13/08/2020
শাহজাহান সিরাজ: স্বাধীনতার ইশতেহার থেকে জাতীয় রাজনীতি।
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের ইতিহাস লিখতে গেলে সুকৌশলে যে ইতিহাসটি ওয়ান লাইনার কয়েকটা কথাবার্তা দিয়ে রেটোরিকাল পরিসমাপ্তি টানা হয় তা হলো ষাট এবং সত্তর দশকের প্রারম্ভের গৌরবোজ্জ্বল ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস।বোধকরি পৃথিবীর ইতিহাসে প্রাচীন গ্রীক,ফরাসি কিংবা হালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা চীনের মতো 'সভ্যতার কারিগর' রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ঘাটলে ছাত্র রাজনীতির এমন প্রকট প্রভাব খুঁজে পাওয়া বেশ দুষ্কর হবে।ছাত্র,জনতার সম্মিলনের এহেন বিজয়কে 'জনযুদ্ধ' বলা হলেও অনেক অসমাপ্ত ঘটনায় ইতিহাস ভর্তি হয়ে থাকার দরুণ প্রজন্মান্তরে জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জনটি ক্রমেই 'সামরিক যুদ্ধে' পরিণত হচ্ছে।একক ব্যক্তি দিয়ে ইতিহাস গঠনের চেষ্টাই হয়তো এর পেছনের বড় কারণ।ইতিহাস বইয়ের বড় অংশটি যেমন একজন ব্যক্তির হাত ধরে লিখা হতে পারে তেমনি অনেকগুলো মানুষের অবদানের সমন্বয় ওই ব্যক্তির লিখা বইটির পূর্ণাঙ্গ সমাপ্তিতে সহায়তা করে।
এমনই এক উত্তাল সময়ে এদেশের ছাত্ররাজনীতিতে ইতিহাসের নায়ক বনে যাওয়া একজন হলেন শাহজাহান সিরাজ।
১৯৪৩ সালের ১ মার্চ টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে জন্ম নেওয়া শাহজাহান সিরাজ গত শতকের ষাটের দশকে ছাত্রলীগের মাধ্যমে রাজনীতিতে যুক্ত হন।
যমুনার কোল বিধৌত টাঙ্গাইল এমনকি দেশের অন্যতম ছাত্ররাজনীতি অন্যতম তুখোড় আঁতুড়ঘর টাঙ্গাইলের করোটিয়া সাদত কলেজ ছাত্র সংসদের ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে ভি.পির দায়িত্ব পালন করেন তিনি।এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শিক্ষার্জনের জন্য ভর্তি হয়ে ছাত্ররাজনীতি চর্চাকে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পান।
স্বাধীনতার প্রশ্নে তখন ছাত্রলীগের মধ্যে চলছিলো সুপ্ত এবং সময়ে অসময়ে প্রকাশ্য দুই গ্রুপের ভিন্ন অবস্থান।
যদিও একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামের প্রশ্নে উভয় গ্রুপই ছিলো নিবেদিত এবং একাত্ম অবস্থানে।
১৯৬২ সালে যখন কিনা কেউ চিন্তা করেনি পূর্ব পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অদূর ভবিষ্যত কি হবে কিংবা এই অঞ্চলের নির্যাতিত,নিষ্পেষিত মানুষগুলোর আদৌ স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত হবে কিনা কিংবা ফাইনাল রেজাল্ট হিসেবে আলাদা একটি ভূখন্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে কিনা তখন ঠিক এই চিন্তাগুলোই ছাত্রলীগের মাঝে তিনজন ব্যক্তি করেন এবং তাঁদের চিন্তাপ্রসূত ফলাফল হয় 'স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস'।যার কাজ ছিলো ছাত্রলীগ এবং আওয়ামীলীগের অভ্যন্তরে সশস্ত্র সংগ্রামের মানসিকতা তৈরী করে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য একটি শক্ত বাহিনী গড়ে তোলা।
সে তিনজন ছিলেন সিরাজুল আলম খান,আব্দুর রাজ্জাক এবং কাজী আরেফ আহমেদ।
পরবর্তীতে এই অংশটি নিজেদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র,স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ এবং শ্রেণীসংগ্রাম বিপ্লবের মতো তৎকালীন বিশ্বের জনপ্রিয় মতবাদগুলোর সাথে নিজেদের সমন্বয় ঘটান।
