Rafia Sultana's Stories

  • Home
  • Rafia Sultana's Stories

Rafia Sultana's Stories রাফিয়া সুলতানার স্বরচিত ছোটগল্প ও প্রবন্ধ�

 #ছোটগল্পকেউ কথা রাখে না রাফিয়া সুলতানা16.07.23দেখে কে বলবে যে ওরা যমজ বোন নয়? পথে ঘাটে পার্কে, সিনেমা হলে যেখানেই যায...
16/07/2023

#ছোটগল্প
কেউ কথা রাখে না
রাফিয়া সুলতানা
16.07.23

দেখে কে বলবে যে ওরা যমজ বোন নয়? পথে ঘাটে পার্কে, সিনেমা হলে যেখানেই যায় , ওরা দুজন। মৃত্তিকা আর কৃত্তিকা। এমনিতেও খুব ভাব দুইবোনে, যদিও ওরা পিঠোপিঠি নয়। রীতিমত তিন তিনটি বছরের তফাৎ দুজনের। বরং মৃত্তিকার গঠন‌ একটু ছোটখাটর ওপরে। এবং কৃত্তিকাই সামান্য হলেও একটু বড়সড়। তাই অনেকেই তাকে মৃত্তিকার বড়দিদি ভেবে ভুল করে। তবে দুইবোনের চেহারাতে তেমন একটা বিশেষ মিল নেই। মৃত্তিকা বেশ একটু সুন্দরী। টিকালো নাক, টানা চোখ দুটিতে যেন কাজল পরানো। ফর্সা রঙ, লাল ঠোঁট। একনজরেই মন কেড়ে নেওয়ার মত! কৃত্তিকা ততটা সুন্দর না হলেও তার‌ চেহারায়ও লাবণ্য আছে যথেষ্ট, মুখের গড়নে আছে মিষ্টতা। একটা স্নিগ্ধ ছোঁয়া আছে ঘুম জড়ানো বড়বড় পাঁপড়ি ওয়ালা দুটি চোখের চাওনিতে! রঙটা অবশ্য একটু চাপা, যাকে বলে শ্যাম বর্ণা! মৃত্তিকা যেমন লেখাপড়ায় ভাল, কৃত্তিকা তেমনই গানে, নাচে ও খেলাধুলায় পারদর্শী। দুই মেয়ে যেন দুটি রত্ন। তাদের নিয়ে চৌধুরী দম্পতির গর্বের‌ অন্ত নেই। বড় বন্ধুত্ব দুইবোনের। বাড়িতে যখন জানাজানি হল পাশের পাড়ার রহমান বাবুর ছেলে কুন্তলকে ভালোবাসে মৃত্তিকা তখন যে ঝামেলা ঝঞ্ঝাটে পড়তে হয়েছিল মৃত্তিকাকে তার অনেকটা ছোটবোন কৃত্তিকাই সামাল দেয়। বাবা মাকে বোঝায় সে যে কুন্তল তাদের সম জাতের না হলেও পড়াশোনায় সে খুবই ভাল । জেলাস্কুলের ছাত্র কুন্তল ওরফে কাজিবুর রহমান প্রত্যেক ক্লাসে প্রথম ছাড়া কোনদিনও দ্বিতীয় হয়নি । ফুটবল ক্রিকেট সব খেলাতেই তুখোড় সে। পাড়ায় সেবার দুর্গাপূজার সময় ক্লাবের পরিচালনায় যে নাটক অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে প্রধান চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছিল কুন্তল। সেই থেকেই কুন্তলকে ভালো লাগতে শুরু করে কৃত্তিকার‌! যদিও দিদির সঙ্গে তার ভাব হয় পাড়ায় দত্ত স্যারের কাছে একসঙ্গে ইংরেজি টিউশন পড়ার সময় এবং সেটার তার পরের বছর থেকেই সূত্রপাত । কৃত্তিকা জানতে পারে সে কথা যখন দিদির খাতার ভিতরে গোঁজা কুন্তলের একটা চিঠি দেখতে পায় সে। কৃত্তিকা তখন ক্লাস সেভেন ও মৃত্তিকা ক্লাস টেনের ছাত্রী। দিদি আর কুন্তল আলাদা আলাদা কলেজে ভর্তি হলে কৃত্তিকা‌ই তাদের চিঠি আদান প্রদানের মাধ্যম হয়ে ওঠে। দিদিকে লেখা কুন্তলদার চিঠি নিয়ে সে কৌতুহলী হয়ে একদিন চুপিচুপি ছাদের চিলেকোঠায় উঠে খুলে পড়তে শুরু করে। কুন্তলের যেমন সুন্দর হস্তাক্ষর তেমন সুন্দর ভাষা! সেদিন থেকে প্রতিবার‌ই সে দিদিকে পৌঁছানর আগেই পড়ে নিত তাদের সেই প্রেমপত্র। পড়তে পড়তে কেমন যেন তন্ময়তায় বিলীন হয়ে যেত! মনে হত এই কুন্তল যেন তার কতকালের চেনা। কোন জন্মের যেন আত্মার যোগাযোগ আছে তার সঙ্গে! মাঝেমাঝে মনে সন্দেহ নিয়ে ভাবত, কুন্তলকে কি ঈশ্বর ঠিক তাঁর দিদির জন্য‌ই সৃষ্টি করেছিলেন? ক্রমে সে কুন্তলের চূড়ান্ত ফ্যান হয়ে গেল একেবারে! তাকে নিয়ে নানারকম জল্পনা কল্পনা চলত তার মনের ভিতর। ভাবতে ভালো লাগতো তাকে নিয়ে। তাই বাবা মা যখন দিদিকে বকাবকি করছিলেন তাদের ভালবাসার কথা জানতে পেরে তখন কৃত্তিকাই রীতিমত ময়দানে নেমে পড়ে, দিদির এই অসম জাতের প্রেম বাঁচানোর জন্য! মনে মনে হাসি পায় এখন কৃত্তিকার সে সব কথা মনে পড়লে! কতটুকুই তখন সে আর, অথচ কত সাহস মনে! তারপর আস্তে আস্তে বাবা মা মেনে নেন। সত্যি তো! আজকাল এসব নিয়ে আর ছুঁইছাঁই করলে চলে না! অনেক আধুনিক হয়ে গেছে সমাজ! পড়ালেখার কাছে এমনকি টাকাপয়সাও আর দেখে না মানুষ! ক্রমে তাদের বাড়িতে কুন্তলের আসা যাওয়া শুরু হয়। কুন্তল তাদের বাড়িতে এলে কৃত্তিকাই যত্ন করে চা কফি বানিয়ে, সঙ্গে পটেটো চিপস্ ফ্রাই ক'রে বিস্কুট সাজিয়ে, কখনো বা গ্রীষ্মের দুপুরে ফল কেটে, দ‌ইয়ের সরবত গুলে, তার সঙ্গে মনের মাধুরী মিশিয়ে পরিপাটি করে নিয়ে আসতো বসার ঘরে তার প্রিয় কুন্তল দার জন্য। কখনো বা জল ঢেলে হাত ধুতে সাহায্য করার সময়, হাতে হাত ঠেকে গেলে একরকম ভালোলাগায় শিহরণ খেলে যেতো তার একরত্তি কিশোরী হৃদয়টায়! কোনো কারণে কুন্তলের উপরে হ‌ওয়া দিদির মান ভাঙাতেও তাকে দেখা যেত কখনো সখনো! কুন্তলের হয়ে ওকালতি করত তখন সে বেশ মুন্সিয়ানার সঙ্গে। তাদের বাড়িতে কুন্তলের যেদিন আসার কথা থাকত, সেদিন মৃত্তিকার চেয়ে তার‌ই বরং মনের অস্থিরতা থাকত বেশি! বারংবার সে ছাদে উঠে বা দোতলার ঝুল বারান্দার রেলিং এ উঁকি ঝুঁকি মারত! আর কখনো আসার কথা থাকা সত্ত্বেও যদি সে না আসত, সেদিন কৃত্তিকার মন খারাপ ও উৎকন্ঠা দেখে কে! কেন সে এল না? কারণটা কী? শরীর খারাপ বা পথে কোন এক্সিডেন্ট হল না তো! হবু শ্যালিকা কৃত্তিকার উপর কুন্তলের টান‌ও নেহাৎ কম ছিল না! একেই তার নিজের কোন বোন ছিল না, তার উপর কৃত্তিকার যত্ন আত্যি ও আন্তরিকতা তার হৃদয়কেও স্পর্শ করত নিঃসন্দেহে। তার প্রতি কৃত্তিকার অসীম টান ও দুর্বলতা বুঝিবা সেও টের পেয়েছিল!

