
16/07/2023
#ছোটগল্প
কেউ কথা রাখে না
রাফিয়া সুলতানা
16.07.23
দেখে কে বলবে যে ওরা যমজ বোন নয়? পথে ঘাটে পার্কে, সিনেমা হলে যেখানেই যায় , ওরা দুজন। মৃত্তিকা আর কৃত্তিকা। এমনিতেও খুব ভাব দুইবোনে, যদিও ওরা পিঠোপিঠি নয়। রীতিমত তিন তিনটি বছরের তফাৎ দুজনের। বরং মৃত্তিকার গঠন একটু ছোটখাটর ওপরে। এবং কৃত্তিকাই সামান্য হলেও একটু বড়সড়। তাই অনেকেই তাকে মৃত্তিকার বড়দিদি ভেবে ভুল করে। তবে দুইবোনের চেহারাতে তেমন একটা বিশেষ মিল নেই। মৃত্তিকা বেশ একটু সুন্দরী। টিকালো নাক, টানা চোখ দুটিতে যেন কাজল পরানো। ফর্সা রঙ, লাল ঠোঁট। একনজরেই মন কেড়ে নেওয়ার মত! কৃত্তিকা ততটা সুন্দর না হলেও তার চেহারায়ও লাবণ্য আছে যথেষ্ট, মুখের গড়নে আছে মিষ্টতা। একটা স্নিগ্ধ ছোঁয়া আছে ঘুম জড়ানো বড়বড় পাঁপড়ি ওয়ালা দুটি চোখের চাওনিতে! রঙটা অবশ্য একটু চাপা, যাকে বলে শ্যাম বর্ণা! মৃত্তিকা যেমন লেখাপড়ায় ভাল, কৃত্তিকা তেমনই গানে, নাচে ও খেলাধুলায় পারদর্শী। দুই মেয়ে যেন দুটি রত্ন। তাদের নিয়ে চৌধুরী দম্পতির গর্বের অন্ত নেই। বড় বন্ধুত্ব দুইবোনের। বাড়িতে যখন জানাজানি হল পাশের পাড়ার রহমান বাবুর ছেলে কুন্তলকে ভালোবাসে মৃত্তিকা তখন যে ঝামেলা ঝঞ্ঝাটে পড়তে হয়েছিল মৃত্তিকাকে তার অনেকটা ছোটবোন কৃত্তিকাই সামাল দেয়। বাবা মাকে বোঝায় সে যে কুন্তল তাদের সম জাতের না হলেও পড়াশোনায় সে খুবই ভাল । জেলাস্কুলের ছাত্র কুন্তল ওরফে কাজিবুর রহমান প্রত্যেক ক্লাসে প্রথম ছাড়া কোনদিনও দ্বিতীয় হয়নি । ফুটবল ক্রিকেট সব খেলাতেই তুখোড় সে। পাড়ায় সেবার দুর্গাপূজার সময় ক্লাবের পরিচালনায় যে নাটক অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে প্রধান চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছিল কুন্তল। সেই থেকেই কুন্তলকে ভালো লাগতে শুরু করে কৃত্তিকার! যদিও দিদির সঙ্গে তার ভাব হয় পাড়ায় দত্ত স্যারের কাছে একসঙ্গে ইংরেজি টিউশন পড়ার সময় এবং সেটার তার পরের বছর থেকেই সূত্রপাত । কৃত্তিকা জানতে পারে সে কথা যখন দিদির খাতার ভিতরে গোঁজা কুন্তলের একটা চিঠি দেখতে পায় সে। কৃত্তিকা তখন ক্লাস সেভেন ও মৃত্তিকা ক্লাস টেনের ছাত্রী। দিদি আর কুন্তল আলাদা আলাদা কলেজে ভর্তি হলে কৃত্তিকাই তাদের চিঠি আদান প্রদানের মাধ্যম হয়ে ওঠে। দিদিকে লেখা কুন্তলদার চিঠি নিয়ে সে কৌতুহলী হয়ে একদিন চুপিচুপি ছাদের চিলেকোঠায় উঠে খুলে পড়তে