23/03/2022
ঈশানের কথা / Ishan Speaks
মাসিক ঈশান কথা - মার্চ সংখ্যা
Feature Theme : বসন্ত
21 March 2022 / ০৬ চৈত্র ১৪২৮
বসন্ত ছিল রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের প্রিয় ঋতু। তবে সেই বসন্ত যত না মিলনের তার চেয়ে অনেক বেশী রিরহ মেদুর। বসন্তের কোকিল কুহু রবে দুরবর্তিনী তার প্রিয়াকে খোঁজে বেড়ায়। বসন্ত তাই কবিমনে অনুচ্চারিত, অনুদ্দিষ্ট, নিবিড় প্রেমে স্মৃতিমেদুর। বসন্ত বাঁধভাঙা প্রেমোচ্চারণ যে বিরহ " অশ্রুধারায় যায় ভেসে যায় দোলের পূর্ণিমাতে, যখন প্রিয়া চরণচিহ্ন রাখি ললিত কুসুমে চলে যায় দূর বিজনে "। আসলে বিরহ অন্তহীন। প্রেম ক্ষনিকের। না পাওয়া আছে বলেই প্রেম অনির্বান। তাই তো প্রেমের মাহাত্ম্য। " মেঘের বুকে যেমন মেঘের মন্দ্র জাগে, বিশ্বনাচের কেন্দ্রে যেমন ছন্দ জাগে, তেমনি আমায় দোল দিয়ে যাও যাবার পথে, রাঙিয়ে দিয়ে কাঁদন বাঁধন ভাগিয়ে দিয়ে ", বসন্তের হু হু বাতাসে এই আকাঙ্ক্ষাই ভেসে বেড়ায়। এই আকাঙ্ক্ষাই চিরসত্য বলেই বোধহয় বিরহের অন্তরালেই প্রেম বেঁচে থাকে।
তবে বসন্ত শুধু বিরহের নয়, বসন্ত উৎসবের, মিলনমেলার রূপ নেয় দোল উৎসবের আনুসঙ্গে। রঙের এই উৎসব সর্বজনীন মান্যতা পেয়েছে, আবহমান কাল থেকে। আমাদের অন্ত্যজ দোলের সাথে ধর্মীয় অনুসঙ্গ মিশে আছে যা লোকায়ত এবং স্বাভাবিক আবেগিক অনুভুতিতে উজ্জ্বল। " নাকের উপরে লাল বেসর দিব, প্রাণনাথ বন্ধুরে আজি রমনী সাজাব "- যখন লেখেন গীতিকার, তখন তার মধ্যেও গোপিনীদের সেই সহজিয়া অনুভূতি অনুদ্দিষ্ট প্রেমের কথাই বলে কারন প্রিয়তমকে চিরদিনের জন্য নয় শুধু আজকের জন্যই " একেলা পাওয়া গেছে নিধুবনে "।
রঙের এই উৎসবকে রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীতে " আপন মনের মাধুরী মিশায়ে " প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন 'বসন্তোৎসব' নামে। উৎসব ধারনাটি চিরকাল রবীন্দ্র চেতনায় অন্য দ্যুতিতে ভাস্বর ছিল। কবি উৎসবকে সমষ্টিগতভাবে মানবমনের মিলন, অনুভুতির আদান-প্রদানের অনুষঙ্গ হিসেবে মান্যতা দিতেন। তাই আজও এই বিশেষ দিনে যখন কচিকাঁচারা " খোল দ্বার খোল লাগল যে দোল " বলে গৃহবাসীদের ডাক দেয় শান্তিনিকেতন, বিশ্বভারতী প্রাঙ্গনে তখন কবিকল্পিত সেই উৎসবের মিলনাভূতিই আমাদের মর্মে নাড়া দেয়, আমরা মেতে উঠি অকারণ আনন্দে।
বিশ্ব উষ্ণায়ন আজ প্রকৃতির সহজ চলাচলকে প্রায় রুদ্ধ করেছে, বসন্তের প্রকৃতি তাই নিজস্ব স্বতন্ত্রতা নিয়ে আজ আর জানান দেয়না। তবুও বানিজ্যায়ন তেমনটা হয়নি বলে উত্তর পূর্বের প্রকৃতি এখনও কিছুটা বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে পেরেছে। তাই স্বল্পদিনের হলেও বসন্ত বাতাস এখনো আমাদের শরীর মনকে ছুঁয়ে যায়। নাহলে তো গ্রীষ্ম আর শীত এই দুটো ঋতুই এখন প্রকটমান , আর তার সাথে ভুলভাল বৃষ্টি, নিম্নচাপের অস্বাভাবিক পুনপৌনিকতা সহ। তাই সেই অর্থে আমরা কিছুটা সৌভাগ্যবান তো বটেই।
