26/11/2024
ইতিহাসের পাতায় অভিনেতা
🌷 কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। 🥀🥀
যুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা পেরিয়ে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর কয়েক দশক জুড়ে বাংলার নাটক ও চলচ্চিত্রে যে স্বর্ণযুগের সূচনা হয়েছিল, তার সাক্ষী যাঁরা ছিলেন তাঁরা জানেন, তখন একঝাঁক শিল্পী গানে, কবিতায়, সাহিত্যে, নাটকে, চলচ্চিত্রে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো আবির্ভূত হয়েছিলেন। যাঁরা আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে আছেন। কালী বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য এক আশ্চর্য প্রতিভা।
কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বললেই মনে আসে ‘কেদার রায়’ নাটকের কার্ভালো, ‘বিসর্জন’-এর জয়সিংহ, ‘আরোগ্য নিকেতন’-এর শশী, ‘ক্ষুধা’র সদা কিংবা চলচ্চিত্রের গনশা (‘বরযাত্রী’), কাশিম (‘লৌহকপাট’), প্রিয়তোষ হেনরি বিশ্বাস (‘পরশপাথর’), বিমল (‘অযান্ত্রিক’), ওয়াংলু (‘নীল আকাশের নীচে’), হকার (‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’), ফণীভূষণ (‘তিনকন্যা/মণিহারা’), বানোয়ারী, (‘হাঁসুলীবাঁকের উপকথা’), বাদশা (‘বাদশা’)-র মতো আরও অনেক চরিত্রের কথা। এই সব চরিত্রের আড়ালে রয়ে গিয়েছেন সাম্যবাদী, দরদী, আত্মভোলা, চঞ্চলমতি মানুষ কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁকে আজও তেমন করে চেনা হয়নি বাঙালির।
সত্তর বছরে পা দিয়ে কালী বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দুই নাতনি শাওন আর সুদেষ্ণাকে একটি অঙ্গীকারপত্র লিখে দিয়েছিলেন। তাতে তিনি লিখেছিলেন, “আমি ওয়াদা করিতেছি যে আজ হইতে আর আমি জোরে কথা বলিব না। জোরে গাড়ী চালাইব না। জোরে হাঁটিব না। এক ভুল বারে বারে করিব না। লোককে চিনিতে ভুল করিব না। ভুঁড়ির প্রতি ঘৃণা জন্মাইব। তোমরা আমার আনন্দের উৎস। তোমাদের সকলের কাছে আমি ঋণী। এ ঋণের সুদ এ জন্মে পাবে। আসল পরের জন্মে দিব কথা দিলাম।” জীবনরসিক কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই অঙ্গীকারপত্রের মধ্যেই রয়েছে তাঁর পরিচয়।
১৯২০ সালের ২০ নভেম্বর কলকাতার কালীঘাটে জন্মেছিলেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর পরিবারের আদি নিবাস পূর্ববঙ্গের ঢাকা, বিক্রমপুর। তাঁর বয়স যখন দশ, তাঁর বাবা লেক মার্কেট অঞ্চলে একটি বাড়ি করে থাকতে শুরু করেন। ঠাকুরদা পুলিশে চাকরি করতেন। বাবা মণীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন আইনজীবী, রাশভারী রক্ষণশীল মানুষ। মা ভবানীদেবী। ছয় ভাই ও পাঁচ বোন নিয়ে বিরাট এক সংসারের দ্বিতীয় সন্তান কালী লন্ডন মিশনারিতে প্রাথমিক এবং সত্যভামা ইনস্টিটিউশন থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। কালীবাবু নিজেই লিখে গিয়েছেন, “ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাপারে বাবা খুব কড়া ছিলেন। কিন্তু