17/04/2023
◾ ◾◾ || প্রসঙ্গ - ডিপি ওয়ার্ক || ◾◾◾
আজকাল সৎসঙ্গ জগতে ডিপি ওয়ার্ক সম্বন্ধে অনেক কথা শোনা যাচ্ছে। এই ডিপি ওয়ার্কের ব্যাপারটা আসলে কী?
দীক্ষাপত্র আপডেট এবং সমস্ত দীক্ষিত মানুষকে এক জায়গায় আনা সংক্রান্ত কাজকেই এক-কথায় ডিপি ওয়ার্ক বলা হয়। পূজনীয় অবিনদাদার নির্দেশে এই কাজ শুরু হয়েছে। সৎসঙ্গের আদর্শে দীক্ষিত মানুষজন অনেক জায়গায় ছড়িয়ে আছেন। তাদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য পূর্ণাঙ্গ কোন ডেটাবেস তৈরি নেই। কেউ নিজেদের আগের বাসস্থান ছেড়ে অন্য কোথাও বসবাস করছেন, কেউ দীক্ষার নিয়মগুলো কোন কারণে পালন করছেন না, আবার কারোর অনেকের মনে সৎসঙ্গ বা ঠাকুরকে নিয়ে অনেক প্রশ্ন জমা হয়েছে যার জবাব তারা খুঁজে পাচ্ছেন না। এরকম সমস্ত দীক্ষিত মানুষদের কাছে পৌঁছানোর জন্য, এদেরকে আরও একবার একত্রিত করার জন্যই ডিপি ওয়ার্ক শুরু হয়েছে।
▪️ ▪️ ডিপি ওয়ার্ক কারা করতে পারেন?
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের সৎনামে দীক্ষিত প্রতিটি মানুষ ডিপি ওয়ার্ক করার অধিকারী। ডিপি ওয়ার্কের জন্য পাঞ্জাধারী কর্মীরা যেমন কাজ করছেন তেমনই কাজ করছেন হাজারে-হাজারে সাধারণ সৎসঙ্গী দাদা এবং মায়েরা।
◾ যদি সবাই ডিপি ওয়ার্ক করতে পারে, তাহলে শুনছি যে এ বিষয়ে একটি টিম গঠন করা হয়েছে?
সৎসঙ্গের দীক্ষিত মানুষদের সংখ্যা সুবিশাল। কাজেই, যদি প্রত্যেক সৎসঙ্গী কোন সেন্ট্রাল বা রিজিওনাল কমিটির সাথে যোগাযোগ না রেখে কাজ করতে থাকেন, তবে ডিপি ওয়ার্কের মতো বড় কাজ সুসংহতভাবে করা দুষ্কর হয়ে উঠবে। তাই ডিপি ওয়ার্কের জন্য একটি সেন্ট্রাল টিম রয়েছে এবং বিভিন্ন রিজিওনাল লেভেলের জন্য আলাদা- আলাদাভাবে একাধিক রিজিওনাল টিম রয়েছে। সাধারণ সৎসঙ্গীরা এই টিমগুলোর ফিল্ড-ওয়ার্কার হিসেবে কাজ করছেন। কোন অসুবিধার ক্ষেত্রে এতে সবাই-সবাইকে সাহায্যও করতে পারছেন।
◾ আমি ডিপি ওয়ার্ক করতে চাই, কার সাথে যোগাযোগ করব? এর জন্য যদি ট্রেনিং লাগে, কে দেবে?
এর উত্তর খুব সহজ, আপনি নিকটবর্তী সৎসঙ্গ মন্দির, বিহার অথবা উপযোজনা কেন্দ্রে যোগাযোগ করুন। সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীরা আপনাকে এই বিষয়ে গাইড করবেন। যদি কোন ট্রেনিং প্রয়োজন হয়, তাহলে তার ব্যবস্থাও ওনারাই করবেন।
◾ ডিপি ওয়ার্ক করা এত জরুরী কেন?
আমরা জানি যে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের জীবননীতির মূল ভিত্তিই হল ইনক্লুসিভ গ্রোথ ফর অল। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুশ্রুতির প্রথম খণ্ডের একটি স্থানে বলছেন,
“পড়শিরা তোর নিপাত যাবে
তুই বসে সুখ খাবি বুঝি ?
