02/11/2022
*‘উপজাতি- আদিবাসী’ ধর্ম, বেদ, সূর্য উপাসনা*
*গন্ড (Gond) ও ভুমিয়া ‘উপজাতির’ ভগবান মহাদেব ও নারায়ণ, এবং মরক্কো-র ইসলামে ‘বাবা আয়শুর’* - পর্ব ৩
রাজা রামমোহন রায়ের সাথে কি ইসলামে ‘বাবা আয়শুর’-এর দেশ মরক্কো-র কোন ‘দূর দূর’ লিঙ্ক আছে? এমন বেমক্কা প্রশ্ন শুনে ঘাবড়াবেন না যেন! ব্যাখ্যার দায় আমার।
সূত্র দিচ্ছি আপাতত। রামমোহন ৩১ বছর বয়সে একটি বই লিখেছিলেন, আরবিতে ভূমিকা ও ফার্সিতে মূল গ্রন্থ - ‘তুহফাত উল-মুয়াহিদ্দিন’। সেই গ্রন্থের নামে যে ‘মুয়াহিদ্দিন’ শব্দ আছে, তা মরক্কো-র একটি ইসলামী সংস্কারবাদী আন্দোলনের নাম। সেই আন্দোলন যারা করেছিলো তারা মূলত ‘বার্বার’ গোষ্ঠীর। সেই বার্বার গোষ্ঠীই ইসলাম হলেও ‘বাবা আয়শুর’ প্রথা বজায় রেখেছে। রামমোহন ‘তুহফাত উল-মুয়াহিদ্দিন’ নামটা এমনি দেননি। সে না হয় রামমোহন প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
বসুধৈব কুটুম্বকম্।
‘বার্বার’ গ্রীকদের দেয়া নাম। ‘বর্বর’ শব্দ ওই থেকে এসেছে।
তা এই মরক্কো-র বার্বারদের সাথে ভারত যোগের কি সম্ভাবনা আছে?
বার্বার-রা প্রাক-ইসলামী যুগে এবং ইসলামে কনভার্টেড হয়ে বা হতে বাধ্য হয়েও যাযাবর ছিল। তাদের বিচরণ ছিল তুরস্ক ও মধ্য প্রাচ্য থেকে সমগ্র উত্তর আফ্রিকা এবং ইথিওপিয়া। মনে রাখা যাক, ইথিওপিয়া ‘ভারত’ হিসাবে গণ্য হয়েছে বুহু গ্রীক লেখকদের কাছে।
মেসোপটেমিয়া ও গান্ধারের মত, ইথিওপিয়া ছিল আর এক Cultural Melting Pot …
এই বার্বারদের সাথে আবার সাবিয়ান এবং মান্দায়ান-দের (তারাই সাবিয়ান – এই মতও আছে) সম্পর্ক আছে। তাদের গ্রন্থ ‘গিঞ্জা রাব্বা’ ও ‘নবতিয় কৃষি’ – তাতে ভারতীয় দর্শনের প্রভাব স্পষ্ট। তাদের বিশ্বাস আদম প্রথম মানুষ নন, আদমের পিতা মাতা ছিল, আদম জন্মেছিল চাঁদে (চন্দ্র বংশ ধরা যায়) এবং আদম ভারত থেকেই মধ্য প্রাচ্যে যায়। অর্থাৎ এরা আব্রাহামিয় আদম সৃষ্টি কাহিনীতে বিশ্বাস করে না।
‘গিঞ্জা রাব্বা’ গ্রন্থে ‘অবতার রাম’ নামে একজনের উল্লেখ আছে। তিনি দাশরথি রাম না হলেও, দাশরথি রামের অনুকরণেই তার নাম, আমার সন্দেহ নেই।
নিশ্চয় সকলে খবর রাখেন যে সম্প্রতি আরবে ৮০০০ খ্রিস্ট পূর্বের উপাসনা স্থল আবিষ্কৃত হয়েছে। তাকে অবশ্যই ‘হিন্দু’ বলার মত তথ্য প্রমাণ নেই। যারা তা এখনই বলছেন, সমর্থন করি না।
আরব যত ‘রুদ্ধদ্বার পলিসি’ প্রত্যাখ্যান করবে, তত অনুসন্ধানের সুবিধা হবে, এবং তাতে আখেরে মানবজাতির মঙ্গল। আরবের সুলতান ইসলামের সংস্কার চাইছেন – মিডিয়ায় পড়েছি।
ইসলামী ইতিহাস বিষয়ে কিঞ্চিৎ জ্ঞান থাকলে নিশ্চয় জানেন, প্রাক-ইসলাম আরবে মক্কায় ৩৬০ দেবদেবী উপাসিত হতেন।
