11/03/2023
মথ-এর সম্পাদকের সাক্ষাৎকার নিয়েছিল অনর্গল পত্রিকা । সেই সাক্ষাৎকার দেওয়া গেল নীচে -
১) আপনার মতে লিটল ম্যাগাজিনের কী কী বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত?
এ প্রশ্নের উত্তর সবারই জানা। আর তাই নতুন করে সেসব না বলাই ভালো। শুধু মনে করিয়ে দেবার জন্য একটা তথ্য—‘বিভাব'-এর একটা সংখ্যায় পঞ্চাশ হাজার টাকার চেয়ে বেশি এমাউন্ট বিজ্ঞাপন উঠেছিল। আর কৌরব প্রকাশ করার জন্য রক্ত দিতেন কমল চক্রবর্তীরা! সম্প্রতি একটি অদ্ভুত পত্রিকা দেখলাম। একটি ছেলের বাবা হাতে লিখে একটি পত্রিকা করতেন। ছেলে পড়ত। তারপর তার বন্ধুরা। এইভাবে রিডারশিপ বেড়ে চলত সেই পত্রিকার। প্রায় তিরিশ বছর আগেকার এই পত্রিকাটির অনেকগুলো সংখ্যা বাঁধানো অবস্থায় দেখলাম। কী নেই সেখানে! ছোটোদের জন্য সমস্ত উপকরণ আছে। লেখার মানও খুব উঁচু। এও তো সবুজপত্রই। হীনভাবে দেখলে বলা যায়, যে পত্রিকার সম্পাদকেরা উপরতলার লেখকদের সঙ্গে গা ঠেকাবার জন্যে আর বড়ো কাগজে লেখবার জন্যে পত্রিকা প্রকাশ করেন তাকে চড়ুইপত্র বলে। সম্পাদকের প্রতিষ্ঠা পাবার সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকাটির ভবলীলা সাঙ্গ হয়।
২) বিশেষ সংখ্যা ব্যাতিরেকে সাধারণ সংখ্যার মূল্য কোন পরিসরে বেঁধে রাখা উচিত?
যেভাবে কাগজের দাম বাড়ছে, ছাপার খরচ বেড়ে চলেছে, তাতে এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়া সম্ভব না। তবে তবে যেমনই বিশেষ সংখ্যার আর্থিক হদিশ পেলেন অমনি মূল্যের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে একটা বড়ো বাড়ি যত তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাঁরা। পত্রিকাও অবশিষ্ট সুলভে ট্যাবলয়েড বা চটি পত্রিকা দিতে পারে, ছোটো পত্রিকার সে ক্ষমতা থাকে না। তাছাড়া যদি সত্যিকারের উত্তীর্ণ হলেন। অন্য দিকে গ্রামে গ্রামে এই বার্তা যখন রটি ভালো কবিতা ( যদিও এ নিয়েও বিস্তর হৈচৈ হতে পারে যে সত্যিকারের ভালো কবিতা কী) ছাপা হয়, তাহলে তারও একটা শিল্পমূল্য আছে। অবশ্য অন্তর্জালিকা মাধ্যমে প্রকাশিত হলে মালকড়ি খরচ করার কোনো গল্প থাকে না ।খরচ অবশ্য আছে। তবে সে মুদ্রিত পত্রিকার থেকে অনেক কম। আর বাঙালি তো সস্তা ও পুষ্টিকর খাবার চায়। সে আম্বানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে রিলায়েন্সের দেওয়া ফোর জি ফ্রি নেট-এ লাইভে আসে। সে মলে যাবে, এসি কিনবে। তার গাড়ি থাকবে। কিন্তু তার লিটল ম্যাগাজিন কম দামে হতে হবে। কেউ কেউ আবার সম্পাদকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে খানিকটা উদাস হয়ে বলবেন পত্রিকাটি পাইনি তো !!
