08/01/2025
সনাতন সংস্কৃতি তে উপাসনা একটা অন্য মাত্রায় রয়েছে। খ্রীষ্টান, ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রে, গির্জা বা মসজিদ হলো উপাসনার স্থল। কিন্তু সনাতন সংস্কৃতি তে, মন্দির ঈশ্বরের নিজস্ব গৃহ। সেখানে ঈশ্বর নিজে বাস করেন। তার নিয়মিত স্নান, বস্ত্র, খাদ্যগ্রহন, এবং শয়ন সবই সাধারন একজন মানুষের মতোই হয়ে থাকে। কিন্তু এই রূপ আমরা পুরাণের সময় থেকে পেয়ে থাকি। বৈদিক মত অনুযায়ী, ঈশ্বর এর ব্যপ্তি সর্বব্যাপী। ব্রহ্মান্ডের প্রতিটি অংশে শক্তি (Energy) এবং প্রতিটি শক্তিই ঈশ্বরের স্বরূপ। প্রকৃতির প্রধান যে পাঁচটি শক্তি, অগ্নি, বায়ু, জল, আকাশ, পৃথ্বী এনারাই আরাধ্য। বৈদিক যুগের আগে থেকেই এই সুবিশাল প্রাকৃতিক শক্তিকে যজ্ঞের মাধ্যমে নৈবিদ্য নিবেদন করা হতো। রাজা, তার নিজের ইচ্ছা, আকাঙ্খ্যা, দেবতার কাছে, দুধ, ঘি, নৈবিদ্য সহযোগে নিবেদন করতেন। আহুতির মাধ্যমে সেই নিবেদন "অগ্নি"দেবের মাধ্যমে শুদ্ধ হয়ে ঈশ্বরের কাছে পৌছাতো। এবং পরিবর্তে, রাজা নিজের অভিষ্ট লাভের জন্য দেবতার কাছ থেকে বর দান পেতেন। "তথাস্তু" - অর্থাৎ তথা অস্তু, সেটাই ঘটবে, এমন বরদান ই ছিলো মূল লক্ষ্য। যজ্ঞের স্থান হতো, জনবসতির থেকে একটু দূরে। রাজা বা যজমান এর এক এক রকম আকাঙ্খ্যার জন্য যজ্ঞের নিয়ম আলাদা থাকতো। আমাদের সকল শক্তির উৎস সূর্য্য। এটা আমরা সবাই জানি। তাই বৈদিক যুগে আদিত্য বা সূর্য্যের গুরুত্ব অনেক ছিলো। প্রাকৃতিক শক্তির অসীম ক্ষমতা কে তুষ্ট করার জন্য, নিবেদনার্থে যজ্ঞের ব্যবস্থা করা হতো। যজ্ঞের পর যেখানে যজ্ঞ হয়েছে, সেই জায়গা তে আর যাতে যজ্ঞ না করা যেতে পারে তেমন ব্যবস্থা করা হতো। আর এই সব কিছুই সিন্ধু সভ্যতার সময়ে বা তার আগে।
পরবর্তী সময়ে, এই নিবেদন ধর্মী যজ্ঞ পরিবর্তন হয়েছে, আবাহন ধর্মী পুজোতে। সেখানে এসেছে, দেবতাকে অতিথি করে, আবাহন করে ঘরে নিয়ে এসে, তার সেবা করার রীতি। ততদিনে, জন সংখ্যা বেড়েছে। সিন্ধু সভ্যতার পর প্রকৃতির রুদ্র রূপ মানুষ দেখেছে। সেখানে খাদ্যের অপ্রতুলতাও সমস্যা তৈরি করেছে। এবং সেই জন্যই অগ্নির পরিবর্তে আবাহনের মূল আধার হয়েছে, বরুন, বা জল। জলের মাধ্যমেই শস্য শ্যামলা ধরিত্রীর রূপ আসে। খাদ্যের অপ্রতুলতা কমে। এবং আবাহনের মাধ্যম হয়েছে, ঘট। আমাদের সকল পুজোর আসল অংশ হলো ঘট। তার মধ্যে জল থাকে। থাকে শ্রীফল। পঞ্চশস্য। এবং এখানে প্রকৃতির শস্য শ্যামলা রূপকেই কল্পনা করা হয়। এবং এই পরিপূর্ণ রূপ যেন চিরকালীন ভাবে থাকে তারই আবাহন করা হয়। দেবতাকে ঘরে সিঙ্ঘাসনে স্থাপন করা হয়। প্রদিপ জ্বালিয়ে, সুগন্ধী ধূপ দিয়ে, আসন পেতে তাকে স্থাপন করা হয়। মন্ত্রে উচ্চারণ করা হয়। "ইহ তিষ্ট, ইহ তিষ্ট, ইহ স্থিত, ইহ স্থিত"। তার নানা কীর্তি কে মনে করানো হয়, তার 'ভজন' করা হয়, ক্ষেত্র বিশেষে, তার পাঁচালি পড়া হয়। আর ঈশ্বরের মুর্তি, নিস্পলক দৃষ্টি তে তার ভক্তের দিকে তাকিয়ে থাকেন। যেখানে ঈশ্বরের সাথে, ভক্তের "দর্শন" হয়। এবং ঈশ্বর ভক্তের অন্তরাত্মার সকল ব্যাথা, সকল যন্ত্রণা, সকল কামনা, সকল ইচ্ছার সাথে পরিচিত হন এবং তার নিবারনে সচেষ্ট হন। সেখানে দেবতা তুষ্ট হয়ে, প্রসাদ দেন। যাতে সকল মনকামনা পূর্ণ হয়। ঈশ্বর কে ঘরে স্থাপন করা যেতে পারে, অথবা মন্দিরে। সব ক্ষেত্রেই, দেবতা, তার অসামান্য ক্ষমতা সহ অধিষ্ঠান করেন। তার অধিষ্ঠানের সকল রকম ব্যবস্থা করা হয়। এখানে দেবতা আমাদের পরিবারের সদস্য। গোপাল, যিনি বিষ্ণূর অবতার, তার অধিষ্ঠান, ঘরে একজন পরিবারের সদস্যের মতো করা হয়। লক্ষ্মী প্রতিমা, ঘরে অধিষ্ঠান করা হলে, তাকে পরিবারের সদস্যের মতো, নিত্য পুজো, সন্ধাহ্নিক, সহ সকল আচার মেনে করা হয়। হিন্দু সংস্কৃতিতে ঈশ্বর আলাদা কোথাও থেকে আমাদের দোষ গুন বিচার করেন না। ঈশ্বর আমাদের মধ্যে থেকে আমাদের জীবন কে সহজ করে তোলার পথ দেখান। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে, প্রতিদিনের আচার আচরণের সাথে, একাত্ম হয়ে জান, এবং জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলনের এক অভিনব বিষয় তৈরি হয়।
এর পরে আরো অনেক কিছু নিয়ে লেখার ইচ্ছা আছে। আপনাদের যদি আমার লেখা ভালো লাগে তাহলে শেয়ার করতে পারেন। আর কমেন্টে আপনাদের অভিমত জানাতে পারেন।