দেখতে দেখতে আরও পাঁচটি বছর কেটে গেছে। দিদি এম এস সি ফার্স্টইয়ার ও সে এখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী! কুন্তল দা এখন আর তেমন তাদের বাড়িতে আসে না! সে এখন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র। বেশ কয়েক বছর ধরে কটকে থেকে পড়াশোনা করছে! তার দিদিও কলকাতায় বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে ভর্তি হয়েছে। সে এখন সেখানকার হষ্টেলে থাকে। তবে আসন্ন দুর্গাপুজোর ছুটিতে নিশ্চিত দুজনেই বাড়িতে আসবে। তখন যদি আবার দিদির সঙ্গে দেখা করতে আসে কুন্তল দা তাদের বাড়ি, তাহলে তার‌ও দেখা হবে ওর সঙ্গে! সেটা কল্পনা করতেই মনটা অনাবিল আনন্দে ভরে উঠছে কৃত্তিকার!
ওদিকে আবার একটা মুশকিল হয়েছে। এবার প্রিটেষ্ট পরীক্ষায় ভীষণ কম নম্বর পেয়ে সে প্রায় সব কটা সাবজেক্টে‌ই টেনেটুনে পাশ করেছে। পড়াশোনাতে কোনকালেই তেমন ভাল ছিল না সে। তার উপর গানের স্কুলে, নাচের ক্লাসে সময় দিতে গিয়ে উঁচু ক্লাসের পড়া আর সামাল দেয়া যাচ্ছে না তার পক্ষে। তাই বাবা নাচগান ছেড়ে দিতে বলছিলেন। অথচ এ দুটোতেই তার মন লাগে বেশি পড়ালেখার চেয়ে। মা জানেন সে কথা! তাই মাও চান না সে এগুলো ছেড়ে দিক। অথচ বাবা চান যেহেতু সামনে তার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা, তাই এ বছরটা বন্ধ রাখতে বলেছিলেন উনি এ দুটো। বলতে গেলে মায়ের জন্য‌ই এগুলো চালিয়ে যেতে পেরেছে এতদিন! মা বলেন, যার যেদিকে ন্যাক, তার সেই লাইনেই লেগে থাকা ভালো। তাতে সাফল্য পাওয়া যায়!

এদিকে পুজোর ছুটি পড়ে গেছে। দিদি এসে গেছে কলকাতা থেকে। শুনেছে কুন্তল দাও ফিরেছে কটক থেকে। কৃত্তিকা এখন অপেক্ষায় আছে দিদির সঙ্গে দেখা করতে ওর এ বাড়িতে আসার !
অথচ দিদির কোন হেলদোল‌ই নেই এ ব্যাপারে! কোন উচ্চবাচ্য‌ই করছে না! সে নিজে থেকে কুন্তল দার প্রসঙ্গ তুললেও কেমন যেন এড়িয়ে যাচ্ছে মৃত্তিকা! অথচ এই কুন্তলের সঙ্গে তার ঘটে যাওয়া সকল খুঁটিনাটি বিষয়, ঘটনা ও আলাপ আলোচনাই সে ছোটবোনের সঙ্গে শেয়ার করতে কত‌ই না ভালবাসত একদিন! কৃত্তিকাও সেই সব শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করত, কখন দিদি কলেজ থেকে ফিরবে! কুন্তল দা কি মজার গল্প শুনিয়েছে আজকে, বা কি নিয়ে তাদের মধ্যে খুনসুটি, কথা কাটাকাটি অথবা তর্কবিতর্ক ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে! বা কোন পার্কে দেখা করেছে তারা আজ। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কোন হলে মুভি দেখতে গেছে দুজনে ইত্যাদি ইত্যাদি! কিন্তু কৃত্তিকা লক্ষ করেছিল কুন্তলের কটকে পড়তে যাওয়া আর মৃত্তিকার কলকাতায় ভর্তি হ‌ওয়ার পর থেকেই সব যেন কেমন পাল্টাতে শুরু করেছিল!

এদিকে দেখতে দেখতে পুজো এগিয়ে আসছে! সেদিন পুজোর কেনাকাটা করতে দুইবোন যখন বাজার করতে বেরিয়েছে তখন মোড়ের মাথায় হঠাৎ কুন্তলদার সঙ্গে দেখা কৃত্তিকাদের! বুকটা খুশিতে ছলাৎ করে উঠলো কৃত্তিকার! চোখাচোখি হতে কুন্তল দা একগাল হাসলেও কোন কথাই বলল না! এদিকে দিদিটাও যেন দেখেও না দেখার ভান করে তাড়াতাড়ি তার হাত ধরে টেনে নিয়ে সামনের গলিতে ঢুকে গেল! কৃত্তিকা অবাক দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে দিদির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল, কিন্তু তার মুখের ভাব দেখে আর কিছু বলতে সাহস করল না! মার্কেটিং থেকে ফিরে এসে মৃত্তিকা অনেক কথা বললেও একবারও কুন্তলের প্রসঙ্গ তুলল না! ভারি বিস্ময় জাগল কৃত্তিকার মনে। একদিন এই নিয়ে খুব জোরাজুরি করাতে অবশেষে দিদি মুখ খুলল! ভীষণ মর্মাহত হল কৃত্তিকা যখন শুনল দিন কয়েক আগে কুন্তলের সঙ্গে তার ব্রেকআপ হয়ে গেছে! ভিতরটা কেমন ছ্যাঁৎ করে উঠল তার! বুকটায় যেন মোচড় দিয়ে উঠল যখন আরও শুনল দিদি তার বাবার বন্ধুর আনা একটা সম্বন্ধয় পাকা দেখায় মত দিয়েছে।
কিন্তু কৃত্তিকার যেন কিছুতেই মন মানছিলো না। যে কুন্তলকে দিদি এত ভালোবাসতো, যাকে দেখা করার জন্য কলেজের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে প্রায় পালিয়ে যেত, যার মুখে সবসময় কুন্তলের কথা লেগেই থাকতো, কী এমন হলো যে তার নাম মুখে আনতেই সে এখন চায় না? ছোটবোনের অনেক পীড়াপীড়িতে অবশেষে মৃত্তিকা বললো,
----জানিস না তুই, ও ভীষণ সেলফিস! জানিস‌ই তো এত ভালো স্টুডেন্ট আমি, পড়াশোনা আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। মাস্টার্স শেষ করে রিসার্চ করতে চাই। তারপর হয় গবেষক নয় প্রফেসর হতে চাই আমি। কিন্তু কুন্তল চায় না আমি চাকরি করি। ও বলে, মেয়েদের কাজ শুধু ভালোভাবে সংসার সামলে রাখা, ভালো স্ত্রী ও কেয়ারফুল মা হয়ে সন্তানদের ভালোভাবে মানুষ করা। বলতো, চাকরি করলে কি এসব হ‌ওয়া যায় না?
যে সব মহিলারা সার্ভিস করেন, তারা কি স্বামী, সন্তানদের খেয়াল রাখে না! কিন্তু ও কিছুতেই এ কথা মানবে না! বলে, চাকরি করলে তুমি যত‌ই চাও না কেন, কিছুতেই সুগৃহিনী হতে পারবে না! দুদিক সমান ভাবে কখনোই নাকি সামলানো সম্ভব নয়।
দ্যাখ, কিছুতেই আমি ওকে বোঝাতে পারলাম না। ফলে
ওর কাছ থেকে সরে আসা ছাড়া আমার আর কোন পথ খোলা ছিলো না!
এই বলে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো! কৃত্তিকা অনুভব করতে পারলো দিদির মর্মব্যথা। তাকে সান্ত্বনা দেয়ার আর কোনো ভাষা খুঁজে পেলো না! মনে মনে ভাবলো, সে নিজে হলে এত দুঃখ পেতো না, কারণ কেরিয়ার নিয়ে তার এত উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই! একজন ভালো জীবনসাথী পেলে, ভালো ব‌উ আর যোগ্য মা হতে পারলেই সে সুখী হতো! কিন্তু মন মানসিকতা তো সবার একরকম হয় না! যে যেমন করে জীবনটাকে ভাবে, সে তেমনটাই পাবার আশা করে আরকি! ফলে তার দিদির এতে কিছু দোষ নেই!

পাড়ায় পুজোয় অনেক হ‌ইহুল্লোড় চললেও কৃত্তিকার যেন কিছুই আর ভাল লাগছিল না! পুজো মণ্ডপে সপ্তমীর অঞ্জলি দিতে যাবার সময় মুখোমুখি দেখা হল আবার কুন্তলের সঙ্গে। সে একপলক দেখেই চোখ নামিয়ে নিলে কুন্তল তার পাশে এসে তাকে নবমীর দিন বিশুদার চায়ের দোকানে দেখা করতে বলল। তবুও কৃত্তিকা আর চোখ তুলে তাকাতে পারল না, তার বুকে এত‌টাই হাতুড়ি পিটছিল! ভাগ্যিস দিদির শরীরটা খারাপ থাকায় সে আজ তার সঙ্গে আসেনি, ন‌ইলে কি ভাবতো! মনে মনে বললো কৃত্তিকা।
বাড়িতে এসে মনটা খারাপ করায় লুকিয়ে লুকিয়ে ভীষণ কাঁদল ও! কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারল না , মনটা কার জন্য বেশি খারাপ করছে ওর! দিদির সঙ্গে কুন্তলের প্রেম ভেঙে যাবার জন্য, না কুন্তলের সঙ্গে আর সেভাবে দেখা হবে না, সে জন্য?

