11/07/2022
‘ এক এক্কে এক দুই এক্কে দুই
নামতা পড়ে ছেলেরা সব পাঠশালার ঐ ঘরে ‘
হ্যাঁ , আজকের ডিজিটাল শিক্ষায় পারদর্শী ছোটরা শুনলে সত্যিই অবাক হবে , আমার শৈশবের বিদ্যাভ্যাস শুরু হয় এই পাঠশালা থেকেই। কিন্তু আমি এখন তোমাদের সোশাল মিডিয়া ও ডিজিটাল ভারতবর্ষের সাথে অভ্যস্থ । আমার নাম হিমাংশু ভূষণ ভট্টাচার্য । আমার বয়স এখন বিরাশি বছর । আমার বর্তমান নিবাস উত্তরপাড়ায় এবং এই বাড়িরই পশ্চিমার ঘরে এক দাইমার হাতে আমার জন্ম । আমি স্বর্গীয় ফণীভূষণ ভট্টাচার্য ও স্বর্গীয়া রমলা ভট্টাচার্যের প্রথম সন্তান । মায়ের কাছেই আমার প্রথম শিক্ষা ও বিদ্যা লাভ হলেও ঠাকুরদার শাসন ও ঠাকুমার অকৃত্রিম স্নেহ আমার শিশুবেলার কিশলয়কে সবুজ করে রেখেছিল । পাঁচ বছর বয়সে ঠাকুরদা স্বর্গীয় শশিভূষণ ভট্টাচার্যের হাত ধরে গিয়ে ভর্তি হই আমাদেরই পাড়ার কাছের হরিসভার খোকা মাস্টারের পাঠশালায় । একে আপনারা আজকের পরিভাষায় K.G class বলতে পারেন । এখন না আছে সেই পাঠশালা , না আছে সেই হরিসভার পুরনো পরিবেশ । বাড়ি থেকে স্লেট খড়ি নিয়ে গিয়ে সেখানকার দালানে আমরা সার বেঁধে বসতাম । একজনই মাস্টারমশাই, খোকা মাস্টার আমাদের বাংলা ও অঙ্ক শেখাতেন । ঘরের বাইরে বালতিতে জল রাখা থাকত । স্লেটে একটি বিসয় লেখা হলে , মাস্টারমশাই তা দেখে দিতেন । বাইরের সেই বালতির জলে ন্যাতা ভিজিয়ে সেই লেখা মুছে আবার নতুন বিষয় লিখতাম । এই দৃশ্য আপনারা হয়তো পুরনো বাংলা সিনেমায় দেখে থাকবেন , কিন্তু এ আমার বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা । এখানে দুই বছর পড়ে এক বছরের জন্য ভর্তি হলাম বাড়ি থেকে একটু দূরে কেষ্ট মাস্টারের পাঠশালায় । প্রথম দিন নিয়ে গেলেন সেই ঠাকুরদাদা । তারপর থেকে অবশ্য একাই হেটে যাতায়াত করেছি । এই পাঠশালাটি ছিল আর একটু উন্নত ,তবে এরও এখন আর কোন অস্তিত্ব নেই । এখানে দু’বছর পড়েছিলাম । এখানেই প্রথম কাগজ পেন্সিলে লিখতে শিখি । এখানে বিভিন্ন বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদা শিক্ষক নিযুক্ত ছিলেন । বাংলা , অঙ্ক ইংরাজির প্রাথমিক শিক্ষালাভ আমার এখান থেকেই । এবং এখানে যে যথেষ্ট ভাল লেখাপড়া হতো তার প্রমাণ পাওয়া যায় আমার পরবর্তী জীবনে । কারণ এরপর উত্তরপাড়া এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের সে সময়ের ছেলেদের সবথেকে কাঙ্ক্ষিত বিদ্যালয় Uttarpara Gvernment High School –এ আমি তৃতীয় শ্রেণিতে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বলা ভাল পঞ্চম স্থান অধিকার করে ভর্তি হই । এই প্রবেশিকা পরীক্ষাটির গুরুত্ব ও মান সম্বন্ধে কিছু বলতে চাই কারণ সেখানে এখন ভাগ্য পরীক্ষার মাধ্যমে ছাত্র ভর্তি করা হয় । তখন তৃতীয় শ্রেণিতে এই স্কুলে ভর্তির জন্য একশ জন পরীক্ষা দিতে পারতো নাম উঠত মাত্র পঁয়ত্রিশ জনের তার মধ্যে মাত্র ত্রিশ জনকে ভর্তি নেওয়া হত । নির্ণয়ের মাপকাঠি ছিল শুধুমাত্র মেধা । আমি যখন তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হতে যাই তখন আমার পিসতুতো দাদা দেবদাস চক্রবর্তী এই বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির কৃতী ছাত্র ছিল এবং পরে সে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় র্যাঙ্ক