প্রসঙ্গত জানাই, আমার পত্রিকাটি প্রথম দশ বছর বিভিন্ন পাঠককে শুধু ডাকেই পাঠিয়েছি। পাঠিয়েছি শুধু এইটা বোঝাতে যে এই পত্রিকাটি কিনে পড়ার যোগ্য। কিন্তু দশ বছর পরে মোটামুটি কম দামেও যখন পত্রিকাটি ‘বিক্রির’ জন্য 'বাজারে' আনা হলো, তখন তেমন বিক্রি হলো না। লোকজন আশা করলেন চিরদিন এই পত্রিকা তাঁরা নিখরচায় পাবেন। কাজেই কাউকেই খুশি করা সম্ভব না। অবশ্য উজানপত্র সে চেষ্টাও করে না।
৩) ‘বিশেষ সংখ্যার নামে কলেজ ইউনিভার্সিটির নোটস্ এর জোগান দিচ্ছে লিটল ম্যাগাজিন'- বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
দেখুন, বিশেষ সংখ্যা করে দু-একজন সম্পাদক তেলের দোকানমালিকের মতো দেখতে হয়ে গেলেন, নিজে তারা পত্রিকার কাজ কোনোদিন কিছু করতেন কিনা জানা নেই, থাকল না। ছোটো পত্রিকা থেকে সম্পাদক প্রকাশনীতে গেল, তখন সেই ডাকাতের গুহায় উচ্চাভিলাষী বৃন্দবৃন্দারা ঢুকে পড়লেন। কিন্তু ‘আলু ফাঁক পটল ফাঁক' বলে গর্জিয়ে উঠে অনেকানেক ভাবে ‘দ্বার খোলাতে' চেষ্টা করলেন।
তবে একদিন ঢোকার পথ ও ধোঁকার পথ পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু সেখান থেকে বেরোনোর পথ মিলল না। এমন সময় এসে পড়ল লিট্ল ম্যাগাজিনের আপোষহীন সম্পাদকেরা। এই দল আবার স্নান করে না। কাঁটাও বেছে খায়। ফলে একটা স্পষ্ট বিভেদরেখা তৈরি হলো পাঠকের মনে। ফলাফল সবার জানা।
যে মুহূর্তে সাহিত্য ক্লাস নোটস-এ পরিণত হয়, সেই মুহূর্তে তার মৃত্যু হয় এমনই জানা ছিল। কিন্তু এক বিশিষ্ট কবির কবিতা পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলে এবং সেই আনন্দে তাঁর উচ্ছ্বাস শুনে মনে হয়েছিল তাহলে আমাদেরও এইসব উন্মাদনার শেষ লক্ষ্য কি এইরকম ‘রোম’ ? কিন্তু এ যে সেই রোম নয় যা একদিনে তৈরি হয়নি, এ কথা আপনি কোন প্যামফ্লেট-এ লিখে বেড়াবেন! সাহিত্যের শেষ লক্ষ্য অনেকের কাছেই পাঠ্যপুস্তক। আমরা কিন্তু জানতাম পাঠ্যপুস্তকের ও ক্লাস নোটসের অন্ধকারে সত্যিকারের সুলেখা গলায় দড়ি দেয়।
৪)ক্রমশ ই-ম্যাগের সংখ্যা বাড়ছে । আগামীতে ছাপা লিটল ম্যাগাজিন-এর অবস্থান ও গুরুত্ব কীভাবে বদলাবে বলে মনে করেন ?
উচিত অর্থে সবকিছুই থাকা দরকার। ই-পত্রিকা, মুদ্রিত পত্রিকা সব। আমি যে পত্রিকাটি সম্পাদনা করি তার ওয়েবসাইট আছে আবার সেটি মুদ্রিতও হয়। সময়ের দাবি মেনে এই যে বহুদিন আগেই আমাদের হালকা পরিবর্তন' হয়েছিল, তার ফললাভ করছি কোভিড পরিস্থিতিতে। বেশ টুকটাক একটা দুটো সংখ্যা বেরোচ্ছে। কাগজে ছাপা ম্যাগাজিনটির কি তাই বলে গুরুত্ব কমবে ? কখনোই না। এর উদাহরণ আবহমান পত্রিকা। সেটি সত্যিই গভীর স্পন্দনে স্পন্দিত একটি ই-পত্রিকা যার মুদ্রিত প্রকাশনার এজেন্ডাই আলাদা। আলাদা করে কিনেছি। এবং শুধু আমি নই। তাঁদের পত্রিকার অনেক মুদ্রিত সংখ্যা শেষও হয়ে যায়। মনে রাখা দরকার, সেগুলো কিন্তু বিশেষ সংখ্যা নয়। ফলে মুদ্রিত পত্রিকার গুরুত্ব কমবে বলে মনে হয় না। শুধু তার উদ্দেশ্য বা প্রাধান্যগুলি একটু বদলাতে হবে।
৫) প্রচুর পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। সম্পাদনার বদলে সংকলনের ওপরেই বেশি ঝোঁক দেখা যাচ্ছে? এটি লিটল ম্যাগাজিনের জন্য কতটা স্বাস্থ্যকর?