কিন্তু প্রাক-ইসলামী এবং ইসলামী আরবেও যে ভারতের উপস্থিতি ছিল, তার প্রমাণ এইবার কয়েকটি ইসলামী সোর্স দেখা যাক –
১। কোরআনে সাবিয়ান-দের তিনবার উল্লেখ আছে: সূরা আল-বাকারা (২.৬২), সূরা আল-মায়েদা (৫.৬৯) এবং সূরা আল-হাজ্জে (২২.১৭)। অনেক পণ্ডিতের মতে, এই সাবিয়ান-রা হল শৈব। যা হোক, তা না হয় তর্কসাপেক্ষ। এই মুহূর্তে সে আলোচনা প্রাসঙ্গিক নয়। আপাতত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই সাবিয়ান-দের একটি গ্রন্থ আছে যার নাম ‘নবতিয় কৃষি’ গ্রন্থ, যার মতে আদমের জন্ম চাঁদে (চন্দ্রবংশ ধরা যায়) এবং আদম ভারত থেকেই ওখানে গিয়েছিল। অর্থাৎ মূলধারা ইসলামের যে বিশ্বাস – আদমের সৃষ্টি মাটি থেকে – তা এনারা মানেননা।
২। হাদিস ‘সহি আল বুখারি ২৪৭৮’ থেকে জানা যাচ্ছে, মোহম্মদ যখন মক্কায় প্রবেশ করেন তখন কাবার চারদিকে ৩৬০-টি প্রতিমা ছিল । তিনি লাঠি দিয়ে সেগুলি আঘাত করতে লাগলেন ও আবৃতি করলেন, ‘ইসলাম এসেছে, মিথ্যা দূর হচ্ছে’। অন্য হাদিসেও এ তথ্য আছে, যেমন জামি আত তিরমিধি ৩১৩৮
৩। সাঈদ আল-আন্দালুসি (১০২৯-১০৭০ সাধারণাব্দ) ছিলেন মুসলিম স্পেনের একজন আরব লেখক। ১০৬৬তে তিনি লিখেছেন: ‘ভারতীয়রা, সমস্ত জাতির মধ্যে, বহু শতাব্দী ধরে এবং প্রাচীনকাল থেকে, জ্ঞান, ন্যায্যতা এবং সংযমের উৎস। তারা মহৎ চিন্তার স্রষ্টা, সর্বজনীন কল্পকাহিনী, বিরল উদ্ভাবন এবং অসাধারণ মেধা’। [Danino, Invasion That Never Was, 2004]
সাইদ আল-আন্দালুসি ১০৬৮ সালে মুসলিম স্পেনে তাবাকাত আল-উমাম (জাতির বিভাগ) লিখেছিলেন। তাতে তিনি প্রাক-ইসলামী ধর্ম বিশ্বাস প্রসঙ্গে লিখেছেন: “আরবদের মধ্যে সকল মূর্তি পূজাকারীরা সর্বোচ্চ আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস করত, কিন্তু তারা সাবিয়ান ধর্মের একটি রূপ হিসাবে মূর্তি পূজা করত”।
অর্থাৎ, ইনি সাবিয়ান-দের ধর্ম স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং মূর্তি পূজার কথা বলেছেন।
খেয়াল রাখবেন, স্পেন আর মরক্কো-র মাঝে একফালি সমুদ্র। ওই সমুদ্র পেরিয়েই ইসলাম একবার স্পেন জয় করেছিলো।
আচ্ছা, একটু অন্যভাবে দেখা যাক।
হর = শিব (রামায়ণ। মহাভারত। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ ১.১০। গৌতম ধর্মসূত্র ৩.৮.১৫। মনু স্মৃতি ১২.১২১। পুরাণ।)
হর = প্রাচীন পারস্যে দৈব পর্বত (আবেস্তা – ‘হর বেরেজৈতি)
হর = সাঁওতালী ভাষায় পর্বত। হড়ম = বৃদ্ধ (সাঁওতালী)। হরম = প্রথম / শ্রেষ্ঠ (সাঁওতালী)।
মরক্কো-র ইসলামে ‘বাবা আয়শুর’ = শিবের মত এবং ‘উপজাতি’ মিথে সিংবোঙ্গার মত তাঁরও কোন সন্তান নেই।
কি বলবেন, কাকতালীয়? আচ্ছা, মেনে নিলাম তাহলে কাক তালি বাজাতে পারে!