শুরু করে। কুন্তলের যেমন সুন্দর হস্তাক্ষর তেমন সুন্দর ভাষা! সেদিন থেকে প্রতিবারই সে দিদিকে পৌঁছানর আগেই পড়ে নিত তাদের সেই প্রেমপত্র। পড়তে পড়তে কেমন যেন তন্ময়তায় বিলীন হয়ে যেত! মনে হত এই কুন্তল যেন তার কতকালের চেনা। কোন জন্মের যেন আত্মার যোগাযোগ আছে তার সঙ্গে! মাঝেমাঝে মনে সন্দেহ নিয়ে ভাবত, কুন্তলকে কি ঈশ্বর ঠিক তাঁর দিদির জন্যই সৃষ্টি করেছিলেন? ক্রমে সে কুন্তলের চূড়ান্ত ফ্যান হয়ে গেল একেবারে! তাকে নিয়ে নানারকম জল্পনা কল্পনা চলত তার মনের ভিতর। ভাবতে ভালো লাগতো তাকে নিয়ে। তাই বাবা মা যখন দিদিকে বকাবকি করছিলেন তাদের ভালবাসার কথা জানতে পেরে তখন কৃত্তিকাই রীতিমত ময়দানে নেমে পড়ে, দিদির এই অসম জাতের প্রেম বাঁচানোর জন্য! মনে মনে হাসি পায় এখন কৃত্তিকার সে সব কথা মনে পড়লে! কতটুকুই তখন সে আর, অথচ কত সাহস মনে! তারপর আস্তে আস্তে বাবা মা মেনে নেন। সত্যি তো! আজকাল এসব নিয়ে আর ছুঁইছাঁই করলে চলে না! অনেক আধুনিক হয়ে গেছে সমাজ! পড়ালেখার কাছে এমনকি টাকাপয়সাও আর দেখে না মানুষ! ক্রমে তাদের বাড়িতে কুন্তলের আসা যাওয়া শুরু হয়। কুন্তল তাদের বাড়িতে এলে কৃত্তিকাই যত্ন করে চা কফি বানিয়ে, সঙ্গে পটেটো চিপস্ ফ্রাই ক'রে বিস্কুট সাজিয়ে, কখনো বা গ্রীষ্মের দুপুরে ফল কেটে, দইয়ের সরবত গুলে, তার সঙ্গে মনের মাধুরী মিশিয়ে পরিপাটি করে নিয়ে আসতো বসার ঘরে তার প্রিয় কুন্তল দার জন্য। কখনো বা জল ঢেলে হাত ধুতে সাহায্য করার সময়, হাতে হাত ঠেকে গেলে একরকম ভালোলাগায় শিহরণ খেলে যেতো তার একরত্তি কিশোরী হৃদয়টায়! কোনো কারণে কুন্তলের উপরে হওয়া দিদির মান ভাঙাতেও তাকে দেখা যেত কখনো সখনো! কুন্তলের হয়ে ওকালতি করত তখন সে বেশ মুন্সিয়ানার সঙ্গে। তাদের বাড়িতে কুন্তলের যেদিন আসার কথা থাকত, সেদিন মৃত্তিকার চেয়ে তারই বরং মনের অস্থিরতা থাকত বেশি! বারংবার সে ছাদে উঠে বা দোতলার ঝুল বারান্দার রেলিং এ উঁকি ঝুঁকি মারত! আর কখনো আসার কথা থাকা সত্ত্বেও যদি সে না আসত, সেদিন কৃত্তিকার মন খারাপ ও উৎকন্ঠা দেখে কে! কেন সে এল না? কারণটা কী? শরীর খারাপ বা পথে কোন এক্সিডেন্ট হল না তো! হবু শ্যালিকা কৃত্তিকার উপর কুন্তলের টানও নেহাৎ কম ছিল না! একেই তার নিজের কোন বোন ছিল না, তার উপর কৃত্তিকার যত্ন আত্যি ও আন্তরিকতা তার হৃদয়কেও স্পর্শ করত নিঃসন্দেহে। তার প্রতি কৃত্তিকার অসীম টান ও দুর্বলতা বুঝিবা সেও টের পেয়েছিল!
