08/03/2025
🌹মসজিদের আদব ও শিষ্টাচার 🌹
✍️ আসমাতুল্লাহ আবু তাহের আলবানী
ছাত্র জামিয়াতুল ইমাম আলবানী ।
মসজিদ ইবাদতের স্থান ,ইবাদতের জায়গা। তাই
সেই জায়গায় যাওয়ার জন্য কিছু আদব-কায়দা রয়েছে। দুনিয়ার অধিকাংশ কর্মক্ষেত্র সিস্টেম ও শিষ্টাচারের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়। যেমন, কোন অফিসে গেলে সেই অফিসের নিয়ম-কানুন মেনে প্রবেশ করতে হয়। ঠিক সেই রকমই আমরা যখন মসজিদে প্রবেশ করব তখন আমাদের কেউ কিছু নিয়ম-কানুন মেনে শান্ত শৃঙ্খলা বজায় রেখে মসজিদে প্রবেশ করতে হবে। মসজিদের আদব, শিষ্টাচার অনেক রয়েছে। যা সাধারণ মুসল্লি থেকে নিয়ে অনেক শিক্ষিত মুসল্লিও ভুল করে থাকে। যার দিকে সাধারণত কোন ভ্রুক্ষেপ দেওয়া হয় না। এই প্রবন্ধে আমি প্রচলিত ভুলগুলি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
রমজান মাস এলেই মসজিদে মুসল্লিদের ভিড় জমে। প্রত্যেক ওয়াক্তে হৈ-চৈ, শোর-গোল, ও চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যায়। যার ফলে ইবাদতকারীর ইবাদতে, মনোযোগে বাধা সৃষ্টি হয়। মসজিদের আদব-শৃঙ্খলা বজায় রাখেনা ও মানে না। জেনে শুনে হোক অথবা অজান্তে হোক আদব শিষ্টাচারকে উপেক্ষা করে চলে। মসজিদে আসার অনেক নিয়ম রয়েছে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর মসজিদে উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত অনেক সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে উপস্থিত হতে হয়। মসজিদে উপস্থিত হওয়ার পরে আমাদের কিছু করণীয় রয়েছে। কিছু নিয়ম-কানুনকে ,আদব-কায়দাকে মেনে চলা একান্ত প্রয়োজন। যেমন,
🌹 তাহিইয়াতুল মসজিদ ছালাত আদায় করা :
মসজিদে প্রবেশ করে বসার পূর্বে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করা সুন্নাত, যাকে তাহিইয়াতুল মসজিদ বলে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِذَا دَخَلَ أَحَدُكُمُ الْمَسْجِدَ فَلاَ يَجْلِسْ حَتَّى يُصَلِّيَ رَكْعَتَيْنِ. وفي رواية فَلْيَرْكَعْ رَكْعَتَيْنِ قَبْلَ أَنْ يَجْلِسَ. ‘তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করলে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করার পূর্বে বসবে না। অন্য বর্ণনায় রয়েছে ‘সে যেন বসার পূর্বে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করে নেয়(সহীহুল বুখারী হা,1167, সহীহ মুসলিম, হা,714)
অনেক মুসল্লিকে দেখা যায় মসজিদে গিয়ে এমনি বসে যায় বা দুই তিন মিনিট সময় থাকলে দাঁড়িয়ে গল্প করতে শুরু করে। মসজিদে প্রবেশ করে সর্বপ্রথম আমাদের করণীয় হল দুই রাকাত সালাত আদায় করা যাকে বলা হয় তাহিয়াতুল মসজিদ।
🌹মুছল্লীর সম্মুখ দিয়ে অতিক্রম না করা :
নবী করীম (ছাঃ) বলেন,لَوْ يَعْلَمُ الْمَارُّ بَيْنَ يَدَيْ الْمُصَلِّي مَاذَا عَلَيْهِ لَكَانَ أَنْ يَقِفَ أَرْبَعِيْنَ خَيْرًا لَهُ مِنْ أَنْ يَمُرَّ بَيْنَ يَدَيْهِ قَالَ أَبُو النَّضْرِ لَا أَدْرِي أَقَالَ أَرْبَعِيْنَ يَوْمًا أَوْ شَهْرًا أَوْ سَنَةً ‘যদি মুছল্লীর সম্মুখ দিয়ে গমনকারী ব্যক্তির জানা থাকত যে, তার উপর কি পাপের বোঝা চেপেছে, তবে চল্লিশ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকাকেও সে প্রাধান্য দিত। আবু নাছর বলেন, আমি জানি না তিনি চল্লিশ দিন, মাস নাকি বছর বলেছেন’।(701) الألباني، صحيح أبي داود صحيح • أخرجه البخاري و مسلم