[শিব দুর্গার সন্তান কার্তিক গণেশ লক্ষ্মী সরস্বতী – এ অনেক পরের পুরাণ। কেউই বায়োলজিক্যাল নন। প্রাচীন ভারতের মূল্যবোধে, বায়োলজিক্যাল সন্তানের চেয়েও অন্য সন্তান অনেক গভীর সম্পর্ক গণ্য হত। গুরু শিষ্য/ শিষ্যা সম্পর্ক তার অন্যতম উদাহরণ।]
যম = ধর্ম, ধর্মের রূপ, মৃত্যুর অধিপতি ইত্যাদি বৈদিক তাৎপর্য। ঋগ্বেদে ঋষিও বটে (যম যমী সংবাদ)। বিবস্বত বা সূর্যের পুত্র – অর্থাৎ সূর্যের অংশ।
যিমা = আবেস্তায় প্রথম মানুষ
যম = যম হুদুর, যম রাজা = সাঁওতালী পুরাণে মৃত্যুর দূত। ‘যম সিম’ এক যজ্ঞ উৎসব।
মরক্কো-র ইসলামে ‘বাবা আয়শুর’ = তাঁর বাৎসরিক মৃত্যু ও পুনরুত্থান – সূর্য মিথ্।
কি বলবেন, কাকতালীয়? আচ্ছা, মেনে নিলাম তাহলে কাক তালি বাজাতে পারে!
মরক্কো-র ইসলামে ‘বাবা আয়শুর’-এর রিচ্যুয়ালসে, একটি জ্বলন্ত চাকা-কে পাহাড় থেকে গড়িয়ে দেবার প্রথা আছে, যা অনেক পণ্ডিতের মতে সূর্যের ‘আকাশ পরিভ্রমণ’ প্রতীক।
খেয়াল রাখুন, সূর্য ও চক্র সম্পর্ক ঋগ্বেদে আছে। ইন্দ্র সূর্যের এক চক্র হরণ করেন এবং সূর্যকে আকাশে প্রতিষ্ঠিত করেন। এর তাৎপর্য পরে ব্যাখ্যা করছি।
আবার অনেক পণ্ডিতের মতে, ‘বাবা আয়শুর’ হলেন vegetation myth – বা প্রকৃতি ও কৃষি মিথ্।
মুশকিল হচ্ছে, যে পণ্ডিতরা এই ‘সোলার মিথ’ বনাম ‘ভেজিটেসন মিথ’ তর্ক করছেন, তাঁরা শ্রুতি পড়াশোনা করলে জানতেন, ইন্দ্র ও বিষ্ণুর মধ্যে এই সমন্বয় ঘটে গেছে বহু হাজার বছর আগে। মহাভারতে পাণ্ডবরা ইন্দ্র বা ইন্দ্রের অংশ বলে কথিত, কিন্তু তাঁদের আবার সূর্য বলা হয়েছে। গীতায় বিষ্ণু-কৃষ্ণের যে বিশ্বরূপ, তা –
দিবি সূর্যসহস্রস্য ভবেদ্ যুগপদুত্থিতা ।
যদি ভাঃ সদৃশী সা স্যাদ্ ভাসস্তস্য মহাত্মনঃ ॥১১.১২॥
যদি আকাশে সহস্র সূর্যের প্রভা যুগপৎ উদিত হয়, তা হলে সেই মহাত্মা বিশ্বরূপের প্রভার কিঞ্চিৎ তুল্য হতে পারে।
[১৬ জুলাই ১৯৪৫, প্রথম অ্যাটমিক পরীক্ষা দেখে ওপেনহাইমার এই শ্লোকটি উচ্চারণ করেছিলেন। কৃষ্ণ ও নতুন যুগের সূচনা যুক্ত হয়ে আছে]
‘বেদ’ ও ‘ধর্ম’ – এই দুটি বৈদিক ধর্ম সংস্কৃতি ঐতিহ্যের মূল শব্দ-ধারণা-আদর্শ।
