অনুভব হিমাদ্রি

  • Home
  • অনুভব হিমাদ্রি

অনুভব হিমাদ্রি Contact information, map and directions, contact form, opening hours, services, ratings, photos, videos and announcements from অনুভব হিমাদ্রি, Digital creator, .

🌷 বাংলা এবং বাঙালির ইতিহাস।
🌷 প্রবন্ধ এবং বাংলা সাহিত্য।
🌷 কবিতা এবং ছোটগল্প।
🌷 ভ্রমণের অভিজ্ঞতা।

YouTube Channel Link 👇
https://youtube.com/.of.bengal?si=z5t-rR3ebOPoYHCZ

🌷 বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী: শ্রদ্ধার্ঘ্য 🌷🥀অঞ্জন চৌধুরী বাংলা চলচ্চিত্রের এক অনন্য প্রতিভা, যিনি...
26/11/2024

🌷 বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী: শ্রদ্ধার্ঘ্য 🌷🥀

অঞ্জন চৌধুরী বাংলা চলচ্চিত্রের এক অনন্য প্রতিভা, যিনি ৮০ থেকে ৯০-এর দশকে বাণিজ্যিক ছবির মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্র জগতে এক নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর পরিচালিত সিনেমাগুলোতে পারিবারিক ও সামাজিক গল্পের সহজাত উপস্থাপনা এবং বাঙালি জীবনের প্রতিচ্ছবি মেলে ধরা হয়েছে।

🌷 শৈশব ও চলচ্চিত্র জীবনের শুরু 🥀

অঞ্জন চৌধুরীর জন্ম বাংলাদেশের যশোর জেলায়। দেশভাগের পর তাঁর পরিবার কলকাতায় চলে আসে। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল এবং তিনি চুমকি নামে একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকার সম্পাদনার কাজ করতেন। সেখান থেকেই তাঁর পরিচয় হয় অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিকের সঙ্গে। রঞ্জিত মল্লিকের হাত ধরেই তিনি প্রথম চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন চিত্রনাট্যকার হিসেবে।

১৯৮৪ সালে অঞ্জন চৌধুরী পরিচালিত প্রথম ছবি "শত্রু" মুক্তি পায়। এটি বাংলা চলচ্চিত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। উত্তম কুমারের অকালপ্রয়াণে যখন বাংলা ইন্ডাস্ট্রি সঙ্কটে ছিল, তখন "শত্রু" আবার বাংলা সিনেমাকে সাফল্যের পথে ফিরিয়ে আনে। এক সৎ পুলিশ অফিসারের চরিত্রে রঞ্জিত মল্লিকের অভিনয় এবং শিশু শিল্পী তপুর অভিনয় দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। ছবিটি সেই সময়ের বাংলা চলচ্চিত্র জগতে এক কাল্ট ক্লাসিক হিসেবে স্থান করে নেয়।

🌷 সাফল্যের ধারাবাহিকতা 🥀
"শত্রু"-এর পর অঞ্জন চৌধুরী একের পর এক হিট ছবি উপহার দেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে "গুরুদক্ষিণা", "বড় বৌ", "মেজ বৌ", "ছোট বৌ", "মুখ্যমন্ত্রী", "ইশ্বর পরমেশ্বর", এবং "বাঙালি বাবু"। এসব ছবিতে তিনি সাধারণ মানুষের জীবন, পারিবারিক টানাপোড়েন, এবং সামাজিক বাস্তবতাকে চিত্রিত করেছেন।

🌷 পরিচালনার বিশেষত্ব 🥀
অঞ্জন চৌধুরীর ছবির মূল বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর গল্পের সহজ সরলতা। তাঁর ছবির চরিত্ররা সাধারণ মানুষের মতন ছিল—পাশের বাড়ির ছেলে-মেয়ে, মায়েরা যেন বাঙালি পরিবারের প্রতিচ্ছবি। গ্রামীণ ও শহরতলির জীবনের গল্প তিনি অত্যন্ত সাবলীলভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তাঁর ছবির সংলাপ, দৃশ্য এবং আবেগ সব ধরনের দর্শকের মন জয় করত।

🌷 প্রভাব ও জনপ্রিয়তা 🥀
অঞ্জন চৌধুরীর ছবির জনপ্রিয়তা এতটাই ছিল যে গ্রাম বাংলার মানুষ তাঁর ছবি মুক্তির জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকত। একটি কথা প্রচলিত ছিল, তিনি ছবি মুক্তি দিতেন ধান কাটার পর, যখন মানুষের সময় ও অর্থ থাকত বিনোদনের জন্য। তাঁর ছবির জন্য সিনেমা হলগুলো হাউসফুল থাকত। তিনি শুধু একজন পরিচালকই ছিলেন না, বাংলা বাণিজ্যিক ছবির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরও হয়ে উঠেছিলেন।

🌷 বাংলা চলচ্চিত্রে অবদান 🥀
অঞ্জন চৌধুরীর ছবি বাংলা চলচ্চিত্রে এক নতুন ধারা এনেছিল। তিনি সাধারণ মানুষের গল্প তুলে ধরার মাধ্যমে সিনেমাকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলেন। তাঁর হাত ধরেই বাংলা সিনেমা গ্রাম-মফস্বল এবং শহরতলির দর্শকদের সঙ্গে গভীর সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছিল।

🌷 উপসংহার 🥀
অঞ্জন চৌধুরী সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেনের মতো বাংলা চলচ্চিত্রের এক স্তম্ভ। বাণিজ্যিক ছবিতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।

তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া।
✍️ অনুভব হিমাদ্রি।

🌷 প্রসঙ্গ: রাজেশ খান্না এবং অমিতাভ বচ্চনের মধ্যে সংঘাত। 🌷🥀70 এর দশক ছিল সেই যুগ যখন রাজেশ খান্না সিনেমা জগতে একটি শক্তিশ...
26/11/2024

🌷 প্রসঙ্গ: রাজেশ খান্না এবং অমিতাভ বচ্চনের মধ্যে সংঘাত। 🌷🥀

70 এর দশক ছিল সেই যুগ যখন রাজেশ খান্না সিনেমা জগতে একটি শক্তিশালী নাম। পরিচালকরা তাদের ছবিতে তাকে কাস্ট করতে মরিয়া ছিলেন। আর অমিতাভ বচ্চনের জন্য এই সময়টা ছিল একজন স্ট্যাগলিং আর্টিস্ট। ইন্ডাস্ট্রিতে এন্ট্রির পরেও তিনি কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাননি। তবে 'নমক হারাম'-এর পর দুই তারকার ভাগ্য বদলে যায় । এবং এটিই একে অপরের সঙ্গে তাদের শেষ ছবি।

1973 সালে মুক্তিপ্রাপ্ত 'নমক হারাম'-এর শুটিংয়ের সময়, রাজেশ খান্না একজন বড় সুপারস্টার এবং অমিতাভ বচ্চন ছিলেন একজন স্ট্রাগল করা অভিনেতা। এর আগে অবশ্য তার 'জাঞ্জির' ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল, যা অবশ্যই অমিতাভের ক্যারিয়ারকে বেশ কিছুটা এগিয়ে নিয়ে গেছিলো।

হৃষিকেশ মুখার্জি যখন 'নমক হারাম' ছবিটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখন রাজেশ খান্নার কোনও ডেট খালি ছিল না এবং অমিতাভ বচ্চনের কাছে সময় অর সময় ছিল। এমন পরিস্থিতিতে অমিতাভ বচ্চনের অনেক একার দৃশ্যের শুটিং করেছিলেন পরিচালক। কিন্তু যখন ছবিটির কিছু ক্লিপ পরিবেশকদের দেখানো হয়, তখন রাজেশ খান্নার চেয়ে অমিতাভ বচ্চনের বেশি দৃশ্য দেখে তারা ছবিটি মহান পরিচালক হৃষিকেশ মুখার্জির হওয়া সত্ত্বেও ছবিটি কিনতে মানা করে দেন।

ডিস্ট্রিবিউটাররা ,অমিতাভ বচ্চনের চেহারা নিয়ে মজা করেছেন। এমনকি তার লম্বা চুলকেও উপহাস করা হয়। কিন্তু ছবি মুক্তির পর বিগ বি-র এই স্টাইল স্টেটমেন্ট বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