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِذَا صَلَّى أَحَدُكُمْ فَلْيُصَلِّ إِلَى سُتْرَةٍ وَلْيَدْنُ مِنْهَا وَلاَ يَدَعْ أَحَدًا يَمُرُّ بَيْنَ يَدَيْهِ فَإِنْ جَاءَ أَحَدٌ يَمُرَّ فَلْيُقَاتِلْهُ فَإِنَّهُ شَيْطَانٌ ‘তোমাদের কেউ ছালাত আদায় করতে চাইলে যেন সুৎরা সামনে রেখে ছালাত আদায় করে এবং এর নিকটবর্তী হয়। সে যেন তার সামনে দিয়ে কাউকে অতিক্রম করতে না দেয়। অতএব যদি কেউ সামনে দিয়ে অতিক্রম করে, তাহ’লে সে যেন তার সাথে লড়াই করে। কারণ সে একটা শয়তান’(আবু দাউদ হা/৬৯৪-৯৫; ইবনু মাজাহ হা/৯৫৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৪১, ৬৫৩, সনদ ছহীহ।)
🌹মসজিদে কণ্ঠস্বর উচ্চ না করা বা শোর-গোল না করা :
মসজিদ ইবাদতের স্থান। সেখানে উচ্চকণ্ঠে কথা বলা ঠিক নয়, যাতে অন্যের ইবাদতে বিঘ্ন ঘটে। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
اعْتَكَفَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فِى الْمَسْجِدِ فَسَمِعَهُمْ يَجْهَرُوْنَ بِالْقِرَاءَةِ فَكَشَفَ السِّتْرَ وَقَالَ أَلاَ إِنَّ كُلَّكُمْ مُنَاجٍ رَبَّهُ فَلاَ يُؤْذِيَنَّ بَعْضُكُمْ بَعْضًا وَلاَ يَرْفَعْ بَعْضُكُمْ عَلَى بَعْضٍ فِى الْقِرَاءَةِ. أَوْ قَالَ فِى الصَّلاَةِ.
‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মসজিদে ই‘তিকাফকালে ছাহাবীদেরকে উচ্চৈঃস্বরে ক্বিরাআত পড়তে শুনে পর্দা সরিয়ে বললেন, জেনে রেখ! তোমাদের প্রত্যেকেই স্বীয় রবের সাথে গোপনে মুনাজাতে রত আছো। কাজেই তোমরা পরস্পরকে কষ্ট দিও না এবং পরস্পরের সামনে ক্বিরাআতে অথবা ছালাতে আওয়ায উঁচু করো না’।(ইবনে আব্দুল বার আত-তামহীদ এর মধ্যে হাদীসটি দিয়েছে এবং সহীহ বলেছেন, সুনানে আবু দাউদ,মুসনাদে আহমদ, এবং শায়খ আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীসটি সহি বলেছেন)
অন্য জায়গায় বলা হয়েছে:
خَرَجَ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى النَّاسِ وَهُمْ يُصَلُّونَ وَقَدْ عَلَتْ أَصْوَاتُهُمْ بِالْقِرَاءَةِ فَقَالَ إِنَّ الْمُصَلِّيَ يُنَاجِي رَبَّهُ فَلْيَنْظُرْ بِمَا يُنَاجِيهِ بِهِ وَلَا يَجْهَرْ بَعْضُكُمْ عَلَى بَعْضٍ بِالْقُرْآنِ-
‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদল লোকের নিকট আগমন করলেন, সে সময় তারা ছালাত আদায় করছিল এবং উচ্চকন্ঠে কুরআন তেলাওয়াত করছিল। তা দেখে তিনি বললেন, ছালাত আদায়কারী ছালাতরত অবস্থায় তার প্রতিপালকের সাথে মুনাজাত করে। তাই তার উচিত সে কিরূপে মুনাজাত করে তার প্রতি লক্ষ্য রাখা। অতএব একজনের কুরআন তেলাওয়াতের শব্দ অন্যজনের কানে যেন না পৌঁছে’( الشيخ امام الباني اصل صفة الصلاة صحيح" ابن عبد البر في التمهيد ،امام مالك، امام احمد، امام نسائ سنن في الكبرى،عبد الحق ألإشبيلى في الأحكام الوسطى،إبن حجر العسقلاني نتائج الفكار