‘আদিবাসী’ ও ‘উপজাতিরা’ তাদের ধর্মকে বলেন –
সারি ধরম = সত্য ধর্ম
সারনা ধরম = সত্য ধর্ম [‘সারনা’ এসেছে ‘সারিন’ বা ‘সারিনাই’ শব্দ থেকে, সাঁওতালী ভাষায় যার অর্থ সত্য]
মানুষের ক্ষমতাতন্ত্রের চিরাচরিত নিয়মে, সারি ধরম না সারনা ধরম – কোন নামে স্বীকৃত হবে, তা নিয়ে ‘আদিবাসীদের’ সংগঠনের মধ্যে দ্বন্দও আছে।
বৈদিক হিন্দু ধর্মের প্রকৃত নাম শুধুই ‘ধর্ম’, এবং তিনটি গুণ প্রকাশক নাম – সনাতন ধর্ম, সত্য ধর্ম ও ধ্রুব ধর্ম।
গৌতম বুদ্ধ এবং মহাবীর নিজেদের ধর্মশিক্ষাকে ‘সত্য ধর্ম’ বলেছেন।
স্মরণে রাখুন, উভয়েই ‘ভগবান’ সম্বোধনে পূজ্য। ঋষি ও গুরুকে ‘ভগবান’ সম্বোধন উপনিষদীয়।
সমস্ত ‘উপজাতির’ সাধারণ উপাস্য (কম-বেশী গুরুত্ব সাপেক্ষে, এবং কখনো সমন্বয়ী/ overlapping, কখনো কম-বেশী ভিন্ন) হল ‘ভগবান’, ‘ঠাকুর’, ‘মহাদেও’, ‘সিংবোঙ্গা’ (সিং = √সহ্ ধাতু থেকে, যার অর্থ ‘শক্তিশালী, ক্ষমতাশালী, বলবান’। ‘সিংহ’ শব্দও ওই থেকে)। তাহলে বৈদিক ধর্ম ঐতিহ্য সংস্কৃতির বাইরে কি করে হল?
‘সারি ধর্ম / ধরম’ ‘সরন ধর্ম/ ধরম’ – ‘ধর্ম’ শব্দ! তাহলে বৈদিক ধর্ম ঐতিহ্য সংস্কৃতির বাইরে কি করে হল? ‘ধর্ম’ শব্দ যারাই গ্রহণ করেছেন, তারাই বৈদিক ছত্রতলে। ভারতীয় উপমহাদেশে, আব্রাহামিয় খ্রিস্টীয় রেলিজিওন ও ইসলাম মজহব/ দ্বীন নিজেদের খ্রিস্ট ধর্ম ইসলাম ধর্ম পরিচয় দিয়ে ভারতীয় এবং বৈদিক হতে চেয়েছে।
ইসলাম দ্বীন শব্দ নিয়েছে প্রাচীন পারস্যের আবেস্তা থেকে।
‘ঠাকুর’ শব্দ খুব ইন্টারেস্টিং। সংস্কৃত শব্দ ‘ঠক্কুর’ - ‘ঠ’ শব্দের অর্থ ‘শক্তিশালী শব্দ’ – অর্থাৎ বাচ্ তাৎপর্য, ‘চাঁদের ফালি’, ‘সকলের গম্য স্থান’ এবং ‘শিব’। ‘ঠক্কুর’ শব্দটি আদি বৈদিক নয়, পরবর্তীকালে সংস্কৃত গ্রহণ করেছে, যদিও তার শব্দাংশ বৈদিক। প্রাকৃত ‘ঠাকুর’ – ক্রমে বিভিন্ন অর্থ দ্যোতক – দেবতা, শ্রেষ্ঠ মানুষ থেকে ঠাকুর পদবী – রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর – থেকে ‘শোলে’ সিনেমায় ‘তেরে হাত মুঝে দে দে ঠাকুর’!