দেখতে দেখতে আরও পাঁচটি বছর কেটে গেছে। দিদি এম এস সি ফার্স্টইয়ার ও সে এখন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী! কুন্তল দা এখন আর তেমন তাদের বাড়িতে আসে না! সে এখন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র। বেশ কয়েক বছর ধরে কটকে থেকে পড়াশোনা করছে! তার দিদিও কলকাতায় বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে ভর্তি হয়েছে। সে এখন সেখানকার হষ্টেলে থাকে। তবে আসন্ন দুর্গাপুজোর ছুটিতে নিশ্চিত দুজনেই বাড়িতে আসবে। তখন যদি আবার দিদির সঙ্গে দেখা করতে আসে কুন্তল দা তাদের বাড়ি, তাহলে তারও দেখা হবে ওর সঙ্গে! সেটা কল্পনা করতেই মনটা অনাবিল আনন্দে ভরে উঠছে কৃত্তিকার!
ওদিকে আবার একটা মুশকিল হয়েছে। এবার প্রিটেষ্ট পরীক্ষায় ভীষণ কম নম্বর পেয়ে সে প্রায় সব কটা সাবজেক্টেই টেনেটুনে পাশ করেছে। পড়াশোনাতে কোনকালেই তেমন ভাল ছিল না সে। তার উপর গানের স্কুলে, নাচের ক্লাসে সময় দিতে গিয়ে উঁচু ক্লাসের পড়া আর সামাল দেয়া যাচ্ছে না তার পক্ষে। তাই বাবা নাচগান ছেড়ে দিতে বলছিলেন। অথচ এ দুটোতেই তার মন লাগে বেশি পড়ালেখার চেয়ে। মা জানেন সে কথা! তাই মাও চান না সে এগুলো ছেড়ে দিক। অথচ বাবা চান যেহেতু সামনে তার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা, তাই এ বছরটা বন্ধ রাখতে বলেছিলেন উনি এ দুটো। বলতে গেলে মায়ের জন্যই এগুলো চালিয়ে যেতে পেরেছে এতদিন! মা বলেন, যার যেদিকে ন্যাক, তার সেই লাইনেই লেগে থাকা ভালো। তাতে সাফল্য পাওয়া যায়!
এদিকে পুজোর ছুটি পড়ে গেছে। দিদি এসে গেছে কলকাতা থেকে। শুনেছে কুন্তল দাও ফিরেছে কটক থেকে। কৃত্তিকা এখন অপেক্ষায় আছে দিদির সঙ্গে দেখা করতে ওর এ বাড়িতে আসার !
অথচ দিদির কোন হেলদোলই নেই এ ব্যাপারে! কোন উচ্চবাচ্যই করছে না! সে নিজে থেকে কুন্তল দার প্রসঙ্গ তুললেও কেমন যেন এড়িয়ে যাচ্ছে মৃত্তিকা! অথচ এই কুন্তলের সঙ্গে তার ঘটে যাওয়া সকল খুঁটিনাটি বিষয়, ঘটনা ও আলাপ আলোচনাই সে ছোটবোনের সঙ্গে শেয়ার করতে কতই না ভালবাসত একদিন! কৃত্তিকাও সেই সব শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করত, কখন দিদি কলেজ থেকে ফিরবে! কুন্তল দা কি মজার গল্প শুনিয়েছে আজকে, বা কি নিয়ে তাদের মধ্যে খুনসুটি, কথা কাটাকাটি অথবা তর্কবিতর্ক ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে! বা কোন পার্কে দেখা করেছে তারা আজ। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কোন হলে মুভি দেখতে গেছে দুজনে ইত্যাদি ইত্যাদি! কিন্তু কৃত্তিকা লক্ষ করেছিল কুন্তলের কটকে পড়তে যাওয়া আর মৃত্তিকার কলকাতায় ভর্তি হওয়ার পর থেকেই সব যেন কেমন পাল্টাতে শুরু করেছিল!