অনুরূপভাবে অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা, গল্প-গুজব, হৈচৈ থেকে বিরত থাকা যরূরী। সায়িব ইবনু ইয়াযীদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كنت قائما في المسجد فحسبني رجل فنظرت فإذا عمر بن الخطاب فقال إذهب فأتني بهذين فجئته بهما فقال من أنتما أو من أين أنتما قلا من أهل الطائف،قال: لو كنتما من أهل البلد لأوجعتكما ترفعان أصواتكما في مسجد رسول الله صلى الله عليه وسلم
অর্থ :আমি মসজিদে নববীতে দাঁড়িয়েছিলাম। এমন সময় একজন লোক আমার দিকে একটা কাঁকর নিক্ষেপ করল। আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে, তিনি ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)। তিনি বললেন, যাও, এ দু’জনকে আমার নিকট নিয়ে এসো। আমি তাদেরকে নিয়ে তাঁর নিকটে আসলাম। তিনি বললেন, তোমরা কারা? অথবা তিনি বললেন, তোমরা কোথাকার লোক? তারা বলল, আমরা তায়েফের অধিবাসী। তিনি বললেন, তোমরা যদি মদীনার লোক হ’তে, তাহ’লে আমি অবশ্যই তোমাদের কঠোর শাস্তি দিতাম। কারণ তোমরা দু’জনে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর মসজিদে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলছ।(ইমাম বুখারী সহীহ বুখারীর মধ্যে হাদীসটিকে মসজিদে আওয়াজ উঁচু করা বাবের মধ্যে নিয়ে এসেছেন)
🌹 কারো ঘাড় ডিঙিয়ে সামনে না যাওয়া :
আবু যাহিরিয়্যাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كُنَّا مَعَ عَبْدِ اللهِ بْنِ بُسْرٍ صَاحِبِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم يَوْمَ الْجُمُعَةِ فَجَاءَ رَجُلٌ يَتَخَطَّى رِقَابَ النَّاسِ فَقَالَ عَبْدُ اللهِ بْنُ بُسْرٍ جَاءَ رَجُلٌ يَتَخَطَّى رِقَابَ النَّاسِ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَالنَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم يَخْطُبُ فَقَالَ لَهُ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم اجْلِسْ فَقَدْ آذَيْتَ. وفي رواية: اجْلِسْ فَقَدْ آذَيْتَ وَآنَيْتَ-
‘একদা জুম‘আর দিন এক ব্যক্তি লোকদের ঘাড় ডিঙ্গিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছিল। নবী করীম (ছাঃ) তখন খুৎবা দিচ্ছিলেন। নবী করীম (ছাঃ) বললেন, তুমি বস, তুমি অন্যকে কষ্ট দিচ্ছ’।অন্য বর্ণনায় রয়েছে, অনর্থক কাজ করছ’।অর্থাৎ তুমি বিলম্বিত করেছ ও শেষে এসেছ।(সুনানে আবু দাউদ, নাসাঈ, মুসনাদে আহমেদ, শায়খ আলবানী সহী বলেছেন)
🌹উপসংহার :
পরিশেষে বলব, আমরা যেন উক্ত নিয়ম-কানুন, আদব কায়দা ও শিষ্টাচার গুলিকে মেনে চলতে পারি, এবং এক নিষ্ঠার সাথে, একাগ্রতা চিত্তে ইবাদত করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি। এবং এর মাধ্যমে ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি হাসিল করে জান্নাতে যেতে পারে। আল্লাহ আমাদের সকলকে উক্ত কাজগুলো পালন করার তাওফীক দান করুন-আমীন!