'নমক হারাম' বক্স অফিসে ভালো সাড়া ফেলেছে। দুই অভিনেতাই ছবিতে তাদের সেরাটা দিয়েছিলেন। তবে শেষ অংশের শুটিং শেষ হওয়ার সময় তাদের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব নিশ্চিতভাবেই চলে এসেছিলো। আসলে, ছবির ক্লাইম্যাক্সে দেখা যাচ্ছে রাজেশ খান্নার চরিত্রের মৃত্যু। যাইহোক, এটি আসল ক্লাইম্যাক্স ছিল না। হৃষিকেশ মুখার্জি ছবির ক্লাইম্যাক্স আলাদা রেখেছিলেন, যেখানে অমিতাভ বচ্চনের চরিত্র মারা যায়। কিন্তু রাজেশ খান্না এটা পছন্দ করেননি।

রাজেশ খান্নার জোরাজুরিতে ক্লাইম্যাক্সের দৃশ্য পরিবর্তন করা হয়।

রাজেশ খান্নার অভিজ্ঞতা ছিল যে ক্লাইম্যাক্সে মারা যাওয়া চরিত্রের দিকে দর্শকরা বেশি মনোযোগ দেন। তবে তার জেদে ক্লাইম্যাক্স পরিবর্তন করা হয়। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অমিতাভ বচ্চন।

ছবিটি যখন মুক্তি পায় তখন অমিতাভের চরিত্রটি , দর্শকদের বেশি পছন্দ হয়েছিল। বিগ বি-র চরিত্রটি রাজেশ খান্নার ভূমিকাকে ছাপিয়েছে গেছিলো। বলা হয় যে তিনি তার তুলনায় অমিতাভ বচ্চনের স্টারডমের উত্থান পছন্দ করেননি, এবং তিনি অমিতাভ বচ্চনের সাথে আর কখনও কাজ করবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।





নিছক কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় নন, আড্ডার মধ্যমণি এক ছেলেমানুষের কথা বললেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ত্রী, স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়...
26/11/2024

নিছক কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় নন, আড্ডার মধ্যমণি এক ছেলেমানুষের কথা বললেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ত্রী, স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়।

প্রসঙ্গ : শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মধ্যে বন্ধুত্ব।

🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷🌷

ড্রিঙ্ক করার পরে বন্ধুর বউয়ের সঙ্গে একটু ফ্লার্ট তো অনেকেই করেন! তাতে আমি দোষের কিছু দেখি না, কিন্তু শক্তিকে অনেকটা খেয়েও তেমন কিছু করতে দেখিনি।

মদ্যপানের পরে সুনীলের বন্ধুদের মধ্যে নানা মজার ঘটনা ঘটত। এএইআই ক্লাবের আড্ডায় একবার কেউ একজন সুনীলকে বললেনও, শোনো, তুমি যদি স্বাতীকে ডিভোর্স করো, আমায় খবর দিও কিন্তু। সুনীল, বুদ্ধদেব গুহ, মতি নন্দী অনেককেই মেয়েদের সঙ্গে একটু-আধটু ফ্লার্ট করতে দেখেছি। আর শ্যামল (গঙ্গোপাধ্যায়) তো ইচ্ছে করে দুষ্টুমি করতেন, ‘স্বাতী তুমি কি আমায় একবারটি চুমু খেতে দেবে?’ বন্ধুদের মধ্যে এ সবই নির্দোষ মজা। শক্তির কিন্তু মেয়েদের নিয়ে এই ব্যাপারটা কখনও দেখিনি!

আমার বরং ওঁকে দেখে কেমন মায়া হতো! মায়েদের যেমন সবচেয়ে দুষ্টু ছেলেটার ওপরে বাড়তি স্নেহ থাকে। আমার মনে হয়, মদ খেলে সুনীল খানিকটা বেশি ‘হোল্ড’ করতে পারত। চট করে অতটা বেসামাল হতো না। হলেও চুপচাপ থাকত। শক্তি তুলনায় বেশি হইচই করতেন। হয়তো একটু বেশি তাড়াতাড়ি অনেকটা খেয়ে ফেললেন! তার পর কয়েক বার বললেন, ‘আমি শক্তি চট্টোপাধ্যায়!’ কিংবা হয়তো নিজেদের মধ্যে একটু গালাগাল করলেন। সুনীলকে দু’-একবার দেখেছি, এই সময়ে ওঁকে সামলাচ্ছে, ‘শক্তি, উঁ-হু এখানে কিন্তু এ সব কথাবার্তা হয় না।’ প্রথম প্রথম লোকটাকে নিয়ে আমার একটু জড়তা ছিল। শক্তিকে একটু ভয়-ভয়ও করত। কিন্তু ক্রমশ সে-সব কেটে গিয়েছিল। তখন মনে হতো, যাই একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিই, কয়েক বার দিয়েওছি! বলেছি, ‘সত্যি আপনারা পারেনও! কেন এত খান? কী যে করেন! ’

শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলতে তো কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় বা সুনীলের বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়— যা-ই হোক, আমার কাছে শুধুই কিছু সুখস্মৃতি। শক্তি আর শঙ্খ ঘোষের কবিতা পড়া আমার বিশেষ প্রিয়। শক্তির খোলা গলায় কবিতা পড়ার মধ্যে একটা নিজস্বতা ছিল। ‘ফুটপাথ বদল হয় মধ্যরাতে’ বা ‘অবনী বাড়ি আছো’ তো শক্তির সিগনেচার কবিতা। আমার কিন্তু ‘ওই বাঘটা’ও বড্ড প্রিয়...সেই যে ‘ভালবাসার বাঘ বেরোল বনে’! তবে কবিতার বাইরের মানুষটাও একটা আলাদা ছাপ ফেলেছিল।

সুনীলের পুরনো বন্ধুদের মধ্যে অনেকের সঙ্গেই পরে খানিক সুর কেটে গিয়েছে, বা কিছু অভিমান জন্মেছে! কিন্তু শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক বিশেষ বদলায়নি। হ্যাঁ, কত লোকে তো কত কথা রটায়। এর-ওর নাম করে এটা-সেটা বলে। শক্তির নাম করেও হয়তো কেউ সুনীলকে কখনও কিছু বলেছে। কিন্তু তার ফলে শক্তি-সুনীল সম্পর্কে শেষ দিন অবধি আমি তেমন কোনও বদল দেখিনি।

এখনও শক্তির কথা ভাবলেই আমার ওঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার শেষ দিনটার কথা মনে পড়ে! উনি তখন আনন্দবাজার থেকে রিটায়ার করেছেন। শান্তিনিকেতনে পড়াচ্ছেন। সে-দিনটায় বেশ সকাল-সকাল আমাদের শান্তিনিকেতনের বাড়িতে এসে হাজির। তা আমার মনে আছে, দু’বন্ধু তো যথারীতি রামের বোতল খুলে বসলেন। আমি বেশ রাগ করেছিলুম! আর শক্তি অমনি ‘অমন করিস না মা, আজ একটু খেতে দে না’ করে উঠলেন। মদ খেলে আমাকে ‘তুই’ বলতেন, ‘মা-মা’ করে ডাকতেন। কিন্তু সে-দিন মদ্যপানের আগেই শক্তি-সুনীলের কিছু কথাবার্তা হয়েছিল, যা আমার মনে থেকে গিয়েছে।

আমি তখন রান্নাবান্না দেখছি, ঘরের কাজ সামলাচ্ছি, আর মাঝেমধ্যে ওঁদের মাঝে এসে বসছি। তখন সুনীল সাহিত্য অ্যাকাডেমি নিয়ে ব্যস্ত, আনন্দবাজারের চাকরিও করছে। লেখালেখির চাপ খুবই! ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে তখন সুনীলের মধ্যে একটা দুশ্চিন্তা ছিল। তখন বোধহয় ‘কৃত্তিবাস’ বন্ধই ছিল, বা বিক্ষিপ্ত ভাবে বেরোচ্ছিল। পরে আমাদের বিলেতের বন্ধু ভাস্কর দত্ত ‘কৃত্তিবাস’-এর পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। সেই সময়ে কে ‘কৃত্তিবাস’টা দেখবেন, কে সময় দেবেন— কিছুই ঠিক করা যাচ্ছিল না। দুই বন্ধুর মধ্যে এ সব নিয়েই কথা হয়েছিল।