কংগ্রেস আমলে বরাকের জন্য পৃথক 'একাডেমিক ক্যালেন্ডার' তৈরি হত যা ঠিক করে দিতেন এখানকার শিক্ষক সংগঠন। কিন্তু বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পরই 'এক রাজ্য এক নীতি' নিয়ম গৃহীত হয়। ফলে সারা রাজ্যের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে বরাকের 'একাডেমিক ক্যালেন্ডার' থেকে বাদ পড়ে ১৯ শে মে বা রবীন্দ্র জয়ন্তীর মতো ছুটি। শুধু এখানেই ক্ষান্তি না দিয়ে গতবছর ১৯ শে মে তে পরীক্ষার দিন ঘোষণা করে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদ। স্বভাবতই প্রতিবাদের ঝড় ওঠে বরাকে, যে ভুখন্ডের আবেগের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে ১৯ শের রক্তস্নাত ইতিহাস। অবশেষে সেই সরকারি নির্দেশ প্রত্যাহৃত হয়। যদিও এরপরও ভাষিক আগ্রাসনের চোরাগোপ্তা নিদর্শন দেখা গেছে তবে সম্প্রতি সরকারি তরফে যে 'একাডেমিক ক্যালেন্ডার' ঘোষিত হয়েছে তাতে বরাকের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে '১৯ শে মে' পালন তথা শিক্ষকদের ভাষাশহীদ দিবসের তাৎপর্য ছাত্রদের কাছে বিশ্লেষণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেভাবে দেখতে গেলে এই প্রথম সরকারি তরফে ভাষা শহীদদের উদ্ধৃতি ও স্বীকৃতি লিপিবদ্ধ হল।
এই পদক্ষেপের জন্য যেমন সরকারের আন্তরিক সাধুবাদ প্রাপ্য তেমনি অভিনন্দন প্রাপ্য উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক কর্মচারী সংস্থা সহ বরাক ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট, বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন, ভাষা আইন সুরক্ষা সমিতি, ইত্যাদি সংগঠনের, যাদের সোচ্চার ভূমিকা ছাড়া হয়তো এই লক্ষ্য অধরা রয়ে যেত। তবে এ প্রথম ধাপ। বহুভাষিক, বহুমাত্রিক এই রাজ্যের সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য যদি সত্যিই উদ্দিষ্ট হয় তবে বরাকের পঞ্চদশ ভাষা শহীদদের প্রত্যক্ষ সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া জরুরি, চাই তাদের পরিবারের জন্য সরকারি অনুদান। তেমনি এতদঅঞ্চলের দীর্ঘদিনের গনদাবি - শিলচর রেলস্টেশনের 'ভাষা শহীদ স্টেশন' নামকরণের ব্যাপারটিকেও ঝুলিয়ে রাখা অবাঞ্ছনীয়। আমরা চাইব এসব ব্যাপারেও সরকারি সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটুক, অবিলম্বে।
বসন্ত থিম নিয়ে প্রকাশিত হল 'ঈশানকথা'র এই মাসিক সংস্করণ। প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা সব মিলিয়ে আমরা সাজিয়েছি এই ইস্যু। অবশ্যই পড়ুন। জানান কেমন লাগল সবার। ভালো থাকুন। আগামীতে আরো নতুন আঙ্গিক, নতুন আকর্ষণ নিয়ে প্রকাশিত হতে চলেছে 'ঈশান কথা', আপনাদের সংলগ্নতা, আপনাদের ভালোবাসাকে পাথেয় করে।
সবাইকে বসন্তের শুভেচ্ছা। পড়তে থাকুন, দেখতে থাকুন ঈশান কথা ...
https://www.ishankotha.com/ishanspeaks
Editorial Page of Ishan Kotha