যা ছুটে যা ওদের বাঁচা
ওরাই যে তোর বাঁচার পুঁজি।”
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সে একা বাঁচতে পারে না। আজকে আমার পাশের মানুষটি যদি ভালো না থাকে, তাহলে তার এই খারাপ থাকা বা কষ্টে থাকা কোন-না-কোনভাবে আমার ব্যক্তিগতভাবে ভালো থাকাকেও প্রভাবিত করবেই। এটিই হল “ইনক্লুসিভ গ্রোথের” আসল বক্তব্য।
ডিপি ওয়ার্ক আমাদেরকে এই অন্যকে ভালো রাখার মধ্যে দিয়ে নিজে ভালো থাকার পথে আমাদেরকে অগ্রসর হতে সাহায্য করে। শ্রীশ্রীআচার্য্যদেব বলছেন যে করোনার কারণে বহুদিন আমরা বিচ্ছিন্নভাবে আছি। কিন্তু এবার সময় হয়েছে আমাদের আবার একসাথে ফিরে আসার। যারা কোন কারণে সৎসঙ্গী হয়েও সৎসঙ্গের জীবনশৈলী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন এবার তাদের ঘরে-ঘরে পৌঁছানোর পালা। এতদিনের অনভ্যাস, অপরিচিতি অস্বাচ্ছন্দ্যর স্থিতিজাড্য ভেঙ্গে ও আমাদেরকেই ঐসব মানুষদের জীবন ও সৎসঙ্গের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে হবে।
আমরা সকলেই জানি, যে দিন-প্রতিদিন যে ভবিষ্যৎ সময়ের দিকে আমরা এগিয়ে চলছি, তা অতি ভয়াবহ। পারিবারিক ভাঙ্গন ধরেছে অনেক আগেই, দেশে-বিদেশে চলছে আর্থিক ও সামাজিক দুর্ভিক্ষ। এই অবস্থায় মানুষ যদি মানুষের পাশে এসে না দাঁড়ায় তাহলে বেঁচে থাকাই দুষ্কর হয়ে উঠবে। এই জন্যই দরকার ডিপি ওয়ার্ক। এই জন্যই দরকার মানুষের কাছে পৌঁছে, মানুষকে তাঁর পথে ধরে রাখা।
◾ তাহলে ডিপি ওয়ার্ক মূলত জনসংযোগের কাজ। এতো সমাজসেবকদের কাজ। সৎসঙ্গর মতো ধার্মিক প্রতিষ্ঠানের এর মধ্যে কেন?
ধর্ম আর সমাজ পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। আসলে, ধর্মের মূল উদ্দেশ্যই হল মানুষকে বাঁচতে সাহায্য করা। আর সমাজেরও উদ্দেশ্য তাই একা মানুষকে সুরক্ষা ও সঙ্গ দিয়ে ভালো রাখা। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে ধর্ম আর সমাজ দুটির লক্ষ্যই এক।
সৎসঙ্গ বিশ্বাস করে ধর্ম কোন আচারসর্বস্ব রীতিনীতি হতে পারে না। আমাদের কাছে ধর্ম হল একটি লাইফ-স্টাইল বা জীবন-ধারনের পদ্ধতি বিশেষ। কাজেই সমাজবিচ্ছিন্নভাবে ধর্ম-পালনের ব্যাপারটা আমাদের কাছে অসম্ভব বলে মনে হয়। সৎসঙ্গীরা নিজেরা ভালো থাকতে চায়, আর এই “নিজেদের ভালো থাকার” জন্যই তারা তাদের পরিবেশের সমস্ত মানুষকে ভালো রাখতে চায়। আর এই জন্যই ডিপি ওয়ার্ক শুরু হয়েছে।
◾ ডিপি ওয়ার্ক করার সময় কোন-কোন দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে?
ডিপি ওয়ার্ক করার সময় যেসব দিকে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে সেগুলো হল,
→ ১। বাড়ির দীক্ষিত মানুষজন ঠিকভাবে ইষ্টভৃতি করেন তো?
→ ২। নিয়ম মেনে ঐ বাড়ি থেকে ইষ্টভৃতি ইষ্টস্থানে পাঠানো হয় তো?
→ ৩। বাড়িতে ঠাকুরের আসন সঠিকভাবে আছে তো?
→ ৪। ঐ পরিবারের সাথে স্থানীয় গুরুভাইদের যোগাযোগ আছে তো?