করেছিল , সেই মেজদাই আমায় পরীক্ষা দেওয়াতে নিয়ে গেলেও তার জন্য আমি কোন অতিরিক্ত সুবিধা পাইনি । এই স্কুলটি তখন তৃতীয় শ্রেনি থেকেই শুরু হতো । তাই এই প্রবেশিকা পরীক্ষায় অঙ্ক ইংরাজি ও বাংলা ভাষার লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হতো । সেই পরীক্ষায় এমন ভাবে প্রশ্ন করা হতো যাতে শুধুমাত্র প্রাথমিক জ্ঞানের সঠিক মূল্যায়ন হয় । মনে আছে লেখা পরীক্ষায় বাংলায় একটি শ্রুতিলিখন লিখতে দেওয়া হয়েছিল । সেখানে আমি একটি মাত্র বানান ভুল করেছিলাম । বাংলার পণ্ডিত হরকান্তবাবু আমাকে মৌখিক পরীক্ষার সময় সেই ভুলটির কথা বলে তা সংশোধন করে দিয়েছিলেন । মৌখিক পরীক্ষাতেও কিছু বানান জিজ্ঞাসা করেছিলেন , যার সবটাই আমি সঠিক বলতে পেরেছিলাম , পরীক্ষা ব্যবস্থাটি এতোটাই স্বচ্ছ ছিল সেই সময় । অঙ্কে কিছু সাধারণ যোগ বিয়োগ করতে দেওয়া হয়েছিল । বাংলার পাশাপাশি ইংরাজি ভাষাকেও সমান গুরুত্ব দেওয়া হতো এই বিদ্যালয়ে । তাই আমরা ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে না পড়েও ইংরাজি বানান ও ব্যাকরণ খুব ভাল ভাবে শিখেছিলাম । প্রবেশিকা মৌখিক পরীক্ষায় হেড মাস্টারমশাই বীরেন বাবু ইংরেজিতে সাধারন কিছু প্রশ্ন করেছিলেন । ইংরাজিতেই তার উত্তর দিতে হয়েছিল । পরের দিন ফল প্রকাশিত হল , আমি পঞ্চম হয়েছি । জীবনের প্রথম সাফল্য । এই সাফল্যের আনন্দটা থেকেও আজকের এই স্কুলের ছাত্ররা বঞ্চিত হয় । এরপর নিয়মিত স্কুল চলতে লাগল । স্কুলে অনুশাসন ছিল খুব কড়া । নিয়মিত লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা হতো । স্কুলের পরে হতো ফুটবল ও হকি খেলা । বিশাল মাঠ ছিল আমাদের স্কুলে । পিছনের ছোট মাঠে ছিল বাস্কেট বল কোর্ট । তবে বাস্কেট বল খেলা কমই হত । এই মাঠটি প্রচুর বিদ্যার ভারে আজ স্কুল বাড়িতে পরিণত হয়েছে । তবে ক্রিকেট খেলার চল ছিল না । আর আমাদের কোন ইউনিফর্ম ছিল না কিন্তু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে সঠিক সময়ে স্কুলে আসতে হতো । মনে আছে জ্যোতিন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় যখন হেড মাস্টারমশাই ছিলেন তখন স্কুলে ঢোকার শেষ ঘণ্টা বাজার সময় তিনি নিজে স্কুল গেটে এসে দাঁড়াতেন এবং যে ছাত্র দেরি করে আসতো তাকে তাঁর কাছে কৈফিয়ত দিতে হতো , তারপরে স্কুল গেট বন্ধ হয়ে যেত । এতটাই কড়া অনুশাসন ছিল তাঁর । তিনি খুব দায়িত্ব নিয়ে স্কুলের প্রতিটি ছেলের পরিচয় জানতেন এবং মনে রাখতেন। তাঁর আমলে এই স্কুল থেকে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় ছাত্ররা দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিল । এই অনুশাসনের বিষয়ে উল্লেখ্য স্কুলের পরে স্কুলের মাঠে যে খেলা হতো সেখানে বাইরের ছেলেদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল । এই দ্বার রক্ষা ও হকিস্টিক বিতরণের দায়িত্বে ছিল গয়া মালি । আমরা তার শাসনকে যথেষ্ট ভয় পেতাম , মান্যতাও দিতাম । এই গয়া মালির দায়িত্ব ছিল স্কুলে আমাদের টিফিন তৈরি করা ও বিতরণ করাও । সিঙ্গারা , লাড্ডু কচুরী, এক একদিন এক একটা টিফিন বানানো হতো । আমরা লাইন দিয়ে টিফিন নিতাম । হরকান্তবাবু ও গয়ামালির অভিজ্ঞ তত্ত্বাবধানে দুষ্টুমি করার সুযোগ ছিল