শক্তি ‘কৃত্তিবাস’-এর দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলেন। ‘আমি তো রিটায়ার করেছি। তুমি আমায় কৃত্তিবাসটা দিয়ে দাও।’ সুনীল এটা শুনে খুবই উৎসাহিত হয়েছিল। শক্তি বলছিলেন, ‘লেখা যে যার মতো দেবে, আমি নিজে বিজ্ঞাপন জোগাড় করে আনব!’ শক্তিই মালিক-সম্পাদক হবেন। সুনীল শুনে বলেছিল, ‘এ তো খুব ভাল কথা! সত্যিই আমি আর পারছি না। তুমি দেখলে নিশ্চিন্ত হতে পারি! কলকাতায় ফিরে বাকি কথা হবে।’

এ সবই আমার নিজের কানে শোনা! খুবই সিরিয়াসলি কথা বলছিলেন দু’জনেই। তখনও কেউ গ্লাস হাতে নেননি। তার আগেই কৃত্তিবাসের ব্যাপারটা ওঁরা ঠিক করে ফেলেন। দু’জনেই একমত হয়েছিলেন। কিন্তু কথা আর হয়নি। শক্তির আর কলকাতায় ফেরাও হয়নি। সে-রাতে আমরা কলকাতায় ফিরে যাই! আর তার পরের দিনই শক্তির চলে যাওয়ার খবরটা ছড়িয়ে পড়ে।

ওই দিনটাতেও শক্তিকে মৃদু বকুনি দিতে হয়েছিল। শক্তি এদেশি। কিন্তু মিষ্টি দু’চক্ষে দেখতে পারতেন না। বোয়াল-চিতল সব মাছ ভালবাসতেন। সে-দিনও বোয়াল মাছ রান্না হয়েছে শুনে খুব ভালবেসে খেতে চাইলেন। কিন্তু ভাত খেতে পারলেন না! কিছুতেই খেলেন না। এত করে বললাম! তবু ভাত ছাড়া ভরদুপুরে শুধু মাছ খেয়েই বেরিয়ে গেলেন। সেই শেষবারের মতো।

এই শক্তির ক-ত গল্পই যে আমি শুনে আসছি, সুনীলের সঙ্গে আলাপ হওয়া ইস্তক। ওঁর কবিতা আমি আগেই পড়েছি, যেমন সুনীলেরটাও পড়তাম। কিন্তু আমি কবিতার তত ভক্ত ছিলাম না গোড়ায়। তখন সুনীলের ‘নীললোহিত’ বেশি ভাল লাগত। এর মধ্যে সুনীলের সঙ্গে আলাপ হল। তখন কিন্তু সুনীলের সঙ্গে শরৎবাবু (শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়), তারাপদ (রায়)— এঁদেরই বেশি দেখতাম। আমি-সুনীল, শরৎবাবু-বিজয়া এখানে-ওখানে বেরোতামও, শক্তি সেখানে থাকতেন না। পরের দিকে সাগরদা (সাগরময় ঘোষ) কোথাও ডেকেছেন। কিংবা এএইআই ক্লাবের আড্ডায় বসেছি! এই সব জায়গায় সব সময়ে শক্তিকে পাওয়া যেত না।

উনি এলে সকলেই কিন্তু খুব খুশি হতেন। শক্তির সঙ্গে বোধহয় হিমানীশ গোস্বামীদের বেশি ভাব ছিল। বন্ধুর সংখ্যা শক্তিরই বেশি। সুনীলের তুলনায় প্রায় ১০-১২ গুণ। সুনীল তো একটু লাজুক প্রকৃতিরও ছিল। লোকে ভাবত দাম্ভিক! কিন্তু শক্তি বরাবরই যেখানে যায় মধ্যমণি! নানা রকম মজা, ছেলেমানুষিতে জমিয়ে রাখে। শক্তিকে দেখার আগেই ওঁদের বিষয়ে অনেক মজার গল্প আমি শুনে ফেলি। তার মধ্যে একটা ওই এলএসডি খাওয়া। শক্তি-সুনীল দু’জনেই খেয়েছিলেন। তারাপদ খাননি। একজনকে তো সামলাতেও হবে! বোধহয় তাই!

শুনেছি, আমেরিকার বিখ্যাত কবি অ্যালেন গিন্‌সবার্গ ওঁদের বলেছিলেন, বেশি নয়, তোমাদের বড় জোর দু’টো করে বড়ি দেব। তা ওরা দু’জনেই বোধহয় একটা করে খেয়েছিল। তাতেই যা হওয়ার হয়! আমার এখন ঠিক ভাল মনে নেই, কার কী হয়েছিল। তবে সুনীল সম্ভবত ছোটবেলায় চলে গিয়েছিল, খানিকটা নিজের থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে দেখছিল।

অনেকগুলো লাল রঙের ফুটকি দেখছিল! আর আলপথের ওপর একটা ছোট ছেলে। কী-সব আশ্চর্য দৃশ্য! হ্যালুসিনেশন! শক্তিও তেমন কী যেন দেখেছিলেন, কিছু একটা দেখে ওঁর বোধহয় খুব কষ্ট হয়েছিল।

এই লোকটাকেই বোধহয় প্রথম দেখলাম ডায়মন্ড হারবারে। তখনও আমার আর সুনীলের বিয়ে হয়নি। আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারটা কেউ জানে না। শুধু দু’জনের মধ্যেই গোপন রয়েছে। সুনীলের অনেক বন্ধুর মধ্যে সে-দিন শক্তিও ছিলেন। সেটা অবশ্য খুব আলাদা করে মনে নেই। এই সময়ের কাছেপিঠেই সুনীলের বন্ধুদের দুদ্দাড় করে বিয়ে হতে লাগল।

১৯৬৭ সালটায় তো বিয়ের লাইন লেগেছিল। তারাপদ, সমরেন্দ্র (সেনগুপ্ত)-র বোধহয় আমাদের আগেই বিয়ে হয়েছিল। আমাদের পরে বোধহয় শক্তি, শরৎবাবু, শ্যামলের।

এর পরে শক্তির কাছেও ওঁদের সবার অল্প বয়সের দৌরাত্ম্যের নানা গল্প শুনেছি। আমায় একবার বলেছিলেন, ‘জানো, তোমার বর আমায় মেরেওছে! ওর মার খেয়েই আমি এখনও কানে একটু কম শুনি!’ সুনীলের হাতের পাঞ্জাটা খুব বড় ছিল তো! সুনীলও পরে বলেছিল, শক্তিকে সামলাতে কখনওসখনও একটু-আধটু অমন করতে হতো। এ সবই ওরা যখন দল বেঁধে রাতের কলকাতা শাসন করত, তখনকার ঘটনা।

মাঝেমধ্যে টলমলে অবস্থায় মাথা গরম করত ওরা সবাই। ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে ঝামেলাটামেলা হয়েছে, শুনেছি। আবার নিজেদের মধ্যেও টুকটাক কিছু! কিন্তু তখনকার এ সব ঘটনা ওঁদের বন্ধুত্বে কোনও দিন ছায়া ফেলেনি।

পরের দিকে, মানে আমাদের বিয়ের পরে অবশ্য ওঁদের মধ্যে কোনও মারকুটেপনা আমি দেখিনি। তবে একটা ঘটনা আলাদা করে মনে আছে। আমাদের বাড়িতেই ঘটেছিল! তখন সম্ভবত আমরা বিজন সেতুর দিকটায় একটা অন্য বাড়িতে থাকতাম। আমার শাশুড়ি-মা অন্য কোথাও গিয়েছিলেন। এই সুযোগে বাড়িতে একটা আসর বসেছিল। শক্তি, সুনীল, মতি... তার পর খেলোয়াড়রা—চুনী গোস্বামী, পিকে ব্যানার্জি এঁরা ছিলেন।

শক্তি তো নিজেই খুব উৎসাহ নিয়ে বললেন, আমি ‘বার’ সামলাচ্ছি। আর ‘বার’ সামলানো মানে তো যত না সামলাচ্ছেন, নিজে ঢকঢক করে খাচ্ছেনও তত বেশি। এর মধ্যেই ঘটল ঘটনাটা। পিকে তো খুব সুন্দর কথা বলতেন। আর অনর্গল কথা বলতেন। শক্তি বোধহয় কিছুতেই ‘এন্ট্রি’ পাচ্ছিলেন না। আচমকা ‘অ্যাই চুপ!’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। আমরা সবাই একটু অপ্রস্তুত।

