18/04/2022
রেনেসাঁ শিল্প
রেনেসাঁ শিল্প বলতে ইউরোপীয় রেনেসাঁর সময়কার চিত্রকলা, স্থাপত্য, এবং আলংকারিক কার্যকলাপসমূহকে বোঝানো হয় যা দর্শন, সাহিত্য, সঙ্গীত, এবং বিজ্ঞানের পাশাপাশি একটি নিজস্ব শৈলী নিয়ে ১৪০০ সালে ইতালিতে আবির্ভূত হয়। রেনেসাঁ চিত্রকলা, যাকে কিনা ক্লাসিকাল এন্টিকুইটির/ধ্রুপদী সভ্যতার শ্রেষ্ঠ বলে মনে করা হয়, তা ক্লাসিকাল বা শাস্ত্রীয় চিত্রকলাকে বুনিয়াদ করেই গড়ে ওঠে, তবে সেই ঐতিহ্যকেই উত্তর ইউরোপের সমসাময়িক শৈল্পিক বিকাশ এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সাথে যুক্ত করে রুপান্তর করে নেয়। সুরভি বন্দোপাধ্যায়ের মতে "ক্লাসিসিজম-এর বৈশিষ্ট্য হল পরিমিতিবোধ, ভারসাম্যবোধ, সংযম এবং আঙ্গিক-সচেতনতা।...ক্লাসিসিজম-এর তাত্ত্বিক অর্থ হল নিয়ম, প্রথা এবং প্রচলিত শৃঙ্খলার অনুসরণ, তাৎক্ষণিক প্রেরণা নয়"। রেনেসাঁ শিল্প এবং রেনেসাঁ মানবতাবাদ দর্শন সমস্ত ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এবং নিত্যনতুন শৈল্পিক কলাকৌশল ও শৈল্পিক সংবেদনশীলতা শিল্পী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের প্রভাবিত করে। রেনেসাঁ শিল্পের মাধ্যমেই ইউরোপ মধ্যযুগ থেকে আদি আধুনিক যুগে উন্নীত হয়।
রেনেসাঁ বলতে সাধারণত নির্দেশ করা হয় মধ্যযুগের অন্তিম পর্যায় ও পাশ্চাত্য আধুনিক যুগের আদি পর্যায়কে। তবে এই তারিখ নির্ণয়ের সমস্যাগুলি বিতর্কের সৃষ্টি করেছে: ১২শ শতকে ইউরোপিয়ান শিক্ষাগ্রহণের একটি নবজাগরণ বর্তমানে স্বীকৃত হয়েছে, অন্যদিকে ১৮শ শতকের আলোকিত যুগ রেনেসাঁ সম্বন্ধীয় বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবণতার একটি ধারাবাহিকতা বা সম্প্রসারণ। সাধারণত শব্দটি নির্দেশ করে ১৫শ ও ১৬শ শতকের সম্মিলিত বুদ্ধিবৃত্তিক ও শৈল্পিক রুপান্তরণ, যার অন্তর্গত মানবধর্ম, রোমীয়মতবিরোধী (প্রটেস্ট্যান্ট) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, কোপার্নিকাসের জ্যোতির্বিদ্যা, এবং আমেরিকার 'আবিষ্কার'।
ইউরোপের বেশ কয়েকটি স্থানে, আদি রেনেসাঁ শিল্প এবং অন্তিম মধ্যযুগীয় শিল্প একই সাথে তৈরি হয়।
একই রেনেসাঁ সম্বন্ধীয় বিকাশসমূহ যা মানবসমাজকে প্রভাবিত করেছিল, তা দর্শন, সাহিত্য, স্থাপত্য, ধর্মতত্ত্ব, বিজ্ঞান, শাসনব্যবস্থা, এবং সমাজের অন্যান্য শাখাকেও প্রভাবিত করে। নিম্নলিখিত তালিকাটি একটি সারসংক্ষেপ, যার বিষয়গুলি উপরে উদ্ধৃত করা বিশ্বকোষের মূল প্রবন্ধগুলিতে আরও বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
শাস্ত্রীয় পুঁথিসমূহ যেগুলি ইউরোপীয় পন্ডিতদের কাছে অনেক শতাব্দী পর্যন্ত উপস্থিত ছিল না, তা সহজলভ্য হল। এর মধ্যে ছিল দর্শন, গদ্য, কাব্য, দৃশ্যকাব্য, বিজ্ঞান, শিল্পকলার উপর একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ, এবং প্রারম্ভিক খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ব।
