02/10/2020
আজকের সেরা সাহিত্যিক মাননীয়া দীপা শিকদার-এর লেখা #প্রতিবিম্ব
অল্প শোকে কাতর,বেশি শোকে পাথর--কোনোটাই কি অল্প, একমাত্র সন্তান তার পর স্বামী । জঙ্গলের বাঘিনীটা মরে গেলে বাঘটা সাতদিন পর্যন্ত খাওয়া দাওয়া করে না। সেই পাখী দুটো "এক তীরে দোঁহে মরে এমন পিরিত কজন করে--"। কিন্তু রিনা?সে তো দিব্য বেঁচে আছে নিজের উপর বড্ড ঘৃণা হয় কিন্তু সে বেঁচে আছে সবার ঝাঁটা লাথি খেয়ে।
রিনার বাঁচতে ইচ্ছে করে না ঠিকই কিন্তু সে মরেও যেতে পারে না।ভালোবেসেই বিয়ে করেছিল রাজাকে পয়সা কড়ি যেমনি থাক হৃদয় খানা এক্কেবারে রাজার মতো। নিজের সমর্থের মধ্যে দান ধ্যান যা করা যায় কখন ও কাউকে ফেরায় নি। একটা Mnc তে কাজ করে মোটামুটি ভালো রোজগার এসব দেখেই প্রেমে পড়েছিল রিনা দুবছর ভালোবাসা বাসি তারপর বিয়ে একদিন কোল আলো করে ছেলে এলো ।বেশ চলে যাচ্ছিল। সুঠাম ও সুন্দর চেহারার রাজা বলতো কুচ পরোয়া নেই হাত পা ঠিক আছে তিনটে পেট ঠিক চালিয়ে নবো।কিন্তু রাজার তল পেটের কাছে একটা লম্বা কাটা দাগ ছিল জিজ্ঞেস করে রিনা জেনেছিল পেয়ারা গাছ থেকে রাজা পরে গিয়েছিল ,এ নিয়ে কর্তা গিন্নিতে আর বেশী কথা হয়নি। কিন্তু কেনো জানি না রাজার এই দাগটা দেখলে রিনার খুব খারাপ লাগত। ছেলে বড় হয় রাজার চরিত্র পাল্টায় না।সেই দরিয়া দিল আজ একে সাহায্য করছে তো কাল তাকে। বারো বছরের ছেলে নন্দনের স্কুল থেকে head mistress ফোন করেছিলেন আপনারা এক্ষুনি হসপিটালে আসুন আপনাদের ছেলেকে আমারা হসপিটালে নিয়ে এসেছি। পড়িমরি ছুটেছিল দুজনে ছেলের ভীষণ শ্বাসকষ্টে হচ্ছিল ।নন্দনের টেস্ট করে ডাক্তার জানালেন কিডনি কাজ করছে না ।কথাটা শুনে রাজা দু পা পেছনে গিয়ে দেওয়ালে এক ধাক্কা খেয়ে সামনে দিকে পরতে পরতে টাল সামলে নিয়ে দাঁড়িয়ে পরল ।ছেলের বাবা বলে কথা হবেই তো। অনেক টেস্ট করার পর ডাক্তারদের বক্তব্য কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ।অদ্ভুত ব্যাপার বাবার সঙ্গে ছেলের গ্রুপ মিলে ও গেল কিন্তু সব কিছু কে ছাপিয়ে আরো অদ্ভুত হল রাজা ছেলে কিডনি দিতে রাজি নয়। ব্যায় বহুল চিকিৎসার খরচ সামলাতে দেনার দায়ে বাড়ীটাও বন্ধকি রাখা হল তাও শেষ রক্ষা হলো না।
ছেলে কে বিদায় দিয়ে রিনা অনেক দিন পরে রাজার মুখোমুখি ।রাজা কেমন পাল্টে গেছে তাও সে জানতে চায় এত পরোপকারি রাজা নিজের ছেলেটাকে একটা কিডনি দান করতে পারল না কেন ?রাজা বোধহয় তৈরিই ছিল একটা একটা করে নিজের পোশাক খুলে পুরোপুরি উলঙ্গ হয়ে রিনার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করল "এই যে এই কাটা দাগ এটা কোন পেয়ারা গাছ থেকে পরে যাওয়ার ক্ষত চিহ্ন নয় ।তখন তুমি আমার জীবনে আসোনি রিনা, অফিস যাওয়ার পথে নিত্ত দেখা হওয়া এক বাদামভাজা বিক্রেতাকে আমি আমার কিডনি দান করেছি তার বউ তখন অন্তঃসত্ত্বা সে ই একমাত্র রোজগার করে। বিহ্বল হয়ে রিনা তার পরিচিত অপরিচিত স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে তারপর নিজেকে সামলে পরম যত্নে রাজাকে জামা কাপড় গুলি পরিয়ে দেয়। কিন্তু রাজা যেন নিজের অস্তিত্ব হারিয়েছে। দেনার দায় পুত্রশোক আর পারে না রিনা হঠাৎ এক সকালে রাজা ও তাকে ছেড়ে চলে যায়। তারপরও রিনা বেঁচে আছে। আজ শরিকেরা তাকে প্রায় ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে তারিয়ে দিয়েছে , এই ঘর এখন তাদের। সত্যিই তো। কিন্তু এক সময় রাজা এদের কতো সাহায্য করেছে। হাতে যে কয়টি পয়সা ছিল আর রাজার মুঠোফোন টা সঙ্গে নিয়ে সে বেরিয়ে এসেছে জানে না কোথায় যাবে। ট্রেন থামতেই সে নামে। স্টেশনের সামনেই একটা হোটেল ।