পিকে নিজেও বেশ খানিকটা হকচকিয়ে গিয়েছেন।

এর কিছুক্ষণ বাদে পিকে, চুনীরা চলে যাওয়ার পরই বোধহয় শক্তি আর মতির মধ্যে গোলমাল শুরু হল। ঠিক কী নিয়ে, এত দিন বাদে তা আর মনে নেই। কিন্তু একটার পর একটা গ্লাস ভাঙছে তখন! কাউকে থামানো যাচ্ছে না। সে যা-হোক, কোনওমতে সামলানো গেল। তবে আমাদের বাড়িতে শক্তির আসাটা খুব ঘন-ঘন ঘটত না। এর একটা কারণ বোধহয় আমার শাশুড়ি-মা আমাদের বাড়িতে থাকতেন। সুনীলের মা খুব ব্যক্তিত্বময়ী ছিলেন। তখনকার দিনে তো মা-বাবারা থাকলে ছেলেমেয়েদের এত মদ খাওয়ার চল ছিল না। আমার শাশুড়ি-মা সুনীলকে দিয়ে মদ খাওয়ার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। তা, সুনীলের পক্ষে তো ‘মদ খাব না’ কথা দেওয়া সম্ভব হয়নি। ও চেষ্টা করত, মা থাকলে বাড়িতে না-খাওয়ার বা বাইরে থেকে খেয়ে এসে চুপ করে শুয়ে পড়ার। এ ছাড়া জানতাম, একটু বেশি খেলে শক্তি মাঝেমধ্যেই বাড়ি না-ফিরে কোনও বন্ধুর বাড়িতে থেকে যাওয়াটা প্রেফার করেন। তারাপদদের বাড়িতে ওঁরা স্বামী-স্ত্রী শুধু দু’জনে থাকতেন। শুনেছি, শক্তি সেখানে খুব যেতেন। কিন্তু আমাদের বাড়িতে তো মা থাকতেন। হয়তো সে-জন্যই শক্তি সচরাচর অত রাতে তেমন একটা আসতেন না।

কিন্তু সেই নিয়মেরও হেরফের ঘটেছে। একবার অন্তত স্পষ্ট মনে আছে, শক্তি আমাদের বাড়িতেই থেকে গিয়েছিলেন। সে রাতে খাওয়ার পরে একটা সিঙ্গল খাট বা ডিভানে ওঁর শোওয়ার বন্দোবস্ত হল। মনে আছে, শুয়ে মাঝেমধ্যেই কী রকম আওয়াজ করছেন! কখনও বা আচমকা ‘অ্যাই সুনীল’ করে ডেকে উঠছেন! উনি এমন করায় আমি দু’-একবার বলেছি, ‘যান, এ বার ঘুমিয়ে পড়ুন’, কিন্তু ফল হচ্ছে না। তখন মাকে গিয়ে বলেছি। মা অমনি উঠে এসে বললেন, ‘শক্তি, কী হল! কেন ঘুমোতে পারছ না? এমন চিৎকার করে না। আমরা কেউ ঘুমোতে পারছি না! যাও, অন্য কথা ভাবো, ঠিক ঘুম চলে আসবে!’ ও মা, ঠিকই তো! দেখলাম, শক্তি একটু বাদে ঠিক ঘুমিয়ে পড়লেন।

শক্তির আর একটা ঘটনাও ভোলা মুশকিল। একবার, বোধহয় ওই বিজন সেতুর বাড়িতেই বাজারের থলে হাতে ওঁর মেয়ে বাবুইকে সঙ্গে নিয়ে হাজির। তার পর এটা-সেটা বলতে বলতে ‘এই একটু বাজারটা সেরে আসছি’ বলে উধাও! তার পর ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাবার। আর আসেনও না! তখন তো অত ফোনও ছিল না। থাকলেও বোধহয় শক্তির স্ত্রী মানে মীনাক্ষীর নম্বর আমাদের কাছে ছিল না। বাড়িতে আমি আর শাশুড়ি-মা। সুনীল একটু বাদে অফিসে বেরিয়ে গেল। আমাদের ছেলে পুপলু, শক্তির মেয়ের থেকে বোধহয় অল্প বড়। কিন্তু ওদের মধ্যেও তত ভাব নেই। বেচারি বাচ্চা মেয়ে তো একটু বাদে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। খালি ‘বাড়ি যাব, বাড়ি যাব’! আমি আর মা ওকে সমানে খাওয়াতে চেষ্টা করছি। কিন্তু বেচারি তখন বাড়ি যাবে বলে অস্থির।

বুঝতে পারছিলাম, মীনাক্ষী কেন ওঁর ওপর এত রাগ করেন। শেষে বোধহয় অনেক পরে এসে বাবুইকে নিয়ে গেলেন। শক্তি নিজে এসেছিলেন, না কোনও জায়গা থেকে খবর পেয়ে মীনাক্ষী এসেছিলেন, তা এত দিন বাদে আর মনে নেই। তবে মনে আছে, পরে শক্তিকে বেশ বকেছিলাম। তাতে অবশ্য ওঁর বয়েই গিয়েছে।

আমাদের দু’টি পরিবারের বাচ্চাদের নিয়ে মেলামেশা ওদের ছোটবেলার পরে অবশ্য বড় একটা হয়নি। কিন্তু পার্ক সার্কাসের কাছে কর্নেল বিশ্বাস রোডে শক্তিদের বাড়িতে ওঁর জন্মদিন আমার খুব মনে আছে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তখন সুনীলের চেয়ে শক্তির বেশি ভাব। আর আমি তো সৌমিত্ররও ফ্যান! তো, শক্তির বাড়িতে গিয়ে দেখি, সৌমিত্র হারমোনিয়াম কোলে নিয়ে বসে গান করছেন। এই দৃশ্যটা শক্তির সৌজন্যেই পাওয়া।

আর মীনাক্ষীকেও আমি খুবই অ্যাডমায়ার করি। উনিও কবিতার পত্রিকা করতেন, লিখতেন। ব্যক্তিত্বময়ী। পরের দিকে শক্তি-সুনীলের অফিসে নিয়মিত দেখা হলেও বাড়িতে আমাদের মেলামেশা কমে গিয়েছিল। কিন্তু প্রথম দিকে একদিন একসঙ্গে বেড়ানো আমার খুব মনে পড়ে। বোধহয় মধ্যপ্রদেশের কবি অশোক বাজপেয়ীর ডাকে শক্তি-সুনীল ভোপালে কবিতা পড়তে গিয়েছিলেন। আমি আর মীনাক্ষীও গিয়েছিলাম। বাচ্চারা তখন একটু বড় বোধহয়। পুপলুকে কলকাতায় মায়ের কাছে রেখে যাই। ভোপাল থেকে ওঁদের দেওয়া একটা গাড়িতে আমাদের চার জনের বেড়াতে যাওয়া হল পাঁচমারি।

তখন কিন্তু শক্তিকে ক’টা দিন খুব লক্ষ্মী ছেলে হয়ে থাকতে দেখেছি। সুনীল তো ড্রাইভারের পাশে বসতে ভালবাসত। গাড়িতে উঠেই একদম সামনে গিয়ে বসেছে। মীনাক্ষী গম্ভীর ভাবে শক্তিকে বললেন, তুমি ধারে বসবে না! শক্তিরও কোনও প্রতিবাদ নেই। মনে আছে, সুনীল সামনে আর পিছনে আমি আর মীনাক্ষী সাইডে বসেছি, শক্তি মাঝখানে। আমার বরং তখন মনে হচ্ছিল, ইস্, সুনীল যদি আমার একটু কথা শুনত...

এমনিতে সাইটসিয়িং-এ শক্তি-সুনীলের তত ঝোঁক ছিল না। নানা জায়গায় ঘোরা হচ্ছে। আমি আর মীনাক্ষীই এ দিক-সে দিক উঠছি নামছি। শক্তি আর সুনীল বড়জোর গাড়ি থেকে নেমে নিজেদের মধ্যে গভীর আলোচনায় মগ্ন। আর গাড়িতে বসে টুকটাক হাতবদল চলছে বোতলের। অত শাসনের মধ্যেও শক্তি-সুনীলের স্টক রেডি থাকত। বোতলে জল মেশানো। গাড়িতে বসেই সামনের সিট-পিছনের সিটের মধ্যে বোতলটা ঘুরছে। এর মধ্যেও মনে পড়ে, শক্তি আর সুনীলও এক বার কোনও একটা জায়গায় নেমেছিল। বোধহয় অনেক সিঁড়ি ভেঙে জলের মধ্যে একটা মন্দিের। পরের দিকে সুনীল আর অত সিঁড়ি ভাঙতে পারত না।