এদিকে দেখতে দেখতে পুজো এগিয়ে আসছে! সেদিন পুজোর কেনাকাটা করতে দুইবোন যখন বাজার করতে বেরিয়েছে তখন মোড়ের মাথায় হঠাৎ কুন্তলদার সঙ্গে দেখা কৃত্তিকাদের! বুকটা খুশিতে ছলাৎ করে উঠলো কৃত্তিকার! চোখাচোখি হতে কুন্তল দা একগাল হাসলেও কোন কথাই বলল না! এদিকে দিদিটাও যেন দেখেও না দেখার ভান করে তাড়াতাড়ি তার হাত ধরে টেনে নিয়ে সামনের গলিতে ঢুকে গেল! কৃত্তিকা অবাক দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে দিদির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল, কিন্তু তার মুখের ভাব দেখে আর কিছু বলতে সাহস করল না! মার্কেটিং থেকে ফিরে এসে মৃত্তিকা অনেক কথা বললেও একবারও কুন্তলের প্রসঙ্গ তুলল না! ভারি বিস্ময় জাগল কৃত্তিকার মনে। একদিন এই নিয়ে খুব জোরাজুরি করাতে অবশেষে দিদি মুখ খুলল! ভীষণ মর্মাহত হল কৃত্তিকা যখন শুনল দিন কয়েক আগে কুন্তলের সঙ্গে তার ব্রেকআপ হয়ে গেছে! ভিতরটা কেমন ছ্যাঁৎ করে উঠল তার! বুকটায় যেন মোচড় দিয়ে উঠল যখন আরও শুনল দিদি তার বাবার বন্ধুর আনা একটা সম্বন্ধয় পাকা দেখায় মত দিয়েছে।
কিন্তু কৃত্তিকার যেন কিছুতেই মন মানছিলো না। যে কুন্তলকে দিদি এত ভালোবাসতো, যাকে দেখা করার জন্য কলেজের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে প্রায় পালিয়ে যেত, যার মুখে সবসময় কুন্তলের কথা লেগেই থাকতো, কী এমন হলো যে তার নাম মুখে আনতেই সে এখন চায় না? ছোটবোনের অনেক পীড়াপীড়িতে অবশেষে মৃত্তিকা বললো,
----জানিস না তুই, ও ভীষণ সেলফিস! জানিসই তো এত ভালো স্টুডেন্ট আমি, পড়াশোনা আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। মাস্টার্স শেষ করে রিসার্চ করতে চাই। তারপর হয় গবেষক নয় প্রফেসর হতে চাই আমি। কিন্তু কুন্তল চায় না আমি চাকরি করি। ও বলে, মেয়েদের কাজ শুধু ভালোভাবে সংসার সামলে রাখা, ভালো স্ত্রী ও কেয়ারফুল মা হয়ে সন্তানদের ভালোভাবে মানুষ করা। বলতো, চাকরি করলে কি এসব হওয়া যায় না?
যে সব মহিলারা সার্ভিস করেন, তারা কি স্বামী, সন্তানদের খেয়াল রাখে না! কিন্তু ও কিছুতেই এ কথা মানবে না! বলে, চাকরি করলে তুমি যতই চাও না কেন, কিছুতেই সুগৃহিনী হতে পারবে না! দুদিক সমান ভাবে কখনোই নাকি সামলানো সম্ভব নয়।
দ্যাখ, কিছুতেই আমি ওকে বোঝাতে পারলাম না। ফলে
ওর কাছ থেকে সরে আসা ছাড়া আমার আর কোন পথ খোলা ছিলো না!
এই বলে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো! কৃত্তিকা অনুভব করতে পারলো দিদির মর্মব্যথা। তাকে সান্ত্বনা দেয়ার আর কোনো ভাষা খুঁজে পেলো না! মনে মনে ভাবলো, সে নিজে হলে এত দুঃখ পেতো না, কারণ কেরিয়ার নিয়ে তার এত উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই! একজন ভালো জীবনসাথী পেলে, ভালো বউ আর যোগ্য মা হতে পারলেই সে সুখী হতো! কিন্তু মন মানসিকতা তো সবার একরকম হয় না! যে যেমন করে জীবনটাকে ভাবে, সে তেমনটাই পাবার আশা করে আরকি! ফলে তার দিদির এতে কিছু দোষ নেই!