‘সারি ধর্ম’ (সারি শব্দ ‘সার’ তাৎপর্যবাহী), ‘সরন ধর্ম’ – এদের প্রকৃত নাম ‘আদি ধর্ম’ – প্রথম প্রস্তাব করেন প্রফেসর রাম দয়াল মুন্ডা (১৯৩৯-২০১১)। ‘আদি ধর্ম’ – বৈদিক শব্দ (বলার অপেক্ষা রাখে না), এবং প্রফেসর মুন্ডা-র নামেও ‘রাম’। [ভারতে রাম নাম খুবই কমন; যেমন, সীতারাম ইয়েচুরি-র নামে ‘সীতা’ ও ‘রাম’]।
সাঁওতালী ভাষায় ‘রাম’ শব্দ গাছ, এক ধরণের ধান (কৃষি), শ্রেষ্ঠ, থাবা বা শক্তি (সংস্কৃত ভাষায় যেমন ‘ব্যাঘ্রপদ’), মনোযোগ এবং ভারসাম্য বোঝায়। (Campbell)
আবার, আর এক দেবতা ‘জাহের এরা-র’ আসল নাম ‘রাম সাল্গি’ – দাশরথি রামের নামের অনুকরণে/ অনুসরণে।
প্রফেসর মুন্ডা আদি-ধর্ম প্রসঙ্গে বলেছেন: ‘The primary aspect of Adi-dharma probably is the fact that unlike the institutionalised religions, it has manifested itself on the mutual relationship of the human being and nature. It does not believe in the superiority of human beings over the creation’
অর্থাৎ, প্রাতিষ্ঠানিক রেলিজিওন নয়, যে ধর্ম মানুষ ও প্রকৃতির পারস্পরিক সম্পর্ক ভিত্তিক, তা-ই আদি-ধর্ম।
প্রফেসর মুন্ডা খুব পরিষ্কার ভাবে ধর্ম ও রেলিজিওনের পার্থক্য করেছেন।
বিশেষ করে মনে রাখা যাক, ঋগ্বেদের তিনটি সূক্ত: ঋষি ভীষজ অথর্বন-এর ‘ওষধি সূক্ত’ (১০.৯৭); ঋষিকা শ্রদ্ধা কামায়নী-র ‘শ্রদ্ধা সূক্ত’ (১০.১৫১) এবং ঋষি দেবমুনি ঐরুম্মদ / ঐরাবত-এর ‘অরণ্যানী সূক্ত’ (১০.১৪৬)।
‘অরণ্যানী সূক্তে’, ঋষি অরণ্যকে বলেছেন ‘মৃগাণাং মাতরম’ – বন্য পশুদের মা। ঋষি বলছেন ‘ন বা অরণ্যানী হর্ন্ত’ – অরণ্য কখনো হত্যা করে না, যদি না তাঁকে কেউ আক্রমণ করে তাহলে কোন আশঙ্কা নেই। অরন্যে বাস করলে তাঁর মধ্যে ‘ব্যক্তি’ উপস্থিতি অনুভব করা যায়।
‘আদিবাসী’ বা ‘উপজাতিদের’ যে উপাস্য – ভগবান ঠাকুর বোঙ্গা – সবই শ্রুতি সম্মত।
‘উপজাতি/ আদিবাসী’ তকমাপ্রাপ্ত যারা, তারা কোন না কোন রূপে সূর্য উপাসনা করে। গন্দ এবং ভুমিয়া ‘সূর্য দেও’ উপাসনা করে এবং শূয়র বলি দেয়।
খোন্দ-দের পরম দেবতা আলোর দেবতা সূর্য এবং তার স্ত্রী তারি। তারি হল পৃথিবী দেবী আবার অন্ধকারের শক্তি।
