17/05/2024
নবি তিনি কখন থেকে
(সব প্রশ্নের জবাব এই পোস্টে)
আল্লাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হচ্ছে আত্মার তৃতীয় সম্মিলন। এর আগে মানব সম্প্রদায় ইস্যুতে আল্লাহপাক আরও দুটি সভা করেছিলেন। প্রথমটি ছিল মানুষ সৃষ্টির আগে, ফেরেশতাদের নিয়ে। আল্লাহ তাঁর ফেরেশতাদের ডেকে বলেছিলেন, 'ইন্নি জায়িলুন ফিল আরদ্বি খালিফাহ', আমি জমিনে আমার প্রতিনিধি সৃষ্টি করতে চাই। দ্বিতীয়টি ছিল সকল মানুষের আত্মার সম্মিলন। আল্লাহ বলেছিলেন, 'আলাসতু বিরাব্বিকুম', আমি কি তোমাদের প্রভু নই? সবাই বলেছিলাম, অবশ্যই আপনি আমাদের প্রতিপালক। তৃতীয়টি ছিল শুধুই নবি-রাসুলদের নিয়ে।
তৃতীয় সভাটি ছিল একটু স্পেশাল। সাধারণ জনগণের প্রবেশাধিকার ছিল না। ডেলিগেটরা সবাই ছিলেন ভিভিআইপি ক্যাটাগরির। আদম থেকে ঈসা, সোয়ালক্ষ আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস সালাম ছিলেন অডিয়েন্স। আলোচ্য বিষয় ছিল শানে মুহাম্মাদ। আর সভাটি পরিচালিত হয়েছিল স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলার সভাপতিত্ব ও পরিচালনায়। আসছি সেখানটায়, একটু পরে।
🔍দুই🔎
একজন নবি নবি হন ওহি নাজিলের মাধ্যমে। মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নাজিলকৃত প্রথম ওহি ছিল; ‘ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক’। তখন তাঁর বয়স ছিল ৪০ বছর। কুরআনে কারিম ও আহাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অথেন্টিক সোর্স থেকে ব্যাপারটি আমরা নিশ্চিত হয়েছি। এ জন্যই সিরাত-লেখকগণ নবিজির জীবনকে তিনভাগে বিভক্ত করেন।
✍️ প্রথম ভাগ : কাবলান নবুওয়াত বা নবুওয়াতের পূর্বকাল তথা জন্ম থেকে ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত।
✍️ দ্বিতীয় ভাগ : বা’দান নবুওয়াত কাবলাল হিজরত বা হিজরতের পূর্বে মক্কি জীবনের ১৩ বছর, তথা ৪০ থেকে ৫৩ বছর বয়সকাল।
✍️ তৃতীয় ভাগ : বা’দান নবুওয়াত বা’দাল হিজরত বা নবিজির মাদানি জীবন তথা দুনিয়ার জীবনের শেষ ১০ বছর। সুতরাং, এ কথা আমরা নিশ্চিতকরেই বলতে পারি, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবি হয়েছিলেন চল্লিশ বছর বয়সে।
আবার
একদিন এক সাহাবি স্বয়ং নবিকে প্রশ্নটি করে বসলেন। ওগো নবিজি! আপনি কখন থেকে নবি হলেন? নবিজি বললেন, আদম যখন তাঁর শরীর ও আত্মার মাঝামাঝি ছিলেন অর্থাৎ যখন আদমের জন্মই হয়নি, আমি তখন থেকেই নবি। তাহলে বোঝাগেল, মানবসৃষ্টির আগেই আল্লাহপাক তাঁর প্রিয় বন্ধুর মাথায় তাজে নবুওয়াত পরিয়ে রেখেছিলেন।
উপরের দুটি বক্তব্য কমপ্লিকেটেড হয়ে গেছে না? চলুন, নবিজি ৪০ বছর বয়সে নবি হয়েছিলেন- এ কথা বলায় যারা পেরেশান, কিছু সময়ের জন্য তাদের পেরেশানিটা আরেকটু বাড়িয়ে দিই।
আদম আলাইহিস সালাম হলেন আল্লাহর সৃষ্টি প্রথম মানব। নবিজিও মানুষ ছিলেন। এখন আমরা যদি বলি, আদমের আগেই নবিজি নবি ছিলেন, তাহলে কথা দাঁড়াল, প্রথম মানুষ সৃষ্টির আগেও মানুষ ছিলেন। তাহলে ‘প্রথম মানব’, এ কথার মানে কী হবে?