আজ ইচ্ছে করেই একটু বেশি রকম সাজগোজ করেছে সে, যেটা সচরাচর তার স্বভাব বিরুদ্ধ। যদিও তার দিদি একটু উগ্র সাজগোজ করতেই বরাবর পছন্দ করত। কিন্তু সে ছিল তার বিপরীত। আজ তার পরনে চ‌ওড়া লাল পাড়ের গরদের শাড়ি। উঁচু করে বাঁধা খোঁপায় গোলাপ ও বেলফুলের মালা জড়ানো। ঠোঁটে গাঢ় করে লাল লিপস্টিক। চোখে আই লাইনার। মুখে হাল্কা মেকআপ! মিষ্টি একটা পারফিউম ছিটিয়ে নিয়েছে গায়ে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিজেরই যেন খুব ভাল লাগছিল ওর!

নবমীর সন্ধ্যারতী চলছে মণ্ডপে! ঢাকের আওয়াজে কিছুই শোনা যাচ্ছে না। রাস্তায় লোকে লোকারণ্য! যত প্যাণ্ডেল হপারদের ভিড়! কৃত্তিকা তাদের পাশ কাটিয়ে পিছনের গলিটাতে দ্রুত ঢুকে পড়ল! খুব তাড়াতাড়ি পা চালাল সে। অবশেষে গন্তব্যে পৌঁছে দেখল বিশুদার চায়ের দোকানের পিছনে দাঁড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে কুন্তল ওরফে কাজিবুর রহমান। পরনে হাল্কা নীল রঙের পাঞ্জাবি, তাতে জরির কাজ করা। হাঁটুর নীচে দেখা যাচ্ছে সাদা ধবধবে পাজামা। হাতে সোনালী ঘড়ির চেনটা যেন অতিরিক্ত ঝকমক করছে। সে কাছে যেতেই কুন্তল এগিয়ে এসে তার সঙ্গে হাঁটতে লাগল পাড়ার শেষপ্রান্তের দিকে। ক্রমে একটু নির্জনে এসে পড়ল তারা। এখানে একটা বাড়ির পিছনে একটু ফাঁকা মাঠ। রাস্তার আলো না পড়লেও চাঁদের আলো শুভ্র দ্যূতি ছড়িয়ে রেখেছে চারিদিকে! পাশে ঝোপের আড়ালে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে! দুজনে এসে মুখোমুখি একটা নেড়া সেগুন গাছতলায় দাঁড়িয়ে। ডালের ফাঁকে চাঁদের আলো দুজনের গায়ে, মুখে এসে পড়ছে। কিছুক্ষণ কারো মুখে কোন কথা নেই। অজানা আশঙ্কায় কৃত্তিকার বুক এত জোরে ঢিপঢিপ করছে যে, সে যেন কান পাতলেই তা সে শুনতে পেতো।
--- কেমন আছো কেতু? তোমাকে ভারি সুন্দর লাগছে আজ!
অনেক দিন পর এই ডাকটা শুনে হঠাৎ চমকে উঠলো কৃত্তিকা। সত্যি তো, আদর ক'রে কুন্তল দা তো এই নামেই ডাকত তাকে! কতদিন পর শুনল আবার সে ডাক! তার উপর কোন প্রিয়জনের কাছে নিজের রূপের প্রশংসা শুনতে কোন মেয়ের না ভাল্লাগে!আবেগে চোখে জল চলে এল কৃত্তিকার! আহা কি নির্দোষ ভালবাসা ছিল সে! কোন স্বার্থ ছাড়াই কত না টান ছিল তার এই কুন্তল দার প্রতি! কত স্নেহ ভ'রে কত যত্ন ক'রে নিজের হাতে খাবার তৈরি ক'রে নিয়ে আসত সে তার জন্য। তার আসার দিনে বাজার থেকে টাটকা ফুল কিনে টেবিলের উপর ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখত কৃত্তিকা ! বৈঠকখানার বিছানা ঝেড়ে নতুন কাচা চাদর বিছিয়ে হাত দিয়ে টান টান করে দিত! পর্দায় ছিটিয়ে দিত রুম ফ্রেশনার পারফিউম! চানাচুর বিস্কুট কফির প্যাকেট মজুত রাখত আগে থেকেই! আর তার আসার আগে কতবার যে দোতলায় ঝুল বারান্দায় উঁকি ঝুঁকি মারত- তার আর লেখাজোকা ছিল না!
--- কী ভাবছ এত?
কুন্তলের কন্ঠস্বরে আবার চমকে উঠে সম্বিত ফিরল যেন কৃত্তিকার।
---না, কিছু না তো!
-----বলো কেমন আছো?
-----ভালো! তুমি?
-----আর কেমন থাকব! তোমার দিদি যা ব্যবহারটা করল আমার সাথে! সব‌ই তো জান বোধহয়!
আমি এত বললাম, আর কটা দিন সবুর কর। এম টেক টা পাশ করে নি। তারপর ভাল একটা প্লেসমেন্ট পেলেই নাহয় ভাববো ভবিষ্যতের জীবন গড়ার কথা! কিন্তু তোমার দিদির আর কোনমতেই তর স‌ইল না! যেই বাবা একটা সরকারী চাকুরে ভাল পাত্রের সন্ধান পেলেন, অমনি সে ঢলে পড়ল সেই দিকে! যত সব রাবিশ!
বুঝতেই পারছ আমার মনের কি অবস্থা হয়েছিল তখন! এক সময় তো সুইসাইড করতে যাচ্ছিলাম! তারপরে ভাবলাম, মিছিমিছি একটা ট্রেইটরের জন্য নিজের জীবন দিয়ে কী হবে? তাই আজ আবার তোমার দেখা পেলাম!

ট্রেইটর!!! কি মানে যেন কথাটার? কৃত্তিকা মনে করার চেষ্টা করে! তবে তার আর দরকার পড়ে না! কথাটাতে এতটাই শ্লেষ মেশানো ছিল যে তাতেই তার অর্থ বলে দেয়!
বিশ্বাসঘাতক‌ই বটে! নিজের দিদির উপর এত ঘৃণা তার আগে কখনও হয়েছে বলে মনে পড়ে না!
হবার‌ই কথা! কুন্তল দা যা বলল, তা যদি সত্যি হয়, তাতে ঘৃণা হবার‌ই কথা বটে! কিন্তু দিদির মুখে তো সে
অন্য কথাই শুনেছিলো! কার কথায় বিশ্বাস করবে সে এখন ? সে তো আর কোর্টের উকিল বা জজসাহেব নয়, যে দুজনকে ডেকে জেরা করে করে দুজনের কথার সত্যতা যাচাই করবে!
-----যাক গে! যা গেছে তা গেছে! নাথিং টু রিগ্রেট ফর এ লষ্ট গেম!
-----যে জন্য তোমাকে ডেকে ছিলাম! তো তুমি কি বলছ?
এতক্ষণ কুন্তলের মুখের কথা বা কন্ঠস্বর শুনতে কৃত্তিকার বেশ ভালই লাগছিল, যদিও তা কোনমতেই কোনদিক দিয়ে মন ভাল করার মত কথা ছিল না! তবুও এক এক জনের কন্ঠস্বরে এমন একটা মধু মিশানো থাকে, যে আরো আরো শুনতে ইচ্ছে করে! কুন্তলেরটাও সে রকমই! এর আগে কতবার যে দরজার আড়ালে লুকিয়ে থেকে সে দিদির সঙ্গে কুন্তলের ভরাট অথচ মিষ্টি স্বরের কথোপকথন শুনেছে , শুধু এই একটি কারণে!
হঠাৎ সেটি থেমে যাওয়ায় একটু বিমর্ষ হল কৃত্তিকা।
কুন্তলের কথার উত্তরে একটু বিস্মিত হয়ে বলল, কিসের কি বলব?
-----বলছিলাম যে, আমিও তোমাকে ভালবাসি কেতু!
তুমি আমার জীবনসাথী হবে তো?
বিস্ময়ের উপর বিস্ময়। সে যে কুন্তলকে মনে মনে ভালবাসতো বা তার তাকে ভাললাগতো, সেটা কুন্তল দা জানত তাহলে? কথাটা তো আর মিথ্যে নয়। সত্যিই তো খুব ভালোবাসে সে কুন্তলকে! কিন্তু নিজের দিদির প্রাক্তন প্রেমিকের প্রেম প্রস্তাবে কি করে সম্মতি দেবে সে? কি লজ্জা, কি লজ্জা! কিছু উত্তর দিতে পারে না কৃত্তিকা।
-----কি হল, কিছু বল কেতু! তুমি যদি রাজি হও তাহলে তোমাকে দিয়েই আমি ওকে একটা মোক্ষম জবাব দিতে চাই! টিট ফর ট্যাট!
এবার টনক নড়ল কৃত্তিকার। কী বলবে সে?
সাতপাঁচ না ভেবেই মুখ দিয়ে ইনস্ট্যান্টলি বেরিয়ে এল
----ছি ছি! কি বলছ তুমি? না কুন্তল দা! না!! এ হতে পারে না! দিদির প্রেমাস্পদ তুমি! এ কথা বলতে তোমার লজ্জা করলো না? না!! সে কিছুতেই সম্ভব নয়!
বলেই ডুকরে উঠে হুহু করে কাঁদতে কাঁদতে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে পড়িমরি করে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে চলে গেল সে সেখান থেকে!