ওদের বন্ধুদের সেই প্রাণবন্ত অতীতটার কথা এখন খুব মনে হয়। শক্তিদের সঙ্গে দল বেঁধে আর কোথাও বেড়ানো খুব একটা হয়নি। হলেও বড়জোর দু’-একদিনের জন্য। শক্তি চলে যাওয়ার পরেও বেলেঘাটায় ওদের বাড়ি গিয়েছি। কী সুন্দর বাগানঘেরা জায়গা! মাঝে মীনাক্ষীর শরীরটা খারাপ হয়েছিল। তখন গিয়েছিলাম। গাছপালা, শক্তির নাতি-নাতনিদের নিয়ে জমজমাট সেই বাড়ি, সত্যিই খুব ভাল লেগেছিল।

আর শক্তিকে যতটুকু দেখেছি, ওঁর পাগলামি বোহেমিয়ানিজমের বাইরেও একটা অন্য মানুষ ছিলেন। শুনেছি, শক্তি বাজার খুব ভাল করতেন। এ দিক-ও দিক ঘুরতেন, বাড়ি ফিরতেন না, আবার কয়েক দিন মাঝেমধ্যে খুব ভাল হয়েও থাকতেন। চান করে মাথা আঁচড়ে বসে পরিপাটি ভাত খেতেন। এই শক্তির জন্য আমার খুব আফসোস হয়। সুনীলদের বন্ধুদের মধ্যে ও-ই তো সবার আগে চলে গেল।

কবিতার আমি কী-ই বা বুঝি, তবে মনে হয়, শক্তির কোথাও একটা ইনার ডিসিপ্লিন ছিল। নইলে এত ভাল লিখবে কী করে? সুনীলকে পরের দিকে দেখেছি, দিনের বেলা অফিসের দিনে মদ খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। শক্তি সে-সব আমল দিতেন না। উনি হয়তো নিজের টার্মসে বেঁচেছেন। আনন্দে থেকেছেন। তবে ওঁকে যাঁরা ভালবাসতেন, তাঁদের কথা ভাবলে মনে হয়, একটু রাশ টানলেই ভাল হতো। এখন দেখি অনেকেই বলেন, শক্তি তো প্রথমে গল্প লিখতেন, সুনীল কবিতা! ওঁরা নাকি চেয়েছিলেন, নিজেরা এক সঙ্গে সব না-করে আলাদা-আলাদা দিক ধরে রাখবেন। আমি অত বুঝি না! সুনীল-শক্তি যে যেমন ইচ্ছে লিখেছেন। শক্তি আরও গল্প লিখলে সেটাও খুব ভাল হতো বলেই আমার মনে হয়। কিন্তু আমি বলব, শক্তির কবিতার মধ্যেও কত ভ্যারাইটি ছিল। আমাকেও তো কত জন বলতেন শক্তির কবিতার কথা। লোকে সুনীলের মহিলা ফ্যানদের কথা এত বলে, আমার কিন্তু বাংলাদেশের এক মহিলার কথা মনে পড়ছে, শক্তির কবিতার অন্ধ ভক্ত। উনি আমায় বলেছিলেন, সুনীলদার কবিতা খুবই ভাল, কিন্তু শক্তিদার কবিতার তুলনা নেই।

শক্তি-সুনীলের সেই শেষ দিনের কথা বার বার মনে হয়! আমার স্থির বিশ্বাস, শক্তি যদি সত্যিই কৃত্তিবাসের দায়িত্ব নিতেন, সে এক অন্য রকম ‘কৃত্তিবাস’ হতো। তাই ওঁকে যাঁরা ভালবাসতেন তাঁদের কাছে তো বটেই, বাংলা সাহিত্যেও বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল শক্তির অত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াটা। অন্তত আমার তাই মনে হয়।

তথ্যসূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা।
কলমে : ঋজু বসু।

ইতিহাসের পাতায় অভিনেতা 🌷 কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। 🥀🥀যুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা পেরিয়ে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর কয়েক দশক জুড়ে বা...
26/11/2024

ইতিহাসের পাতায় অভিনেতা
🌷 কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। 🥀🥀

যুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা পেরিয়ে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর কয়েক দশক জুড়ে বাংলার নাটক ও চলচ্চিত্রে যে স্বর্ণযুগের সূচনা হয়েছিল, তার সাক্ষী যাঁরা ছিলেন তাঁরা জানেন, তখন একঝাঁক শিল্পী গানে, কবিতায়, সাহিত্যে, নাটকে, চলচ্চিত্রে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো আবির্ভূত হয়েছিলেন। যাঁরা আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে আছেন। কালী বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য এক আশ্চর্য প্রতিভা।

কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বললেই মনে আসে ‘কেদার রায়’ নাটকের কার্ভালো, ‘বিসর্জন’-এর জয়সিংহ, ‘আরোগ্য নিকেতন’-এর শশী, ‘ক্ষুধা’র সদা কিংবা চলচ্চিত্রের গনশা (‘বরযাত্রী’), কাশিম (‘লৌহকপাট’), প্রিয়তোষ হেনরি বিশ্বাস (‘পরশপাথর’), বিমল (‘অযান্ত্রিক’), ওয়াংলু (‘নীল আকাশের নীচে’), হকার (‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’), ফণীভূষণ (‘তিনকন্যা/মণিহারা’), বানোয়ারী, (‘হাঁসুলীবাঁকের উপকথা’), বাদশা (‘বাদশা’)-র মতো আরও অনেক চরিত্রের কথা। এই সব চরিত্রের আড়ালে রয়ে গিয়েছেন সাম্যবাদী, দরদী, আত্মভোলা, চঞ্চলমতি মানুষ কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁকে আজও তেমন করে চেনা হয়নি বাঙালির।

সত্তর বছরে পা দিয়ে কালী বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দুই নাতনি শাওন আর সুদেষ্ণাকে একটি অঙ্গীকারপত্র লিখে দিয়েছিলেন। তাতে তিনি লিখেছিলেন, “আমি ওয়াদা করিতেছি যে আজ হইতে আর আমি জোরে কথা বলিব না। জোরে গাড়ী চালাইব না। জোরে হাঁটিব না। এক ভুল বারে বারে করিব না। লোককে চিনিতে ভুল করিব না। ভুঁড়ির প্রতি ঘৃণা জন্মাইব। তোমরা আমার আনন্দের উৎস। তোমাদের সকলের কাছে আমি ঋণী। এ ঋণের সুদ এ জন্মে পাবে। আসল পরের জন্মে দিব কথা দিলাম।” জীবনরসিক কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই অঙ্গীকারপত্রের মধ্যেই রয়েছে তাঁর পরিচয়।

১৯২০ সালের ২০ নভেম্বর কলকাতার কালীঘাটে জন্মেছিলেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর পরিবারের আদি নিবাস পূর্ববঙ্গের ঢাকা, বিক্রমপুর। তাঁর বয়স যখন দশ, তাঁর বাবা লেক মার্কেট অঞ্চলে একটি বাড়ি করে থাকতে শুরু করেন। ঠাকুরদা পুলিশে চাকরি করতেন। বাবা মণীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন আইনজীবী, রাশভারী রক্ষণশীল মানুষ। মা ভবানীদেবী। ছয় ভাই ও পাঁচ বোন নিয়ে বিরাট এক সংসারের দ্বিতীয় সন্তান কালী লন্ডন মিশনারিতে প্রাথমিক এবং সত্যভামা ইনস্টিটিউশন থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। কালীবাবু নিজেই লিখে গিয়েছেন, “ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাপারে বাবা খুব কড়া ছিলেন। কিন্তু আমার ঝোঁক পড়াশোনার থেকে বেশি ছিল খেলাধুলার দিকে।” স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে মস্ত খেলোয়াড় হবেন। বাবাকে লুকিয়ে খেলতে গিয়ে পুরস্কার জিতে বাড়ি ফিরেও বাবার হাতে মার খেয়েছেন অনেক বার। লিখেছেন, ‘‘আজ মনে হয়, বাবার এই শাসনের সঙ্গে সমানে মোকাবিলা করতে হয়েছে বলেই আমার চরিত্রে জিদটা বেশি, যে কোনও চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করতে পারি এক কথায়।” আরও লিখেছেন, “আর একটা ঝোঁক ছোটবেলা থেকেই আমার চরিত্রে ছিল, প্রকৃতিকে বেজায় ভালবাসতাম আমি। সঙ্গী মনে হত। ঝম্‌ঝম্‌ করে বৃষ্টি পড়ছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বাজ পড়ার শব্দ শুনছি কাছে-পিঠে কোথাও, আর তার মধ্যে হাঁটুজল ভেঙে হাঁটছি আমি। কখনও একা, কখনও দল বেঁধে। এত ভালো লাগত, যেন ভারি একটা মুক্তির স্বাদ পেতাম।”

