02/02/2025
॥ এখনো সারেঙ্গীটা বাজছে...” ॥
অনেক মেয়ে ছোটবেলায় পুতুল খেলে, ঘর সাজায়, রান্নাবাটি খেলে। কিন্তু ছোট্ট মেয়েটি খেলত গান-গান! কাগজ পাকিয়ে মাইকের চোঙ বানাত, তারপর উঁচু জায়গায় উঠে দাঁড়িয়ে গাইত, যেন বিশাল কোনো স্টেজে দাঁড়িয়ে পারফর্ম করছে। চারপাশে দর্শকদের কল্পনা করত, আর গান শেষে মনে মনে শুনত করতালির শব্দ!
কে জানত, সেই ছোটবেলার কল্পনার মঞ্চ একদিন সত্যিকারের বাস্তব হয়ে উঠবে! সেই স্টেজ, সেই হাততালি, সেই ভালোবাসা— সবই ধরা দেবে তার জীবনে!
সেই সময় টেলিভিশনের পর্দায় রিয়েলিটি শো-র দাপট ছিল না, ছিল না অগুনতি কচিকাঁচাদের প্রতিযোগিতা। কিন্তু প্রতিভার সন্ধান তখনও চলত, সংগীতের আঙিনায় তখনও নতুন কুঁড়িদের তুলে আনার প্রচেষ্টা ছিল জোরদার। তখনকার "ট্যালেন্ট হান্ট" গুলোয় বিশেষ গুরুত্ব পেত শাস্ত্রীয় সংগীত।
একদিন ঠিক তেমনই এক প্রতিযোগিতায় হাজির হয়েছিল বহু প্রতিযোগী। বিচারকদের সামনে একের পর এক প্রতিযোগী গান গাইছে, পরিবেশটা জমে উঠেছে। হঠাৎ করেই স্টেজে এল এক সোনামুখো ছোট্ট মেয়ে— মাত্র সাড়ে তিন বছরের! এতটুকু বয়স, অথচ কী আত্মবিশ্বাস! মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে অবলীলায় ধরল রাগ ভূপালী।
বিচারকদের চোখ ছানাবড়া! এতটুকু মেয়ে, অথচ রাগাশ্রয়ী সংগীতে এমন দখল! বিস্ময়ে, মুগ্ধতায়, প্রশংসায় তারা প্রশ্ন করলেন— "কে শেখায় তোমায় গান?" ছোট্ট মেয়ে অবাক চোখে সরল গলায় বলল— "বাবা।"
— “তোমার বাবার নাম কী?”
— "শ্রী হরিহর শুক্লা।"
এক মুহূর্তের নীরবতা। পরক্ষণেই বিচারকদের বুঝতে এতটুকু দেরি হয়নি— এমন প্রতিভার পেছনে তো এমনই গুরু থাকতে হয়! পণ্ডিত হরিহর শুক্লার নাম শোনেনি এমন সংগীতপাগল মানুষ ছিল না তখন। আর সেই দিনের ছোট্ট মেয়েটি? সে-ই যে ভবিষ্যতের হৈমন্তী শুক্লা, তখন কে জানত!
হৈমন্তীর বাবা, পণ্ডিত হরিহর শুক্লা ছিলেন একনিষ্ঠ রাগাশ্রয়ী শিল্পী। তাঁর বাড়ির পরিবেশটাই ছিল সংগীতময়। ছাত্রছাত্রীরা আসত তালিম নিতে, প্রতিদিন চলত রেওয়াজ, আর সেই সুরের আবহেই বেড়ে উঠছিল ছোট্ট হৈমন্তী। বয়স তখন কেবল কয়েক বছর, বোঝার ক্ষমতা ছিল না, কিন্তু গানের প্রতি টান যেন জন্মগত! বাবার ছাত্রদের গান শুনতে শুনতেই তার কণ্ঠে রাগের আলাপ ফুটে উঠতে লাগল।
একদিন বাবা খেয়াল করলেন— মেয়ে যখন খেলার ছলে চিৎকার করছে, তখনও তার গলায় সুর! আর সেটাই ছিল প্রথম ইঙ্গিত— মেয়ের মধ্যে গানের ঈশ্বরপ্রদত্ত আশীর্বাদ রয়েছে। সেই থেকেই শুরু হল তালিম। গুরু অন্য কেউ নন, স্বয়ং বাবা!