আমার ঝোঁক পড়াশোনার থেকে বেশি ছিল খেলাধুলার দিকে।” স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে মস্ত খেলোয়াড় হবেন। বাবাকে লুকিয়ে খেলতে গিয়ে পুরস্কার জিতে বাড়ি ফিরেও বাবার হাতে মার খেয়েছেন অনেক বার। লিখেছেন, ‘‘আজ মনে হয়, বাবার এই শাসনের সঙ্গে সমানে মোকাবিলা করতে হয়েছে বলেই আমার চরিত্রে জিদটা বেশি, যে কোনও চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করতে পারি এক কথায়।” আরও লিখেছেন, “আর একটা ঝোঁক ছোটবেলা থেকেই আমার চরিত্রে ছিল, প্রকৃতিকে বেজায় ভালবাসতাম আমি। সঙ্গী মনে হত। ঝম্ঝম্ করে বৃষ্টি পড়ছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বাজ পড়ার শব্দ শুনছি কাছে-পিঠে কোথাও, আর তার মধ্যে হাঁটুজল ভেঙে হাঁটছি আমি। কখনও একা, কখনও দল বেঁধে। এত ভালো লাগত, যেন ভারি একটা মুক্তির স্বাদ পেতাম।”
১৯৩৯ থেকে ১৯৪০ সালে রিপন (আজকের সুরেন্দ্রনাথ) কলেজে ভর্তি হন ও সংস্কৃত পণ্ডিতমশায়ের বকুনির ভয়ে ঠিক করেন, পালি ভাষা শিখে গবেষণা করবেন। কিন্তু এরই মধ্যে মায়ের সঙ্গে ‘দরজা-বন্ধ বাক্স ঘোড়ার গাড়ি’তে চেপে মামার বাড়ি বাগবাজারে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে। কুমোরটুলিতে মাসির বাড়ির অনেক ভাইবোনের মধ্যে বড়দা নরেন বন্দ্যোপাধ্যায় আর মেজদা রমেন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর জীবনে বিশেষ প্রভাব ফেলতে শুরু করেছেন। বড়দা ছিলেন চৌকস খেলোয়াড়। তিনি তাঁকে টেনেছিলেন খেলাধুলোর দিকে আর মেজদা দিয়েছিলেন রাজনৈতিক দীক্ষা।
মাসির বাড়ি যাতায়াতের সূত্রেই বাগবাজার, কুমোরটুলি, শোভাবাজারের পুজোর সময় যাত্রা দেখা সম্ভব হয়েছিল তাঁর। লিখেছেন, ‘‘সে এক আশ্চর্য জগৎ। রাজা-রাণী, তলোয়ার, যুদ্ধ, কনসার্ট সব মিলিয়ে মুগ্ধ করে দিত আমাকে। সমস্ত মন দিয়ে নিবিষ্ট হয়ে যেতাম। এই নিবিষ্টতা কিন্তু আমার মধ্যে এখনও আছে।”
কালীবাবু অভিনয়ের আগে বা পরে কারও সঙ্গে কথা বলতেন না। অভিনীত চরিত্রটা তাঁকে গ্রাস করে নিত। এর সাক্ষী থেকেছেন তাঁর বহু সহশিল্পী ও কলাকুশলী। পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তীর মনে আছে, “আমি তখন অঞ্জন চৌধুরীর ‘গুরুদক্ষিণা’ ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করছি। একদিন শুটিং শুরুর আগে দেখা গেল মেকআপ রুমে কালীদা গম্ভীর হয়ে বসে। কারও সঙ্গে কথা বলছেন না। আমরা ভাবলাম হয়তো শরীর ভাল নেই।
অঞ্জনদাও চিন্তিত হয়ে পড়লেন, কারণ সে দিন খুব ইম্পর্ট্যান্ট সিনের শুটিং ছিল। আমরা ফ্লোরে সবাইকে বলে দিলাম কেউ যেন শট চলার সময় কথা না বলে। শট রেডি হতে আমি কালীদাকে নিয়ে এলাম ফ্লোরে। শট ও ডায়লগ বুঝিয়ে দিলাম। শট শুরু হল। দেখি একটার পর একটা শট অনায়াসে দিয়ে চলেছেন। কী অবাক করা অভিনয়! আমরা ভাবছি ভালয়-ভালয় শটগুলো শেষ করতে পারবেন তো কালীদা! দেখলাম, সব শটই ঠিকঠাক দিলেন। তার পর যেই শেষ শটটা হল, কালীদার সে কী অট্টহাসি! শিশুর মতো লাফাচ্ছেন আর বলছেন, ‘দেখলি, কেমন বোকা বানালুম সবাইকে। যদি সকাল থেকে তোদের সঙ্গে গল্প করে, ইয়ার্কি মেরে কাটাতাম, তা হলে কি এমন শট দিতে পারতুম? কখনই পারতুম না।’ আমরা হতভম্ব! এমন বিচিত্র অভিনেতা আমি জীবনে দেখিনি।”
কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনটাই ছিল বিচিত্র। কৈশোর ও যৌবনের দিনগুলোতে বাড়ি পালিয়ে দেখেছেন সিনেমা ‘কপালকুণ্ডলা’, কিন্তু মনে ধরেনি। শিশির ভাদুড়ীর ‘চাণক্য’ ছবির শুটিং দেখতে গিয়ে ভিড়ের দৃশ্যে ঢুকে পড়ে অভিনয় করে ফেলেছেন। স্কুলে থাকতেই নাটক করতে শুরু করেন। আবার হঠাৎই একদিন সেকালের দক্ষিণ কলকাতার শৌখিন অভিনেতা বিদ্যুৎ বসুর ডাকে ‘কেদার রায়’ নাটকে কার্ভালো-র চরিত্রে অভিনয় করে প্রথম রজনীতেই পুরস্কার পেলেন। তার পরই বন্ধুদের মধ্যে তাঁর নাম হয়ে গেল, ‘কার্ভালো কালী’। কিন্তু তখনও অভিনয় করার কথা তিনি চিন্তা করেননি। কারণ, যে দিকেই মন টানছে তাই নিয়েই মেতে উঠছেন। নাটক, ক্রিকেট ফুটবলের সঙ্গে বক্সিং, লাঠিখেলা, ছোরাখেলা, জিমন্যাস্টিক শেখায় যেমন আছেন, তেমনই বাঘাযতীনের মরদেহ নিয়ে বিরাট মিছিলে হাঁটতে-হাঁটতে বড় হয়ে স্বাধীনতার সৈনিক হওয়ার স্বপ্নও দেখছেন। ফুটবল খেলায় তিনি এতটাই ভাল ছিলেন যে, বিভিন্ন ক্লাব তাঁকে ভাড়া করে নিয়ে যেত খেলাতে। আর প্রায় সব ম্যাচের শেষে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার তিনিই পেতেন। পুরস্কার বিতরণ করতে এসে একবার বিস্মিত গোষ্ঠ পাল জিজ্ঞেস করেছিলেন কালী বন্দোপাধ্যায়কে, “আচ্ছা খোকা, বলো তো প্রকৃতই তুমি কোন ক্লাবের মেম্বার? আমার মনে হচ্ছে আজ নিয়ে এই বছরে অন্তত চারবার তোমাকে মেডেল দিলাম চারটে বিভিন্ন ক্লাবের মেম্বার হিসেবে! তা ছাড়া উপরি বেস্ট প্লেয়ার মেডেল।” কালী বন্দোপাধ্যায়ের বন্ধুরা তখন ধরেই নিয়েছিলেন যে, তিনি বড় হয়ে ময়দানের কোনও বড় দলের হয়ে খেলবেন।
কিন্তু হঠাৎ কালী বন্দোপাধ্যায়ের মন গিয়ে পড়ল অভিনয়ে। প্রশংসা পেয়ে কৈশোরে নাটক করার ইচ্ছেটা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠল। পাড়ার মাঠে স্টেজ তৈরি করে বন্ধুদের সঙ্গে চলতে লাগল বিভিন্ন রকম নাটকের অভিনয়। যৌবনে পা দিয়ে লেখা হয়ে গেল কিছু কবিতা। ‘ঝর্ণা’ নামে হাতে লেখা পত্রিকার জন্য কবিতা লিখলেন, “আম পাকে জাম পাকে দাদা তুমি কেন পাকো না?” সেই লাইন বন্ধুদের মুখে-মুখে ফিরতে লাগল ব্যঙ্গোক্তি হয়ে।
তখন যুদ্ধের কাল। সারা দেশে অস্থির অবস্থা। ফুটবল, নাটক কবিতা ছেড়ে এক বন্ধুর পরামর্শে যোগ দিলেন আর্মিতে। ট্রেনিং নিতে চলে গেলেন সুদূর পঞ্জাবে। “কিন্তু প্রবেশন শেষ হবার আগেই বাবা কলকাতা দপ্তরে হাঁটাহাঁটি করে ফিরিয়ে আনলেন আমাকে। স্বপ্ন ভেঙে চুরমার। চারপাশের অনিশ্চয়তা আর ভিতর থেকে কে যেন আমাকে ক্রমাগত ঠেলা দিয়ে চলেছে।” তাই আবার পালালেন। এ বার ওয়ারলেস হেড কোয়াটার্স, দিল্লি। আশা, পরে এয়ারফোর্সে যোগ দিয়ে আকাশে উড়বেন। কিন্তু একই সময় দিল্লির রাজপথ ’৪২-এর আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল। দেখলেন সাধারণ মানুষ হাসিমুখে জেলে ঢুকছে। “এই সময় মনে প্রশ্ন এল, যে ইংরেজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এতগুলো মানুষ মরছে, সেই জাতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যুদ্ধের ট্রেনিং নিচ্ছি আমি? কোনটা ঠিক?” আবার ফিরে এলেন কলকাতায়।