পাড়ায় পুজোয় অনেক হইহুল্লোড় চললেও কৃত্তিকার যেন কিছুই আর ভাল লাগছিল না! পুজো মণ্ডপে সপ্তমীর অঞ্জলি দিতে যাবার সময় মুখোমুখি দেখা হল আবার কুন্তলের সঙ্গে। সে একপলক দেখেই চোখ নামিয়ে নিলে কুন্তল তার পাশে এসে তাকে নবমীর দিন বিশুদার চায়ের দোকানে দেখা করতে বলল। তবুও কৃত্তিকা আর চোখ তুলে তাকাতে পারল না, তার বুকে এতটাই হাতুড়ি পিটছিল! ভাগ্যিস দিদির শরীরটা খারাপ থাকায় সে আজ তার সঙ্গে আসেনি, নইলে কি ভাবতো! মনে মনে বললো কৃত্তিকা।
বাড়িতে এসে মনটা খারাপ করায় লুকিয়ে লুকিয়ে ভীষণ কাঁদল ও! কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারল না , মনটা কার জন্য বেশি খারাপ করছে ওর! দিদির সঙ্গে কুন্তলের প্রেম ভেঙে যাবার জন্য, না কুন্তলের সঙ্গে আর সেভাবে দেখা হবে না, সে জন্য?
আজ ইচ্ছে করেই একটু বেশি রকম সাজগোজ করেছে সে, যেটা সচরাচর তার স্বভাব বিরুদ্ধ। যদিও তার দিদি একটু উগ্র সাজগোজ করতেই বরাবর পছন্দ করত। কিন্তু সে ছিল তার বিপরীত। আজ তার পরনে চওড়া লাল পাড়ের গরদের শাড়ি। উঁচু করে বাঁধা খোঁপায় গোলাপ ও বেলফুলের মালা জড়ানো। ঠোঁটে গাঢ় করে লাল লিপস্টিক। চোখে আই লাইনার। মুখে হাল্কা মেকআপ! মিষ্টি একটা পারফিউম ছিটিয়ে নিয়েছে গায়ে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিজেরই যেন খুব ভাল লাগছিল ওর!
নবমীর সন্ধ্যারতী চলছে মণ্ডপে! ঢাকের আওয়াজে কিছুই শোনা যাচ্ছে না। রাস্তায় লোকে লোকারণ্য! যত প্যাণ্ডেল হপারদের ভিড়! কৃত্তিকা তাদের পাশ কাটিয়ে পিছনের গলিটাতে দ্রুত ঢুকে পড়ল! খুব তাড়াতাড়ি পা চালাল সে। অবশেষে গন্তব্যে পৌঁছে দেখল বিশুদার চায়ের দোকানের পিছনে দাঁড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে কুন্তল ওরফে কাজিবুর রহমান। পরনে হাল্কা নীল রঙের পাঞ্জাবি, তাতে জরির কাজ করা। হাঁটুর নীচে দেখা যাচ্ছে সাদা ধবধবে পাজামা। হাতে সোনালী ঘড়ির চেনটা যেন অতিরিক্ত ঝকমক করছে। সে কাছে যেতেই কুন্তল এগিয়ে এসে তার সঙ্গে হাঁটতে লাগল পাড়ার শেষপ্রান্তের দিকে। ক্রমে একটু নির্জনে এসে পড়ল তারা। এখানে একটা বাড়ির পিছনে একটু ফাঁকা মাঠ। রাস্তার আলো না পড়লেও চাঁদের আলো শুভ্র দ্যূতি ছড়িয়ে রেখেছে চারিদিকে! পাশে ঝোপের আড়ালে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে! দুজনে এসে মুখোমুখি একটা নেড়া সেগুন গাছতলায় দাঁড়িয়ে। ডালের ফাঁকে চাঁদের আলো দুজনের গায়ে, মুখে এসে পড়ছে। কিছুক্ষণ কারো মুখে কোন কথা নেই। অজানা আশঙ্কায় কৃত্তিকার বুক এত জোরে ঢিপঢিপ করছে যে, সে যেন কান পাতলেই তা সে শুনতে পেতো।
--- কেমন আছো কেতু? তোমাকে ভারি সুন্দর লাগছে আজ!