১৯৩৯ থেকে ১৯৪০ সালে রিপন (আজকের সুরেন্দ্রনাথ) কলেজে ভর্তি হন ও সংস্কৃত পণ্ডিতমশায়ের বকুনির ভয়ে ঠিক করেন, পালি ভাষা শিখে গবেষণা করবেন। কিন্তু এরই মধ্যে মায়ের সঙ্গে ‘দরজা-বন্ধ বাক্স ঘোড়ার গাড়ি’তে চেপে মামার বাড়ি বাগবাজারে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে। কুমোরটুলিতে মাসির বাড়ির অনেক ভাইবোনের মধ্যে বড়দা নরেন বন্দ্যোপাধ্যায় আর মেজদা রমেন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর জীবনে বিশেষ প্রভাব ফেলতে শুরু করেছেন। বড়দা ছিলেন চৌকস খেলোয়াড়। তিনি তাঁকে টেনেছিলেন খেলাধুলোর দিকে আর মেজদা দিয়েছিলেন রাজনৈতিক দীক্ষা।

মাসির বাড়ি যাতায়াতের সূত্রেই বাগবাজার, কুমোরটুলি, শোভাবাজারের পুজোর সময় যাত্রা দেখা সম্ভব হয়েছিল তাঁর। লিখেছেন, ‘‘সে এক আশ্চর্য জগৎ। রাজা-রাণী, তলোয়ার, যুদ্ধ, কনসার্ট সব মিলিয়ে মুগ্ধ করে দিত আমাকে। সমস্ত মন দিয়ে নিবিষ্ট হয়ে যেতাম। এই নিবিষ্টতা কিন্তু আমার মধ্যে এখনও আছে।”

কালীবাবু অভিনয়ের আগে বা পরে কারও সঙ্গে কথা বলতেন না। অভিনীত চরিত্রটা তাঁকে গ্রাস করে নিত। এর সাক্ষী থেকেছেন তাঁর বহু সহশিল্পী ও কলাকুশলী। পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তীর মনে আছে, “আমি তখন অঞ্জন চৌধুরীর ‘গুরুদক্ষিণা’ ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করছি। একদিন শুটিং শুরুর আগে দেখা গেল মেকআপ রুমে কালীদা গম্ভীর হয়ে বসে। কারও সঙ্গে কথা বলছেন না। আমরা ভাবলাম হয়তো শরীর ভাল নেই।

অঞ্জনদাও চিন্তিত হয়ে পড়লেন, কারণ সে দিন খুব ইম্পর্ট্যান্ট সিনের শুটিং ছিল। আমরা ফ্লোরে সবাইকে বলে দিলাম কেউ যেন শট চলার সময় কথা না বলে। শট রেডি হতে আমি কালীদাকে নিয়ে এলাম ফ্লোরে। শট ও ডায়লগ বুঝিয়ে দিলাম। শট শুরু হল। দেখি একটার পর একটা শট অনায়াসে দিয়ে চলেছেন। কী অবাক করা অভিনয়! আমরা ভাবছি ভালয়-ভালয় শটগুলো শেষ করতে পারবেন তো কালীদা! দেখলাম, সব শটই ঠিকঠাক দিলেন। তার পর যেই শেষ শটটা হল, কালীদার সে কী অট্টহাসি! শিশুর মতো লাফাচ্ছেন আর বলছেন, ‘দেখলি, কেমন বোকা বানালুম সবাইকে। যদি সকাল থেকে তোদের সঙ্গে গল্প করে, ইয়ার্কি মেরে কাটাতাম, তা হলে কি এমন শট দিতে পারতুম? কখনই পারতুম না।’ আমরা হতভম্ব! এমন বিচিত্র অভিনেতা আমি জীবনে দেখিনি।”

কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনটাই ছিল বিচিত্র। কৈশোর ও যৌবনের দিনগুলোতে বাড়ি পালিয়ে দেখেছেন সিনেমা ‘কপালকুণ্ডলা’, কিন্তু মনে ধরেনি। শিশির ভাদুড়ীর ‘চাণক্য’ ছবির শুটিং দেখতে গিয়ে ভিড়ের দৃশ্যে ঢুকে পড়ে অভিনয় করে ফেলেছেন। স্কুলে থাকতেই নাটক করতে শুরু করেন। আবার হঠাৎই একদিন সেকালের দক্ষিণ কলকাতার শৌখিন অভিনেতা বিদ্যুৎ বসুর ডাকে ‘কেদার রায়’ নাটকে কার্ভালো-র চরিত্রে অভিনয় করে প্রথম রজনীতেই পুরস্কার পেলেন। তার পরই বন্ধুদের মধ্যে তাঁর নাম হয়ে গেল, ‘কার্ভালো কালী’। কিন্তু তখনও অভিনয় করার কথা তিনি চিন্তা করেননি। কারণ, যে দিকেই মন টানছে তাই নিয়েই মেতে উঠছেন। নাটক, ক্রিকেট ফুটবলের সঙ্গে বক্সিং, লাঠিখেলা, ছোরাখেলা, জিমন্যাস্টিক শেখায় যেমন আছেন, তেমনই বাঘাযতীনের মরদেহ নিয়ে বিরাট মিছিলে হাঁটতে-হাঁটতে বড় হয়ে স্বাধীনতার সৈনিক হওয়ার স্বপ্নও দেখছেন। ফুটবল খেলায় তিনি এতটাই ভাল ছিলেন যে, বিভিন্ন ক্লাব তাঁকে ভাড়া করে নিয়ে যেত খেলাতে। আর প্রায় সব ম্যাচের শেষে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার তিনিই পেতেন। পুরস্কার বিতরণ করতে এসে একবার বিস্মিত গোষ্ঠ পাল জিজ্ঞেস করেছিলেন কালী বন্দোপাধ্যায়কে, “আচ্ছা খোকা, বলো তো প্রকৃতই তুমি কোন ক্লাবের মেম্বার? আমার মনে হচ্ছে আজ নিয়ে এই বছরে অন্তত চারবার তোমাকে মেডেল দিলাম চারটে বিভিন্ন ক্লাবের মেম্বার হিসেবে! তা ছাড়া উপরি বেস্ট প্লেয়ার মেডেল।” কালী বন্দোপাধ্যায়ের বন্ধুরা তখন ধরেই নিয়েছিলেন যে, তিনি বড় হয়ে ময়দানের কোনও বড় দলের হয়ে খেলবেন।

কিন্তু হঠাৎ কালী বন্দোপাধ্যায়ের মন গিয়ে পড়ল অভিনয়ে। প্রশংসা পেয়ে কৈশোরে নাটক করার ইচ্ছেটা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠল। পাড়ার মাঠে স্টেজ তৈরি করে বন্ধুদের সঙ্গে চলতে লাগল বিভিন্ন রকম নাটকের অভিনয়। যৌবনে পা দিয়ে লেখা হয়ে গেল কিছু কবিতা। ‘ঝর্ণা’ নামে হাতে লেখা পত্রিকার জন্য কবিতা লিখলেন, “আম পাকে জাম পাকে দাদা তুমি কেন পাকো না?” সেই লাইন বন্ধুদের মুখে-মুখে ফিরতে লাগল ব্যঙ্গোক্তি হয়ে।

তখন যুদ্ধের কাল। সারা দেশে অস্থির অবস্থা। ফুটবল, নাটক কবিতা ছেড়ে এক বন্ধুর পরামর্শে যোগ দিলেন আর্মিতে। ট্রেনিং নিতে চলে গেলেন সুদূর পঞ্জাবে। “কিন্তু প্রবেশন শেষ হবার আগেই বাবা কলকাতা দপ্তরে হাঁটাহাঁটি করে ফিরিয়ে আনলেন আমাকে। স্বপ্ন ভেঙে চুরমার। চারপাশের অনিশ্চয়তা আর ভিতর থেকে কে যেন আমাকে ক্রমাগত ঠেলা দিয়ে চলেছে।” তাই আবার পালালেন। এ বার ওয়ারলেস হেড কোয়াটার্স, দিল্লি। আশা, পরে এয়ারফোর্সে যোগ দিয়ে আকাশে উড়বেন। কিন্তু একই সময় দিল্লির রাজপথ ’৪২-এর আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল। দেখলেন সাধারণ মানুষ হাসিমুখে জেলে ঢুকছে। “এই সময় মনে প্রশ্ন এল, যে ইংরেজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এতগুলো মানুষ মরছে, সেই জাতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যুদ্ধের ট্রেনিং নিচ্ছি আমি? কোনটা ঠিক?” আবার ফিরে এলেন কলকাতায়।