ঋগ্বেদে সূর্য অন্যতম দেবতা, কখনো কখনো ইন্দ্র ও বিষ্ণুর মধ্যে সূর্যের সমন্বয়ী রূপ আছে, আবার কখনো কখনো ইন্দ্র সূর্যের চক্র হরণ করে তার ক্ষতিকারক দিক নাশ করেন। এই মিথ ফিরেছে অর্জুন কর্ণের দ্বন্দে। বৈদিক পুরাণে, পৃথিবীর এক নাম কালি বা কৃষ্ণা। বেদে পৃথিবী মাতা রূপে উপাস্য।
বিহারের ওরাওঁ ‘উপজাতি-র’ পরম দেবতা ‘ধর্মেশ’ এবং সূর্য।
ধর্মেশ = ধর্ম + ইশ।
মুন্ডা, অসুর, ভুমিয়া প্রভৃতির শ্রেষ্ঠ দেবতার বিষয়ে আসা যাক – ‘সিংবোঙ্গা’।
‘সিংগ’ শব্দের অর্থ আলো। সিংবোঙ্গা = আলোর দেবতা = সূর্য। আবার কখনো কখনো চাঁদও।
‘সিংগ’ শব্দের আলোর তথা শ্রেষ্ঠ তাৎপর্য ধরে,
১। সিংবোঙ্গা = পরম দেবতা;
২। সিংগভূম = সিংগদিশুম = শ্রেষ্ঠ ভূমি/ দেশ [খেয়াল করুন – দিশুম = দেশ]
৩। সিংকুল = সিংহ = শ্রেষ্ঠ প্রাণী
সিংবোঙ্গার দৃশ্যমান রূপ সূর্য এবং চাঁদ; আর অদৃশ্য রূপ ‘হরম সিংবোঙ্গা’। তিনি স্রষ্টা, রক্ষাকর্তা, মহা শক্তিশালী ও সর্বব্যাপী।
শ্রুতিতেও, সূর্যের দুই রূপ। দৃশ্যমান রূপ আকাশের সূর্য। আর অদৃশ্য ঈশ্বরীয় রূপ হিরণ্যগর্ভা।
'বৈদিক' শব্দ আমি ব্যবহার করি all inclusive অর্থে। যারা বৈদিক / অবৈদিক মেরুকরণ করেন, তা 'বৈদিক' বিষয়ে তাঁদের কিছু পূর্ব-সিদ্ধান্ত ভিত্তিক; যেমন, ‘বেদ’ মানে ‘যাগ যজ্ঞ, রিচ্যুয়ালস, বলি’ ইত্যাদি অর্থ করা। অর্থাৎ এই পূর্ব-সিদ্ধান্ত আসলে সঙ্কীর্ণ এবং প্রায়ই এজেন্ডা প্রসূত। এবং ঘোরতর ‘পাঠ ঘাটতি’ আছে। প্রকৃতপক্ষে, ‘বৈদিক’ শব্দ-ধারণার কোন বিপরীত মেরু সম্ভব নয় – অর্থাৎ ‘অবৈদিক’ বলে কিছু হয়না, কারণ সমস্ত মত সমস্ত বিশ্বাস সমস্ত উপাসনা সমস্ত মানুষ – বেদ স্বীকৃত। ব্যাস ঋগ্বেদ সঙ্কলন করেছিলেন এই সর্ব স্বীকৃতি ও ‘সমষ্টি প্রজ্ঞা-র’ প্রতীক রূপে। ঋগ্বেদের মূল বার্তা এই সঙ্কলন ‘স্থাপত্য’।
বেদ √বিদ্ ধাতু থেকে মানে জ্ঞান – বৈচিত্রের বা বহুত্বে প্রকাশের জ্ঞান। কোন মানব জ্ঞানবিহীন নন।
এই বেদ-এর কোন বিপরীত মেরু নেই; ঠিক যেমন ঋগ্বেদে ‘আর্য’ শব্দের কোন বিপরীত ‘অনার্য’ শব্দ নেই।
‘বেদ’ শব্দ শ্রুতির মূল শব্দ; আবেস্তায় আছে, বুদ্ধ মহাবীর আজিবক – সকলেই জীবনের লক্ষ্য বলেছেন। সাঁওতালী ভাষাতেও ‘বেদ’ শব্দ আছে একই তাৎপর্য নিয়ে।