অন্যদিকে, ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মনি শুরুতে কিছুটা নিষ্ক্রিয় থাকলেও এই গ্রুপ বা উইংটিকে প্রতিবিপ্লবী আখ্যা দিয়ে স্বায়ত্তশাসন এবং শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে স্বাধীনতার পথ ত্বরান্বিত করার আহ্বান জানান।
বলাই বাহুল্য তখন ছাত্রলীগে সিরাজুল আলম খান পন্থী তথা নিউক্লিয়াস পন্থী এই বলয়ের প্রভাব স্পষ্টতই বেশ গাঢ় ছিলো।এই যখন বিভক্তি তখন শাহজাহান সিরাজ
নিউক্লিয়াস পন্থী হিসেবে ছাত্রলীগে রাজনীতি শুরু করেন।
ঢাকার অদূরে টাঙ্গাইল থেকে ছয়দফা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎকালীন ইকবাল হলে থেকে ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের পর উত্তাল সময়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্বের পর্যায়ে চলে আসেন।
সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামীলীগের হয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর মাধ্যমে টাঙ্গাইলে আওয়ামীলীগকে শক্ত অবস্থান এনে দিতে সহায়তা করেন।
ছাত্ররাজনীতির জীবনে সবচেয়ে বড় স্বীকৃতিটি পান ১৯৭০ সালের।মুক্তিযুদ্ধের অদ্যাবদি সময়ে তিনি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।সত্তরের ১৮-১৯ মার্চ এক সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন নূরে আলম সিদ্দিকী।ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে প্রকাশ্য এই গ্রুপিংয়ের ফল হিসেবে সিরাজুল আলম খান গ্রুপ হতে শাহজাহান সিরাজ সেক্রেটারি এবং শেখ মনি গ্রুপ হতে সিদ্দিকী সভাপতি নির্বাচিত হন।ঐতিহাসিকভাবে এই কমিটি ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠার পেছনে অন্যতম কারণ হলো পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সর্বশেষ এবং স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রথম কমিটি ছিলো এটি।
একই বছর ডাকসুর ইতিহাসের প্রথম প্রত্যক্ষ নির্বাচনে ছাত্রলীগ নিরঙ্কুশ জয় পায়।ভি.পি,জি.এস সহ বেশিরভাগ পদেই ছাত্রলীগ সমর্থিত প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়।ছাত্রলীগ বা অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ে এখনো এই ডাকসু নির্বাচনটিকে মাপকাঠি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।এই নির্বাচনে ভি.পি নির্বাচিত হন এর আগের কমিটিতে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা আ স ম আব্দুর রব এবং জিএস নির্বাচিত হন আব্দুল কুদ্দুস মাখন।
তবে, ইতিহাসে যে পৃষ্ঠাটি মুছে দেয়ার মাধ্যমে তাৎপর্যপূর্ণ অনেকগুলো বিষয়কে মুছে দেয়ার অপপ্রয়াস করা হয় তা হলো ১৯৭০ সালের ৬ জুন তৎকালীন ইকবাল হল বর্তমান জহুরুল হক হলে বসে ডিজাইন হওয়া জাতীয় পতাকার ইতিহাস।শাহজাহান সিরাজ এই হলেরই ১১৬ নম্বর রুমে থাকতেন।একই রুমে ডাকসু ভিপি আ স ম রবও থাকতেন।ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে সিরাজ পন্থী নেতা মনিরুল হক মার্শাল মনি,হাসানুল হক ইনু,কাজী আরেফ আহমেদ,সালাউদ্দিন সহ বেশ কিছু ছাত্রলীগ নেতা সেদিন উপস্থিত ছিলেন।কে জানতো সেদিন তৎকালীন ছাত্রনেতা রফিক আর খসরুর নবাবপুর চষে বন্ধ থাকা নিউমার্কেটের দোকানিকে তুলে কেনা কাপড় আর রং তুলি বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম নেয়া নতুন একটি দেশের জাতীয় পতাকা ডিজাইনে কাজে লাগতে চলেছে!
