12/11/2024
অশোক মহান: একটি সাম্রাজ্য, একটি ধর্ম, এবং এক মহান শাসকের জীবন ও কীর্তি
অশোক মহান (প্রায় ২৬৮–২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), ভারতের মৌর্য সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট, ছিলেন এক যুগান্তকারী শাসক যিনি তার শাসন ব্যবস্থায় সামাজিক, ধর্মীয় এবং মানবিক পরিবর্তন এনেছিলেন। অশোকের জীবন ও শাসনামল ভারতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এবং মানবজাতির জন্য সহিষ্ণুতা, ধর্মীয় সমন্বয়, এবং অহিংসার অনুপ্রেরণা হিসেবে বিবেচিত। অশোকের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড তাকে শুধু ভারত নয়, সমগ্র বিশ্বে একজন মহান নেতায় পরিণত করেছে।
পারিবারিক পটভূমি ও শৈশব
অশোক চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পৌত্র এবং বিন্দুসারের পুত্র ছিলেন। তার শৈশবকাল এবং শিক্ষাজীবন সম্পর্কে অনেক কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। যদিও তাকে কঠোর সামরিক প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল, তার শৈশব থেকেই বুদ্ধিমত্তা এবং সাহসের জন্য পরিচিত ছিলেন। অশোকের শৈশবকালে রাজপরিবারের প্রতিযোগিতা এবং ক্ষমতার লড়াই তার ব্যক্তিত্বে গভীর প্রভাব ফেলে।
কলিঙ্গ যুদ্ধ ও মানবিক বিপর্যয়
অশোকের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী ঘটনা ছিল কলিঙ্গ যুদ্ধ (খ্রিস্টপূর্ব ২৬১)। এটি তার সাম্রাজ্যের বিস্তারের জন্য সংঘটিত একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ। কলিঙ্গ, যা আজকের ওড়িশা রাজ্যে অবস্থিত, তখনও একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। অশোকের সামরিক বাহিনী অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল এবং যুদ্ধের ফলে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। ঐতিহাসিকদের মতে, এই যুদ্ধের পরবর্তী ধ্বংসযজ্ঞ এবং মানুষের দুর্দশা দেখে অশোক মানসিকভাবে প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত হন।
কলিঙ্গ যুদ্ধ পরবর্তী মর্মান্তিক দৃশ্য তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ঐতিহাসিক রোমিলা থাপার উল্লেখ করেছেন, “কলিঙ্গ যুদ্ধের পরে অশোকের মধ্যে এক অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন ঘটে যা তাকে ধর্ম, সহানুভূতি এবং মানবতার প্রতি এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে।” এই পরিবর্তনের প্রভাবে অশোক বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অহিংসা ও দয়ার নীতি প্রয়োগ করেন।
বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা ও ধর্মপ্রচারে অশোকের উদ্যোগ
কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোক বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং বৌদ্ধ মঠে গিয়ে দীক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি জীবনের শেষ পর্যন্ত বৌদ্ধধর্মের অনুশীলন ও প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। বৌদ্ধ ধর্মের মূলনীতি ছিল অহিংসা, করুণা, এবং মানুষের প্রতি সহানুভূতি। অশোক নিজেকে দায়িত্বশীল শাসক হিসেবে গণ্য করতেন এবং এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে মনোনিবেশ করেন।
বৌদ্ধ ধর্মপ্রচার প্রসারে অশোকের ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। তিনি শুধু ভারতবর্ষেই নয়, বরং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা এবং অন্যান্য অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটান। তার পুত্র মহেন্দ্র এবং কন্যা সংঘমিত্রাকে শ্রীলঙ্কায় পাঠিয়ে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেন। ঐতিহাসিক এ.এল. বাশাম এই প্রচারাভিযানকে ‘ভারতীয় ধর্মীয় ইতিহাসের অন্যতম বড় সাফল্য’ বলে অভিহিত করেছেন।
অশোকের শাসননীতি: ‘ধম্ম’ বা ধর্মের প্রচার