১৯৪৬ সালে কলকাতা জুড়ে শুরু হয়েছিল দাঙ্গা। সেই দাঙ্গা থামাতে অনেকের মতোই কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ও রাস্তায় নেমেছিলেন সক্রিয় ভাবে। এই সময়ে তাঁর কাছে হিরন্ময় সেন-এর ‘বার্মার পথে’ ছবিতে অভিনয় করার প্রস্তাব আসে। একটি ভিলেনের চরিত্র, নাম তুলসী। কিছু না ভেবে জেদের বশে অভিনয় করতে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। এই ভাবেই ‘ধাত্রীদেবতা’, ‘পদ্মাপ্রমত্তা নদী’, ‘অ্যায়সা কিঁউ’ ও ‘বিশ রোজ কে বাদ’, ‘তথাপি’ ছবিতে কাজ করেছিলেন আর্থিক কারণে।
কিন্তু তবু ভাল লাগছে না। বন্ধু অরুণের পরামর্শে শ্রীরঙ্গমে গিয়ে শিশির ভাদুড়ীর সঙ্গে দেখা করতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু দেখা হল না। শিশিরবাবুর ভাই বিশ্বনাথ ভাদুড়ী তাঁকে প্রথমে থিয়েটারে না আসার পরামর্শ দিলেও তাঁর নাছোড় মনোভাব দেখে মহলা দেখার অনুমতি দিয়েছিলেন। এই মহলায় উপস্থিত থাকতে-থাকতেই একদিন সুযোগ এল ‘তাইতো’, ‘সাজাহান’ নাটকে অভিনয় করার। নিয়মিত নাটক করার একটা ব্যবস্থা হয়েছিল কিছু দিনের জন্য। কিন্তু তা বন্ধ হয়ে যায় বিশ্বনাথ ভাদুড়ীর মৃত্যুতে।
যদিও থিয়েটার তখন বাসা বেঁধেছে তাঁর মাথায়। তাই নিজেরাই দল বানিয়ে নাটক করা শুরু করলেন। সেই সময় প্রচুর বাইরের বই পড়া আরম্ভ করেছেন। কিনেছেন হারমোনিয়াম, ভয়েস ট্রেনিং করছেন তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে। মিনার্ভা থিয়েটারে অভিনীত হল ‘কেদার রায়’ নাটক। যেখানে কার্ভালো চরিত্রে অভিনয় করলেন, যা তিনি আগেও করেছেন। সেই অভিনয়ের খ্যাতিই তাঁকে মহেন্দ্র গুপ্তর কাছাকাছি নিয়ে আসে। মহেন্দ্র গুপ্তর পরিচালনায় ‘শতবর্ষ আগে’, এর পর ‘টিপু সুলতান’, ‘স্বর্গ হতে বড়’ নাটকেও তিনি কাজ করেন। ‘টিপু সুলতান’ নাটকের পঞ্চাশ রজনীতে পুরস্কার হিসেবে সকলের সঙ্গে পেলেন একটি হাতঘড়ি। কিন্তু তার পরই একদিন স্টারে অভিনয় করতে যাবেন বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় ‘রশিদ আলি দিবস’-এর মিটিং দেখে সব ভুলে নেমে পড়লেন বাস থেকে। মিশে গেলেন অগণিত জনতার মিছিলে। নাটক করতে আর যাওয়া হল না। এর খেসারত হিসেবে জুটল মহেন্দ্র গুপ্তর বকুনি। একশো রজনীতে পুরস্কৃতের তালিকা থেকে বাদ পড়ল তাঁর নাম। কারণ জানতে চেয়ে হাজির হলেন মহেন্দ্র গুপ্তর সামনে। তিনি জানালেন, সেই দিনের অনুপস্থিতির শাস্তি হিসেবেই এই সিদ্ধান্ত। মেনে নিতে পারলেন না কালীবাবু। নাটক শুরুর আগেই মেকআপ তুলে বেরিয়ে পড়লেন রাস্তায়। মন খারাপ, ভাবছেন, “যারা নাটকে দামি দামি কথা সাজায়, রশিদ আলির ঘটনার গুরুত্ব তাদের কাছে নেই কেন?”