অনেক দিন পর এই ডাকটা শুনে হঠাৎ চমকে উঠলো কৃত্তিকা। সত্যি তো, আদর ক'রে কুন্তল দা তো এই নামেই ডাকত তাকে! কতদিন পর শুনল আবার সে ডাক! তার উপর কোন প্রিয়জনের কাছে নিজের রূপের প্রশংসা শুনতে কোন মেয়ের না ভাল্লাগে!আবেগে চোখে জল চলে এল কৃত্তিকার! আহা কি নির্দোষ ভালবাসা ছিল সে! কোন স্বার্থ ছাড়াই কত না টান ছিল তার এই কুন্তল দার প্রতি! কত স্নেহ ভ'রে কত যত্ন ক'রে নিজের হাতে খাবার তৈরি ক'রে নিয়ে আসত সে তার জন্য। তার আসার দিনে বাজার থেকে টাটকা ফুল কিনে টেবিলের উপর ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখত কৃত্তিকা ! বৈঠকখানার বিছানা ঝেড়ে নতুন কাচা চাদর বিছিয়ে হাত দিয়ে টান টান করে দিত! পর্দায় ছিটিয়ে দিত রুম ফ্রেশনার পারফিউম! চানাচুর বিস্কুট কফির প্যাকেট মজুত রাখত আগে থেকেই! আর তার আসার আগে কতবার যে দোতলায় ঝুল বারান্দায় উঁকি ঝুঁকি মারত- তার আর লেখাজোকা ছিল না!
--- কী ভাবছ এত?
কুন্তলের কন্ঠস্বরে আবার চমকে উঠে সম্বিত ফিরল যেন কৃত্তিকার।
---না, কিছু না তো!
-----বলো কেমন আছো?
-----ভালো! তুমি?
-----আর কেমন থাকব! তোমার দিদি যা ব্যবহারটা করল আমার সাথে! সবই তো জান বোধহয়!
আমি এত বললাম, আর কটা দিন সবুর কর। এম টেক টা পাশ করে নি। তারপর ভাল একটা প্লেসমেন্ট পেলেই নাহয় ভাববো ভবিষ্যতের জীবন গড়ার কথা! কিন্তু তোমার দিদির আর কোনমতেই তর সইল না! যেই বাবা একটা সরকারী চাকুরে ভাল পাত্রের সন্ধান পেলেন, অমনি সে ঢলে পড়ল সেই দিকে! যত সব রাবিশ!
বুঝতেই পারছ আমার মনের কি অবস্থা হয়েছিল তখন! এক সময় তো সুইসাইড করতে যাচ্ছিলাম! তারপরে ভাবলাম, মিছিমিছি একটা ট্রেইটরের জন্য নিজের জীবন দিয়ে কী হবে? তাই আজ আবার তোমার দেখা পেলাম!
ট্রেইটর!!! কি মানে যেন কথাটার? কৃত্তিকা মনে করার চেষ্টা করে! তবে তার আর দরকার পড়ে না! কথাটাতে এতটাই শ্লেষ মেশানো ছিল যে তাতেই তার অর্থ বলে দেয়!
বিশ্বাসঘাতকই বটে! নিজের দিদির উপর এত ঘৃণা তার আগে কখনও হয়েছে বলে মনে পড়ে না!
হবারই কথা! কুন্তল দা যা বলল, তা যদি সত্যি হয়, তাতে ঘৃণা হবারই কথা বটে! কিন্তু দিদির মুখে তো সে
অন্য কথাই শুনেছিলো! কার কথায় বিশ্বাস করবে সে এখন ? সে তো আর কোর্টের উকিল বা জজসাহেব নয়, যে দুজনকে ডেকে জেরা করে করে দুজনের কথার সত্যতা যাচাই করবে!
