28/01/2025
|| শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র ও কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর কথোপকথন ||
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের সান্নিধ্যে এসে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র সমন্ধে
স্বনামধন্য কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকুলচন্দ্রের সান্নিধ্যে আসেন ১৩৩২ সালে। শ্রীশ্রীঠাকুর প্রতিষ্ঠিত তপোবন বিদ্যালয়ের বিশেষ অনুষ্ঠান উপলক্ষে।
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র সম্পর্কে শরৎচন্দ্রের অনেক কৌতুহল ছিল। শ্রীশ্রীঠাকুর দর্শন করে অনেকগুলি প্রশ্ন করেছিলেন তিনি।
শ্রীশ্রীঠাকুর বিয়োগান্তক সাহিত্য পছন্দ করেন না। শরৎচন্দ্রের অধিকাংশ রচনাই বিয়োগান্তক। তাঁর লেখায় শুধু সমাজের সমস্যার কথাই তুলে ধরেছেন, সমাধান দেননি।
সাহিত্য নিয়ে এইসব প্রসঙ্গ ওঠায়
শরৎচন্দ্র_বললেন: ---❝ঠাকুর কতলোক যে আত্ম-স্বীকৃতি জানিয়ে আমাকে কত পত্র দিয়েছে তার সীমা নেই। তাঁদের কথাই আমি লিখেছি আমার উপন্যাসে❞.....।।
শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন: --- ❝আমার কাছেও কত লোক যে Confession করেছে এবং তা যে কী বীভৎস তা কাউকে জানাবার উপায় নেই কারণ, তারা বলেছে একথা যেন গোপন থাকে।❞
..❝সমাজ পচে গিয়েছে সত্য কিন্তু তাই বলে অমরা যদি দুঃখের চিত্র, হতাশার ছবি, বিকৃত মনস্তত্ত্বের অভিব্যক্তি লোকের সামনে তুলে ধরি তবে কারও কোন উপকারই আমরা করতে পারিনা। সাহিত্যিকের দায়িত্ব গঠনমূলক চিত্র তুলে ধরা, যার ফলে তারা হতাশার মধ্যে আশা ও দুঃখের মধ্যেও পায় শান্তির ঈঙ্গিত। বাস্তববাদের সঙ্গে যদি আদর্শবাদের সমন্বয় না থাকে তবে কোন সুফলই হবেনা। আদর্শ চরিত্র রূপায়ন করলে তা থেকে মানুষ পাবে উদ্দীপনা - বাস্তব অসুবিধা এবং ভাগ্য বিপর্যয়কে প্রতিহত করে দাঁড়াতে চেষ্টা করবে। সাহিত্যিক যদি পাঠকের মনে ভরসার সৃষ্টি করতে না পারে, কল্যাণের ঈঙ্গিত দিতে না পারে তবে সে সাহিত্যের মূল্য কতটুকু?❞
ঠাকুরের প্রেমল কন্ঠের প্রজ্ঞাদীপ্ত কথাগুলি অবাক বিষ্ময়ে শুনছিলেন শরৎচন্দ্র। তাঁর এতদিনের লালিত চিন্তার স্রোত যেন থমকে দাঁড়াল।
কাতরকন্ঠে শরৎচন্দ্র বললেন ---
❝এমন করে কখনও তো ভাবিনি ঠাকুর, -এতদিন ভাবনার ধারাটাই ছিল উল্টো রকমের। সমস্যাটা তুলে ধরেছি,ভেবেছি সমাজ সংস্কারক করবে তার
সমাধান। এখন কি আর শেষ সময়ে অন্য ভাবের রচনা সৃষ্টি করতে পারব?❞
ব্যথাহীন কন্ঠে কথাগুলো বলে ঠাকুরের জ্যোতির্ময় মুখের দিকে তাকালেন শরৎচন্দ্র।
শ্রীশ্রীঠাকুর ভরসাদীপ্ত কন্ঠে বললেন:--- অবশ্যই পারবেন। এখনই লেগে পড়েন।
অনুশোচনার সুরে... শরৎচন্দ্র খুব আফসোস করে বললেন—❝ঠাকুর আমার জীবনের প্রথম উপন্যাস
লেখার আগে কেন আপনার কাছে এলাম না❞
এরপর শরৎচন্দ্র খানিক মৌনতা অবলম্বন করে বসে রইলেন। তাঁর মন তখন আরো হাজারো প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার অস্থির হয়ে উঠে। এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রশ্ন করে যান ঠাকুরকে।
শ্রীশ্রীঠাকুরও তাঁহার সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়াছিলেন। সেই প্রশ্নোত্তর-প্রসঙ্গটি সংক্ষেপে নিম্নে আলোচনা করা হলো—
শরৎচন্দ্র—❝ঈশ্বরের অস্তিত্বে আপনি বিশ্বাস করেন? আমার তো কিছুই বিশ্বাস হয় না। আমি একেবারে নাস্তিক।❞
শ্রীশ্রীঠাকুর— ❝আমি তো আছি, আমার অস্তিত্ব তো দেখতে পাচ্ছি।❞
শরৎচন্দ্র—❝আচ্ছা, পাবনায় আপনার এত নিন্দা কেন? নিন্দুকের উপর আপনার রাগ হয় না❞?