→ ৫। পরিবারের সদস্যদের মনে সৎসঙ্গকে নিয়ে কি কোন প্রশ্ন আছে? থাকলে তা কী?
→ ৬। পরিবারের দীক্ষিত মানুষদের নাম, ঠিকানা, দীক্ষার বিবরণ, যোগাযোগের নম্বর সংগ্রহ করা।
উপরোক্ত ছয়টি বিষয় ছাড়াও যে জিনিসটির ওপর বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়, তা হল, বাড়িতে যদি কেউ ইষ্টভৃতিব্রত ভঙ্গ করে থাকেন, অর্থাৎ নিয়মিত ইষ্টভৃতি না করেন তাহলে তাকে যাজনের মধ্য দিয়ে যথাশীঘ্র সম্ভব ইষ্টভৃতিপরায়ণ করে তোলা। এছাড়াও বাড়িতে যদি এমন কেউ থাকেন যিনি দীক্ষা নিয়েছেন অথচ বীজনাম ইত্যাদি মনে নেই, তাহলে তাকে যাজন করে পুনরায় ইষ্টপথে নিয়ে আসাও ডিপি ওয়ার্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।
◾ ডিপি ওয়ার্কের সময় ঠাকুরের আসন সাজানোর দিকে নজর দেওয়ার কারণ কী?
ডিপি ওয়ার্কের উদ্দেশ্যই হল মানুষকে কেন্দ্রমুখী করে তোলা। শ্রীশ্রীঠাকুর আমাদের কাছে শুধু আরাধ্যই নন, তিনি আমাদের পরিবারের প্রধান সদস্য। এবার, আমি আমার পরিবারের মানুষদের যেমন যত্নে রাখি তেমন যত্নেই আমার তাঁকেও রাখা উচিত। আবার, আমি নিজে তাঁর আসন কীভাবে বা কী পরিস্থিতিতে রেখেছি তা থেকেই বোঝা যায় যে আমি নিজে কী প্রকার জীবনে অভ্যস্ত। এছাড়াও, ঠাকুরঘরকে বাড়ির সবচেয়ে পবিত্র স্থান বলা হয়। সে জায়গা তো ঠিকভাবে সাজানো থাকাই উচিত।
◾ ঠাকুরের আসন কীভাবে সাজানো উচিত?
সৎসঙ্গের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে থাকা ৩১.১২.২০২১ তারিখের নোটিশে এই নিয়ে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া আছে। প্রথাগতভাবে সৎসঙ্গীদের ঠাকুরের আসনে, মধ্যে অবস্থান করেন শ্রীশ্রীঠাকুর। ঠাকুরের বামপাশে থাকেন শ্রীশ্রীবড়মা ও ডানপাশে থাকেন শ্রীশ্রীবড়দা। শ্রীশ্রীঠাকুর এবং শ্রীশ্রীবড়মাকে আমরা অভেদ বলে মানি। তাই তাঁদের প্রতিকৃতি সমান ও সমঅবস্থানে হওয়াই উচিত। শ্রীশ্রীবড়দার স্থান এর চেয়ে সামান্য নিচে হয়। এছাড়াও ঠাকুরের আসনের সাথেই রাখতে হয় শ্রীশ্রীআচার্য্যদেবের আসন, তবে একটু নিচু লেভেলে। এছাড়া ঠাকুরের আসনে অন্য কোন দেব-দেবতার ছবি বা মূর্তি রাখা উচিত নয়।
শ্রীশ্রীঠাকুর সাদা রঙ খুব পছন্দ করতেন। তাই তাঁর আসনে পাতার কাপড়টি সাদা রঙের হবে। আসনটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে রাখা উচিত। অযথা ফুল, চন্দন ইত্যাদির ভারে আসনকে ভারাক্রান্ত করা উচিত নয়।
মনে রাখতে হবে, ঠাকুর আমার বাড়ির মানুষ, আমার অভিভাবক। তিনি কোন অজানা অতিথি নন যে তাঁকে রাজভোগ সাজিয়ে দিতে হবে। তিনি আমার মনের রাজা, আমার সংসারের রাজা। আমার যা সামর্থ্য তা দিয়েই আমি তাঁকে নিজের কাছে রাখব। ভালো আসন কেনার সামর্থ্য না হলে, ফলের কার্টুনকে সাদা রঙ করে বা সাদা কাগজ লাগিয়ে ঠাকুরের আসন হিসেবে ব্যবহার করার কথা শ্রীশ্রীআচার্য্যদেব অনেকবার বলেছেন।
আসলে ঠাকুরের আসন সাজানোর মূলকথা হল, আমি তাঁকে ঠিক কীভাবে আমার জীবনে গ্রহণ করেছি। আমি যদি তাঁকে বাড়ি সাজানোর পুতুল বানিয়ে রাখি তাহলে আমার আসন-সজ্জা দেখেই তা বোঝা যাবে। আর পুতুল না হয়ে, আমার কাছে তিনি যদি আমার জীবনস্বামী হন, আমার সংসারের ভিত্তি হন, তাহলে সেই সমর্পণও আমার বাড়ির আসন- সজ্জায় স্পষ্ট প্রতিভাত হয়ে উঠবে। এই বিষয়টি মাথায় রাখলেই আসনসজ্জার ব্যাপারটা সহজ হয়ে যাবে।
◾ ঠাকুরের আসন সাজানো নিয়ে এত বিধি-নিষেধের কি কোন দরকার আছে?