হরিহর শুক্লা তখন ঠিক করে ফেললেন— মেয়েকে তৈরি করবেন শাস্ত্রীয় সংগীতের পথে। সাধনা সহজ ছিল না, কিন্তু ছোট্ট মেয়েটি যেমন আগ্রহী, তেমনি পরিশ্রমী! তারপর বাবা নিজেই তাঁকে পাঠালেন চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতে আরও গভীর জ্ঞান অর্জনের জন্য।
শুধু হরিহর শুক্লা বা চিন্ময় লাহিড়ী নন, হৈমন্তী শুক্লার গানের যাত্রাপথে এমন সব মহান সঙ্গীত ব্যক্তিত্বের হাত পড়েছিল, যা সত্যিই ঈর্ষণীয়! সংগীত জগতে পা রাখার পর একে একে তাঁর জীবনে এসেছেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর, উস্তাদ আলি আকবর খাঁ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, মান্না দে, শ্যামল মিত্রের মতো কিংবদন্তিরা। একেকজন যেন একেকটি জ্বলন্ত আলোকবর্তিকা।
তাঁদের সংস্পর্শে এসে হৈমন্তী শুধু গান শেখেননি, বরং গানের গভীরতা, তার সূক্ষ্মতা, তার সৌন্দর্যকে অনুভব করতে শিখেছেন। এই গুরুরা শুধু সুর দিয়েই তাঁকে তৈরি করেননি, গানের প্রতি এক অদ্ভুত শ্রদ্ধা এবং দায়বদ্ধতাও শিখিয়েছেন। আর সেই শিক্ষার প্রতিফলন দেখা গেছে তাঁর একের পর এক গানে।
পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় যখন একসঙ্গে কাজ শুরু করলেন, তখন তাঁদের লক্ষ্য ছিল নতুন প্রতিভাদের সুযোগ দেওয়া। সেই ভাবনা থেকেই তাঁরা ঠিক করলেন, দুটি সিনেমায় নতুন কণ্ঠকে সুযোগ দেবেন— দুষ্টু-মিষ্টি এবং বালক শরৎচন্দ্র। গানগুলোর কথা ও সুর অসাধারণ হল, কিন্তু প্রশ্ন উঠল, কে গাইবে? দুজনেই একবাক্যে বললেন— নবাগতা হৈমন্তী শুক্লার কণ্ঠেই ফুটবে এই সুরের জাদু।
এই সিদ্ধান্তই হৈমন্তী শুক্লার সংগীতজীবনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করল। বিশেষ করে বালক শরৎচন্দ্র ছবির গানই তাঁকে এনে দিল অসামান্য জনপ্রিয়তা। আকাশ-বাতাস মুখরিত হল তাঁর কণ্ঠে—
"শিবঠাকুরের গলায় দোলে
বৈঁচি ফলের মালিকা।
তোর গলায় দড়ি কে পরাল,
বল না গৌরী বালিকা।"
এই গান হৈমন্তীর সংগীতজীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল।
একদিন ঠিক হল, দুই কিংবদন্তি সুরকার একসঙ্গে দুটি গান তৈরি করবেন। তবে তাঁরা কি রাজি হবেন? সংশয় ছিল, কিন্তু অবাক করার মতো ব্যাপার— পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও উস্তাদ আলি আকবর খাঁ দুজনেই প্রস্তাব গ্রহণ করলেন!
পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় বহু আগে থেকেই পণ্ডিত রবিশঙ্করের এক সুরের ওপর বাংলা কথা লিখে রেখেছিলেন। সেই কথা শোনানোর জন্য একদিন পুলকবাবু ও হৈমন্তী পৌঁছে গেলেন রবিশঙ্করের বাড়িতে। তিনি কথা শুনেই মুগ্ধ! সঙ্গে সঙ্গে সেই সুরেই তৈরি হল গান—
"মনে পড়ে তোমারে..
কেন এত মনে পড়ে তোমারে।
ভুলে যেতে চাই, তবু কেন হায়,
মনে পড়ে তোমারে..."
