![ফিনল্যান্ডের জাতীয় জাদুঘরে গেলে আপনি একটি পাথরের মৎস্যকন্যা দেখতে পাবেন। তবে এটা কিন্তু কোন সাধারণ মৎস্য কন্যা নয়। ইনি হ...](https://img4.medioq.com/534/422/628226195344221.jpg)
09/22/2022
ফিনল্যান্ডের জাতীয় জাদুঘরে গেলে আপনি একটি পাথরের মৎস্যকন্যা দেখতে পাবেন। তবে এটা কিন্তু কোন সাধারণ মৎস্য কন্যা নয়। ইনি হলেন ইনুয়েট ধর্মের দেবী সারনা। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা আংগুতার মেয়ে এই সারনা। সাগরের যত মৎস্য ও প্রাণী রয়েছে তাদের সকলের জননী তিনি। সকল প্রকার সামুদ্রিক প্রাণী তার কথামত চলে।
দেবী সারনাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য তার বাবা অনেকগুলো পাত্র পছন্দ করেছিলেন । কিন্তু এদের কাউকেই দেবীর ভাল লাগেনি। বাবার সাথে রাগ করে তিনি ভীষণ এক কাণ্ড করে বসেন। বিয়ে করেন এক কুকুরকে। এতে তার বাবা প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন। তিনি এতই রেগে দিয়েছিলেন যে– তিনি মেয়েকে মধ্য সমুদ্রে নিয়ে যান আর ফেলে দেন কায়াক থেকে। সারনা যখন প্রাণপণে কায়াকে উঠার জন্য হাত বাড়াচ্ছিল, তখন তার বাবা তার হাতের আগুলগুলো এক এক করে কেটে দিতে থাকেন। তার এই কেটে যাওয়া আঙুলগুলো থেকেই তৈরি হয় সিল, ডলফিন, তিমি জাতীয় প্রাণীগুলো। আর তিনি পরিনত হন এক মহাশক্তিশালী দেবীতে।
ইনুয়েট ধর্মের মানুষ ছড়িয়ে আছে পুরো উত্তর মেরুর চারপাশে। গ্রিনল্যান্ড, কানাডার কিউবেক, ল্যাব্রাডর, আলাস্কা, নুনাভুট ও কানাডার নর্থওয়েস্ট টেরিটরিতে এদের বসবাস। উপরে সারনা দেবীর যে কাহিনী আছে তার অন্তত ৮-১০ টা ভার্সন পাওয়া যায়। একেক অঞ্চলের কাহিনীতে একটু একটু করে তফাৎ। তবে একটা কাহিনীতে দেবী হওয়ার আগে সারনা ছিলেন নিতান্তই একজন সাধারণ নারী।
এই কাহিনী অনুসারে সারনা একজন সাধারণ নারী ছিলেন। একদিন তিনি তার পরিবারের সাথে কায়াকে করে সমুদ্রে যান। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয় মারাত্মক ঝড়। তার মা-বাবা মনে করেন যে মেয়ের কোন পাপের কারনেই সম্ভবত এই বিপদ হচ্ছে। তখন তারা মেয়েকে কায়াক থেকে সাগরে ফেলে দেন। তখন সারনা কায়াকে উঠার চেস্টা করতে থাকে। কিন্তু কায়াক ধরতে গেলে তার বাবা একে একে তার আংগুলগুলো কেটে দিতে থাকেন। তার কাটা আঙুলগুলো থেকে তৈরি হয় সকল প্রকার সামুদ্রিক প্রাণীর। সমুদ্রের সকল প্রাণী তার কথামত চলাফেরা করে।
সারনা দেবীকে রাগিয়ে দিলে তার ইশারায় তিমি, সিল আর ডলফিনরা হান্টিং সাইটে আসা বন্ধ করে দেয়। ফলে শুরু হয় দুর্ভিক্ষ। তিনি প্রচণ্ড রাগী। একবার রেগে গেলে তাকে শান্ত করা খুবই কঠিন। শিকারীরা তাকে শান্ত করার জন্য নৈবেদ্য হিসাবে জীর্ণ হারপুন-মাথা, ভাঙা ছুরি এবং মাংস ও হাড়ের টুকরো সমুদ্রে ফেলে দেয়।
অনেক নৃতাত্ত্বিক ও গবেষকদের ধারণা– সারনার কাহিনী আসলে একজন বাস্তব মানুষের কাহিনী। পরবর্তীতে বিভিন্ন ধরণের সংযোজন বিয়োজনের মাধ্যমে এক পর্যায়ে তা মিথে পরিনত হয়েছে। একটি জনপ্রিয় কাহিনীর সাথে মিথের উপাদান যুক্ত করে অনেক ক্ষেত্রে মিথ তৈরি হতে পারে। সারনার করুন কাহিনীটুকু হয়ত বাস্তব ঘটনা। কেউ হয়ত সত্যিই তার মেয়েকে পানিতে ফেলে দিয়েছিল। কারন এই কাহিনীর যতগুলো ভার্সন আছে সবগুলোতেই এইটুকু কমন। পরবর্তীতে এই জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়েই এটাকে মিথে পরিনত করা হয়েছে।
এই কাহিনীর মধ্য দিয়ে মূলত ইনুয়েট শিকারীদের এক ধরনের বার্তা দেওয়া হয়েছে। আর্কটিক অঞ্চলের তীব্র ও চরম আবহাওয়ায় টিকে থাকার জন্য অনেক ধরণের সতর্কতা মেনে চলতে হয়। একটু ভুল হলেই হতে পারে মৃত্যু। ইনুয়েটদের ঐতিহ্য, ট্যাবু, রিচুয়াল ও সামাজিক আইনগুলো তৈরি হয়েছে মূলত সতর্কতার জন্য। ইন্যুয়েটরা প্রাচীনকাল থেকে তিমি, ডলফিন, শীল ইত্যাদি শিকার করে খেত। অতিরিক্ত শিকার যে মাঝে মাঝে বিপদ ডেকে আনতে পারে, সামুদ্রিক প্রাণীদের বংশবৃদ্ধিতে অসুবিধা করতে পারে, তা ইনুয়েটদের পূর্বপুরুষরা জানত। সারনা দেবী যদি অসন্তুষ্ট না হন, তবে শীল আর তিমির অভাব হবে না। অর্থাৎ ইচ্ছেমত শিকার করা চলবে না। এই মিথের কাহিনীর মত ইনুয়েটদের বিভিন্ন ধরনের ট্যাবু রয়েছে, যা মূলত আর্কটিক অঞ্চলের চরম পরিবেশে টিকে থাকার জন্যই তৈরি করা হয়েছে।