26/01/2023
দেবী সরস্বতীর আবির্ভাব —
এক সময় শ্রীব্রহ্মা সৃষ্টিকার্যের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। শান্তভাবে ধ্যানস্থ আছেন। কী করবেন, কী করা উচিত, চিন্তা করছেন। এমন সময় তাঁর শরীর থেকে এক সুন্দরী দেবীমূর্তি প্রকাশিত হয়।
দেবী ব্রহ্মাকে বলে, “হে বিধাতা, আমি আপনার থেকেই প্রকাশিত হলাম। এখন দয়া করে আপনি আমার স্থান এবং আমার কী কর্ম তা নির্দেশ করুন।”
ব্রহ্মা বললেন, “তোমার নাম সরস্বতী। তুমি অবস্থান করো সকলের জিহ্বাতে। বিশেষভাবে সুশিক্ষিত ব্যক্তিদের জিহ্বাতে তুমি নৃত্য করো। পৃথিবীতে তুমি একটি নদীরূপে প্রকাশিত হও।"
দেবী সরস্বতী প্রশ্ন করলেন, "হে বিধাতা, আপনি বললেন, আমি সবার জিহ্বাতে অবস্থান করব, আবার বললেন, সুশিক্ষিত ব্যক্তিদের জিহ্বাতে নৃত্য করব; আবার বললেন, নদীরূপে থাকব। এর ব্যাখ্যা কী ?"
ব্রহ্মা বললেন, "সরস্বতী, তুমি যখন লোকের জিহ্বাতে অবস্থান করবে, তখন লোকের জিহ্বা থেকে বাকশক্তি হবে। তাই তোমার নাম বাক্দেবী। তুমি আমার মুখ থেকেই প্রকাশিত। তুমি পবিত্রবর্তী।
জগৎসংসারে বহু অপবিত্র মানসিকতাসম্পন্ন জীব থাকবে, অপবিত্র মানুষদের জিহ্বায় কদর্য বাক্য স্ফুরিত হবে, সেসব জিহ্বায় তুমি সুখী হতে পারবে না, সেজন্য সুশিক্ষিত ব্যক্তির জিহ্বাতে তুমি অবস্থান করে সুখী হতে পারবে।
হে সরস্বতী, তুমি সাক্ষাৎ বুদ্ধিস্বরূপিনী। তুমি বলো, কোথায় তুমি আনন্দ লাভ করবে ?"
সরস্বতী বললেন, "যেসমস্ত ব্যক্তি পরমসুন্দর পরমেশ্বর ভগবানের আরাধনা করেন, তাঁদের জিহ্বায় সর্বদা পরম প্রভুর নাম কীর্তিত হবে। আমি তাঁদের পবিত্র জিহ্বায় অধিষ্ঠান করব।
যেসমস্ত ব্যক্তি ভগবদ্বিমুখ মানসিকতা নিয়ে থাকবে, তাদের জিহ্বায় আমি নিছক ছায়ারূপে বিরাজ করব। আর আমি হিমালয়ে নদীরূপে প্রবাহিত হলে, ভগবানের শুদ্ধ ভক্ত আমার তটে বসে ভাগবত কথা কীর্তন করবে, লিপিবদ্ধ করবে। আর আমার তটে ভগবানের নামকীর্তন হলে আমি আনন্দিত হবো। আমিও স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের নাম গান করেই আনন্দিত থাকবো।"
আদিগুরু শ্রীব্রহ্মার হৃদয়ে সৃষ্টি বিষয়ক স্মৃতি প্রকাশের জন্য যে সরস্বতী দেবী ভগবানের প্রেরণায় প্রকটিতা হন, তিনি শ্রীকৃষ্ণকেই উপাস্য মনে করেন। যারা শ্রীকৃষ্ণের চরণে নিজেদের সমর্পণ করেন, কৃষ্ণের কৃপায়ই তাদের সরস্বতীদেবীর কৃপা লাভ হয়। সরস্বতী নামরূপে তাদের জিহ্বায় নৃত্য করে থাকেন।
দেবী সরস্বতী জ্ঞান, সঙ্গীত, কলা এবং বিদ্যার দেবী। বিদ্যা দুই প্রকার — পরা বিদ্যা (নশ্বর জড় বিদ্যা) এবং অপরা বিদ্যা (ভগবদ্ সম্বন্ধীয় বিদ্যা)। দুই প্রকার বিদ্যা লাভের তারতম্য হেতু সরস্বতী দেবীর আরাধনা দুই প্রকার। একটি পরাবিদ্যা লাভ করার জন্য, আরেকটি অপরা বিদ্যা লাভের জন্য। এক স্বরূপে দেবী অপরা সরস্বতী, অন্য স্বরূপে দেবী পরা সরস্বতী বা শুদ্ধা-সরস্বতী।
অপরা সরস্বতী আমাদের কৃষ্ণ ভিন্ন অন্য বিষয় অর্থাৎ মায়িক বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেন। আর শুদ্ধা-সরস্বতী কৃষ্ণভজনের অনুকূল পথ প্রদর্শনপূর্বক শরণাগত ভক্তের জিহ্বায় নৃত্য-কীর্তন করেন।
বৈদিক শাস্ত্রে সরস্বতী দেবীকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয় — ব্রাহ্মণী (জ্ঞান-বিজ্ঞানের দেবী), বাণী এবং বাচী (বাদ্যগীত এবং বচন), বর্ণেশ্বরী (বর্ণের দেবী), কবিজিহ্বাগ্রবাসিনী (যিনি কবিগণের জিহ্বায় অবস্থান করেন), এছাড়াও আরো বিভিন্ন নামে দেবীকে অভিহিত করা হয়।
দেবী সরস্বতী শ্বেতপদ্মে আসীনা, শ্বেতপুষ্পে শোভিতা, শ্বেতবস্ত্র-পরিহিতা এবং শ্বেতগন্ধে অনুলিপ্তা। অধিকন্তু তাঁহার হস্তে শ্বেত রুদ্রাক্ষের মালা; তিনি শ্বেতচন্দনে চর্চিতা, শ্বেতবীণাধারিণী, শুভ্রবর্ণা এবং শ্বেত অলঙ্কারে ভূষিতা।
মাতৃগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ , নদীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, দেবীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হে সরস্বতী, আমরা অসমৃদ্ধের ন্যায় রয়েছি, আমাদের সমৃদ্ধশালী করো।
সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে।
বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যাং দেহি নমোহস্তু তে॥
জয় জয় দেবী চরাচর সারে,
কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।
বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে,
ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে॥
জয় মা
(সংগৃহীত)