এরপর রেকর্ডের অন্য পৃষ্ঠার জন্য উস্তাদ আলি আকবর খাঁ নতুন সুর দেবেন। তাঁর পুরনো বাড়িতে পৌঁছে গেলেন পুলকবাবু ও হৈমন্তী। ওস্তাদজী সরোদে একটি সুর বাজিয়ে বললেন— "এটা আমার সৃষ্টি! এবার এই সুরে গান লেখো।"
কিন্তু সমস্যা হল, ওস্তাদজী যে গাইছেন, তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না! তবে পুলকবাবুর অসাধারণ প্রতিভার কাছে সেটা কোনো বাধাই নয়। সেখানেই বসে তিনি লিখে ফেললেন এক চিরকালীন গান—
"স্মৃতি শুধু থাকে
সেই তো মনে রাখে...
সেই তো পিছু ডাকে
সেই তো পিছু ডাকে.."
এই রেকর্ড এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল যে সত্যজিৎ রায় পর্যন্ত বলেছিলেন—
"আমাদের দেশের দুজন সর্বোচ্চ স্তরের সংগীতজ্ঞ, পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও উস্তাদ আলি আকবর খাঁ একই গায়িকার জন্য দুটি গান রচনা করেছেন, যা এক রেকর্ডের দুই পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছে। এমন ঘটনা বিরল!"
শুধু বাংলা নয়, হৈমন্তী শুক্লা হিন্দি, উড়িয়া, গুজরাটি, পাঞ্জাবি, অসমিয়া, ও ভোজপুরি ভাষাতেও গান গেয়েছেন। হিন্দি ছবিতেও তাঁর গান জনপ্রিয়তা পেয়েছে, পুরস্কৃতও হয়েছেন। কিন্তু তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার? শ্রোতাদের ভালোবাসা। বিশেষ করে বাঙালি শ্রোতাদের উজাড় করা স্নেহ, যা তাঁর শিল্পীসত্তাকে সবসময় বাঁচিয়ে রেখেছে।
বাংলা আধুনিক ও সিনেমার গান ছাড়াও তিনি সমান দক্ষতায় গেয়েছেন ভজন, সেমি-ক্লাসিক্যাল, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি। ছোটবেলা থেকেই বাবার আশেপাশে বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞদের দেখার সুযোগ হয়েছিল। তাঁদের গান শুনতে শুনতেই তৈরী হয়েছিল তাঁর সংগীতবোধ।
শৈশব থেকেই হৈমন্তী লতা মঙ্গেশকরের গান গাইতেন। একবার লতা মঙ্গেশকর কলকাতায় এলেন। আয়োজকদের মধ্যস্থতায় হৈমন্তী গেলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। কলকাতার অনুষ্ঠানে লতাজী শুরুতেই কয়েকটি বাংলা গান গাইতেন, আর সেই গানগুলো শেখানোর দায়িত্ব পড়ল হৈমন্তী শুক্লার ওপর! সেই থেকেই গড়ে উঠল লতা মঙ্গেশকর ও হৈমন্তী শুক্লার এক ভালো সম্পর্ক।
এইভাবেই একের পর এক সুরের জগতে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন হৈমন্তী শুক্লা। সংগীতের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা আর একাগ্রতা তাঁকে বাংলা গানের জগতে স্থায়ী আসন দিয়েছে। তাঁর গলায় যে আবেগ, যে আন্তরিকতা, তা বাংলা সংগীতকে সমৃদ্ধ করেছে আজও।
একবার পুজোর গান তৈরি হবে। গীতিকার বিশ্বনাথ দাস— আকাশবাণীতে কাজের সুবাদে বহু বিশ্বখ্যাত শিল্পীর সান্নিধ্যে এসে গানের কারিগরি দেখেছেন কাছ থেকে। কীভাবে সেখানে লিরিক লেখা হয়, কীভাবে সুর বাঁধা হয়, কীভাবে অনবদ্য গায়কীতে তা প্রাণ পায়— সবই তাঁর দেখা। এরকমই এক নষ্ট হয়ে যাওয়া জলসার অনুষঙ্গে কলম তুলে নিলেন তিনি। আর সেই কথায় সুর দিলেন অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। কেউ ভাবেনি, এই গানটা একদিন ইতিহাস গড়বে। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই তা হয়ে উঠল কালজয়ী! হৈমন্তী শুক্লার গাওয়া সেরা গানের তালিকায়ও জায়গা পেল উপরের দিকেই—
“এখনো সারেঙ্গীটা বাজছে
এখনো চেনা চেনা আতরের গন্ধ..