🔍 তিন🔎
এখন আরেকটু অ্যাডভান্স লেভেলের একটা কথা বলি। কথাটি আমরা শিখেছি হুজ্জাতুল্লাহি ফিল আরদ্ব মাওলানা মুহাম্মাদ কাসিম নানুতবি রাহিমাহুল্লাহর কাছ থেকে। সোয়ালক্ষ নবি-রাসুলের মধ্যে প্রথম নবির নাম ছিল মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ, শেষনবিও তিনিই ছিলেন। সিলসিলায়ে নবুওয়াত যার মাধ্যমে শুরু, তাঁর মাধ্যমেই শেষ। যেখানে শুরু, সেখানেই খতম। মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষনবিও, আবার তিনি প্রথম নবিও।
কীভাবে সম্ভব? মানবজাতির মধ্যে আল্লাহপাক তো হযরত আদম আলাইহিস সালামকেই সর্বপ্রথম সৃষ্টি করেছিলেন। কুরআনে কারিমের মাধ্যমে তো আমরা সেটাই জানি। তবে কি আমরা ভুল জানি? এতদিন কি তবে ভুল জেনে এসেছি?
উত্তর হচ্ছে- না। এতদিন আমরা ঠিকই জেনে এসেছি। আদম আলাইহিস সালামই আল্লাহর সৃষ্টি প্রথম মানব। পৃথিবীতে সর্বপ্রথম এ’লানে নবুওয়াত তিনিই করেছিলেন। তাঁর কালিমা ছিল, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আদম সফিউল্লাহ।
বুঝতে পারছি কথাগুলো আরও জটিল হয়েগেছে। যাকে বলে সমাধানের ভেতরে নতুন করে সমস্যা তৈরি করা। চলুন সহজ করে বুঝি। বুঝে ফেলতে পারলে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বক্তা নামের বিশেষ কিছু লোক যেভাবে ‘নবিজি চল্লিশ বছর বয়সে নবি হয়েছিলেন’- বলে ফেলার কারণে অন্য আলেমদের নামে কুফরির ফতওয়া ফেরি করে বেড়াচ্ছেন, তারা আর বিভ্রান্তি ছড়াতে পারবেন না। আর, ‘নবিজি কখন থেকে নবি ছিলেন’- এটা নিয়ে সাধারণ মুসলমানকেও আর কনফিউশনে ভুগতে হবে না।
🔍চার🔎
আত্মার তৃতীয় সম্মিলনের কথা বলছিলাম। আদম থেকে ঈসা, সোয়ালক্ষ নবি-রাসুলের রূহসমূহকে একত্রিত করে আল্লাহপাক বললেন, আমি তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমাহ দান করব, তবে আমার একটা শর্ত আছে।
-আল্লাহ! কী সেই শর্ত?
-তোমাদের পরে আমার একজন রাসুল যাবেন। যিনি তোমাদের কিতাবগুলো সত্যায়িত করবেন। তোমাদেরকে কথা দিতে হবে তোমরা তাঁর প্রতি ঈমান নিয়ে আসবে। নবিগণ কথা দিলেন- তাঁরা ঈমান নিয়ে আসবেন। (তথ্যসূত্র: ওয়া-ইজ আখাজাল্লাহু মিসাকান-নাবিয়্যিন…, সুরা আলে ইমরান, আয়াত—৮১।)
নবিগণের কাছ থেকে ওয়াদা নিতে গিয়ে আল্লাহপাক বললেন, তোমাদের পরে আমি যাকে পৃথিবীতে পাঠাব, তাঁর উপর তোমাদেরকে ঈমান আনতে হবে। লাতু’মিনুন্না বিহ। মানে কী? এই একটিমাত্র বাক্য 'লাতু’মিনুন্না বিহ' দ্বারা মাওলানা নানুতবি প্রমাণ করে দিলেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই প্রথম নবি। যেহেতু তিনি প্রথম নবি, তাই তিনি যে আদম আলাইহিস সালামের আগেই নবি ছিলেন, একথা বলার আর অপেক্ষাই রাখে না।
কীভাবে প্রমাণ হলো?