তৎকালীন সময়ে ছাত্রলীগের মাঝে ব্যানার,ফেস্টুনে আঁকাআকি করা কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শিবনারায়ণ দাশ কে ডেকে আনা হলো পতাকা আঁকার জন্য।
নিউক্লিয়াসের পরামর্শে এবং বঙ্গবন্ধুর সম্মতিক্রমে জাতীয় পতাকায় লাল এবং সবুজ রং যুক্ত করার পাশাপাশি সোনালী আঁশ পাটের রঙে এখনো স্বাধীনতার ঘোষণা না পাওয়া দেশটির মানচিত্র সমেত নির্দিষ্ট করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।অতঃপর শাহজাহান সিরাজে রুমের মেঝেতে আঁকা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।যেটি পাক ফ্যাশন টেইলার্সে প্রথম সেলাই করা হয়।
একাত্তরের শুরুতে স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনকে বেগবান করতে ডাকসুর ভিপি-জিএস এবং ছাত্রলীগের সভাপতি-সম্পাদকের সমন্বয়ে গঠিত হয় 'স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ'।ইতিহাসে যে পরিষদের ৪ নেতা সর্বজনবিদিত হয়েছেন 'বঙ্গবন্ধুর চার খলিফা' নামে।
শাহজাহান সিরাজ এদেরই একজন ছিলেন।
১৯৭১ সালের ২রা মার্চ ঢাবির বটতলায় এক ছাত্র জমায়েতে লক্ষ ছাত্রজনতার উপস্থিতিতে আ স ম আব্দুর রব ডিজাইনকৃত জাতীয় পতাকাটি প্রথমবারের মতো উত্তোলন করেন এবং নেড়ে দেখান।সেখানে 'স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ' এর বাকি ৩ নেতা ও উপস্থিত ছিলেন।
সেদিনই বিকেলে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে কবিগুরুর 'আমার সোনার বাংলা',জাতির পিতা এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হিসেবে শেখ মুজিবের নাম নিউক্লিয়াস ও ছাত্রলীগের এক সভায় নির্ধারিত হয়।
এ সকল ম্যান্ডেটকে একটি খসড়া ম্যানিফেস্টো আকারে প্রকাশ করার লক্ষ্যে ৩রা মার্চ পল্টনে 'স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে'র আরেকটি জনসভা ডাকা হয়।যার খসড়া প্রণয়নের পর 'জয় বাংলা ইশতেহার নং-১' এবং ব্র্যাকেটে 'স্বাধীন সার্বভৌম বাঙলাদেশের জন্ম ও কর্মসূচি' হিসেবে প্রচারপত্রের আকার দেন রায়হান ফেরদৌস মধু এবং মহিউদ্দিন আহমেদ।
বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন এবং সংক্ষিপ্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণে বিস্তারিত ঘোষণা দেয়ার কথা বলেন।
সেই ইশতেহার পাঠের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার কর্মসূচি ও আন্দোলন কীভাবে পরিচালিত হবে, সেটাও তিনিই পাঠ করেন। মুহুর্মুহু করতালি আর জনতার শ্লোগানে মুখর হয়ে গিয়েছিল পল্টন ময়দান।
এভাবেই, টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে বেড়ে উঠা কিশোর শাহজাহান সিরাজ হয়ে যান এই ভূখণ্ডের স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক।
এরপর ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে গঠিত বিএলএফ তথা মুজিব বাহিনীর হয়ে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের পাশাপাশি প্রবাসী সরকারের সাথে সমন্বয় রক্ষার কাজ করেন শাহজাহান সিরাজ।
স্বাধীনতার পর 'স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ' এবং শ্রেণীসংগ্রাম আন্দোলনকে সামনে রেখে জাতীয় বিপ্লবী সরকার ইস্যুতে সিরাজুল আলম খানের দেয়া ১৫ দফা দাবী শেখ মুজিবুর রহমান মেনে নিতে অপারগ হলে ছাত্রলীগের মাঝে চলতে থাকে বিভাজন।সমাজতন্ত্রী ছাত্রলীগ এবং মুজিববাদী আওয়ামী ছাত্রলীগ নামে দুটো গ্রুপ তৈরী হয়।যার প্রথমটির নেতৃত্বে ছিলেন আ স ম রব,শাহজাহান সিরাজ এবং পেছনে সিরাজুল আলম খান আর দ্বিতীয়টির নেতৃত্বে ছিলেন নূরে আলম সিদ্দিকী,আব্দুল কুদ্দুস মাখন এবং পেছনে শেখ ফজলুল হক মনি,তোফায়েল আহমেদ আর আব্দুর রাজ্জাকরা।
১৯৭২ এর ২৩ জুলাই স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রথম সম্মেলন ডাকা হয়।দুটো গ্রুপ দুটো আলাদা জায়গায় সম্মেলন আহ্বান করেন।