আসলে কালী বন্দ্যোপাধ্যায় তখন নিজের অজান্তেই ক্রমশ সরে আসছিলেন নিয়তিনির্দিষ্ট জীবনের দিকে। অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ ছবিটি তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র ছিলেন ছবির সংগীত পরিচালক, সহকারী সলিল চৌধুরী আর সজল রায়চৌধুরী ছিলেন পরিচালকের সহকারী। এঁদের সঙ্গে পরিচয় সূত্রেই আই পি টি এ-তে যোগ দেন তিনি।
দিশাহীন কালী বন্দোপাধ্যায়ের গণনাট্য সংঘের সঙ্গে যোগাযোগ তাঁর নোঙর-ছেঁড়া জীবনকে যেন একটা তীরে পৌঁছে দিল। গণনাট্য সংঘই তাঁকে দক্ষিণ কলকাতার অলিগলি থেকে জীবনের বিরাট এক রাজপথে এনে দাঁড় করাল। সেই রাজপথের জনতার ‘মুখরিত সখ্য’র আস্বাদই ক্রমশ তাঁর অভিনয়ের প্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়। নিজেকে অভিনেতা হিসেবে গড়ে তুলতে গ্যারি কুপার, গ্রেটা গার্বো, পল মুনি, রোনাল্ড কোলমান, লরেন্স অলিভিয়রের অভিনয় দেখছেন, মুগ্ধ হচ্ছেন। দু’বছরের মধ্যে তিনি তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়ে স্থায়ী কর্মী হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। স্বয়ং জ্যোতি বসু তাঁর নাম প্রস্তাব করেন পার্টির কাছে।
আই পি টি এ-তে যোগ দিয়ে কালী বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের পরিচালনায় সলিল চৌধুরীর লেখা ‘শান্তি চাই’ পথনাটিকা করেন, এ ছাড়াও করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মুক্তির উপায়’। কিন্তু তিনি লিখছেন, “সলিল চৌধুরীর লেখা ‘লেখক’ (জনান্তিকে) আই পি টি এ-তে আমার প্রথম নাটক।” ক্রমশ তিনি ‘নয়ানপুর’, ‘সংকেত’, ‘ভাঙাবন্দর’, ‘বিসর্জন’ ‘দলিল’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন। আলাপ হয়েছিল প্রগতিশীল শিল্পী ও কলাকুশলীদের সঙ্গে। আই পি টি এ-র ব্যস্ততার মধ্যেই তাঁর পরিচয় হয় বামপন্থী নেতা অবনী লাহিড়ীর বোন প্রীতির সঙ্গে। ১৯৫১ সালে দু’জনে বিয়ে করেন।
কিন্তু একটা সময় গণনাট্যর কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে অসুবিধে হচ্ছিল। ‘ব্যক্তিগত ও আন্দোলনের সংকট’ জড়িয়ে যাচ্ছিল। ’৫১তে জীবনের জটিল জায়গায় এসে দাঁড়ালেন তিনি। কারণ, আর্থিক অনটনে যেমন নিজের অস্তিত্ব রক্ষা কঠিন হয়ে উঠছিল, তেমনই আন্দোলনের কিছু অভিজ্ঞতাও প্রশ্ন আনছিল। এই সময় বন্ধু মনোরঞ্জন ঘোষ ‘বরযাত্রী’ ছবিতে গনশা চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। এই ছবির জনপ্রিয়তাই কালী বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাতারাতি তারকার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল।