কারও প্রতি ঈমান আনতে হলে যার উপর ঈমান আনা হবে, আগে তাঁর নিজের ঈমান থাকতে হবে। আল্লাহপাক সকল নবিগণকে মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহর উপর ঈমান আনতে নির্দেশ দিচ্ছেন- মানে হলো, সোয়ালক্ষ নবিগণের আগেই মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’র ঈমান ছিল। আর, নবির ঈমান মানে নূরে নবুওয়াত। কারণ, আল্লাহর উপর ঈমান আনতে হয় কোনো না কোনো নবির কালিমা পাঠ করে। সুতরাং, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ প্রথম ঈমানদার, মানে প্রথম নবি। সংগতকারণেই 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ' কালিমাওয়ালা নবি, আমাদের নবি মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়াসাল্লামই প্রথম নবি। একই সাথে শেষনবিও।
🔍পাঁচ🔎
এখন একই সাথে বেশ অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে চলে আসলো।
✍️ ১. মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ যদি আদমের আগেই নবি হয়ে থাকেন, তাহলে আদম আলাইহিস সালামকে প্রথম নবি বলা হয় কেন?
✍️ ২. মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ যদি আদমের আগেই নবি হয়ে থাকেন, তাহলে তো আদমের আগে তাকে সৃষ্টি হবার কথা। তাহলে আদমকে প্রথম সৃষ্টি বলা হয় কেন?
✍️ ৩. মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ যদি আদমের আগেই নবি হয়ে থাকেন, তাহলে ৫৭০ খৃস্টাব্দে মক্কায় জন্মগ্রহণ করে চল্লিশ বছর বয়সে যে নবি নবুওয়াত-প্রাপ্ত হয়েছিলেন, তাঁর নাম কী?
✍️ ৪ .অনেকের মজমায় একজন ব্যক্তি একই সাথে প্রথমও, আবার শেষও- এটা কীভাবে সম্ভব?
✍️ ৫. তিনি যদি প্রথম নবিই হয়ে থাকবেন, তাহলে ৫৭০ খৃস্টাব্দের আগের পৃথিবী তাঁর উম্মত হল না কেন?
প্রশ্ন অনেক কিন্তু জবাব এক। একটা হলো উজুদে নবুওয়াত, একটা হলো জুহুরে নবুওয়াত। উজুদ মানে অস্তিত্ব, জুহুর মানে প্রকাশ। আমাদের নবি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ উজুদান ছিলেন প্রথম নবি, এবং জুহুরান শেষনবি। সহজ ভাষায়, সৃষ্টিগতভাবে মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ হলেন প্রথম নবি, কিন্তু পৃথিবীতে প্রকাশগতভাবে সর্বশেষ। সুতরাং, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৪০ বছর বয়সে নবি হয়েছেন- একথাও যেমন ঠিক, আবার আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টির আগেই তিনি নবি ছিলেন- সেকথাও ঠিক। এটা নিয়ে পাবলিক প্লেইসে পন্ডিতি করা মানে খামাখা বিভ্রান্তি ছড়ানো।
🔍ছয় 🔎
আউল বাউল লালনের দেশের বাবা মাইকেল জ্যাকসন, ডিজে জিকিরের প্রবক্তা প্রিয় বাউল সম্রাট, এবং আরও যারা হাওয়ার তালে দুললেন, আপনারাও- কেউ কিছু কি বুঝলেন?
লিখেছেন- মাওলানা রশীদ জামিল
বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক