17/11/2024
ভিক্টর ফ্রাঙ্কলের লেখা "Man's Search for Meaning" এই বইয়ে জীবনের গভীরতম কষ্ট, যন্ত্রণা এবং মানবিকতার খোঁজে পাঠকদের নিয়ে যায় এক অদ্ভুত জার্নিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, নাৎসি বন্দিশিবিরে কাটানো তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি এই বইটি লিখেছেন। হলোকাস্টের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও কীভাবে জীবনের মানে খুঁজে পাওয়া যায়, তারই এক জীবন্ত দৃষ্টান্ত তিনি এই বইয়ে তুলে ধরেছেন।
ফ্রাঙ্কল ছিলেন একজন সাইকিয়াট্রিস্ট এবং তিনি হলোকাস্টের অন্ধকার সময়ে শারীরিক, মানসিক, এবং আবেগিক কষ্টের চূড়ান্ত অবস্থায়ও জীবনের প্রতি আশা ধরে রেখেছিলেন। বন্দিশিবিরের নির্মম পরিবেশে দিন কাটিয়ে, খালি পায়ে বরফের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে, প্রতিনিয়ত মৃত্যুর ভয়ে দিন যাপন করেও তিনি জীবনের গভীরতম অর্থ খুঁজে পেয়েছিলেন।
এই বইয়ের মূল পয়েন্টগুলো:
1. জীবনের মানে খোঁজার প্রয়োজনীয়তা: ফ্রাঙ্কল মনে করেন, জীবন মানে কেবল সুখ পাওয়া নয়; বরং এমন কিছু পাওয়া, যা জীবনের লক্ষ্যকে পরিপূর্ণ করে। তিনি বলেন, আমাদের প্রতিটি মানুষের জীবনে এমন কিছু না কিছু লক্ষ্য থাকা উচিত, যা তাকে সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে।
2. কষ্টকে অর্থময় করে তোলা: ফ্রাঙ্কল বুঝিয়েছেন, কষ্ট এড়ানো সবসময় সম্ভব নয়, কিন্তু সেই কষ্টকে অর্থময় করে তোলাই আসল চ্যালেঞ্জ। তাঁর মতে, মানুষ যদি জীবনের মানে খুঁজে নিতে পারে, তাহলে কঠিন পরিস্থিতিতেও তাকে সহজ মনে হয়। কষ্টকে মেনে নিয়ে, তার মধ্যেও নিজের লক্ষ্য স্থির রেখে জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলাই মানবজীবনের এক বিশেষ গুণ।
3. আশার আলো ও জীবনের লক্ষ্য: ফ্রাঙ্কল লিখেছেন, বন্দিশিবিরে প্রতিদিন মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তিনি জীবনের প্রতি আশা ধরে রেখেছিলেন। যাদের জীবনে কোনো ভালোবাসা, কোনো লক্ষ্য ছিল, তারা অনেক কষ্টেও টিকে থাকতে পেরেছিলেন। অর্থাৎ জীবনের প্রতি বিশ্বাস থাকলে মানুষ যে কোনো কঠিন সময়ও পার করতে পারে।
4. মন ও মানসিক শক্তি: ফ্রাঙ্কল বলছেন, শারীরিকভাবে অসহায় হলে মানুষ মানসিকভাবে শক্তিশালী হতে পারে। নিজের চিন্তা, অনুভূতি এবং মন নিয়ে কাজ করেই মানুষ সবচেয়ে কঠিন সময়েও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে।
5. মানুষের স্বাধীনতা ও দায়িত্ববোধ: ফ্রাঙ্কল বিশ্বাস করেন, মানুষ তার জীবনের মানে খুঁজে নিতে স্বাধীন এবং সেই মানে অনুযায়ী কাজ করার দায়িত্বও তার নিজের। তার মতে, মানুষকে কেবল জীবনযাপন নয়, বরং জীবনের অর্থ খুঁজে জীবনকে পূর্ণতা দান করতে হবে। জীবন মানেই কিছু অর্জন করা নয়; বরং জীবনের প্রতি এক দায়িত্ব ও সেবামূলক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা উচিত।
এই বই থেকে শেখার দিকগুলো:
- দুঃখেরও অর্থ থাকতে পারে: ফ্রাঙ্কল মনে করিয়ে দেন, কষ্ট বা যন্ত্রণাকে যদি আমরা কোনো বড় লক্ষ্য বা অর্থের সাথে যুক্ত করতে পারি, তবে তা আর শুধু কষ্ট থাকে না। তা হয়ে যায় আমাদের জীবনকে গঠন করার একটি মাধ্যম।
- নিজের মনকে শক্তিশালী করা: ফ্রাঙ্কল মনে করিয়ে দেন, জীবনের কঠিন সময়ে মনের শক্তি আর আত্মবিশ্বাসই আমাদের আসল সম্বল। শারীরিক দিক থেকে হারিয়ে গেলেও, মনের দিক থেকে আমরা কখনোই পুরোপুরি হেরে যাই না।
- কঠিন পরিস্থিতিতে আশা ধরা রাখা: বইটা পড়ে বোঝা যায়, জীবনের কঠিন সময়েও যদি আমরা কোনো সুন্দর ভবিষ্যতের কথা কল্পনা করতে পারি, তাহলে তা আমাদের বেঁচে থাকার শক্তি দেয়। সেই আশাই মানুষকে টিকে থাকার শক্তি জোগায়।
শেষ কথা-
এইটা শুধুমাত্র একটা বই নয়; এটি জীবন, কষ্ট এবং বেঁচে থাকার মানে নিয়ে এক অসাধারণ প্রতিফলন। ফ্রাঙ্কলের নিজের অভিজ্ঞতা, তার জীবনবোধ এবং তার মনোবিজ্ঞানী হিসেবে গভীর উপলব্ধি আমাদের জীবনের গভীরতম প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পেতে সাহায্য করে। এটি এমন এক বই যা পড়ার পর, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি সম্পর্ক, এমনকি প্রতিটি কষ্টকেও নতুনভাবে দেখতে ইচ্ছে হয়।
এই বইটা পড়লে মনে হয়, আসলেই জীবনটা অর্থহীন নয়; বরং তার ভেতরে অনেক গভীর অর্থ লুকিয়ে আছে, যা খুঁজে পাওয়া আমাদের নিজের দায়িত্ব।