শ্রীশ্রীঠাকুর—❝না। আমি মনে করি, প্রত্যেকে নিজের হিসাব মত দেখে। আমি দেখেছি, একজন হয়তো গাই দুয়াতে যেয়ে, দুধ একটু কম হল বলে, গরুটাকে মারলে, বললে---হারামজাদী আজ দুধ কম দিলি। সে ভেবে দেখল না, কি জন্য গরুর দুধ কম হল। ভাল গয়লা যে, সে বিবেচনা করে দেখে যে, হয় গরুর খাওয়া কম হয়েছে, নয় তার ব্যারাম পীড়া কিছু হয়েছে।❞
শরৎচন্দ্র— 'সকল বিষয়েরই কি solution হয়' ?
শ্রীশ্রীঠাকুর—❝সকল বিষয়েরই solution হয়, কেবল supreme cause-এর solution হয় না❞।
শরৎচন্দ্র— 'মানুষের প্রবৃওি খারাপ দিকেই যায় কেন' ?
শ্রীশ্রীঠাকুর—❝যে কাজে আপাতত সুখ আছে, মানুষ তাতেই আসক্ত হয়, কিন্তু তার পরে যে দুঃখ আসে তখন তা মনে করে না। যেমন একজন মদ খেল, খেয়ে নেশা হলো, স্ফুর্তি হলো, কিন্তু পরক্ষণেই কতরকম অবসাদ অশান্তি আসে।❞
শরৎচন্দ্র: --- 'পাপ পূণ্য কি' ?
শ্রীশ্রীঠাকুর—❝যে কাজে মনের প্রসারণ নিয়ে আসে, আনন্দ নিয়ে আসে, তাই পুন্য। আর এর বিরোধী যা, অর্থাৎ যে কাজে মনের সঙ্কোচ নিয়ে আসে, বিষাদ নিয়ে আসে, মৃত্যু নিয়ে আসে তাই পাপ।❞
শরৎচন্দ্র: --- 'ভগবান কি দেখা যায়?'
শ্রীশ্রীঠাকুর—'হ্যাঁ'।
শরৎচন্দ্র— ❝ভগবানের উপর আমাদের ভালবাসা হয় না কেন ?❞
শ্রীশ্রীঠাকুর --- ❝তাঁতে আমরা আসক্ত নই, অন্য বিষয়ে আসক্ত আছি, এই বুঝতে হবে। তাঁতে যখন আসক্ত হব, তখন অন্য দিকের আসক্তি কমে যাবে।❞
শরৎচন্দ্র: --- 'তাঁর প্রতি ভালবাসা কি করে হবে ?'
শ্রীশ্রীঠাকুর—❝আমার মনে হয়, ভালবাসলেই ভালবাসা হয়, আমরা যাতে আসক্ত হই, তারই বিষয়ে আমাদের জ্ঞান হয়। আপনি যখন আইনে আসক্ত হলেন, আইন পড়তে লাগলেন, তখন আইনের বিষয়ে জ্ঞান আসতে আরম্ভ হলো। ছেলেবেলায় যখন লেখাপড়ায় আসক্ত হলেন, পড়তে আরম্ভ করলেন, পন্ডিত হলেন। সেইরূপ ভগবানের উপর আসক্তি হলেও, তাঁর চর্চ্চায় তাঁর ধ্যানাদিতে তাঁর জ্ঞান চলে আসে।❞
শরৎচন্দ্র: --- 'আমরা পাপ করলেই ভগবান শাস্তি দেন না কেন ?'
শ্রীশ্রীঠাকুর—❝ভগবান এত দয়ালু যে আমাদের ভাল কাজেও রাজী থাকেন, মন্দ কাজেও রাজী থাকেন। মন্দ কাজ করবার সময়ও বারণ করেন না, ডাকাতি করতে যাচ্ছে, তাকেও বারণ করেন না, ভগবান এত দয়ালু। একজন খুন করে ফাঁসিতে যাবার সময় ডাবের জল খেয়ে বলেছিল---কৈ, খুন করেছি বলে তো ডাবের জল আমার কাছে তিতা লাগে না! ভগবান যদি রুষ্ট হতেন, তবে ডাবের জল আমার কাছে তিতা হয়ে যেত, তিনি তো আমায় ক্ষমা করেছেন---মানুষ আমাকে ক্ষমা করতে পারল না।❞
তবে পাপের শাস্তি কি রকম পায়?
---ঠেকে শেখার মত। যেমন বাবা গরম জল করে রেখেছে, আবার ঠান্ডা জলও রেখেছে; ছেলে না জেনে গরম জলে হাত দিলে হাত পুড়ে গেল, কিন্তু যদি ঠান্ডা জলে হাত দেয়, তবে শান্তি পায়। রসগোল্লা খেলেন ত ভাল লাগলো। যদি দু'একটা খেয়ে থেমে যান, তবে উপকারই হয়, কিন্তু মিষ্টতার লোভে খেতেই আরম্ভ করলেন, শেষে পেটের অসুখ হয়।।
সূত্র: জীবন চরিত"(তৃতীয় খন্ড)---শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র।
#তাঁরঅমিয়বাণী #শ্রীশ্রীঠাকুর