তার বিলিয়মান উড়ন্ত আঁচলের দিকে তাকিয়ে কুন্তলের যেন মনে হলো, নিমেষে তার স্বপ্নগুলো হাতের মুঠো থেকে যেন ছাড়া পাওয়া প্রজাপতির মত হঠা‌ৎ ই উড়ে বহুদূরে, তার নাগালের বাইরে, কোথায় যেন পালিয়ে গেলো! হাজার চেষ্টা করলেও তা আর পাবার নয়!!
ভাঙা মনকে সান্ত্বনা দিতে, অবশিষ্ট তলানি টুকু নিয়ে যে স্বপ্নের জাল বুনে ছিলো সে , তা যেন তার বুকে সজোরে একটা আঘাত দিয়ে ছিঁড়ে খান খান হয়ে গেলো! বুকে মোচড় দিয়ে বেরিয়ে আসা গভীর একটা দীর্ঘশ্বাসে যেন সে বলে উঠলো, সবাই ট্রেইটর!
কেউ কথা রাখে না!

 #ছোট গল্পনিজের বাড়িরাফিয়া সুলতানা14.07.23বাবা সুতোর কারখানার একজন কর্মী। জমি জায়গা , আগান বাগান, পুকুর বাকর ঘিরে আছে...
14/07/2023

#ছোট গল্প
নিজের বাড়ি
রাফিয়া সুলতানা
14.07.23

বাবা সুতোর কারখানার একজন কর্মী। জমি জায়গা , আগান বাগান, পুকুর বাকর ঘিরে আছে তাদের ভিটেটাকে জুড়ে। মাটির হলেও বসত বাড়িখানা বেশ বড়সড় ও মজবুত করে বাগানো। বক্স প্যাটার্নের বড় বড় জানালা। সৌখিন দরজা ও দেয়াল আলমারি।
ছয় ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ অবস্থান পল্লীবালা আনোয়ারার। মা সদাই ঘর, গেরস্থালি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বাড়িতে হাঁসমুরগী, ছাগল গরু সব‌ই ছিলো। জমিতে ধান গমের চাষবাস লেগেই থাকতো! তাই সারাদিন ধান সেদ্ধ করেন, শুকাতে দেন, ঢেকিতে ভানেন, জমির কিষাণদের ভাত তরকারি রান্না করেন। আনোয়ারা অন্যান্যদের সঙ্গে সেই কিষাণদের জন্য খাবার বয়ে নিয়ে, যাওয়া আসা করে ফূর্তি করতে করতে! দিনের খানিকটা সময় স্কুল ও স্কুলের কিছু পড়াশোনা বাকি সময়টা গাঁয়ের অন্যান্য ছেলেপিলের সঙ্গে খেলাধূলায় হৈহৈ করে কাটিয়ে দেয় আনোয়ারা। বাড়ির উঠানে গাছে বাঁধা দোলনায় দোল খেয়ে, আহ্লাদে, আবদারে তরতর করে কেটে যায় তার ছেলেবেলা। পৃথক সংসার হলেও, খালাতো, চাচাতো ভাইবোনদের কেউ কেউ মানুষ হয় তাদের‌ই পরিবারে, তাদের‌ই ভাইবোনদের মাঝখানে। ছেলেবেলায় অভাব অনটনের মুখ দেখেনি কখনো। যাই চেয়েছে তাই পেয়েছে। গাছে চড়ে, পুকুরে সাঁতরিয়ে, বাগানের আনাচে, কানাচে খেলে বেড়িয়ে কেটে গেছে তার শৈশব কৈশোরের রঙবাহারী দিনগুলো। সেয়ানা হলে যথারীতি পাত্রস্থ হয়ে শ্বশুরবাড়ি পাড়ি জমিয়েছে পাশের‌ই এক গ্রামে। স্বামী আক্তার লড়িতে মাল খালাসের কাজও করলেও আয় মোটেও কম নয়।
ছোটবেলায় পিতৃহারা হ‌ওয়ায়, তার মা আবার একজনকে বিয়ে করে। ফলে এক‌ই সঙ্গে মাতৃহারা হয়ে মামার বাড়িতে মানুষ হয়েছে আক্তার। বিয়ের পর আনোয়ারাকে নিয়ে ভাড়াবাড়িতে গিয়ে ওঠে। সুখেই কাটছিলো দিনগুলো। আক্তারের হাতখোলা স্বভাবের জন্য প্রথম দিকে খাওয়াদাওয়া, বিলাস ব্যসনে কোনো কমতি ছিলো না আনোয়ারার সংসারে। আনোয়ারাও অতিথি পরায়ণা হ‌ওয়ায় তাদের ভাড়া বাড়িতে আত্মীয়
কুটুমের আসা যাওয়া লেগেই থাকতো। ছোট ছোট দেওর, ননদেরা বেশিরভাগ তার বাড়িতেই এসে পড়ে থাকতো সব সময়। বাড়িতে কুটুম আসার কথা হলেই
আকতার গ্রামের সবচেয়ে বড় মোরগটা কিনে আনতো।আনোয়ারাও লেগে পড়তো পোলাও কোরমা সহযোগে
অতিথি আপ্যায়নে। কিন্তু চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়! দেখতে দেখতে একদিন আক্তার আদিবাসী বন্ধুদের সঙ্গে মিশে অভ্যস্থ হয়ে উঠলো হাড়িয়া মদ তাড়ি খাওয়ায়। ফলে যা কিছু রোজগার তার সব‌ই
এসবের পিছনে চলে যেতো। এদিকে সঞ্চয় বলে কিছু জানা ছিলো না তার। ফলে আনোয়ারার সংসারে শুরু হলো অভাব, অনটন। কিছু বলতে গেলেই কপালে জুটতো মারধর অত্যাচার। সচরাচর মাতালের সংসারে যা হয়। তার উপর জুয়া তাসের আড্ডায় খোয়া গেলো তার ঘটিবাটি গয়নাগাটি, এক কথায় বাপের বাড়ি থেকে পাওয়া সবকিছু। ছোটছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে আনোয়ারার প্রায় পথে বসার উপক্রম! বাধ্য হয়ে
এর ওর কাছ থেকে ব্লাউজের হুক বসানো, হেম সেলাই, পুঁথির মালা গাঁথা, টায়ারের সুতো ছাড়ানো, কাগজের ঠোঙ্গা বানানো, গোবর কুড়িয়ে ঘুঁটে বিক্রি কি না করলো
না বেচারী বাচ্চাদুটোকে মানুষ করার জন্য ।মাতাল স্বামী আর্ধেক রাত‌ই বাড়ি ফেরে না। ফিরলেও এসে মারধর করে। সংসারে এক নয়াও দেয় না। সুযোগ বুঝে খারাপ লোকেরা কুপ্রস্তাব দেয় তাকে। অনেক কষ্টে বেঁচে বর্তে থাকে সে। দেখতে দেখতে ছেলেমেয়েরা বেশ ডাগর হয়ে উঠলো। সাইকেলে করে তাদের ভালো স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে আসে নিয়ে যায়। মাস্টার দিদিমণিরা সবাই ভালোবেসে নানাভাবে সাহায্য করে ওদের। এত দুঃখ কষ্ট তার জীবনে, তবুও পরের উপকার করতে ছাড়ে না আনোয়ারা। কি শ্বশুর বাড়ির, কি পাড়া প্রতিবেশীর! কোথায় কার খাওয়া হয়নি, নিজে না খেয়েও তাকে দেয়া, কোন অসুস্থ বৃদ্ধার বাড়িতে কাজের লোক নেই তাকে সাহায্য করা, লোকের বাড়ি থেকে ছোট বাচ্চাদের ছোট হয়ে যাওয়া পুরনো জামাকাপড়, জুতো, মোজা এনে পাড়ার গরীবদের বিলানো, লোকেদের তাদের গাছের ফল পেড়ে সাহায্য করা, বনজঙ্গল সাফ করে দেয়া, এসব করতেই থাকে সে। শাশুড়ি ননদের আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড সব‌ই দৌড়ঝাঁপ করে জোগাড় করে দেয় আনোয়ারা। কিন্তু অকৃতজ্ঞ শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তার স্বামীকে এক আনাও ভাগ দেয় না, তার পিতৃকুলের বা মাতৃকুলের ভূসম্পদের। এমনকি আনোয়ার বাবার অকাল প্রয়াণের তার বেশির ভাগ সম্পত্তিই তার জ্ঞাতীদের কাছে বেহাত হওয়ায় বাপের বাড়ির জমি জমার‌ও এক পয়সাও ভাগ পায় না সে। ফলে সারাজীবন ভাড়াবাড়ির ভাড়া গুণতে হয় তাকে। সামান্য আয় করে তা দিয়ে সবকিছুর খরচ চালাতে তাকে হামেশাই হিমশিম খেতে হতো! ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যয় বহন করতে কখনো বন্ধন ব্যাঙ্কে লোন নিয়ে একশ দিনের কাজ করে তা পরিশোধ করে। কায়িক শ্রমে যা উপার্জন হয় তাতে না পোষায়, আনোয়ারা এবার নিকটবর্তী এক নতুন আবাসনে রান্নার, বাসন মাজার কাজ নেয়। আবাসনের মালিকরা বেশ অবস্থাপন্ন হ‌ওয়ায় তার দুঃখের কথা শুনে এবং কাজে খুশি হয়ে তাকে অনেক সাহায্য করতে থাকে। বাপের এবং শ্বশুরের পর্যাপ্ত জমিজমা ভূসম্পত্তি থাকলেও আনোয়ারা তা থেকে এক কাঠাও পেলো না যে সরকারী সাহায্যে একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই বানাতে পারে। তবে পরিশেষে কাজের বাড়ি থেকে ধারদেনা করে কোনোমতে দেড় কাঠা একটা জায়গা কিনতে সক্ষম হলো আনোয়ারা। তবুও স্বামী তার একটুও সাহায্য করলো না তাকে। কোথায় গেলে স্বস্তায় সিমেন্ট বালি পাওয়া যায়, কোন ভাটায় কখন কম দরে ইটপাথর মেলে, কোথায় গেলে কাঠের পুরনো দরজা জানালা পাওয়া যায়, কাজের ফাঁকে ফাঁকে খুঁজে আর দৌড়ে বেড়ায় সেগুলির সন্ধানে। পুরনো একটা ভ্যান রিক্সা জোগাড় করে মা বেটায় বয়ে আনে সে সব। মা এবং ছেলে রাজমিস্ত্রিদের সঙ্গে জোগাড়ের খরচ বাঁচাতে নিজেরাই গায়ে গতরে অমানুষিক পরিশ্রম করে কাজের বাড়ির মালিকদের আনুকূল্যে দেখতে দেখতে একটা দুকামরা বাড়ি বানিয়ে ফেলে এক বছরের মধ্যে। যদিও মেঝে পাকা করতে বা প্লাস্টার করতে পারে নি এখনো, তবুও সারাদিন পর কাজ শেষে ফিরে কাঁচা মেঝেয় বসে একটু জিরিয়ে নিতে নিতে ভাবতে থাকে আনোয়ারা, যা সে স্বপ্নেও ভাবেনি! কথায় বলে, কাউকে উপকার করলে, একদিন না একদিন সেই উপকার অন্যভাবে আবারো তার কাছেই ফিরে আসে! এককালে তার‌ও করা একাধিক পরোপকারের ফল হিসাবে, অবশেষে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে, উপর ওয়ালা মিলিয়ে দিয়েছে তাকে তার সেই কষ্টার্জিত বহু কাঙ্ক্ষিত নিজের বাড়ি!