তখন রেসকোর্সের সম্মেলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি তোফায়েল আহমেদের সমর্থনপুষ্ট তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী এবং ডাকসুর জি.এস আবদুল কুদ্দুস মাখন গ্রুপ।আর পল্টনের সম্মেলনের পেছনে ছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল আলম খানের সমর্থনপুষ্ট ডাকসুর সাবেক ভি.পি. ও ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আ স ম আবদুর রব,তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ প্রমুখের গ্রুপ।দুটি সম্মেলনেই প্রধান অতিথি করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় অংশ পল্টনের সম্মেলনে যাননি বঙ্গবন্ধু। তিনি যোগ দেন রেসকোর্সের সম্মেলনে।
সম্মেলনের উদ্বোধন করে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে হবে।’
বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শেষে রেসকোর্স সম্মেলনের ছাত্রলীগ নেতারা স্লোগান দেন- ‘এক নেতা এক দেশ বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ, ত্যাগ কর সব বাদ, কায়েম কর মুজিববাদ।’
একই সময়ে পল্টনের সম্মেলনে আ স ম আবদুর রব,শাহজাহান সিরাজ ও অন্যান্য ছাত্রলীগ নেতারা বলেন, ‘গণতন্ত্র দিয়ে সমাজতন্ত্র হবে না। মার্কসবাদই হচ্ছে মুক্তির মতবাদ।’ তাদের কর্মীদের মাঝে স্লোগান ওঠে- ‘সামাজিক বিপ্লবের পথ ধর, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েম কর।’
রেসকোর্সের সম্মেলনে শেখ শহীদুল ইসলামকে সভাপতি ও এম এ রশীদকে সাধারণ সম্পাদক করে আওয়ামীপন্থী ছাত্রলীগ কমিটি প্রদান করে।অন্যদিকে পল্টনের সম্মেলনে শরীফ নুরুল আম্বিয়াকে সভাপতি ও আ ফ ম মাহবুবুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রলীগের পাল্টা কমিটি গঠন করা হয়।যা পরবর্তীতে জাসদ ছাত্রলীগ নামে পরিচিত হয়।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এভাবেই দুই ভাগে বিভক্ত হয়।সবচেয়ে বড় অংশটি সমাজতন্ত্রী ছাত্রলীগদের পক্ষে যায়।
ছাত্রলীগের বিভাজনের পর শাহজাহান সিরাজকে আওয়ামীপন্থী ছাত্রলীগ তাদের কমিটি থেকে বহিষ্কার করে।
১৯৭২ সালের ৩১শে অক্টোবর সমাজতন্ত্রী ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার উদ্দেশ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদ গঠন করেন।সিরাজুল আলম খান এর নেপথ্যে থাকলে তিনি কোনো পদ গ্রহণ করেননি।সভাপতি হন মেজর জলিল এবং সাধারণ সম্পাদক হন আ স ম আব্দুর রব।প্রতিষ্ঠাকালীন ৭ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটির অন্যতম নেতা হিসেবে শাহজাহান সিরাজ জাসদের প্রতিষ্ঠা লগ্ন হতে দলটির সাথে যুক্ত থাকেন।
১৯৭২-১৯৭৫ পর্যন্ত তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকারের একমাত্র বিরোধীদল হিসেবে জাসদ রাজপথ থেকে সংসদ সর্বত্র সরব ছিলো।ক্যাম্পাসগুলোতেও সমাজতন্ত্রী ছাত্রলীগের প্রচ্ছন্ন প্রভাব বিদ্যমান ছিলো।শাহাজাহান সিরাজ এই সময়ে সক্রিয়ভাবে জাসদ রাজনীতির নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখেন।
বিপ্লবী চেতনায় উজ্জীবিত লাখো মুক্তিযোদ্ধা এবং তরুণের রোমান্টিসিজমের কেন্দ্রে থাকা তুমুল জনপ্রিয় এই ছাত্রনেতা পরবর্তীতে জাসদ রাজনীতির সবচেয়ে বড় পটপরিবর্তনগুলোরও সাক্ষী।জিয়াউর রহমান ক্ষমতা নেয়ার পর কর্ণেল তাহেরের মৃত্যু এবং সামরিক শাসনের টালমাটাল পরিস্থিতিতে জাসদ ভাঙনের শিকার হয়।
জাসদে ভাঙনের শুরুতে শাহজাহান সিরাজের সঙ্গে ছিলেন হাসানুল হক ইনু; পরে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাঁধলে ইনু আলাদা জাসদ গড়েন। তখন অনেকটা একা হয়ে পড়েন শাহজাহান সিরাজ।এরপর মির্জা সুলতান রাজা সহ আরেকটি অংশ গড় তুললেও তা চিরস্থায়ী হয়নি।
