27/06/2022
বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কে না জেনেই 'সাম্প্রদায়িক' বলেন সেকুলার বুদ্ধিজীবী। বঙ্কিমের প্রতি মুসলমানদের অসন্তোষের কারণও থাকা উচিত নয়।
[ *Secular intellectuals call 'communal' without knowing about Bankimchandra. There should be no reason for Muslims to be dissatisfied with Bankim.*]
বঙ্কিম-বিদ্বেষের মূল কারণ হচ্ছে 'শিক্ষিত সমাজ'-এর জ্ঞানের দীনতা এবং অজ্ঞানতা। উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবেই 'বঙ্কিম-বিদ্বেষ' ছড়ানো হয়েছে, যাতে 'বন্দেমাতরম' মন্ত্রের মর্যাদাহানি করা সম্ভব হয়। 'সাম্প্রদায়িক' তকমা এঁটে তাঁর দুর্লভ সাহিত্য-শক্তিকে বিড়ম্বিত করার এতটাই চেষ্টা হয়েছে, যে আজও তিনি যুগোপযোগী সম্মান পান নি। বঙ্কিমের লেখনিতে যতটুকু নিন্দা বা প্রশংসা আছে, দুইই ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে করা হয়েছে; কোনো আবেগ সেখানে স্থান পায়নি। বঙ্কিম সবসময় 'বুদ্ধিজীবীর সততা রক্ষা' করেছেন, অধিকারের সীমা কখনোই লঙ্ঘন করেন নি। তাই সংকীর্ণতা কখনও কলুষিত করতে পারে না তাঁর সাহিত্যকে।
বঙ্কিমচন্দ্র মুসলমানদের কিছু বর্বরোচিত কাজের নিন্দা করেছেন। তার মানেই তা মুসলমান বিদ্বেষ নয়। কাজী নজরুলও করেছিলেন, তাঁকে তাই 'কাফের' বলা হয়েছিল। পরে তাঁকেই মহাকবি আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। এখন, ইসলাম আর মুসলমান কি সমার্থক? তা তো নয়। মুসলমানদের নিষ্ঠুর হত্যালীলাকে নিন্দা করলেই ইসলামকে নিন্দা করা হবে কেন? তিনি কি কোনো মুসলমান পয়গম্বরের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন, তবে?
বঙ্কিমের উপন্যাসে মুসলমানদের শৌর্যবীর্যের কথাও আছে। তাঁর 'রাজসিংহ' উপন্যাস গ্রন্থে লিখেছেন, "কোনো পাঠক না মনে করেন যে, হিন্দু মুসলমানের কোনো প্রকার তারতম্য নির্দেশ করা এই গ্রন্থের উদ্দেশ্য। হিন্দু হলেই ভাল হয় না, মুসলমান হইলেই মন্দ হয় না। ভালমন্দ উভয়ের মধ্যে তুল্যরূপেই আছে।... ইহাও সত্য নহে, সকল মুসলমান রাজা সকল হিন্দু রাজা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ছিলেন। অনেক স্থলে মুসলমানই হিন্দু অপেক্ষা রাজকীয় গুণে শ্রেষ্ঠ; অনেক স্থলে হিন্দু রাজা মুসলমান অপেক্ষা রাজকীয় গুণে শ্রেষ্ঠ। অন্যান্য গুণের সহিত যাহার ধর্ম আছে -- হিন্দু হউক, মুসলমান হউক, সেই শ্রেষ্ঠ। অন্যান্য গুণ থাকিতেও যাহার ধর্ম নাই -- হিন্দু হউক, মুসলমান হউক -- সেই নিকৃষ্ট...।" এরপর কী বলবেন?
অনেক বিদ্যাবিদ বলেছেন বঙ্কিম 'ইতিহাস বিকৃতি' করেছেন। 'রাজসিংহ' উপন্যাসের প্রেক্ষিতে বঙ্কিম ঔরঙ্গজেবকে যেমন ভাবে চিত্রিত করেছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে নাকি তাঁকে 'সাম্প্রদায়িক' বলা যায়। বঙ্কিমের অপরাধ হল, তিনি উপন্যাসে চঞ্চলকুমারীকে দিয়ে ঔরঙ্গজেবের ছবি পদদলিত করেছেন, আর তাতেই নাকি বঙ্কিমের মুসলমান-বিদ্বেষ ঠিকরে পড়েছে। কিন্তু তন্নিষ্ঠ পাঠক, আপনারা বলুন তো, ঔরঙ্গজেবের সাম্প্রদায়িক 'জিজিয়া কর' পুনঃপ্রবর্তন কি হিন্দুরা খুশি মনে নিয়েছিল? ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে অসন্তোষ কি দানা বাঁধে নি? ইতিহাসে কি তার সমর্থন নেই? চঞ্চলকুমারী কি তাদেরই প্রতিনিধি নয়, যারা ঔরঙ্গজেবকে ঘৃণা করত? তাহলে বঙ্কিম কোথায় ইতিহাস বিকৃতি করলেন আর কিভাবেই বা সাম্প্রদায়িক হলেন?
বঙ্কিম তাঁর ইতিহাস-আশ্রিত উপন্যাস রচনার জন্য ঐতিহাসিক প্রামাণ্য পুস্তকই বিবেচনা করেছেন, যেগুলি নিয়ে কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। যেমন প্রিঙ্কেল কেনেডির 'A History of the Great Mughals', জেমস্ টডের 'The Annals and antiquities of Rajasthan' প্রভৃতি। তাই তার রচনায় যদি ইতিহাস বিকৃতি ঘটে, তার দায়ভার সাহেব ঐতিহাসিকদেরও। বঙ্কিম যদি তাঁর সাহিত্য রচনায় সমকালীন সময়ের মেজাজকে, ইতিহাসকে সম্পৃক্ত করতে চান, তবে তা 'সাম্প্রদায়িক' পদবাচ্য হবে কেন? বরং বলা ভাল, তাঁর রচনা ইতিহাসকে যথার্থ মর্যাদায় স্থাপিত করেছে। তিনি ইতিহাসের ব্যবহারিক প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন। কেউ বলতে পারবেন না, তিনি সত্যকে ছাপিয়ে কল্পনার পক্ষীরাজ ঘোড়ায় পাড়ি দিয়েছেন।
বঙ্কিম 'বঙ্গদেশের কৃষক' প্রবন্ধে যে রায়তদের দুর্দশার চিত্র দেখান, সেখানে 'রামা কৈবর্ত' আর 'হাসিম শেখ' আলাদাভাবে হিন্দু কিংবা মুসলমান নন। তারা কৃষকদের একটি শ্রেণী, প্রতীক চরিত্র। তারা অসহায়, অবহেলিত, শোষিত, বঞ্চিত। যারা তাঁকে 'সাম্প্রদায়িক' বলে গাল দেন, তারা বরং ভাবুন, 'ভাবা প্র্যাকটিস করুন' মার্কসবাদী দীক্ষায় দীক্ষিত না হয়েও বঙ্কিম কিভাবে বাংলায় সাম্যবাদের বীজ বপন করে গেছেন। মনে রাখবেন, 'সাম্য' নামে তাঁর একটি প্রবন্ধও আছে। আর একটি কথা জানাই, যে উপন্যাসের জন্যও তিনি বিধর্মীদের দ্বারা 'সাম্প্রদায়িক' পদবাচ্য, সেই 'সীতারাম' উপন্যাসে সীতারামের হিন্দু রাজ্যের নাম 'মহম্মদপুর'। কী করে তা হল? কারণ হিন্দু সম্রাট হিন্দু-মুসলমান উভয়কে নিয়েই চলতে চান। আর তার বিপরীতটা?
তাছাড়া, সমকালীন পরিবেষ্টনে অর্থাৎ উনিশ শতকে হিন্দু-স্বপ্নের প্রসার ও প্রচার শুধু স্বাভাবিক ছিল তাই নয়, প্রায় অনিবার্যই ছিল। উনিশ শতকে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে এক বড় রকমের ব্যবধান ফুটে উঠেছিল। কারণ ব্রিটিশ শাসনের প্রথমাবস্থায় মুসলমানেরা রাজশক্তির সঙ্গে প্রবল বিরোধিতা করেছিল আর হিন্দুরা করেছিল প্রাণঢালা মিতালি। মুসলমানদের বিরূপতা আর রাজশক্তির অপ্রসন্নতা যুক্ত হয়ে তার লব্ধি বলে একদা প্রাধান্য-প্রবল উদ্ধত-গর্বিত মুসলমান আম-দরবার থেকে হারিয়ে গেল। পক্ষান্তরে মঞ্চে আসর জাঁকিয়ে বসল দীর্ঘদিনের অবহেলিত, বঞ্চিত, কোণঠাসা হিন্দুর দল। ঐতিহাসিক কারণেই উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে প্রধান অধিবাসী হয়ে উঠল নবজাগরণে উদ্বুদ্ধ হিন্দু-সমাজ। তাই দেখা যায়, এই সময়ের সকল প্রথিতযশা হিন্দু বিদ্বজ্জন ও সুধীমণ্ডলী হিন্দুত্বের নব জাগরণের স্বপ্ন দেখেছেন এবং স্বপ্নকে রূপ দেবার চেষ্টা করেছেন।
বঙ্কিম-সমসাময়িক বৌদ্ধিক পরিমণ্ডলে ধর্মের স্থান ছিল। সমাজে ধর্মীয় পরিচিতি অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য ছিল। হিন্দু বলে, মুসলমান বলে, খ্রিস্টান বলে নিজেদের পরিচয় দেওয়াকে কেউই আপত্তিকর মনে করেন নি। তাই উনিশ শতকে হিন্দু সমাজের কোনো প্রখ্যাত ব্যক্তিই হিন্দু-নবজাগরণের স্বপ্ন না দেখে পারেন নি। রামমোহন, বিদ্যাসাগরও বাদ ছিলেন না। তবে হিন্দুত্বের জন্য বঙ্কিমকে আলাদা করে দায়ী করা হবে কেন? হ্যাঁ, বঙ্কিম হিন্দুধর্মের গৌরব প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেটাকে ঠিক হিন্দুয়ানার প্রতিষ্ঠা বলা ভুল। সেটাকে বলা ভাল, লুপ্ত চৈতন্যের পুনরুদ্ধার; ঔপনিবেশিক শক্তির বিপ্রতীপে সাজাত্যবোধের প্রকাশ।
*-- ড. কল্যাণ চক্রবর্তী*