24/01/2023
# গল্প:ক্ষতিপূরণ
~ ©Tirtharaj
সকাল থেকে পেটে দানাপানি পড়েনি। টোটোর প্রাবল্যে রিক্সায় কি আর লোক চড়ে! সকাল সাতটা থেকে বাসস্ট্যান্ডে হরেন বসেই আছে রিক্সা নিয়ে। খাবার বলতে এককাপ চা আর লেড়ো বিস্কুট। বউটা গতবছর বাচ্চা পেটে মরেছে। আর কারো পেটের দায় নেই। কিন্তু একটা পেটের দায় পালন করাটাই এখন চাপের এই শহরে।
বাসস্ট্যান্ডের পেছনে একটা হেলেঞ্চা (ছায়াপ্রদানকারী এক বৃক্ষের উত্তরবঙ্গে চলতি ভাষায় নাম, শাক নয়) গাছের ছায়ায় রিক্সায় বসে ঝিমোচ্ছিল হরেন। গায়ে হাতের ছোঁয়া পেতেই ধড়ফড় করে চোখ খোলে হরেন। বিষ্টু বর্মন। রিক্সাচালক ইউনিয়নের সভাপতি। এককালে রিক্সা চালাতো ঠিকই কিন্তু এখন দু'টো হোটেল আর দু'টো লরির মালিক।
বিষ্টুকে দেখেই ভয় মাখানো সম্মানে হরেন বলে "দাদা, আপনি! কিছু বলবেন?"
- "এইতো প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে এসেছিলাম। দেখি এই ভরদুপুরে ঘুমোচ্ছিস তাই দেখতে এলাম। হাজার হলেও ইউনিয়নের সদস্য তুই। আসছি, ভালো থাকিস।"
বিষ্টু বর্মন হাঁটা শুরু করতেই তার পেছনে ছোটে হরেন।
- "দাদা....."
পেছন ঘুরে বিষ্টু বর্মন দেখে হরেন আসছে।
- "কী হল?"
কান্নামাখা গলায় হরেন হাতজোড় করে বলে উঠল "দাদা, কাজ নেই। খাবার নেই। আপনি বাঁচান। বউটা বাচ্চা পেটে মরল গতবছর দশমীতে। চিকিৎসা পেলনা টাকার অভাবে।"
- "আমার হোটেলে একটা কাজ আছে করবি?"
- "কী কাজ?"
- "স্মাগলিং।"
- "কিন্তু দাদা, সিনেমাতে দেখেছি ওসব পাপ কাজ।" ভয় পেয়ে যায় হরেন।
- "ধুর, ভয় পাসনাতো। আর মরলিই নাহয়। তোর ওপর কারও দায়তো নেই আর।"
চোখে জল ভরে আসে হরেনের।
- "আসি। যদি পেট ভরাতে চাস দেখা করিস।"
বিষ্টু বর্মন চলে যায়। চারিদিক ফাঁকা এখন। দুপুর হয়ে গেছে। রিক্সাটা রেখে পাশের হোটেলে গিয়ে চোলাই নিয়ে আসে হরেন। আজ দুপুর অবধি আয় শূন্য! চোলাই খেতে খেতে আকাশপাতাল ভাবতে থাকে হরেন।।বছর পনেরো আগে বাইশ বছর বয়সে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল সুমাইয়াকে। গ্রামের কেউ স্বভাবতই মেনে নেয়নি সেই বিয়ে। পঞ্চায়েতে সালিশি সভায় নিদান হল গ্রাম ছাড়ার। মা-বাপকে গ্রামে রেখেই সজল চোখে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে উঠেছিল বউকে নিয়ে। শহরে আসার কিছুদিন পর হরেন খবর পায় তার মা-বাবা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে। আজো খুঁজে পাওয়া যায়নি তাদের। শহরে এসে প্রথমে কিছুদিন অন্যের রিক্সা চালাতো। তারপর টাকা জমিয়ে নিজেই রিক্সা কেনে। বিয়ের চোদ্দো বছরের মাথায় বাচ্চা যখন বউয়ের পেটে এল তখন হুট করেই দুর্ঘটনা। বউটা মরল সঙ্গে বাচ্চাটাও। আস্তে আস্তে চোলাইটা শেষ হয়ে এল। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে এল হরেনের শরীর। পরদিন খবর এল "চোলাই মদে বারোজনের মৃত্যু। প্রতি পরিবারকে ২ লাখ করে ক্ষতিপূরণ...." কী হবে এই ক্ষতিপূরণে! মাধ্যমিক পাশ নিমাই চাকরি চেয়েছিল সংসারের হাল ধরার জন্যে। কিন্তু ভ্যানে মাল বয়েই জীবন শেষ হল। হালদারপাড়ার চৈতন্য হালদার দিনমজুর ছিল। মেয়ের বিয়ের পণ হিসেবে ওই দু'লাখ কাজে লাগবে এবার। কিন্তু কন্যাদান কে করবে!
হরেনের দেহটা পড়ে থাকে গাছতলায়। হয়তো কেউ এসে দেখবে তাঁর মৃতদেহ। হয়তো হবে সৎকার। কিন্তু ক্ষতিপূরণ?
~ Tirtharaj Bhattacharjee