ওই সময় সব দলের বর্জনের মধ্যে এরশাদের অধীনে ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে তার অংশগ্রহণও সমালোচনায় পড়ে। তার আগে ১৯৭৯ ও ১৯৮৬ সালে তিনি জাসদের হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
তবে, রাজনীতিবিদ শাহজাহান সিরাজকে নিয়ে আলোচনা সমালোচনার সবচেয়ে বড় কেন্দ্রবিন্দুর তৈরী হয় সম্ভবত ১৯৯৫ সালে।রাজনীতির শেষজীবনে বাম আদর্শের বিপরীতে হেঁটে বিএনপিতে যোগ দেন শাহজাহান সিরাজ।সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত যারা তাঁর নেতৃত্ব জীবনের যৌবন উৎসর্গ করেছিলেন বিপ্লবের উজ্জ্বল লেলিহান প্রজ্বলনীতে তাদের অনেকেই সেদিন আশাহত হলেও রাজনীতিক শাহজাহান সিরাজের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছাতে হয়তো এটি নিয়ামক ছিলো
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত সংসদ নির্বাচনে বিএনপির হয়ে অংশ নিয়েছিলেন তিনি, পরে ২০০১ সালে আবারও ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচিত হন।
জাসদ এবং বিএনপি মিলিয়ে নিজ আসন টাঙ্গাইল-৪(কালিহাতী) হতে সর্বমোট ৫ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন শাহজাহান সিরাজ।
২০০১ সালে খালেদা জিয়া সরকার গঠন করলে বন ও পরিবেশমন্ত্রী করা হয় শাহজাহান সিরাজকে।তখনই বাংলাদেশে পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। পরিবেশ রক্ষায় যে সিদ্ধান্তটি ছিল প্রশংসিত।বায়ু দূষণ কমাতে টু স্ট্রোক অটোরিকশা নগরীতে বন্ধ করাও হয়েছিল ওই সময়ে।এর পাশাপাশি বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন।
একটি বিশেষ ব্যাপার হলো, বিএনপি হতে সাংসদ কিংবা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পর কিংবা আমৃত্যু বিএনপির সাথেই থাকার পরেও শাহজাহান সিরাজ রাজনৈতিক মহলে 'জাসদ নেতা' হিসেবেই সমধিক সমাদৃত।
জীবনের শেষ ১০টি বছর স্ট্রোক,প্যারালাইসিস সহ নানাবিধ শারীরিক সমস্যায় ভুগেছিলেন।বিএনপি রাজনীতি করেও বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান এবং সর্বাধিনায়ক বলাতে তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ তাঁকে সাহসিকতার আসনে যেমন বসিয়েছে তেমনি রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং কৌশলের চাপাকলে পড়ে এদেশের ইতিহাস বিনির্মানের অন্যতম সারথী হয়েও পাননি তেমন কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি কিংবা আর্থিক/চিকিৎসা সহায়তা।
২০২০ সালের ১৫ জুলাই ঢাকার এ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগে বর্ণাঢ্য এই রাজনীতিবিদের বয়স হয়েছিলো ৭৭ বছর।
স্বাধীনতা পরবর্তী শাহজাহান সিরাজের রাজনৈতিক অবস্থান কিংবা দল পরিবর্তন বা সম্পূর্ণ ভিনধারার রাজনৈতিক দলে অভিযোজন কতটা ভুল কিংবা সঠিক সেটা ইতিহাসের বিচার্য।
তবে, বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের জন্মলগ্ন এবং অভ্যুদয়ের পেছনে তৈরী হওয়া স্বর্ণোজ্জ্বল এবং বর্ণাঢ্য ইতিহাসের সোনালী অধ্যায়ের অন্যতম রূপকার শাহজাহান সিরাজের স্বীকৃতি অবশ্য প্রাপ্য।
এই স্বীকৃতির কতোটা দিতে আমরা পেরেছি তার হিসেব হয়তো ভবিষ্যত করবে কিন্তু এদেশের ছাত্ররাজনীতির যে শৈল্পিক এবং হীরকখচিত অধ্যায় ষাট,সত্তরের দশকে রচিত হয়েছিলো তার ধারাবাহিকতা রক্ষাও কি অন্তত হয়েছে?
প্রকাশ্য গ্রুপিংয়েরও মূল উদ্দেশ্য যেখানে ছিলো দেশ মাতৃকার স্বাধীনতা অর্জন সেখানে দেশ,জনতার স্বার্থে ছাত্র সংগঠনগুলোকে ছাত্রজনতার কাতারে দেখা হয়তো বা দূর্লভ বস্তুতেই পরিণত হবে।
একাত্তরের শাহজাহান সিরাজদের বাংলাদেশকে নিয়ে দেখা অসম্পূর্ণ স্বপ্নগুলো পূর্ণতা পাক।জাতীয় বীর শাহজাহান সিরাজ অন্তিম শয়ানে শান্তিতে থাকুন।