08/03/2023
নারী দিবসের ভাবনা
#মাধবী
আজ বিশ্ব নারী দিবস, আমরা খুব হইচই করে দিবসটি পালন করি এবং যথানিয়মে ঘরে এসে যেই নারীটি প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হয়- সে আজও নির্যাতিত হবে।যতদিন পর্যন্ত নারী দিবস পালনের জন্য একটি নির্দিষ্ট দিন থাকবে ততদিন পর্যন্ত নারীরা যে নির্যাতিত হচ্ছে এবং পিছিয়ে পড়ছে সেটাই প্রমাণিত হচ্ছে, তা নাহলে এই একটি দিন পালন করে নারীদের সতর্ক করে দেওয়ার প্রয়োজন হতো না।
“নারী দিবস” পালনের দিনটি থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত খুব একটা বড় তফাৎ যে হয়ে গেছে এমন মনে করার কোন কারণ নাই,হয়তো কিছুটা এগিয়ে এসেছে নারীরা কিন্তু আরো অনেকটা পথ বাকি আছে, যেদিন নারী দিবস পালন করার প্রয়োজন পড়বে না-তাদের অধিকার আর মূল্যবোধ নিয়ে ভাবনার কোন অবকাশ হবেনা।অনেক নারীরা আজও জানেই না তাদের অধিকার বা দিবসের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ।এই অধিকার এবং নারী স্বাধীনতার কথা বলতে গেলেই কিছু কিছু পুরুষ শ্রেণীর দল হামলে পড়ে যেন বা নারীরা তাদের স্বাধীনতাটুকু হয়তো নিয়েই বুঝি গেল এবং তা নিয়ে যথারীতি খারাপ মন্তব্য ছুড়ে দেয়।অনেকেই মনে করেন যতদিন পর্যন্ত নারী অধিকার আর স্বাধীনতার কথা বলা হবে ততদিন পর্যন্ত নারী আর পুরুষের বৈষম্য বেড়েই চলবে, ডিভোর্সের সংখ্যা বাড়বে, কলহ ও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হবে।তাদেরকে বলছি, আগে নারীর স্বাধীনতা এবং অধিকার কি -তা জেনে আসুন।নারীরা সচেতন হলে নাকি মুখে মুখে কথা বলে,অন্যায়ের পথে রুখে দাঁড়ায়, সমান সমান অধিকার চায়, আর সমাজের চোখে “খুব ভালো মেয়ে” শিরোনাম নিয়ে যারা বেঁচে থাকে-তারা যেন খুব বাহবা নিয়ে বেঁচে থাকে এমন মনে হবার কোন কারন নেই।মুখ বুঝে সহ্য করে হয়তো এ “ভালো মেয়ে” উপাধির মেয়েগুলো একদিন বিষণ্ণতায় ভোগে, পড়ে পড়ে মার খায়, প্রতিনিয়ত প্রতারিত হয় আবার কখনো হয়তো মরে গিয়েই শোধ করে তার জীবনের ঋন। তাতে কি ডিভোর্স তো হয় না, মুখে মুখে তর্ক করেনা, সব মুখ বুজে মেনে নেয়। দুই-একটা মেয়ের মৃত্যুতে সমাজ বা দেশের তেমন কিছু আসে যায় না , এমন কত মেয়ে কত ঘরে ঘরে রোজ মরছে কে তার হিসাব রাখে।
এই যে প্রতিটি মেয়ে কারো হয়তোবা কন্যা, কারো বউ অথবা কারো মা , আমরা নিজেদের ঘরে নারীদের কতটুকু মূল্যায়ন করি? বড় কোনো আলোচনায় তাদের অংশগ্রহণ কতটা নিশ্চিত করি? অথবা তাদের মতবাদ এর কতটুকু গুরুত্ব দেই? বেশির ভাগ আলোচনায় তারা শুধু শ্রবণকারী এবং সেবিকার ভূমিকা পালন করে।কথায় কথায় বলা হয় “মেয়ে মানুষের বুদ্ধি ,মাথায় কোন ঘিলু নেই অথবা ঘরে বসে শাড়ি চুড়ি পড়ে থাকো”এভাবে অপমানসূচক কথা বলা হয় পুরুষকে কটাক্ষ করার সময়।
প্রতিটি ঘর যেদিন নারীকে মূল্যায়ন করতে শিখবে তখন একটা সমাজ এবং একটা রাষ্ট্র পরিবর্তন হতে বাধ্য। নারীরা যদি একটু সময় করে তার
ঘর সংসারের পাশাপাশি মেধার বিকাশ ঘটায় এটাও তার একটা সফলতা বয়ে নিয়ে আসবে একদিন। নিদেনপক্ষে নারীরা তার পছন্দের কাজগুলো করার জন্য একটু সময় বের করে নিতে পারে সুস্থ থাকার জন্য, নিজের মন ভালো থাকার জন্য- এই যেমন বই পড়া, বাগান করা, চাইলে কোথাও বেড়াতে যাওয়া, ভাল লাগার কোন খাবার অথবা শপিং করা। এটা অনেক সময় একঘেয়েমি দূর করে নতুন করে কাজে মনোনিবেশ করার জন্য সাহায্য করে।
নারীরা ইট-পাথরে ঘেরা একটা আবৃত দেয়ালকে ভালোবাসা মায়ার পরশে একটা শান্তির পরিবেশ রচনা করে।এই যে দিনের পর দিন সবার প্রয়োজন বুঝে চোখের সামনে নিমিষেই সব হাজির করে দেয়, টাকা দিয়েও কি এমন কোথাও মিলবে? বেতন ছাড়া- ছুটি ছাড়া একটা নারী কখনো সেবিকা, কখনো রাঁধুনি, কখনোবা শিক্ষিক, একটা হাউজ মেইড, বেবিসিটার,ইন্টেরিয়্যুর ডিজাইনার, প্রেমিকা ড্রাইভার পৃথিবীর আর কোথাও মিলবে এমন?