বোর্ডে বড় বড় হরফে লেখা "গরীব মানুষের সেবায় রাজা হোটেল " মাথাটা কেমন গরম হয়ে যায় মূখে বিদ্রুপের হাসি কিন্তু পেটে বড্ড ক্ষিদে।পায়ে পায়ে ভিতরে প্রবেশ করে। বছর কুড়ির একটি মেয়ে পরম যত্ন করে তাকে খাওয়ায় বলে-- এখনে যে যার সামর্থ অনুযায়ী পয়সা দেয়, না দিলেও অসুবিধা নেই, এটা 'রাজার হোটেল '।
চমক লগল হাত ধুতে গিয়ে ঠাকুরের সিংহাসনে লক্ষ্মী গনেশের পাশে ও --কার ছবি হ্যাঁ রাজার ছবি ।রিনাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হোটেল মালিক এগিয়ে এসে বলেন --এই হোটেল ওনার দয়ায় চলে অনেক বছর আগে এই রাজা বাবু কয়েক দিনের পরিচয়ে তাকে একটি কিডনি দান করেছিলেন তখন তিনি বাদামভাজা বিক্রি করতেন। সেই কিডনি পেয়ে তিনি বেঁচে আছেন শুধু তাই নয় তিনি সুস্থ হয়েছেন বলে তার স্ত্রী ও সেই সময় একটি কন্যার জন্ম দিতে পেরেছেন ।না হলে কি যে হতো ,তখন ঐ বাদামভাজা বিক্রির ওপরেই তাদের সংসার চলত।রাজা বাবু ভগবান দিদি। হোটেল মালিক বলে চলে আমাদের কন্যার নাম রাজনন্দিনী।আসলে মেয়ে তো রাজা বাবুরই আশীর্বাদ তাই। জানেন দিদি আমার মেয়ে খুব লক্ষ্মী ,ও আসার পর অল্প পুঁজি তে হোটেল করেছিলাম এখুন দেখুন। যে যা দেয় তাতেই চলে হোটেল কিন্তু কখনও লক্ষ্মী বাড়ন্ত হয় না রাজা বাবুর আশীর্বাদ যে। রিনা জানতে চায় কখনও রাজা বাবুর খোঁজ করেন নি ?,উত্তরে হোটেল মালিক বলে করেছে তবে পায়নি।
যে কটা পয়সা ছিল হোটেল মালিকের হাতে দিয়ে হন হন করে হাঁটতে থাকে রিনা, কোথায় যাচ্ছে কিছু জানা নেই। পা দুটো ক্লান্ত হতে বসে পরে। সামনে নদী উপরে সূর্য নদীর বুকে সূর্যের প্রতিবিম্ব। মনটা একটু শান্ত হতে চায়। হঠাৎ খেয়াল হয় মুঠোফোনটা হোটেলে ফেলে এসেছে। মরুকগে কে আছে তার খোঁজ নেবে,না সে কারোর ?নন্দনের বাপ কিডনি দিয়েছে সে নাহয় দিলেই মোবাইলেটা হঠাৎ আঁচলে টান পরে ফিরে দেখে সেই হোটেল মালিকের মেয়ে । মেয়েটি বলতে থাকে "আপনার ফোন থেকে অনেককে কল করে আমরা বুঝতে পারেছি আপনি আমাদের রাজা বাবুর বউ রানীমা" আপনি আমাদের সঙ্গে চলুন । রানীমা অনেক অন্যায় হয়েছে আপনার সাথে অনেক দুঃখ পেয়েছেন আপনি এবার আমাদের সঙ্গে চলুন। কুচ পরোয়া নেই বাবা, মা,আমি ,আপনি আর হোটেল ঠিক চলে যাবে। রিনা আবাক হয়ে ভাবে একি শুনছে সে এ যেন রাজার কথার প্রতিধ্বনি। মেয়েটি বলতে থাকে রানী মা আপনি চার দেওয়ালের মাঝে রাজা বাবুকে খোঁজ করছেন তাই কি পাবেন? রাজা বাবুতো অনেক বড়, ভগবান আমার বাবার প্রান বাঁচিয়েছেন আরও কতো লোকের উপকার করেছেন। তার প্রতিফলন চার দেওয়ালের মাঝে পাবেন না ঐ দেখুন সূর্য কে ।সূর্যের প্রতিবিম্ব কেবল নদীর ওপরেই পরে। আমাদের ঐ হোটেলে যাঁরা আজ বিনে পয়সায় আথবা অল্প পয়সায় খাবে তারাও একদিন কারোর উপকার করবে। আমি রাজনন্দিনী ,রাজা আর নন্দন এর প্রতিবিম্ব। আমারই মধ্যে আপনি ওদের প্রতিবিম্ব দেখতে পাবেন রানী মা, ঠিক যেমন নদীর বুকে সূর্যের প্রতিবিম্ব।