একি রোমাঞ্চ, শুধু রোমাঞ্চ..
নাকি আগামী দিনের কোনো
ঝড়ের আভাস বয়ে আনছে..”
একটা গান, একটা সুর— এক চিরস্থায়ী আবেগ হয়ে রয়ে গেল মানুষের মনে।
সঙ্গীতের সফরটা তাঁর কাছে ছিল এক আজীবন যাত্রা। দিকপাল শিল্পীদের সঙ্গ পেয়েছেন বহুবার, এমনকি হিন্দি ছবির সুরকাররাও তাঁর কণ্ঠের জন্য সৃষ্টি করেছেন বাংলা গান। যেমন, কিংবদন্তি সুরকার নৌশাদজী তাঁর "বোল রে পাপিহারা"-র সুরের ছায়ায় বুনেছেন এক অপূর্ব সৃষ্টি—
“বিকেল হলেই তোমায় মনে পড়ে
কত না স্মৃতি আসা-যাওয়া করে।”
সেই ১৯৭২ সাল থেকে শুরু। পথ চলতে চলতে অনেক কিছুই বদলেছে, বদলায়নি শুধু তাঁর কণ্ঠের জাদু। হৈমন্তী শুক্লা— নামটাই যেন এক মায়ার পরশ। কপালে বড় লাল টিপ, চোখে উজ্জ্বলতা, মুখে একগাল চেনা হাসি। অনেকে বলেন, তিনি এক বটবৃক্ষ— যার ছায়ায় বহু মানুষের আশ্রয়। কিন্তু যিনি এত মাতৃস্নেহে ভরা, তিনি কেন সংসার পাতলেন না?
একবার এক রিয়ালিটি শোর মঞ্চে অকপটে বলেছিলেন তিনি—
“গান ছাড়া আমার কিছুই ভালো লাগে না। গানটার সঙ্গেই গভীর প্রেম, আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে।”
তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল—
“কখনও মনে হয়নি সংসার করলাম না?”
জবাব এসেছিল নিঃসংকোচে—
“না, কখনও না। কেন আমার বর হল না, ছেলেপুলে হল না, এসব কখনও মনে হয়নি। আসলে আমার এত ছেলেপুলে যে, লোক আমাকে মা বলে ডাকে।”
জন্ম দিলেই যে মা হওয়া যায়, তা তো নয়! তাঁর ছাত্রছাত্রীদের কাছেও তিনি মা-ই।
তাহলে প্রেম? প্রেম কি কোনওদিন আসেনি জীবনে? একটুও রাখঢাক না করে বলেছিলেন—
“কেউ হয়তো ভালোবেসেছে, আমি বুঝতে পারিনি। অনেকেই আমায় জিজ্ঞেস করেন, তুমি এত ভালোবাসার গানগুলো কাকে ভেবে গাও? আমি তখন উত্তর দিই, ওই মাইক্রোফোনটাই আমার প্রেমিক হয়ে যায় তখন।”
একটা মাইক্রোফোন, এক আকাশ গান, আর অগণিত ভালোবাসা— এটাই তো তাঁর জীবন! পুরস্কার পেয়েছেন অগুনতি, তানসেন পুরস্কার থেকে বঙ্গবিভূষণ। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি? মানুষের ভালোবাসা।
শিল্পীর জন্মদিনে একটাই কামনা— তাঁর ‘সারেঙ্গীটা’ চিরকাল বাজুক… চিরদিন....
লেখক ©️ কিছু কথা ॥ কিছু সুর
তথ্য সংগ্রহ: সারেগামা (HMV) ও অন্যান্য।
#সংগৃহীত
_____________________________
এই লেখা অথবা লেখা থেকে কোনো অংশ নিলে লেখকের অনুমতি অথবা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বাধ্যতামূলক।