১৯৪৬ সালে কলকাতা জুড়ে শুরু হয়েছিল দাঙ্গা। সেই দাঙ্গা থামাতে অনেকের মতোই কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ও রাস্তায় নেমেছিলেন সক্রিয় ভাবে। এই সময়ে তাঁর কাছে হিরন্ময় সেন-এর ‘বার্মার পথে’ ছবিতে অভিনয় করার প্রস্তাব আসে। একটি ভিলেনের চরিত্র, নাম তুলসী। কিছু না ভেবে জেদের বশে অভিনয় করতে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। এই ভাবেই ‘ধাত্রীদেবতা’, ‘পদ্মাপ্রমত্তা নদী’, ‘অ্যায়সা কিঁউ’ ও ‘বিশ রোজ কে বাদ’, ‘তথাপি’ ছবিতে কাজ করেছিলেন আর্থিক কারণে।

কিন্তু তবু ভাল লাগছে না। বন্ধু অরুণের পরামর্শে শ্রীরঙ্গমে গিয়ে শিশির ভাদুড়ীর সঙ্গে দেখা করতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু দেখা হল না। শিশিরবাবুর ভাই বিশ্বনাথ ভাদুড়ী তাঁকে প্রথমে থিয়েটারে না আসার পরামর্শ দিলেও তাঁর নাছোড় মনোভাব দেখে মহলা দেখার অনুমতি দিয়েছিলেন। এই মহলায় উপস্থিত থাকতে-থাকতেই একদিন সুযোগ এল ‘তাইতো’, ‘সাজাহান’ নাটকে অভিনয় করার। নিয়মিত নাটক করার একটা ব্যবস্থা হয়েছিল কিছু দিনের জন্য। কিন্তু তা বন্ধ হয়ে যায় বিশ্বনাথ ভাদুড়ীর মৃত্যুতে।

যদিও থিয়েটার তখন বাসা বেঁধেছে তাঁর মাথায়। তাই নিজেরাই দল বানিয়ে নাটক করা শুরু করলেন। সেই সময় প্রচুর বাইরের বই পড়া আরম্ভ করেছেন। কিনেছেন হারমোনিয়াম, ভয়েস ট্রেনিং করছেন তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে। মিনার্ভা থিয়েটারে অভিনীত হল ‘কেদার রায়’ নাটক। যেখানে কার্ভালো চরিত্রে অভিনয় করলেন, যা তিনি আগেও করেছেন। সেই অভিনয়ের খ্যাতিই তাঁকে মহেন্দ্র গুপ্তর কাছাকাছি নিয়ে আসে। মহেন্দ্র গুপ্তর পরিচালনায় ‘শতবর্ষ আগে’, এর পর ‘টিপু সুলতান’, ‘স্বর্গ হতে বড়’ নাটকেও তিনি কাজ করেন। ‘টিপু সুলতান’ নাটকের পঞ্চাশ রজনীতে পুরস্কার হিসেবে সকলের সঙ্গে পেলেন একটি হাতঘড়ি। কিন্তু তার পরই একদিন স্টারে অভিনয় করতে যাবেন বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় ‘রশিদ আলি দিবস’-এর মিটিং দেখে সব ভুলে নেমে পড়লেন বাস থেকে। মিশে গেলেন অগণিত জনতার মিছিলে। নাটক করতে আর যাওয়া হল না। এর খেসারত হিসেবে জুটল মহেন্দ্র গুপ্তর বকুনি। একশো রজনীতে পুরস্কৃতের তালিকা থেকে বাদ পড়ল তাঁর নাম। কারণ জানতে চেয়ে হাজির হলেন মহেন্দ্র গুপ্তর সামনে। তিনি জানালেন, সেই দিনের অনুপস্থিতির শাস্তি হিসেবেই এই সিদ্ধান্ত। মেনে নিতে পারলেন না কালীবাবু। নাটক শুরুর আগেই মেকআপ তুলে বেরিয়ে পড়লেন রাস্তায়। মন খারাপ, ভাবছেন, “যারা নাটকে দামি দামি কথা সাজায়, রশিদ আলির ঘটনার গুরুত্ব তাদের কাছে নেই কেন?”

আসলে কালী বন্দ্যোপাধ্যায় তখন নিজের অজান্তেই ক্রমশ সরে আসছিলেন নিয়তিনির্দিষ্ট জীবনের দিকে। অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ ছবিটি তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র ছিলেন ছবির সংগীত পরিচালক, সহকারী সলিল চৌধুরী আর সজল রায়চৌধুরী ছিলেন পরিচালকের সহকারী। এঁদের সঙ্গে পরিচয় সূত্রেই আই পি টি এ-তে যোগ দেন তিনি।

দিশাহীন কালী বন্দোপাধ্যায়ের গণনাট্য সংঘের সঙ্গে যোগাযোগ তাঁর নোঙর-ছেঁড়া জীবনকে যেন একটা তীরে পৌঁছে দিল। গণনাট্য সংঘই তাঁকে দক্ষিণ কলকাতার অলিগলি থেকে জীবনের বিরাট এক রাজপথে এনে দাঁড় করাল। সেই রাজপথের জনতার ‘মুখরিত সখ্য’র আস্বাদই ক্রমশ তাঁর অভিনয়ের প্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়। নিজেকে অভিনেতা হিসেবে গড়ে তুলতে গ্যারি কুপার, গ্রেটা গার্বো, পল মুনি, রোনাল্ড কোলমান, লরেন্স অলিভিয়রের অভিনয় দেখছেন, মুগ্ধ হচ্ছেন। দু’বছরের মধ্যে তিনি তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়ে স্থায়ী কর্মী হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। স্বয়ং জ্যোতি বসু তাঁর নাম প্রস্তাব করেন পার্টির কাছে।

আই পি টি এ-তে যোগ দিয়ে কালী বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের পরিচালনায় সলিল চৌধুরীর লেখা ‘শান্তি চাই’ পথনাটিকা করেন, এ ছাড়াও করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মুক্তির উপায়’। কিন্তু তিনি লিখছেন, “সলিল চৌধুরীর লেখা ‘লেখক’ (জনান্তিকে) আই পি টি এ-তে আমার প্রথম নাটক।” ক্রমশ তিনি ‘নয়ানপুর’, ‘সংকেত’, ‘ভাঙাবন্দর’, ‘বিসর্জন’ ‘দলিল’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন। আলাপ হয়েছিল প্রগতিশীল শিল্পী ও কলাকুশলীদের সঙ্গে। আই পি টি এ-র ব্যস্ততার মধ্যেই তাঁর পরিচয় হয় বামপন্থী নেতা অবনী লাহিড়ীর বোন প্রীতির সঙ্গে। ১৯৫১ সালে দু’জনে বিয়ে করেন।

কিন্তু একটা সময় গণনাট্যর কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে অসুবিধে হচ্ছিল। ‘ব্যক্তিগত ও আন্দোলনের সংকট’ জড়িয়ে যাচ্ছিল। ’৫১তে জীবনের জটিল জায়গায় এসে দাঁড়ালেন তিনি। কারণ, আর্থিক অনটনে যেমন নিজের অস্তিত্ব রক্ষা কঠিন হয়ে উঠছিল, তেমনই আন্দোলনের কিছু অভিজ্ঞতাও প্রশ্ন আনছিল। এই সময় বন্ধু মনোরঞ্জন ঘোষ ‘বরযাত্রী’ ছবিতে গনশা চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। এই ছবির জনপ্রিয়তাই কালী বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাতারাতি তারকার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল।