এই যে বিদেশ বিভূঁইয়ে এত বছর পরে আছি- চারপাশের দেখছি তো কত ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ গুলোকে, কেমন করে তারা পার্টনারের সাথে নিজের কাজের প্যাটার্ন ভাগ করে নেয়, এক এক দিন এক এক জন কাজ রুটিনমাফিক করে। যেদিন যে ঘরে থাকে- সে ঘরের সব রান্না, বাচ্চাদের দেখাশোনা, ঘর গোছানো, ক্লিনিং ওয়াশিং, শপিং সব করে, তারপর আবার ওয়াইফ কাজ থেকে এলে তার মন ভালো করার জন্য চা-কফি অফার করে, দিন কেমন গেল তা নিয়ে কথা বলে, একসাথে খাবার পরিবেশন করে প্রয়োজনীয় কথা সারে।কই আমাদের দেশের মতো বউরা কাজ থেকে এলেতো শুনতে হয় না “এত দেরি হল কেন? ঘরেই এলে ক্লান্ত হয়ে যাও? বাইরের পর পুরুষের সাথে তো ভালোই সময় কাটে? অফিসে সারাদিন কি করো তা জানিনা মনে করেছো? সারাদিন ফুর্তি করে আর ঘরে না ফিরলেই তো পারতে।এমন সব কথার পর সেই নারীই আবার রান্না করে, পরিবেশন করে, রাতের অর্ধেকটা পেরিয়ে যায় আবার ভোরে উঠে সব কাজ শেষ করে তাকে কাজেও যেতে হয়।বেশিরভাগ চাকরিজীবীর নারীদের এটাই রুটিন।কখনো একবারও মনে হয় না? এরাও মানুষ তারও কষ্ট হতে পারে,তারও কখনো কখনো মন খারাপ হয়, পরিবারের কথা মনে হতে পারে অথবা শরীর খারাপ হতে পারে, নিদেনপক্ষে রাগ অথবা ক্ষোভও তো হতে পারে।
একবারের জন্যও কি ঘরের পুরুষটি জিজ্ঞেস করে “তুমি কেমন আছো? আজ মন ভালো তো?তোমার পছন্দের খাবার কি? প্রিয় রং কি? মন খারাপ কেন-আমাকে কি বলা যায়? কোথাও যেতে চাও? একটু চা করে দিই? পছন্দের খাবার টা করে নিয়ে আসি? অথবা আজকে আমি রান্না করি, চলো একসাথে তোমার পছন্দের গান শুনি অথবা বাগানে গিয়ে চলো গল্প করি, আজ ঘরের কাজ আমি করি- তুমি রেষ্ট করো। কপালে হাত রেখে কখনো কোনো পুরুষ প্রয়োজন ছাড়া একবারও জানতে চেয়েছে “কি ভাবছো? এমন মলিন দেখাচ্ছে কেন? চলো আজকে কোন ফোন হাতে নেব না-শুধু তোমার সাথে গল্প করবো, “এতো ভাবছো কেন আমি তো আছি”এই যে আবেগ,এইযে প্রেমময় কথা, বিশ্বাস-আস্থা, যত্ন-ভালোবাসা এগুলো একটা নারীকে কত দুর ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে তা ভাবতেও পারবেন না।
সব নৌকায় পাল দিতে হয় না,বাতাসের গতি জানলে। সব মেয়ে কি আর ডায়মন্ড চায়? কেউ কেউ তো এক গাছি রেশমি চুরি আর একটা বেলি ফুলেও স্বর্গ রচনা করে। খুব বেশি কিছু লাগে না সুখী হতে, উপাদানগুলো খুজে বের করলে যে কোন স্তরে থেকেও সুখী হওয়া যায়। বিশ্বাস করুন- নারীরা নারী দিবস পালন করতে চায় না।চলুন না সবাই মিলে একটা নির্ভরযোগ্য পৃথিবী খুঁজে আনি, যেখানে নারী-পুরুষ সবাই মিলে স্বচ্ছন্দে বাস করতে পারি। কোন নারীকে যেন অকালে ঝরে যেতে না হয়। নারীদের শক্তি হয়ে পাশে দাঁড়ান, খুব কান্না পেলে যেন স্বস্থির একটা কাঁধ পাওয়া যায়, যেখানে পরম বিশ্বাসে মাথা রেখে একটা নারী কাঁদতে পারে, হাসতে পারে। আপনারাই তো কারো বাবা, কারো স্বামী অথবা কারো ছেলে। নারীদের মূল্যায়ন করুন আর নারীরা দু’হাত ভরে ছায়ায় মায়ায় উপহার দেবে নিরাপদ একটা ভালোবাসা ঘর।
“পুরুষ যদিও ইটের ঘেরা দেয়ালগুলো বাঁধে
নারী ছাড়া সেই ঘরের ইটগুলিও কাঁদে।”
নারী দিবসে আমার ছোট্ট একটা অ্যাচিভমেন্ট নিচে শেয়ার করলাম-