দেখুন বেশিরভাগ লিট্ল ম্যাগাজিনের সম্পাদক স্বঘোষিত । ফলে সম্পাদনার জন্যেও যে তৈরি হতে হয় এটা বুঝবার আগেই সে সম্পাদক পদে আসীন হয়ে যায়। হীন অর্থে দেখলে, একধরনের দলবাজি ও পালের গোদা হওয়াই এর উদ্দেশ্য। আর দাদাবাজি ও পালের গোদার শেষ কমিটমেন্ট তার দলের ফুটো মস্তান থুড়ি কবিদের প্রতি। তারা অনন্ত সুযোগ দিয়ে যান এইসব ছিঁচকে লেখকদের। ফলে পত্রিকাটি একটি পাড়ার বিচিত্রানুষ্ঠানে পরিণত হয়। নাচ হয় গান হয় কবিতা হয়। মাঝে মাঝে ক্যুইজ, ম্যাজিক, ব্যায়াম এবং সবশেষে একটি নাটক। এই নাটকের ফলে আরও একটি পত্রিকার জন্ম হয়। ফলে আরও একটি পালের গোদা। বৃহদর্থে, এই পত্রিকার জন্মমৃত্যুকে আপনি অনায়াসে ফিনিক্স-এর সঙ্গে তুলনা করে জিশাস-এর রেফারেন্স আনতে পারেন। হীন অর্থে একে আপনি বলতেই পারেন রক্তবীজের ঝাড়।
৬) লিটল ম্যাগাজিন-এর কাছে সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ কোনগুলি ?
টিকে থাকা। এবং টিঁকে থাকলে কী করে আরও মননের অন্দরমহলে যাওয়া যায়, তার চেষ্টা করা। সত্যিকারের সম্পাদনা করার জন্য যে অবজেক্টিভিটি দরকার, তাকে লালন করা আর নিজের মধ্যে নিয়ে আসা। এমন সাধনার থেকে বড়ো দূরে থেকে যায় ছোটো পত্রিকার জগৎ। আগেই বলেছি, সম্পাদক এখানে স্বঘোষিত। কেউ তাকে বলেনি পত্রিকা সম্পাদনা করতে। তাও তিনি একাই একশো। একাধারে তিনি সংকলক অন্যদিকে তিনিই প্রুফ রিডার। তিনি প্রেস-এ যাবেন। তিনিই কী কাগজে ছাপা হবে ঠিক করবেন। মূল্য নির্ধারণ করবেন এবং তিনিই বিক্রয়কেন্দ্র!! এতসব ঘূর্ণাবর্তে তাঁর নৈর্ব্যক্তিক হওয়ার সাধনাটি হারায়। তবু কেউ কেউ স্থির থাকেন তাঁদের লক্ষ্যে। অবিচল এইসব মানুষদের আমি প্রণাম জানাই।
৭) ভালো সম্পাদনার নিরিখে আপনার পছন্দের কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিনের নাম বলুন—
দাহপত্র, ধ্রুবপদ, এক্ষণ, পরিচয়, কৌরব, আবহমান, বাল্মীকি, আমি আর লীনা, বিদুর, হৃৎপিণ্ড, কৃত্তিবাস, মন্তাজ, পাঠকই কবিতা, শতানীক, বিজ্ঞাপনপর্ব, কবিতীর্থ, রক্তমাংস ইত্যাদি।
কুন্তল মুখোপাধ্যায় সম্পাদক, মথ
অনর্গল ৷৷ ১০ম সংখ্যা।। 2021 ।।