১৯৫২ সালে তাঁর কন্যা তাপসীর জন্ম হয়। ৫২ সাল থেকেই তিনি সব দ্বিধা ঝেড়ে পেশাদার অভিনেতা হিসেবে বাংলা চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় করতে শুরু করেন। ‘জবানবন্দি’, ‘সিরাজদ্দৌলা’ ইত্যাদি চারটে ছবি মুক্তি পায় ওই বছরেই। সত্যেন বসুর ‘ভোর হয়ে এল’ মুক্তি পায় ১৯৫৩ সালে। আর পরের বছর তপন সিংহ তাঁকে নির্বাচন করেন তাঁর প্রথম ছবি ‘অঙ্কুশ’-এর জন্য। তার পর ‘টনসিল’। এরই মধ্যে অবশ্য ঋত্বিক ঘটকের ‘নাগরিক’ ছবির জন্য শুটিং করেছেন। বারীন সাহার ‘তেরো নদীর পারে’ ছবিতে কাজ করেছেন। অজয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেষ্টায় ‘রিক্সাওয়ালা’ ছবির কাজ শুরু হয়েছিল উৎপল দত্ত ও সলিল চৌধুরীর সঙ্গে। ছবির নায়কের ভূমিকায় কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। কাজ চলাকালীন, “সলিল হঠাৎ বিমল রায়ের কাছে ছবির হিন্দি ‘রাইটস’ দিল বিক্রি করে। কিছু দিনের মধ্যেই ‘দো বিঘা জমিন’ নামে মুক্তি পেল ‘রিক্সাওয়ালা’। ওরা টিম নিয়ে গেল রাশিয়া, আর সেই অবস্থায় আমাদের ছবি বন্ধ হয়ে গেল।” সত্যেন বসুর পরিচালনায় ‘রিক্সাওয়ালা’ ছবিটি পরে শেষ করা সম্ভব হয়েছিল এবং মুক্তি পেয়েছিল ২১ জুন ১৯৫৫।
১৯৫৬ সাল থেকে সংকটকাল কাটিয়ে কালীবাবু স্থিতু হন বাংলা নাটক ও সিনেমার নির্ভরযোগ্য চরিত্রাভিনেতা হিসেবে। একে-একে সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্বিক, তপন সিংহর ছবিতে কাজ করতে শুরু করেন। ‘অযান্ত্রিক’, ‘কত অজানারে’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘লৌহকপাট’, ‘ডাকহরকরা’, ‘পরশপাথর’ ছবিতে কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল।
অন্য দিকে পেশাদার মঞ্চ থেকেও এসেছিল ডাক। ‘আরোগ্য নিকেতন’ নাটকে শশী কম্পাউন্ডার ও ‘ক্ষুধা’ নাটকে সদার চরিত্রে তাঁর অভিনয় আজ মিথের আকার নিয়েছে। সমসাময়িক সাংবাদিক সেবাব্রত গুপ্তর মতে, “বোম্বের চরিত্রশিল্পী বলরাজ সাহনি অভিনয়ের গুণে স্টারের মর্যাদা পেয়েছিলেন। কলকাতার তেমনই একজন অভিনেতা স্টার কালী বন্দ্যোপাধ্যায়।” উত্তমকুমারকেও বলতে শোনা যায়, “সৌমিত্র নয়, আমার আসল প্রতিদ্বন্দ্বী কালী বন্দ্যোপাধ্যায়।”
কালী বন্দ্যোপাধ্যায় মুম্বই গিয়ে হিন্দি ছবিতেও কাজ করেছেন সত্তরের দশকে। নবেন্দু ঘোষের ‘ডগদরবাবু’, হৃষীকেশ মুখ্যোপাধ্যায়ের ‘বাবর্চি’, ‘সব সে বড়া সুখ’। কিন্তু সেখানে তাঁর মন টেকেনি। ফিরে এসেছিলেন কলকাতায়। সক্রিয় বামপন্থী রাজনীতি থেকে সরে এলেও তাঁর মানসিকতার বদল ঘটেনি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মতে, “কালী ব্যানার্জি বাংলা সিনেমার প্রথম ব্যতিক্রমী নায়ক। সত্যিকারের মানুষকে অভিনয়ের মধ্যে ব্যক্ত করার আগ্রহটা সব অভিনেতার থাকে না।”