উত্তরণ (অনুগল্প)রাফিয়া সুলতানামুর্শিদাবাদ জেলায় লালগোলা থানার অন্তর্গত একটি ছোটখাট পাড়াগাঁ হলো দিয়াড় ফতেপুর । সে‌ই ...
13/04/2023

উত্তরণ
(অনুগল্প)
রাফিয়া সুলতানা

মুর্শিদাবাদ জেলায় লালগোলা থানার অন্তর্গত একটি ছোটখাট পাড়াগাঁ হলো দিয়াড় ফতেপুর । সে‌ই গ্রামের প্রভাব প্রতিশালী ওসিমুদ্দিন হাজীকে কে না চেনে? আশেপাশের পঁচিশটা গ্রামের যত ঝুটঝামেলার মীমাংসার ভার পড়ে তাঁর‌ই উপর। এমন কি তাঁর ইশারায় বাঘে শিয়ালে একঘাটে জল খায় পর্যন্ত। জমিজমাও একশো বিঘার কম নয়। তাঁর দুইছেলে ও চার মেয়েকে নিয়ে গ্রামের গেরস্থ বাড়িতে যেমন সচরাচর হয়ে থাকে, খামার জুড়ে বড়বড় ধানের মরাই, খড়ের পালুই, ছাল ছাড়ানো সারিসারি পাট শুকাতে ঝুলিয়ে রাখা। আনাচে কানাচে পাটকাঠির স্তুপ। গরুর গোয়াল, হাঁস মুরগীর দরমা, চাকরবাকর, রাখাল মুনিষ, সবকিছু নিয়ে একেবারে এলাহি কারবার! কিন্তু হলে কি হবে? স্কুলের হেডমাস্টার বড়ছেলে মোখলেস যেমন বিচক্ষণ ও বিষয়ী, বেকার ছোটছেলে এখলাস তেমনি আলাভোলা ও বাউণ্ডুলে!

আগেকার দিনের পাড়াগাঁয়ের চল হিসাবে সেই কোন ছোটবেলায় দুইছেলের জন্য আশপাশের গাঁ থেকে দুটো ফ্রকপরা আট নয় বছরের বাচ্চাবাচ্চা মেয়েকে তুলে এনেছেন ব‌উমা করে! সেই থেকে তারা কোলেপিঠে মানুষ হতে হতে আজ গিন্নিবান্নি হয়ে গেছে । তবে হ্যাঁ, ব‌উদুটি হয়েছে আবার ছেলে দুটোর ঠিক বিপরীত। বড়টি যেমন বোকাসোকা , ছোটটি তেম‌ন‌ই চোখা ! পরিকল্পনা মাফিক বিধি যেন গড়েছিলো নির্জনে! বড়ছেলে কাকভোরে উঠে সারাদিন স্কুল আর চাষবাস দেখাশোনায় ব্যস্ত ! ছোটটি বেলা নটা দশটায় উঠে সারাদিন পড়ে থাকে চায়ের দোকানে তাসের আড্ডায় । বাবা তো খুবই চিন্তিত তাকে নিয়ে। শুধু গালমন্দ দেন আর কপাল চাপড়ে হাহুতাশ করেন! কাপড়ের ব্যবসায় লাগিয়ে দোকান করে দেন, তো সেখানে ধার বাকিতে সব কাপড় চোপড় গাঁয়ের লোককে বিকিয়ে দিয়ে খালি হাতে ফিরে আসে। অবশেষে তদবির তোষামোদ করে গ্রামীণ হাসপাতালে ফ্যামিলি প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্টে চাকরি জুটিয়ে দিলেন। কিন্তু তাহলে হবে কি? তাস পিটিয়ে আর বিড়ি সিগারেট টেনে সেখানেও সে চাকরির টাকাপয়সা সব উড়িয়ে দেয় ! তবে মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন অতি ভদ্র, অমায়িক, সৎ ও সাহিত্য সংস্কৃতি পরায়ণ। শোনা যায় তিনি কবিতা টবিতা লিখতেন যা স্থানীয় কাগজ পত্রে বের হতো। এমনকি ক্লাবের পরিচালনায় বিভিন্ন নাটকে অভিনয়েও অংশগ্রহণ করতেন। তবে পরিবেশ পরিস্থিতি তাঁর সেই প্রতিভার উপযুক্ত মূল্যায়ণ করতে ব্যর্থ হয়। তাই বোধহয় তিনি সংসারী হিসেবে অমনোযোগী, উদাসীন ও অসফল ছিলেন।

পিতা গত হ‌ওয়ার পর তার বেলাগাম জীবন যাপনে আট ছেলেমেয়েকে নিয়ে অভাব অনটনে যখন পথে বসার উপক্রম, তখন গিন্নী ফরিদাবিবি উঠেপড়ে শক্তহাতে সংসারের হাল ধরলেন। রাতদিন খেটেখুটে, ভোররাতে উঠে ধানসেদ্ধ করে, তা শুকিয়ে ঢেঁকিতে কুটে, সংসার চাষবাস সামলে, জোরতালে তাগাদা তালিম দিয়ে ছেলেদের পড়াতে লাগলেন! দিনরাত তাঁর একটাই বুলি, "বাবা ভালো করে পড়াশোনা কর। মানুষ হতে হবে, বাবু হতে হবে। জমি জায়দাদ সবকিছুর ভাগ হয়। কিন্তু নিজের চাকরিতে যে রোজগার, তাতে আর কারোর ভাগ থাকে না!" মোক্তার ও আক্তার বড়দুটি যমজ ছেলেও মায়ের সাথেসাথে শীতের ভোরে উঠে, লেপের ভিতরেই পড়াশোনা করতে থাকে । আবার সময় করে মাথায় করে রুটির বোঝা নিয়ে চাষি মজুরদের জমির আলে খেতে দিয়ে আসা, ঘানি থেকে সঃতেল ভাঙিয়ে আনা ইত্যাদি সব‌রকমের সংসারের ও চাষবাসের কাজে মাকে সাহায্য‌ও করে। কখনো পরনে সাকুল্যে একখানি হাফশার্ট, একটাই লুঙি, পায়ে হয়তো চটিজোড়াও জোটেনি, সেইভাবেই বগলে ব‌ইখাতা নিয়ে ছোট্টছোট্ট পায়ে গ্রামের মাঠঘাট পেরিয়ে দূরদূরান্তের পাঠশালায় পড়তে যায়। আবার বাড়িতে এসে হাতমুখ ধুয়ে, পুকুর থেকে ছিপে মাছ ধরে, কেটেবেছে, ভেজে ভাতে মেখে খায়। কখনো বা দুটোডিম ভেজে মা ভাগ করে দেন আট ভাইবোনকে।
হাতে গড়া কলাইয়ের রুটিতে রসুন কাঁচা মরিচ কুচি দিয়ে কখনো বা খেতে দেন ছেলেপুলেদের। তারপর সন্ধ্যা হলে দুই ভাই নিজেরাই হ্যারিকেন ধুয়েমুছে, কেরোসিন ঢেলে, আলো জ্বালিয়ে পড়তে বসে । এইভাবেই কষ্টেসৃষ্টে পড়াশোনা করতে থাকে।