অবশ্যই দরকার আছে। পূজনীয় বিংকিদাদা ৩১.১২.২০২১ তারিখে হওয়া ঋত্বিক সম্মেলেন চলাকালীন এই প্রসঙ্গে বলেছেন,
" ঠাকুরের আসনে যা থাকে সবই সম্পর্ণ ঠাকুরের ভাববাহী একটা একক প্রতিকৃতি সেটারও একটা অর্থ আছে, উদ্দেশ্য আছে। এখানেও কিন্তু খামখেয়ালি ভাবে যা-ইচ্ছে করলে, যেমন-তেমন ভাবে করলে, বিশেষ করে সমষ্টিগত ভাবে যখন আমরা তাঁকে নিয়ে চলি, তখন কিন্তু খেয়াল-খুশি মতো চললে তা ব্যত্যয় ডেকে আনে। খামখেয়ালে চলার কোন অধিকার আমাদের নেই। নিজেদের মনগড়া রকমের সাধান-ভজন করা, যা ইচ্ছে করা, বা সেই করাতে অন্যকে সামিল করা, অন্যকে উদ্বুদ্ধ করার কোন অধিকার আমাদের নেই। যারা এমন করেন, যারা মানুষকে বিভ্রান্ত করেন নিজেদের মনগড়া রকমে চলার জন্য, তাঁদের বিভ্রান্তির মায়াজালে কেউ জড়িয়ে পড়বেন না।”
তাহলে কী বোঝা গেল এই নির্দেশগুলো থেকে ? আমরা, যারা শ্রীশ্রীঠাকুরের পথে চলার শপথ নিয়েছি তাদের কারোর নিজের মর্জিমাফিক উল্টোচলনে চলা উচিত নয়। ঠাকুরের আসন সাজানো নিয়ে যখন সুস্পষ্ট নির্দেশ আছে, তখন আমাদের উচিত সেই নির্দেশ অক্ষরে-অক্ষরে মেনে চলা।
ঠাকুরের আসন একটি বিশেষ জীবনচর্যার প্রতীক, যেমনটা ঠাকুরবাড়ি থেকে অনেকবার বলা হয়েছে। এবার যদি কেউ প্রশ্ন করেন যে কেন মানতে হবে এই নির্দেশ, তাহলে আমার জবাব এটাই যে, আচার্য্যদেব চাইছেন বলেই আমরা এই নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করব। আমরা জানি যে ঠাকুর বারবার বলতেন, “এক আদেশে চলে যারা / তাদের নিয়েই সমাজ গড়া।” কাজেই, যদি আমরা মনে করি যে আমরা তাঁর আদেশ মাথায় নিয়ে চলব, তাহলে আমাদের ঠাকুরের আসন সাজানো থেকে শুরু করে আর বাকী যা কিছু আছে সব বিষয়য়েই ইষ্টআদেশ মেনে চলার অভ্যেস করতে হবে। এতেই সবার মঙ্গল।
একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা " আপ্তি "
আলোচনায় আপ্তিঃ প্রসঙ্গ " ডিপি ওয়ার্ক "
মৈত্রেয়ী পাণ্ডে শিক্ষিকা, মুর্শিদাবাদ
ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল ২০২৩ ইং