অশোকের শাসননীতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ধম্ম বা ধর্মের প্রচার, যা মূলত বৌদ্ধ নীতি দ্বারা প্রভাবিত ছিল। অশোক তার শাসনব্যবস্থায় ধম্মকে একটি সামাজিক নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। এই নীতিতে সহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সামাজিক শান্তি, এবং মানুষের প্রতি দয়া ও সহানুভূতির কথা উল্লেখ ছিল। অশোক তার শাসনকালে বিভিন্ন শিলালিপি ও স্তম্ভ স্থাপন করেন, যেখানে তার ধম্ম নীতির ব্যাখ্যা দেওয়া আছে।
শিলালিপি ও স্তম্ভ: অশোকের নীতি এবং নির্দেশনা
অশোক তার শাসনকালে বিভিন্ন স্থানে শিলালিপি ও স্তম্ভ স্থাপন করেন, যেখানে তার ধম্ম নীতির ব্যাখ্যা এবং মানুষের প্রতি তার দায়িত্ববোধের প্রতিফলন রয়েছে। এই স্তম্ভ ও শিলালিপিগুলি ভারতের প্রাচীন ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে বিবেচিত এবং অশোকের চিন্তা-চেতনার অন্যতম প্রধান প্রমাণ।
অশোক স্তম্ভের শিলালিপির অংশবিশেষ: “মানুষের প্রতি সহানুভূতি, বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি সম্মান এবং সকল জীবের প্রতি করুণাই হল শ্রেষ্ঠ ধর্ম।” ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট এ. স্মিথের মতে, “অশোকের শিলালিপিগুলি তার শাসন ব্যবস্থার আদর্শ এবং তার মানবিক মূল্যবোধের একটি স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।”
সামাজিক কল্যাণমূলক কাজ
অশোক বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় কল্যাণমূলক কাজ পরিচালনা করেন। তিনি বিভিন্ন স্থানে হাসপাতাল, স্কুল এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেন। অশোকের শাসনকালে রাস্তা নির্মাণ, বৃক্ষরোপণ এবং বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা হয়। তিনি স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের সুবিধার জন্য নানান প্রকল্প শুরু করেন।
ঐতিহাসিক রাধাকুমুদ মুখার্জি উল্লেখ করেছেন, “অশোক ছিলেন এমন একজন শাসক, যিনি সাম্রাজ্যের জনগণের কল্যাণে নিবেদিত ছিলেন। তার শাসনকালে মানুষ সামাজিক এবং ধর্মীয় ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও সুরক্ষা পায়।”
ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং সমন্বয়
অশোকের শাসনকালের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্মীয় সহিষ্ণুতা। তিনি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও অন্যান্য ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তার শিলালিপিতে বিভিন্ন ধর্ম এবং সম্প্রদায়ের প্রতি সহিষ্ণুতা প্রদর্শনের কথা উল্লেখ আছে। অশোক বিশ্বাস করতেন, প্রকৃত ধর্ম হল একে অপরের প্রতি সহানুভূতি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন।
অশোকের আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং ধর্মপ্রচারের উদ্যোগ
অশোক কেবল ভারতেই নয়, বরং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং মিশরেও তার ধম্ম প্রচার এবং শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেন। তিনি বিভিন্ন দেশে ধর্মীয় কূটনীতি প্রতিষ্ঠা করেন এবং বৌদ্ধধর্ম প্রচারে বিভিন্ন মিশনারি পাঠান। অশোকের এই উদ্যোগ তাকে বিশ্ব ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান প্রদান করেছে।
উপসংহার: অশোকের প্রভাব এবং উত্তরাধিকার
অশোক মহান একজন যুগান্তকারী শাসক ছিলেন, যিনি শুধু একজন শাসকই নন, বরং মানবতার প্রতি দায়িত্বশীলতার এক উজ্জ্বল প্রতীক হয়ে ওঠেন। কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোক যে ধর্মীয় ও সামাজিক নীতিগুলি গ্রহণ করেন, সেগুলি মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে রয়ে গেছে। তাঁর শাসনকালের আদর্শ, মানবিক মূল্যবোধ এবং শান্তির নীতিগুলি আজও অনুপ্রেরণা হিসেবে বিবেচিত।
রেফারেন্স
Thapar, Romila. Ashoka and the Decline of the Mauryas, Oxford University Press, 1961.
Basham, A. L. The Wonder That Was India, Macmillan, 1954.
Mukherjee, Radha Kumud. Asoka, Motilal Banarsidass, 1962.
Smith, Vincent A. The Early History of India, Oxford: Clarendon Press, 1904.
Sharma, R. S. India's Ancient Past, Oxford University Press, 2005.