বড় হয়ে পাশের শহরের ভালো কলেজে ভর্তি হয়। তারপর বিএসসি শেষ করে, বড়ছেলে মোক্তার কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে এমএসসিতে ঢোকে। পড়াশোনায় তার একাগ্রতা ও অধ্যাবসায় অচিরেই প্রফেসারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফার্স্টক্লাস সেকেণ্ড হয় সে। এরপর পিএইচডি ও নামীসংস্থায় মুখ্যগবেষকের পদে আসীন । গবেষণায় সাফল্যে চারিদিকে নামযশ,খ্যাতি প্রতিপত্তি, টাকাপয়সা একে একে সব হয় তার। অন্যান্য তিনভাইও সরকারি স্কুলে, বড়বড় দপ্তরে নিযুক্ত। বোনেদের‌ও সব ভালোঘরে বিয়ে হয়েছে। পরিশ্রম ও বিচক্ষণতার জোরে একদা চরম দারিদ্রতা ও সংকটময় ভাগ্যকে জয় করে এইভাবেই কালক্রমে, সাধারণ থেকে উত্তরণ ঘটে অসাধারণ হয়ে ওঠেন কৃতি সন্তানের গরবিনী মাতা ফরিদা বিবি।

সততা ও নিষ্ঠার ফলরাফিয়া সুলতানা03.01.23উপরে দুই দাদা, আর বড় দুইবোনের পর অবস্থান আলেয়ার। পরে আরো দু একটা বোন। কিন্তু ত...
05/01/2023

সততা ও নিষ্ঠার ফল
রাফিয়া সুলতানা
03.01.23

উপরে দুই দাদা, আর বড় দুইবোনের পর অবস্থান আলেয়ার। পরে আরো দু একটা বোন। কিন্তু তাতে কি? সব্বার মধ্যে আহ্লাদে আবদারে সে-ই সেরা। যখন তার যা মন চায়, তখন তার সেটাই চাই। কিংবা যখন যেখানে যাবার বাই ওঠে, তৎক্ষণাৎ সেখানেই যায়। বড় দুই দাদার আবার তাদের স্বাধীনভাবে কোথাও যাওয়ার উপায় নাই। সে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাওয়াই হোক, বা কোন মেলায়, হাটে বাজারে। সঙ্গে সঙ্গে পিছু নেয় আলেয়া। তাদের সঙ্গে যাবেই সে! একদম নাছোড়বান্দা! ফলে তারা যতটা সম্ভব লুকিয়ে চুরিয়ে তাকে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করে! কিন্তু একবার যদি ধরা পড়ে তো, ভোগান্তির চুড়ান্ত! কেন তাকে বাদ দিয়ে যাওয়া হয়েছে? অত‌এব আবার সেখানে তাকে নিয়ে যাওয়া চাই! ফলে সাইকেলের সামনে বসিয়ে ঘুরিয়ে আনতে হয় তাদের! এমন জিদ আর এমন একরোখা আর কেউ ছিলো তার আর কোন ভাইবোনদের মধ্যে! খেলাতেও ভীষণ ভালো ছিলো সে। যখন যেখানে মা খেলা হতো, কখনো খালি হাতে ফিরতে হতো না তাকে। খানকতক পুরস্কার আনা চাইই চাই! অবশ্য তার বড়দিদিও ছিলো খেলায় ভীষণ ভালো! পাড়াগাঁয়ে বাড়ি হ‌ওয়ায় সারাদিন‌ই আগান বাগান ঘুরে বেড়িয়ে, গাছে চড়ে ও খেলাধুলা করেই কাটিয়ে দিতো সে! পাড়ায় ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলতে খেলতে কখন তাকে ভালোবেসে ফেলে পাড়াতুতো এক দাদা! ভাবে ভঙ্গিতে একসময় ধরাও পড়ে যায় সে আলেয়া এবং আরো সবার কাছে। কিন্তু গ্রামগঞ্জে এসব তখন চলতো না। বা প্রশ্রয় পেতো না বললেই চলে! ফলে ভালোবাসার সেই কুঁড়ির আর ফুল হয়ে ফোটা হয়ে ওঠেনি কোনোদিন। বছর পনেরোয় পা পড়তে না পড়তেই দেখাশোনা করে বিয়ে হয়ে গেলো তার একটু দূরে আরেক গ্রামের এক ছেলের সঙ্গে। কিন্তু সেই ছেলেটি, যে তাকে মনে মনে ভালোবেসে
ছিলো তার আর বিয়ে করে ওঠা হলো না জীবনে!

আলেয়ার প্রথম প্রথম কয়েকবছর বেশ ভালোই কাটলো! স্বামীর আয় ভালো। মন‌ও ভালো। এখানে সেখানে বেড়াতে নিয়ে যায় তাকে। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন এলে গোটা গোটা জবাই করা মুরগি কিনে আনে। আলেয়াও দৌড়ঝাঁপ করে বড় বড় হাঁড়িতে
বিরিয়ানি রান্না করে। বেশ যত্ন সহকারে খাওয়ায় অতিথিদের। ফলে ঘনঘন যাতায়াত চলতে থাকে শ্বশুরবাড়ির লোকদের। তার সুনাম‌ও বাড়তে থাকে। ছোট দেওর আর ননদ তো তাকে ছাড়তেই চায় না। সেও যত্নআত্যি ক'রে দেখভাল করে তাদের! ক্রমে সময় গড়িয়ে চলে! দেখতে দেখতে দুটো ছেলেমেয়ে জন্ম নেয় তার গর্ভে। ইতিমধ্যে স্বামী তার কুসঙ্গে জড়িয়ে পড়ে নেশাভাঙ করতে থাকে। জুয়া সাট্টাখেলায় মেতে উঠে রোজগারের সব টাকাকড়ি চলে যায়। কোনো কোনো দিন রাতে সে বাড়িই ফেরে না! বাড়িতে শুরু হয় অভাব অনটন। ছোট্ট দুটো বাচ্চা নিয়ে আলেয়া পড়ে ভীষণ বিপদে। যদিও তার বাপের বাড়ির অবস্থা তখন‌ও ভালো, কিন্তু জানতে দেয় না সে তাদের নিজের দুরবস্থার কথা! একদিন ঘরদোর সাফ করতে গিয়ে আলেয়ার নজরে পড়লো তার বিয়ের সময় বাপের বাড়ি থেকে পাওয়া কাঁসাপিতল একটাও নেই! নেই তার সোনার হার, কানের ঝুমকো, পায়ের নুপূর ও হাতের বালাজোড়াও! মাথায় যেন বাজ পড়লো ওর! স্বামী ফিরে এলে সেই প্রশ্ন তুলে তুমুল শোরগোল করাতে, তার পিঠে পড়লো উত্তম মধ্যম! বাধা দেয়াতে মোচড় দিয়ে তার একটা হাত ভেঙেই ফেললো উচ্ছন্নে যাওয়া লোকটা। পাড়াপ্রতিবেশীর কাছে খবর পেয়ে তার দাদা
তাকে নিয়ে চলে এলো বাপের বাড়ি। কিন্তু দুধের বাচ্চা
দুটো পড়ে র‌ইলো তার চণ্ডাল স্বামীর কাছে। কেঁদে কেঁদে একসা হতে হতে ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লো
আলেয়া। ফলে বাধ্য হলো তার দাদা বোনকে বাচ্চাদের
কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে!