পৃথিবীর সমস্ত সভ্যতা সংস্কৃতির মূল সত্ত্বা হল সমন্বয়। সমস্ত সভ্যতা সংস্কৃতি আসলে নেটওয়ার্ক। এটিই আমার টেম্পলেট। এই টেম্পলেট ভিত্তি করেই বাস্তব পরীক্ষা করবো।
সমন্বয় মানে ভিন্নতা বা বহুত্বের সহাবস্থান ও সম্পর্ক ও গ্রহণ। অর্থাৎ বহুত্ব ও ভিন্নতা থাকবেই। তার মানে বহু ও ভিন্ন আইডেন্টিটি থাকবেই। ভিন্নতা ও অন্যের আইডেন্টিটি লুপ্ত করে কখনো ‘একত্ব’ হয়না। ‘সবাই এক হয়ে যাক, একরকম হয়ে যাক, একই ছাঁচে ঢালাই হোক’ – এই ‘রক্তবীজবাদ’ ও ‘ক্লোনবাদ’ মানবতা ও বাস্তব ও সত্য ও ধর্মের শত্রু।
এই ভিন্নতা ও বহুত্ব নিয়েই ঋগ্বেদের শেষ সূক্তে বৈদিক ঋষি ঐক্যের আদর্শ ঘোষণা করেছেন।
‘আদিবাসী’ ‘মূলনিবাসী’ ‘ভূমিপুত্র’ ‘উপজাতি’ ‘দলিত’ – এই শব্দগুলি দিয়ে যে জনগোষ্ঠী ও আইডেন্টিটি বোঝানো হয়, জেনে রাখা যাক, এই প্রত্যেকটি শব্দ ও syllable বৈদিক ও সংস্কৃত। তাহলে বৈদিক ধর্ম ঐতিহ্য সংস্কৃতির বাইরে কি করে হল?
সভ্যতা সংস্কৃতি হল নেটয়ার্ক। সমন্বয় ও সংমিশ্রণ তার ধর্ম। এর বাইরে যাবার রাস্তা নেই।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আর রেলিজিয়াস কনভার্সনের উদ্দেশ্যে বর্ডার টানার চেষ্টা মিথ্যাচার। কালের তরঙ্গে ভেসে যাবে। যারা ‘অন্যকে’ লুপ্ত করে নিজের আইডেন্টিটি কায়েম করতে চায়, তাদের ‘মৃত মন’, তারা লোপাট হয়ে যাবে।
ঋষি বলে গেছেন - বসুধৈব কুটুম্বকম্।
এর অন্যথা হবে না।
প্রত্যেকেই নিজ নিজ আইডেন্টিটি ভালবাসুক, আঁকড়ে থাকুক, শ্রদ্ধা করুক, স্বাধিকারে অস্তিত্বমান থাকুক। তবেই আত্মীয়তা ও সহাবস্থান সম্ভব।
তথ্যসূত্র
পূর্বের পর্বে দেয়া তথ্যসূত্র, এবং
SINGH, K. S. (1992). Solar Traditions in Tribal and Folk Cultures of India. India International Centre Quarterly, 19(4), 28–39. http:// www. jstor. org/ stable/ 23004006
Canney, M. A. (1928). The Santals and Their Folklore. Folklore, 39(4), 329–343. http:// www. jstor. org/ stable/ 1255968
Kochar, V. K. (1966). Village Deities of the Santal and Associated Rituals. Anthropos, 61(1/2), 241–257. http:// www. jstor. org/ stable/ 40458237
ক্রমশ
ইন্দ্রজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯.১০.২২
বুধবার
---------
barnakharpublisher.com