15/04/2023
নববর্ষের মিষ্টিমুখ,
নববর্ষের মিষ্টি সুখ
বৃষ্টি নেই তো কী, মিষ্টি তো আছে। তাই, নরম কিংবা কড়া, যে পাকই হোক না কেন, গরমকে গোল দিয়ে বাঙালির বৈশাখের পয়লা দিনেই প্রসন্ন মুখ। উৎসবেও উন্মুখ। দরদরে দহন সেদিনও পারেনি, আজও পারে না প্রিয় পার্বনের পরম্পরাকে ভেস্তে দিতে। মিষ্টি, স্রেফ মিষ্টিই যুগে যুগে, বর্ষে বর্ষে গলদঘর্ম হাঁসফাঁসে উল্লাস-উতল উদযাপন উপহার দিয়েছে।
সক্কাল সক্কাল স্নান সেরে চুবড়িতে লক্ষ্মী-গনেশ, হালখাতা কিংবা হালের ট্যাব সাজিয়ে ঠাকুরকে মিষ্টি নিবেদন। মন্ত্র পড়ে, মগজে গঙ্গাজল ছিটিয়ে ধুনোয়, ধুপে দোকান সাজিয়ে আপ্যায়নে মিষ্টি। খড়খড়ে তাঁত আর কড়কড়ে ধাক্কা পাড়ের ধুতি ধরে পরিজনের পায়ে পড়ার আগে মিষ্টি, পরে মিষ্টি। মনমরা প্রেম আর ম্যাদামারা দাম্পত্যে দখিনা বাতাস ওই মনোহরা মিষ্টিই ম্যান অব দ্য ম্যাচ।
সুগারে-কোলেস্টেরলে, বাতে-বদহজমে, পেট খারাপে-মন খারাপে মিষ্টি সুখের উল্লাস তো বাঙালির বংশগত। পয়লা বৈশাখ উপলক্ষ্য মাত্র। সমবচ্ছরের রসগোল্লা, জিলিপির জায়গায় চকচকে চকলেট সন্দেশ, মোলায়েম মালাই চমচম, গদগদ গোলাপজাম, কলাইভোগ, মালাইচপ, হরিভোগ কিংবা রসনা ভোগ… হোক না কবজি হাত ডুবিয়ে। শুভ দিনে মিষ্টি মুখ না করলে হয়!
সুখ তো ক্ষণেকের। তা সে সুখ যদি সুখকর সন্দেশে হয়, এর থেকে বড় সন্তোষজনক সন্দেশ কিছু হয় না। তার জন্য আদি অনন্তকাল ধরে বাঙালির ঐতিহাসিক ময়রারা তো আছেনই। আর কাছে পিঠে হাল আমলের ফিউশন আর এক্সপেরিমেন্টাল মিষ্টির দোকান যদি থাকে, তো কথাই নেই। পয়লা বৈশাখ জমে ক্ষীর।
শুধু ক্ষীরে আবার মন ভরে না খুঁতখুঁতে বাঙালির। শেষ পাতে চাটনি, দই-এর সঙ্গে রাবড়ি, রস মালাই, সরভাজা আর নলেন গুড়ের পায়েস যদি আয়েশ করে খাওয়া নাই গেল, তাহলে পয়লা বৈশাখের পাতই যে অপূর্ণ রইল।
তবে ইদানিং ইন হয়েছে পুরনো মিষ্টিও। লবঙ্গলতিকা, ভাপা দই, সীতাভোগ, জলভরা, মনোহরা, দেলখোশ, পেস্তা সন্দেশ বা আম সন্দেশ এবারের পয়লা বৈশাখে আবারও আম বাঙালির উচ্চাশাকে উসকে দিয়েছে।
তবে বঙ্গ জীবনের অঙ্গে জুড়ে রয়েছে রসগোল্লা। এছাড়াও বাঙালির আদি মিষ্টির পরম্পরায় 'প্যাঁড়া'ও একটি উল্লেখযোগ্য খাদ্যবস্তু। ময়মনসিংহের এই মিষ্টির কথা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বেশ রসিয়ে লিখেছেন তাঁর ‘দূরবীন’ ও ‘উজান’ উপন্যাসে। ইতিহাস বলছে, মিষ্টির জন্য ছানার ব্যবহার বাঙালি প্রথম শেখে ডাচদের কাছে। সাহিত্যিক শংকর তাঁর ‘বাঙালির খাবার দাবার’-এ বলেছেন 'ছানা ও চিনি অনেকটা সাহিত্যের কাগজ ও কলমের মতো–রবীন্দ্রনাথের হাতে পড়লে একরকম ফল, আর হরিদাস পালের হাতে পড়লে আরেক রকম।‘ মিষ্টান্নতেও রবীন্দ্র সান্নিধ্য, ভাবা যায়!
গুড়, ছানা আর চিনি যদি বাঙালির মিষ্টির মহাকাব্যে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর হয়, তাহলে নারকোলকেও নারদ বলা যেতেই পারে। সে একদা নারী কুলের অত্যন্ত সোহাগের সামগ্রী ছিল সে বিষয়ে দ্বিমত নেই। চন্দ্রপুলী, নারকোল ছাপা, নারকোল নাড়ু, নারকোল বরফি, এ সবেরই সুতিকাগার হল গৃহস্থের অন্দরমহল। মাত্র এক প্রজন্ম আগেও মা, ঠাকুমা, দিদিমা, রাঙাপিসিদের দ্বিপ্রাহরিক পি এন পি সি-র মুখরোচক বিষয়ের ‘সমুদ্র মন্থন’-এ উৎপন্ন হতো বিচিত্র স্বাদ ও সৌন্দর্যের মিষ্টি। এই ঘরে ঘটিত মিষ্টিই ছিল একদা বাঙালির পয়লা বৈশাখের প্রথম ব্যাঞ্জন। তবে এই শিল্পের সমাধি ঘটছে ধীরে ধীরে। আজকের কর্মব্যস্ত নারীকুল কল্পনাই করতে পারবে না মিষ্টি মহলের মজলিসের কথা।
পরচর্চা পরনিন্দা আর পঞ্চব্যঞ্জন — দুই ‘পাতে’ই ‘সন্দেশ’ না হলে বাঙালির ঠিক ‘ভাত হজম’ হয় না। একদিকে ‘খবর’, অন্যদিকে ‘খাবার’—দুই অর্থেই বিষয়বস্তুটি কখনও কাড়াপাকের, কখনও আবার মাখোমাখো। সরেস এবং রসালো ‘সন্দেশ’-এ বাঙালির তাই কখনও অরুচি নেই। তাই মিষ্টি মুখে আর মিষ্টি সুখে এবারের পয়লা বৈশাখ ব্যাঞ্জনাময় হয়ে উঠুক বঙ্গ জীবনের অঙ্গে, প্রত্যঙ্গে।
#নববর্ষ