কিন্তু দিনের পর দিন তার অবস্থা আরও শোচনীয় হতে লাগলো! কোনো কোনো দিন ভাতের হাঁড়িই চড়ে না তার! দিনের পর দিন তার স্বামীকে ঘরে না আসতে দেখে প্রতিবেশী খারাপ লোকেদের নজর পড়ে তার উপর! তারা গায়ে পড়ে সাহায্য করতে চায়! আলেয়া দৃঢ়ভাবে ফিরিয়ে দেয় তাদের দয়া দাক্ষিণ্য! আশেপাশের বনজঙ্গল থেকে কাঠকুটো জোগাড় ক'রে, গোবর কুড়িয়ে ঘুঁটে বিক্রি ক'রে, লোকের শাড়ির ফলস বসিয়ে, জামার বোতাম লাগিয়ে, টায়ার সেলাই করে মরিয়া হয়ে রোজগার করতে চায় কিছু দুবেলা পেট চালাতে! ছেলেমেয়ে দুটোকে স্কুলে ভর্তি করলো একদিন। তাদের স্কুলে দিয়ে এসে লোকের বাড়িতে কাজ করতে শুরু করলো! এদিকে অভাব দেখে শ্বশুরবাড়র আত্মীয়স্বজনেরা তো কবেই দূরে সরে গেছে! তার উপর আলেয়া লোকের
বাড়িতে কাজ ধরায়, তারা এখন পরিচয় দিতেও লজ্জা
বোধ করে। উৎসবে অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ ও করে না! চোখাচোখি হলে চোখ সরিয়ে নেয়। অথচ এই শ্বশুরবাড়ির লোকেদের জন্য এককালে কিই না করেছে আলেয়া! খেটেখুটে ছোটাছুটি করে শাশুড়িদের প্রত্যেকের আধার কার্ড, রেশন কার্ড জোগাড় করে দেয়া, শাশুড়িকে ডাক্তার দেখানো, চোখ অপারেশন করানো, তাদের উৎসবে অনুষ্ঠানে গায়ে গতরে খেটে কাজ উদ্ধার করে দেয়া! তবুও তার স্বামীকে বাপের বাড়ির জমিজমা ঘরবাড়ির একআনা অংশ‌ও দেয়া হয়নি, তার দ্বিতীয় বাবার সৎছেলে বলে! ছোটবেলায় নিজের বাপ মরে গেলে, তার মা আরেকটা বিয়ে করায়, তখন থেকে মামারবাড়িতেই মানুষ তার স্বামী। তবুও তাকে না শেখানো হয়েছে লেখাপড়া, না দেয়া হয়েছে মায়ের সম্পত্তির একফালি অংশ! শ্বশুরবাড়ির চরম অনাদরে ও অবহেলায় আলেয়াকে পড়তে হয়েছে চরম সংশয়ে!
এদিকে তার নিজের বাপের বাড়ির অবস্থাও তথৈবচ। বাপ ম'রে গেলে জমিজায়গা টাকাপয়সা সব চলে যায় দুই দাদার হাতে। এমন কি তার দাদির গয়নাগাটির‌ও ভাগ পায়নি সে! দুই দাদাই মনের মত দেখেশুনে সংসার গড়ায়, তার মাও হয়ে গেছে চরম অসহায় তার বৌদিদের পাল্লায় প'ড়ে! বাপত্তি সম্পত্তিতে সব বোনেদের নামমাত্র কিছু শরিকানা থাকলেও পরবর্তিতে বড় দাদার দেনার দায় পরিশোধ করতেই তাদের
দিয়ে দিতে হয়েছে সবকিছু। ফলে আলেয়া বুঝে নিয়েছে, যা করার তাকে নিজেকেই করতে হবে!

এর মধ্যে রাস্তাঘাটে এক আধবার দেখা হয়েছিলো তার বাপের গাঁয়ের সেই ছেলেটির সঙ্গে। একটু হেসে, সামান্য কুশল বিনিময় করেই তার কাছ থেকে সরে এসেছিলো আলেয়া। তাকে দেখে তার মনে পড়ে যেতো হারিয়ে যাওয়া সেই দুরন্ত ছেলেবেলার দিনগুলো। তার বাপের ভরা গেরস্থ সংসারে কত সুখ, কত সমৃদ্ধি, কত‌ই না আমোদ আহ্লাদ ছিলো তখন! দাদাদের সঙ্গে বায়না করে সিনেমা দেখতে যাওয়া! ভাইবোনদের সঙ্গে দল বেঁধে শ্যামা নগরের কালীতলার মেলা দেখতে যাওয়া। খেলাধূলা, হ‌ইহুল্লোড়! খেলার মাঝে ছলেবলে সেই ছেলেটির ঘুরেফিরে তার কাছে আসা, মনে একটু আধটু অনুরাগের দোলা লাগা, মন ছুঁয়ে যাওয়া তার সেই প্রেম নিবেদন! আর তার নিজের লজ্জা জড়ানো প্রত্যাখ্যান! কি নির্দোষ আর মায়ামাখা সেই ফেলে আসা ছোটবেলার দিনগুলো! কি সুধাভরা সেই স্বপ্নময় স্মৃতি! ভাবতে ভাবতে উদাস হয়ে যায় আলেয়ার মন! ভাবে, কি জানি! তার সঙ্গে যদি তার বিয়ে হতো, হয়তো এদিন তাকে দেখতে হতো না আজ! হয়তো অনেক সুখের হতো তার সেই সংসার! তবে কি ছেলেটির দীর্ঘশ্বাসের অভিশাপেই আজ এমন হলো তার সংসার জীবন! এমন বিষাদ মাখা! এতটা বিষাক্ত! এমন ধারা তিক্ততা ভরা সেই সংসার , যে তাকে ভাড়াকরা অন্ধকার কুঠরির মত ঘিঞ্জি নিজের সেই ঘরটাতে যেতেই ইচ্ছে করে না আর, কাজের বাড়ির ছেড়ে!

ছেলেমেয়ে দুটোকে লোকের বাড়িতে ঝিগিরি করেই বড় করে তুলেছে সে। তার আন্তরিকতায় কাজের বাড়ির মন কেড়ে নিয়েছে । ফলে তাদের সহৃদয়তা ও সর্বাঙ্গীন সহযোগিতায় দেড় কাঠা জায়গা কিনতে পেরেছিলো। তাতে ছেলেমেয়ে সমেত গায়েগতরে খেটেখুটে মিস্ত্রীদের সঙ্গে লেগেপ'ড়ে কোনরকমে দুকামরা ঘর তুলে সেই ঘরে পাকাছাদ দিতে সক্ষম হয়েছে আলেয়া। বলা হয়ে থাকে নিজেই নিজের ভাগ্য পরিবর্তনে সচেষ্ট না হলে স্বয়ং আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন না ভাগ্য পরিবর্তনে সফল হতে। সততা ও নিষ্ঠার চুড়ান্ত ফলস্বরূপ একদিন সে তার একমাত্র ছেলেকে যে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে পারবেই , এবং এভাবেই শেষ হবে তার চরম দুর্দিনের, এই আশায় এখন বুক বাঁধছে আলেয়া!

 #ছোটগল্পসুরের বাঁধনেরাফিয়া সুলতানা18.11.22কলেজের জীববিদ্যা বিভাগের ডিগ্রীকোর্সে ভর্তি হ‌ওয়ার পর, রোজ সেদিন সকাল সকাল ...
19/11/2022