১৯৫২ সালে তাঁর কন্যা তাপসীর জন্ম হয়। ৫২ সাল থেকেই তিনি সব দ্বিধা ঝেড়ে পেশাদার অভিনেতা হিসেবে বাংলা চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় করতে শুরু করেন। ‘জবানবন্দি’, ‘সিরাজদ্দৌলা’ ইত্যাদি চারটে ছবি মুক্তি পায় ওই বছরেই। সত্যেন বসুর ‘ভোর হয়ে এল’ মুক্তি পায় ১৯৫৩ সালে। আর পরের বছর তপন সিংহ তাঁকে নির্বাচন করেন তাঁর প্রথম ছবি ‘অঙ্কুশ’-এর জন্য। তার পর ‘টনসিল’। এরই মধ্যে অবশ্য ঋত্বিক ঘটকের ‘নাগরিক’ ছবির জন্য শুটিং করেছেন। বারীন সাহার ‘তেরো নদীর পারে’ ছবিতে কাজ করেছেন। অজয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেষ্টায় ‘রিক্সাওয়ালা’ ছবির কাজ শুরু হয়েছিল উৎপল দত্ত ও সলিল চৌধুরীর সঙ্গে। ছবির নায়কের ভূমিকায় কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। কাজ চলাকালীন, “সলিল হঠাৎ বিমল রায়ের কাছে ছবির হিন্দি ‘রাইটস’ দিল বিক্রি করে। কিছু দিনের মধ্যেই ‘দো বিঘা জমিন’ নামে মুক্তি পেল ‘রিক্সাওয়ালা’। ওরা টিম নিয়ে গেল রাশিয়া, আর সেই অবস্থায় আমাদের ছবি বন্ধ হয়ে গেল।” সত্যেন বসুর পরিচালনায় ‘রিক্সাওয়ালা’ ছবিটি পরে শেষ করা সম্ভব হয়েছিল এবং মুক্তি পেয়েছিল ২১ জুন ১৯৫৫।

১৯৫৬ সাল থেকে সংকটকাল কাটিয়ে কালীবাবু স্থিতু হন বাংলা নাটক ও সিনেমার নির্ভরযোগ্য চরিত্রাভিনেতা হিসেবে। একে-একে সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্বিক, তপন সিংহর ছবিতে কাজ করতে শুরু করেন। ‘অযান্ত্রিক’, ‘কত অজানারে’, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘লৌহকপাট’, ‘ডাকহরকরা’, ‘পরশপাথর’ ছবিতে কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল।

অন্য দিকে পেশাদার মঞ্চ থেকেও এসেছিল ডাক। ‘আরোগ্য নিকেতন’ নাটকে শশী কম্পাউন্ডার ও ‘ক্ষুধা’ নাটকে সদার চরিত্রে তাঁর অভিনয় আজ মিথের আকার নিয়েছে। সমসাময়িক সাংবাদিক সেবাব্রত গুপ্তর মতে, “বোম্বের চরিত্রশিল্পী বলরাজ সাহনি অভিনয়ের গুণে স্টারের মর্যাদা পেয়েছিলেন। কলকাতার তেমনই একজন অভিনেতা স্টার কালী বন্দ্যোপাধ্যায়।” উত্তমকুমারকেও বলতে শোনা যায়, “সৌমিত্র নয়, আমার আসল প্রতিদ্বন্দ্বী কালী বন্দ্যোপাধ্যায়।”

কালী বন্দ্যোপাধ্যায় মুম্বই গিয়ে হিন্দি ছবিতেও কাজ করেছেন সত্তরের দশকে। নবেন্দু ঘোষের ‘ডগদরবাবু’, হৃষীকেশ মুখ্যোপাধ্যায়ের ‘বাবর্চি’, ‘সব সে বড়া সুখ’। কিন্তু সেখানে তাঁর মন টেকেনি। ফিরে এসেছিলেন কলকাতায়। সক্রিয় বামপন্থী রাজনীতি থেকে সরে এলেও তাঁর মানসিকতার বদল ঘটেনি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মতে, “কালী ব্যানার্জি বাংলা সিনেমার প্রথম ব্যতিক্রমী নায়ক। সত্যিকারের মানুষকে অভিনয়ের মধ্যে ব্যক্ত করার আগ্রহটা সব অভিনেতার থাকে না।”

কালী বন্দ্যোপাধ্যায় সব মিলিয়ে প্রায় দেড়শো ছবিতে কাজ করেছেন। নাটক করেছেন একত্রিশটি। তাঁর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে অভিনেতা, পরিচালকেরা অবাক হয়েছেন চরিত্রের জন্য তাঁর মনঃসংযোগ ও অভিনয় কুশলতা দেখে। ‘বাদশা’ ছবির শিশুশিল্পী শংকর ঘোষ জানালেন এমনই একটা পর্যবেক্ষণের কথা, “আমি ছোটবেলা থেকেই আমার বাবাকে ‘বাপি’ বলে ডাকতাম। ফ্লোরে কালীজেঠু সেটা খেয়াল করে পরিচালক বিভূতি লাহাকে বলেছিলেন, ‘শঙ্কর যেন আমাকে ছবিতে ‘বাবুজি’, ‘পিতাজি’ এই সব বলে না ডাকে। যদি বাপি বলে ডাকে, খুব সুন্দর শুনতে লাগবে। বিভূতি লাহা সেটা শুনে বললেন, ‘তাই হোক’। সারা ছবিতে আমি কালীজেঠুকে বাপি বলেই ডেকেছি। সেই মারাত্মক দৃশ্য, যেখানে অসিতবরণ আমাকে নিতে এসেছেন আর কালীজেঠু আমাকে তাঁর হাতে তুলে দিচ্ছেন, তখন আমি বলছি, ‘বাপি, তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছ?’ এই ‘বাপি’ বলায় সংলাপটা এত ন্যাচারাল হয়েছিল যে, হলে দর্শকদের খুব আপ্লুত করত।”

মাধবী মুখ্যোপাধ্যায় মনে করেন, “কালী বন্দ্যোপাধ্যায় একজন জাতশিল্পী ছিলেন। মঞ্চ আর সিনেমা দু’ধরনের অভিনয়েই তিনি ছিলেন অতি দক্ষ। শিল্পীসুলভ এক ধরনের পাগলামি ওঁকে তাড়িয়ে বেড়াত।” ঋত্বিকপত্নী সুরমা ঘটকের অনুভবে “তাঁকে ছাড়া ‘অযান্ত্রিক’, ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ আর ‘কত অজানারে’র মতো ছবি সম্ভবই হত না।” তপন সিংহর অভিমত, “দুঃখ এটাই যে, ওঁকে ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারল না টালিগঞ্জ।” মৃণাল সেনেরা যেখানে আড্ডা দিতেন, সেখানে “নিত্যনতুন বন্ধু জুটত এবং আমরা সবাই যেন তখন একটা বড় রকমের হইচই বাঁধিয়ে দেওয়ার জন্য লুকিয়ে আছি। একটা ‘বিপ্লব’, অবশ্যই সংস্কৃতির আসরে।” মৃণাল সেনের বাবা ওঁর ছেলে ও তার বন্ধুদের এই উদ্দীপনা দেখে নাম দিয়েছিলেন ‘দেবদূত’। মৃণাল সেনের মতে, “সেই দেবদূতদেরই একজন কালী ব্যানার্জি।”

সময় বদলাচ্ছিল, বয়স বাড়ছিল। কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের চারপাশটা বদলে যাচ্ছিল। উত্তমকুমারের মৃত্যুর পর আশির দশক থেকে বাংলা ছবির মান ক্রমশ নিম্নগামী হয়ে যেতে থাকে। ভাল চরিত্রের অভাবের কথা বারে বারে প্রিয়জনদের বলতেন তিনি। তাঁর মনে হত, তখনও তাঁর অনেক কিছু দেওয়া বাকি।

জীবনের শ্রেষ্ঠ চরিত্রে তখনও কাজ করা হয়নি। সারা জীবন জুড়ে প্রচণ্ড সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অভিনয়শিল্পের যে শিখরে তিনি পৌঁছেছিলেন, সেই শিখর ছোঁয়া চরিত্র তাঁকে দেওয়ার মতো তেমন কোনও পরিচালকও আর ছিলেন না তাঁর চারপাশে।

আর্থিক কারণে এমন সব চরিত্রে তাঁকে অভিনয় করতে হয়েছে এই সময়, যা দেখে অনেকেরই দুঃখ হয়েছে। কিন্তু পেশাদার অভিনেতা হয়ে থেমে যেতে রাজি হননি জীবনের শেষ দিন অবধি। জীবনের শেষ ছবি ‘তান্ত্রিক’-এ অভিনয় করতে গিয়ে বৃষ্টিতে খুব ভিজতে হয়েছিল। তা থেকেই তিনি ব্রঙ্কো-নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও ৫ জুলাই ১৯৯৩ তাঁর মৃত্যু হয়।

তথ্যসূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ সংখ্যা, লিখেছেন সুদেষ্ণা বসু।

Address


Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when অনুভব হিমাদ্রি posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Videos

Shortcuts

  • Address
  • Alerts
  • Videos
  • Claim ownership or report listing
  • Want your business to be the top-listed Media Company?

Share