-----যাক গে! যা গেছে তা গেছে! নাথিং টু রিগ্রেট ফর এ লষ্ট গেম!
-----যে জন্য তোমাকে ডেকে ছিলাম! তো তুমি কি বলছ?
এতক্ষণ কুন্তলের মুখের কথা বা কন্ঠস্বর শুনতে কৃত্তিকার বেশ ভালই লাগছিল, যদিও তা কোনমতেই কোনদিক দিয়ে মন ভাল করার মত কথা ছিল না! তবুও এক এক জনের কন্ঠস্বরে এমন একটা মধু মিশানো থাকে, যে আরো আরো শুনতে ইচ্ছে করে! কুন্তলেরটাও সে রকমই! এর আগে কতবার যে দরজার আড়ালে লুকিয়ে থেকে সে দিদির সঙ্গে কুন্তলের ভরাট অথচ মিষ্টি স্বরের কথোপকথন শুনেছে , শুধু এই একটি কারণে!
হঠাৎ সেটি থেমে যাওয়ায় একটু বিমর্ষ হল কৃত্তিকা।
কুন্তলের কথার উত্তরে একটু বিস্মিত হয়ে বলল, কিসের কি বলব?
-----বলছিলাম যে, আমিও তোমাকে ভালবাসি কেতু!
তুমি আমার জীবনসাথী হবে তো?
বিস্ময়ের উপর বিস্ময়। সে যে কুন্তলকে মনে মনে ভালবাসতো বা তার তাকে ভাললাগতো, সেটা কুন্তল দা জানত তাহলে? কথাটা তো আর মিথ্যে নয়। সত্যিই তো খুব ভালোবাসে সে কুন্তলকে! কিন্তু নিজের দিদির প্রাক্তন প্রেমিকের প্রেম প্রস্তাবে কি করে সম্মতি দেবে সে? কি লজ্জা, কি লজ্জা! কিছু উত্তর দিতে পারে না কৃত্তিকা।
-----কি হল, কিছু বল কেতু! তুমি যদি রাজি হও তাহলে তোমাকে দিয়েই আমি ওকে একটা মোক্ষম জবাব দিতে চাই! টিট ফর ট্যাট!
এবার টনক নড়ল কৃত্তিকার। কী বলবে সে?
সাতপাঁচ না ভেবেই মুখ দিয়ে ইনস্ট্যান্টলি বেরিয়ে এল
----ছি ছি! কি বলছ তুমি? না কুন্তল দা! না!! এ হতে পারে না! দিদির প্রেমাস্পদ তুমি! এ কথা বলতে তোমার লজ্জা করলো না? না!! সে কিছুতেই সম্ভব নয়!
বলেই ডুকরে উঠে হুহু করে কাঁদতে কাঁদতে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে পড়িমরি করে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে চলে গেল সে সেখান থেকে!
তার বিলিয়মান উড়ন্ত আঁচলের দিকে তাকিয়ে কুন্তলের যেন মনে হলো, নিমেষে তার স্বপ্নগুলো হাতের মুঠো থেকে যেন ছাড়া পাওয়া প্রজাপতির মত হঠাৎ ই উড়ে বহুদূরে, তার নাগালের বাইরে, কোথায় যেন পালিয়ে গেলো! হাজার চেষ্টা করলেও তা আর পাবার নয়!!
ভাঙা মনকে সান্ত্বনা দিতে, অবশিষ্ট তলানি টুকু নিয়ে যে স্বপ্নের জাল বুনে ছিলো সে , তা যেন তার বুকে সজোরে একটা আঘাত দিয়ে ছিঁড়ে খান খান হয়ে গেলো! বুকে মোচড় দিয়ে বেরিয়ে আসা গভীর একটা দীর্ঘশ্বাসে যেন সে বলে উঠলো, সবাই ট্রেইটর!
কেউ কথা রাখে না!