কালী বন্দ্যোপাধ্যায় সব মিলিয়ে প্রায় দেড়শো ছবিতে কাজ করেছেন। নাটক করেছেন একত্রিশটি। তাঁর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে অভিনেতা, পরিচালকেরা অবাক হয়েছেন চরিত্রের জন্য তাঁর মনঃসংযোগ ও অভিনয় কুশলতা দেখে। ‘বাদশা’ ছবির শিশুশিল্পী শংকর ঘোষ জানালেন এমনই একটা পর্যবেক্ষণের কথা, “আমি ছোটবেলা থেকেই আমার বাবাকে ‘বাপি’ বলে ডাকতাম। ফ্লোরে কালীজেঠু সেটা খেয়াল করে পরিচালক বিভূতি লাহাকে বলেছিলেন, ‘শঙ্কর যেন আমাকে ছবিতে ‘বাবুজি’, ‘পিতাজি’ এই সব বলে না ডাকে। যদি বাপি বলে ডাকে, খুব সুন্দর শুনতে লাগবে। বিভূতি লাহা সেটা শুনে বললেন, ‘তাই হোক’। সারা ছবিতে আমি কালীজেঠুকে বাপি বলেই ডেকেছি। সেই মারাত্মক দৃশ্য, যেখানে অসিতবরণ আমাকে নিতে এসেছেন আর কালীজেঠু আমাকে তাঁর হাতে তুলে দিচ্ছেন, তখন আমি বলছি, ‘বাপি, তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছ?’ এই ‘বাপি’ বলায় সংলাপটা এত ন্যাচারাল হয়েছিল যে, হলে দর্শকদের খুব আপ্লুত করত।”
মাধবী মুখ্যোপাধ্যায় মনে করেন, “কালী বন্দ্যোপাধ্যায় একজন জাতশিল্পী ছিলেন। মঞ্চ আর সিনেমা দু’ধরনের অভিনয়েই তিনি ছিলেন অতি দক্ষ। শিল্পীসুলভ এক ধরনের পাগলামি ওঁকে তাড়িয়ে বেড়াত।” ঋত্বিকপত্নী সুরমা ঘটকের অনুভবে “তাঁকে ছাড়া ‘অযান্ত্রিক’, ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ আর ‘কত অজানারে’র মতো ছবি সম্ভবই হত না।” তপন সিংহর অভিমত, “দুঃখ এটাই যে, ওঁকে ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারল না টালিগঞ্জ।” মৃণাল সেনেরা যেখানে আড্ডা দিতেন, সেখানে “নিত্যনতুন বন্ধু জুটত এবং আমরা সবাই যেন তখন একটা বড় রকমের হইচই বাঁধিয়ে দেওয়ার জন্য লুকিয়ে আছি। একটা ‘বিপ্লব’, অবশ্যই সংস্কৃতির আসরে।” মৃণাল সেনের বাবা ওঁর ছেলে ও তার বন্ধুদের এই উদ্দীপনা দেখে নাম দিয়েছিলেন ‘দেবদূত’। মৃণাল সেনের মতে, “সেই দেবদূতদেরই একজন কালী ব্যানার্জি।”
সময় বদলাচ্ছিল, বয়স বাড়ছিল। কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের চারপাশটা বদলে যাচ্ছিল। উত্তমকুমারের মৃত্যুর পর আশির দশক থেকে বাংলা ছবির মান ক্রমশ নিম্নগামী হয়ে যেতে থাকে। ভাল চরিত্রের অভাবের কথা বারে বারে প্রিয়জনদের বলতেন তিনি। তাঁর মনে হত, তখনও তাঁর অনেক কিছু দেওয়া বাকি।
জীবনের শ্রেষ্ঠ চরিত্রে তখনও কাজ করা হয়নি। সারা জীবন জুড়ে প্রচণ্ড সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অভিনয়শিল্পের যে শিখরে তিনি পৌঁছেছিলেন, সেই শিখর ছোঁয়া চরিত্র তাঁকে দেওয়ার মতো তেমন কোনও পরিচালকও আর ছিলেন না তাঁর চারপাশে।
আর্থিক কারণে এমন সব চরিত্রে তাঁকে অভিনয় করতে হয়েছে এই সময়, যা দেখে অনেকেরই দুঃখ হয়েছে। কিন্তু পেশাদার অভিনেতা হয়ে থেমে যেতে রাজি হননি জীবনের শেষ দিন অবধি। জীবনের শেষ ছবি ‘তান্ত্রিক’-এ অভিনয় করতে গিয়ে বৃষ্টিতে খুব ভিজতে হয়েছিল। তা থেকেই তিনি ব্রঙ্কো-নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও ৫ জুলাই ১৯৯৩ তাঁর মৃত্যু হয়।
তথ্যসূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ সংখ্যা, লিখেছেন সুদেষ্ণা বসু।