুনরায় পরিবার তথা সমাজে সেই সোনালী আভা ফুটিয়ে তোলায় সচেষ্ট হব। মহান রাব্বুল আলামিন আহলে বাইতে রাসূল (দ.) বিশেষত নবি নন্দিনীর উসিলায় আমাদের এই ফরিয়াদ কবুল করুন। আমিন।