না । ছাত্রদের অনুপস্থিতির কারণে যে টিফিন অতিরিক্ত হতো তা এক একদিন এক একটা জুনিয়র ক্লাসের ছেলেদের মধ্যে বিতরণ করা হতো । এতো সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা আজকের দিনে বিরল । ক্লাসে কোন পড়া ভুল করলে শিক্ষকরা ছুটির পরে শিক্ষকদের ঘরে দেখা করতে বলতেন এবং সামান্য বেতনের মাস্টারমশাইরা স্বেচ্ছায় সাগ্রহে অতিরিক্ত সময় স্কুলে থেকে সেই পড়া আমাদের বুঝিয়ে দিতেন । তাই বোধহয় আজকের দিনে আমাদের আদর্শগুলো এতোটাই back dated । তামসরঞ্জন বাবু যখন আমাদের হেড মাস্টারমশাই হয়ে আসেন তখন একটি সুন্দর নিয়ম শুরু করেন- উচু ক্লাসের ছাত্রদের একটি বোর্ডে দৈনিক খবরগুলি দিনের শুরুতে লিখে রাখতে হতো । এতে ছাত্রদের সমাজ সচেতনতা বৃদ্ধি পেত। মনে আছে, এই বিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে রাজ্যপাল এসেছিলেন । আমাদের কতো অবুঝ উন্মাদনা তখন। কিন্তু বিদ্যান গম্ভীর শিক্ষকদের আমরা খুবই ভয় পেতাম , শ্রদ্ধাও করতাম সমান ভাবে । তাদের ব্যক্তিত্বই ছিল শ্রদ্ধা করার মতো ।তাই উন্মাদনা কোনদিন শৃঙ্খলাকে ভঙ্গ করেনি ।
স্কুলের সরস্বতী পুজোর প্রধান দায়িত্ব থাকতো দশম শ্রেণির ছাত্রদের ওপর । পুজোর আগের দিন সন্ধ্যায় নির্দিষ্ট কুমোর বাড়ি থেকে ঠাকুর আসত । দশম শ্রেণির ছাত্ররা এবং শক্ষকরা ওই রাতটি স্কুলে থেকে ঘর সাজাতেন । হেড মাস্টারমশাই নিজের খরচে ওই রাতে সব ছাত্রের খাবার ব্যবস্থা করতেন । কী দায় ছিল বলুন তো ওনার ? শুধুমাত্র ভালবাসা ।
স্কুলে প্রতি বছর বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হতো । প্রতি বছর অংশ নিতাম । মনে আছে এক বছর কমলালেবু দৌড় প্রতিযোগিতায় একটা কাপ পুরস্কার পেয়েছিলাম । এখনও যত্ন করে রেখে দিয়েছি । যত্ন করে মনে রেখেছি স্কুলের দিনগুলো । তবু অনেক কিছুই ঝাপসা হয়ে আসে । কিছু বন্ধু এখনও আছে , তাদের সাথে যোগাযোগও আছে । বিদ্যালয়ের প্রতি বছরের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যাই । তাদের সাথে দেখা হয় । দেখি অতীত , দেখি বর্তমান । তারপর আমার মেজ ভাই ভাইপো এবং আরও অনেক স্বজন এই স্কুলে পড়েছে । দিন বদলেছে , স্কুল বদলেছে । তবু এই বিদ্যালয়টি আমাদের উত্তরপাড়ার ঐতিহ্য । এই বিষয়ে বলা ভাল আমার ঠাকুরদাদা প্রথম জীবনে উত্তরপাড়ার জমিদার শ্রী জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের জমিদার বাড়ির গৃহশিক্ষক ছিলেন । তারপর তিনি এই স্কুলের পণ্ডিত হন । তখন এটি সরকারি স্কুল ছিল না । ছিল জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত একটি স্কুল । পরে এটি যখন উত্তরপাড়া রাষ্ট্রীয় উচ্চবিদ্যালয়য় হয় তখন ঠাকুরদা একটি অন্য সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়ে দিয়েছেন । ফলে স্কুলটির সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক আছে । তাবলে , দাদুর নাতি বলে কখনো আলাদা আদর পাইনি স্কুলে আর সেটাই হওয়া উচিৎ ।
এখন সমাবর্তনে গিয়ে বুঝতে পারি বিদ্যালয়ের অনেক কিছুই বদলেছে। যুগের দাবীতে বদলানোটাই কাঙ্ক্ষিত । কিন্তু আশা করবো , যে বদলই হোক না কেন তা যেন স্কুল ও ছাত্রদের মঙ্গলের জন্য হয় এবং তা যেন উত্তরপাড়ার ঐতিহ্যকে রক্ষা করে ।
Written by – মধুরিমা ভট্টাচার্য