একইসঙ্গে, ইউরোপ পরিণত গণিতে, যা ইসলামী পন্ডিতদের রচনায় উৎপত্তি হয়েছিল, প্রবেশাধিকার লাভ করল।
পঞ্চদশ শ্তাব্দীতে চলমান টাইপ প্রিন্টিং এর আবির্ভাব হওয়ার ফলে চিন্তাধারণা খুব সহজেই প্রচার করা সম্ভব হয়, এবং বৃহত্তর জনগণের উদ্দেশ্যে ক্রমবর্ধমান হারে পুস্তক রচিত হতে থাকে।
মেডিচি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা এবং ফলত ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ইতালির একটিমাত্র শহর, ফ্লোরেন্সে, বিপুল ধনসম্পদ নিয়ে আসে।
ইতালিয় ব্যাংক-পরিচালক ও রাজনীতিবিদ কসিমো ডি মেডিচি শিল্পকলায় উৎসাহদানের নতুন মানদণ্ড স্থির করেন। এই মানদণ্ড চার্চ বা রাজতন্ত্র থেকে মুক্ত ছিল। কসিমো ডি মেডিচি তার বিপুল ধনসম্পদ যেমন ফ্লোরেন্সিয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার উন্নয়নে ব্যবহার করেন, একইভাবে বক্তা, কবি, দার্শনিকদের উদ্দেশ্যে,[৩] ও বেশ কয়েকটি শৈল্পিক সম্পাদনের জন্যও তিনি মূলধন যোগান দেন। [৪]
মানবতাবাদী দর্শনের ফলে মানবসমাজের সঙ্গে মনুষ্যত্ব, মহাবিশ্ব ও ভগবানের সম্পর্কের উপর গির্জার আর একচেটিয়া অধিকার রইল না।
গ্রীক ত্ত ল্যাটিন ভাষার রচনার প্রতি একটি পুনরুজ্জীবিত আগ্রহ গড়ে ওঠায় স্থপতি ব্রুনেলেস্কি ও ভাস্কর ডোনাটেলোর নেতৃত্বে রোমান সাম্রাজ্যের ভগ্নাবশেষের প্রত্নতাত্ত্বিক অধ্যয়ন শুরু হয়। শাস্ত্রীয় উদাহরণের উপর ভিত্তি করে স্থাপত্যশিল্পের একটি নির্মাণকৌশলের পুনঃপ্রচলন হওয়ার দরুন চিত্রাঙ্কন ও ভাস্কর্যে গ্রিক ও ল্যাটিন উদাহরণের অনুকরণ শুরু হয়, যা ১৪২০ তেই মাসাচ্চিও ও উচ্চেলো-র চিত্রাঙ্কনে প্রতিভাত হয়।
উন্নত তেল রং এর উৎপাদন এবং ইয়ান ভন আইক, রোখইয়ের ভন দ্যর ওইদেন ও হিউগো ভন দ্যর খুস প্রমুখ ডাচ শিল্পীর অধিনায়কত্বে তৈল চিত্রের কলাকৌশলের বিকাশ হয় ও তা ইতালিতে ১৪৭৫ এর কাছাকাছি সময়ে গৃহীত হয় এবং শেষপর্যন্ত পৃথিবীব্যাপী চিত্রাঙ্কণ পদ্ধতির উপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে।
১৫শ শতকে ফ্লোরেন্স ভূখণ্ডের মধ্যেই শৈল্পিক প্রতিভাবান ব্যক্তিগণ যেমন মাসাচ্চিও, ব্রুনেলেস্কি, গিবারটি, পিয়েরো ডেলা ফ্রান্সেসকা, ডোনাটেল্লো, ও মাইকেলোতসো প্রমুখের লাভজনক উপস্থিতি একটি বিশেষ ইথস বা মেজাজের জন্ম দেয় যার থেকে আবির্ভুত হন হাই-রেনেসাঁ বা অন্তিম পর্যায়ের রেনেসাঁর মহান ব্যক্তিত্বগণ, আবার একই মেজাজ অনেক মাঝারি মানের শিল্পীদেরও অসাধারণ শিল্পকর্ম তৈরিতে উৎসাহিত করে। [৫]
একই রকমের বংশপারম্পরিক শিল্পকর্ম সৃষ্টি হয় ভেনিসের মেধাবী বেলিনি পরিবারে, তাদের প্রভাবশালী আত্মীয় ম্যান্টেগ্না, জরজনে, টিশান, ও তিন্তরেত্তো প্রমুখের দ্বারা। [৫][৬][৭] লেওন বাতিস্তা আল্বারতি দুটি নিবন্ধের প্রকাশ করেন, 'ডি পিকচুরা' ('অঙ্কন সম্বন্ধে'), ১৪৩৫, এবং দে রে এদিফিকাতোরিয়া ('নির্মাণ কৌশল শিল্প সম্বন্ধে'), ১৪৫২।
তথ্য সংগ্রহেঃ