#ছোটগল্প
সুরের বাঁধনে
রাফিয়া সুলতানা
18.11.22

কলেজের জীববিদ্যা বিভাগের ডিগ্রীকোর্সে ভর্তি হ‌ওয়ার পর, রোজ সেদিন সকাল সকাল এসেছে প্রথমদিনের ক্লাস করতে । একা একা দোতলার নিরিবিলি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখছে সে চারপাশের পরিবেশটাকে। যদিও কলেজটা তার কাছে নতুন নয়, এখানেই পড়েছে সে আগের বছরগুলোতে, তবু এ বিল্ডিঙে তার আগে কখনো আসা হয়নি। একটা বড় রাধাচূড়া গাছের ছায়া ঢেকে রেখেছে সামনেটা। সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো বেদী গাছটার গুঁড়িটাকে গোলাকারে ঘিরে রেখেছে। গেটের সামনে দুপাশে দেবদারু গাছের সারির মাঝ দিয়ে চলে গেছে লালমাটির মোরামে ঢাকা পথ অফিসরুমের দিকে। এ পথে কত ঘুরেছে সে বন্ধু করবীর সঙ্গে ইলেভেন টুয়েলভে পড়তে। তাকাতে তাকাতে হঠাৎ চোখে পড়লো বিল্ডিংএর ওপাশে এক নবাগতের ম্রিয়মান চেহারা। মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে সে গ্রিলে ঠেঁস দিয়ে। বোধহয় অন্যত্র থেকে এসেছে । সঙ্গে তার বাবাও এসেছেন। আরো অনেকেই এসেছে বাইরে থেকে। তার সঙ্গে পড়তো এমন একজনকেই দেখতে পেলো ক্লাসে। সে হলো জ্ঞানেন্দ্র। যদিও সেও তার শহরের নয়। পড়তে আসতো পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে। তাকে অনেকটা তার পিসতুতো দাদার মত দেখতে। সৌম্য দর্শন। পাশে সিঁথি করে চুল আঁচড়ানো। পুঁইশাকের লতার মত চিকন লতানো কুচকুচে চুল। আরো একজন ছিলো ওরকম ধরনের। তার নাম সুখেন। এরকম টাইপের মুখ দেখলে কেন জানি না, রোজের মনে হয় ভালোছেলে ভালোছেলে । আজকের দেখা ঐ আগন্তুকটিও এধরণের দেখতে। তার নাম সৌরদীপ। ক্লাস শুরু হলে এক এক করে সবার নাম জানতে পারলো রোজ। কিন্তু কারোর সঙ্গেই তেমন মেলামেশা করতে পারে না সে তার স্বভাবসিদ্ধ মুখচোরামির জন্য। ক্লাসে পড়া বুঝতে না পারলেও ঐ একই কারণে স্যারদের‌ও কিছু প্রশ্নটশ্ন‌ করা হয়ে ওঠে না তার। রোজের অনুপস্থিতিতে ক্লাসে বা ব্যালকনিতে ছেলেরা হট্টগোল করে গল্পগুজব করতো। কিন্তু রোজকে আসতে দেখলেই ফিসফিস করে, আসছে আসছে, বলে সবাই চুপ করে যেতো । ছেলেরা এমন‌ই সমীহ করতো তাকে। জয়তী আর প্রগতি নামে আর দুই যময বোন পড়তো। তারা নিজেদের ছাড়া আর কারো সাথেই তেমন মিশতো না । একটা টিউশন‌ও পড়তো রোজ। সেখানেও তার ঐ এক‌ই অবস্থা। কেবল সাকুল্যে দুএক জনের সঙ্গে এক আধটা কথা হলেও ভীষণ বোরিং লাগছে রোজের ক্লাস করতে। প্র্যাকটিকাল ক্লাস‌ও তাকে একা একাই করতে হয় দিনের পর দিন। এরকম বোবার মত থাকা কাঁহাতক আর সহ্য করা যায়। যদিও সময় কারো জন্য থেমে থাকে না। তাই এমনি ভাবেই কেটে গেলো দু-দুটো বছর। ফলে রেজাল্টও ভালো হলো না তেমন।

তৃতীয় বর্ষে নতুন একটা টিউশনি ঠিক হলো পাশের শহরে। বাসে করে যাতায়াত করতে হয় সেখানে। তাদের ক্লাসের অন্যান্য সকলেই পড়তে যায় সেখানে। তাদের মধ্যে একজন ছিলো, যে তার সঙ্গে প্রাইমারিতে পড়েছে। নাম অখিলেশ। যেতে আসতে রোজের ক্রমে ভাব হলো সৌরদীপের সঙ্গে। বেশ ভালোই বন্ধুত্ব হলো
তাদের মধ্যে।
যদিও দুজন ছিলো ভিন্ন সম্প্রদায়ের। কিন্তু তাদের আচার ব্যবহারে তা কোনোভাবেই টের পাওয়া যেতো না। টিউশনি পড়তে গেলে, পরস্পরের জন্য অপেক্ষা ক'রে , একসঙ্গে যাওয়া আসা করে রোজ ও সৌর। রোজ এক প্রফেসারের বাড়িতে সাইকেলটা রেখে এসে হাটতে থাকে বাসস্যান্ডের উদ্দেশ্যে। কিছুক্ষণের মধ্যে ঐ পথেই এসে পড়ে সৌর তার কলেজের হোস্টেল থেকে। হাসিমুখে কুশল বিনিময় করে দুজনে। তারপর গুটি গুটি পায়ে চলতে থাকে টুকটাক কথা বলতে বলতে।বাসে করে যাবার সময় যে যার সিটে বসে যেতো।রোজ বসতো লেডিজ সিটে, আর সৌর তার অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে। ড্রাইভারের কেবিন থেকে বিভিন্ন হিন্দি সিনেমার গান ভেসে আসতো। তা শুনতে শুনতে কেমন যেন উদাস হয়ে যেতো রোজের মন। হারিয়ে যেতো সে কোনো এক অজানা জগতে! জানালার বাইরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও গ্রামীণ দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যেন সময় কেটে যেতো। তারপর বাস থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে পথ চলতো অধ্যাপকের বাড়ির গন্তব্যে।তখন রোজ আর সৌর একসঙ্গে যেতো না। সৌর যেতো তার ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে।আর রোজ যেতো তাদের পিছনে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে।ফেরার সময় বাস থেকে নেমে রোজ আর সৌর একসঙ্গেই ফিরতো। হ্যালোজেনের হলুদ আলোয় আলো আঁধারি পথে স্কুলের বড়মাঠটা পার হয় দুজনে গল্প করতে করতে। তারপর অধ্যাপকের বাড়িতে আসে রোজ নিজের সাইকেল নিতে। আর সৌর চলে যায় সোজা তার হোস্টেলের উদ্দশ্যে। রোজ বা সৌর কিছু কিনলে দুজনে মিলে তা ভাগ করে খেতে খেতে আসে । মাঝেমাঝে নোট বিনিময় করতে তার বাড়িতেও আসে সৌর। রোজের মায়ের দেয়া টুকটাক কিছু খাবার‌ও খায় সে তাদের পালপার্বণে। রোজও একবার গেছিলো তার হোস্টেলের দিকে বোনকে সঙ্গে নিয়ে নোট ফেরত দিতে। ভীষণ প্যালপিটিশন হচ্ছিলো সেদিন রোজের সেই গেটের কাছে যেতে। যদি কেউ কিছু মনে করে। হলোও তাই। পাশ দিয়ে যেতে যেতে একজন টিপ্পনি কেটে গেলো!
লোকের আর কাজ কী, এছাড়া? যদিও তাদের বন্ধুত্ব ছিলো নিষ্পাপ তবুও একটা‌ যেন কিরকম অদ্ভুত অনুভূতি যেন সর্বদা তাড়া করতো পিছনে! একটা আশঙ্কা, কিছুটা দুর্বলতাও। এ‌ই সুন্দর সম্পর্ক যেন কোনোভাবে হারিয়ে না ফেলে! যেদিন তার বাড়িতে সৌরদীপের আসার কথা থাকতো, খুব মন দিয়ে ঘর ঝাড়পোঁছ করতো রোজ। আর মনে মনে খালি সেই গানের কলিটাই গুণগুণ করতো,

"আমার এ ঘর বহু যতন করে, ধুতে হবে, মুছতে হবে ওরে!
আমারে যে জাগতে হবে, কি জানি সে আসবে কবে, যদি আমায় পড়ে তাহার মনে! বসন্তের এই মাতাল সমীরণে!
আজ জোছনারাতে সবাই গেছে বনে..."।

সৌরদীপ তাকে নোট ফেরত দিয়ে গেলে কি জানি কী যেন একটা আশঙ্কা জনিত কৌতূহলে সেই নোটের পাতা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখতো রোজ, তাদের এই নির্দোষ বন্ধুত্বের সমাপ্তি না ঘটে কোনো একটা অহেতুক কারণে, কোনোরকম ছন্দপতন হয়ে!

তারপর বহু বছর কেটে গেছে । পড়ার পাঠ চুকিয়ে নিজের শহরে ফিরে গেছে সৌর। এরপর‌ও কয়েক বছর চলেছে তাদের একটানা পত্রের আদানপ্রদান। বন্ধুত্বের স্বাদের একটুও পরিবর্তন হয়নি তখন‌ও! অবশেষে যে যার মত সংসারী হয়ে গেলে, ক্রমে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তাদের যোগাযোগ। কিন্তু মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি কেউ কাউকে। অন্তরের অন্তরালে, স্মৃতির অলিন্দে কখনো কোনো অবসর বেলায়, মাঝেমধ্যেই বেজে উঠতো টুং টাং শব্দে সেই হারানো জলতরঙ্গের সুর! অভাব বোধ হতো যেন কিছু একটার! কালক্রমে সন্তানাদি মানুষ করতে করতে প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে যায় ওরা! ফেসবুকের আমদানি পর, নিজের নিজের আইডি খোলা হলে খুঁজতে থাকে ক্রমাগত, পরস্পরকে। এভাবে আরও অনেক ক'টা বছর পেরিয়ে যায়! রোজের প্রচেষ্টায় একদিন হঠাৎই সৌরর খোঁজ মিললে আবার যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয় দুজনের মধ্যে । নতুন করে ঝালিয়ে নেয় তারা তাদের সেই ফেলে আসা যৌবনের সোনালী দিনগুলোর সুরের বাঁধনে বাঁধা যে অবিচ্ছেদ্য বন্ধন, তার সাময়িক ভাঙা অংশটুকু!

Address


Telephone

+919836980041

Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Rafia Sultana's Stories posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Contact The Business

Send a message to Rafia Sultana's Stories:

Shortcuts

  • Address
  • Telephone
  • Alerts
  • Contact The Business
  • Claim ownership or report listing
  • Want your business to be the top-listed Media Company?

Share