15/06/2022
স্বপ্নের পদ্মা সেতু
অনেককে বলতে শোনা যায় যে পদ্মা সেতু নিয়ে এতো মাতামাতির কি আছে, এমন সেতু কি দুনিয়ায় এর আগে হয় নাই নাকি? তাদের কৌতূহলের জবাব হচ্ছে, হ্যা, পদ্মা সেতুর মত কিছু আসলেই দুনিয়ায় এর আগে তৈরি হয় নাই। তিনটা প্রধান বিশ্বরেকর্ড হয়েছে এই সেতু করতে গিয়ে, যেগুলো হচ্ছেঃ
রেকর্ড নম্বর ১ঃ
৪০ তলা দালানের সমান পাইলিং করতে হয়েছে সেতুর জন্য, যা করতে বানিয়ে আনতে হয়েছে একেবারেই নতুন যন্ত্র। পদ্মার গড় গভীরতা ৪০ মিটার, অর্থাৎ পানির ৪০ মিটার নিচে নদীর তলদেশ। মিটার কিন্তু। ফিট না। চল্লিশ মিটার মানে ১৩১ ফিট প্রায়। সাধারণত প্রতি তলার উচ্চতা হয় দশ ফিট করে। সেই হিসাবে, পদ্মা নদীর তলদেশ থেকে পানির পৃষ্ঠের হাইট হল ১৩ তলা বিল্ডিং এর সমান। তাহলে ব্রিজের কলামগুলো (যেগুলোকে আসলে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ভাষায় পিয়ার বলে ) ১৩ তলা বিল্ডিং এর সমান হতে হবে। কিন্তু কলাম যদি মাটিতে গাঁথা না থাকে, পদ্মার যে স্রোত, কলাম তো ভেসে চলে যাবে। কি মনে হয়, ১৩ তলার সমান লম্বা কলাম ভেসে যাবে না? যাবে ভাই। এটা পদ্মা।
তো কলাম মাটিতে গেঁথে দিতে হবে। কতটুকু গাঁথবেন? পদ্মার তলদেশের মাটি হল বালি টাইপের, নরম কাদা টাইপ। পাথরের মত শক্ত না। বেডরক প্রায় ৮ কিমি নিচে বলে ধারনা করা হয়। ৮ কিমি হল মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা! তো বেডরক পর্যন্ত যাওয়ার স্বপ্ন না দেখাই ভাল। অনেক দেশেই বেডরক অনেক অল্প নিচেই পাওয়া যায়। তাদের দেশে যে কোন সেতু বা স্ট্রাকচার বানানো অনেক কম খরচের ব্যাপার কারণ তাদের ফাউন্ডেশন বানানো অনেক সহজ, বেশি গভীরে যেতে হয় না বলে খরচও কম। কিন্তু আমাদের এদিক দিয়ে কপাল খারাপ।
.
যাইহোক, তাহলে পদ্মা নদীর ব্রিজের পাইল কতটুকু দিতে হবে?
বর্ষাকালে যখন অতিরিক্ত স্রোত থাকে, এই পদ্মার তলদেশের বালির মতন মাটি, ধুয়ে চলে যায়। এটাকে scour হওয়া বলে। পদ্মা নদীর scour হওয়ার সর্বোচ্চ রেকর্ড হল ৬৫ মিটার (প্রায়)(বা ৬১ মিটার)। মানে কোন কোন মৌসুমে স্রোতের তীব্রতায় নদীর নিচ থেকে ৬৫ মিটার উঁচু মাটি ধুয়ে চলে যায়। মানে ২১৩ ফিট। মানে ২১ তলা বিল্ডিং এর সমান হাইটের মাটি ধুয়ে চলে যায়। পদ্মার এই প্রায় ২১ তলার সমান মাটি ধুয়ে চলে যাবার রেকর্ড বা এত বেশি পরিমাণ সেডিমেন্ট (মাটির কণা) ট্রান্সপোর্ট করার রেকর্ড অন্য কোন নদীর নেই। এ অবস্থায় পানির নিচে মাটি পেতে হলে আপনাকে নিচে নামতে হবে কমপক্ষে ১৩+২১=৩৪ তলা!
তাহলে আপনাকে ব্রিজের যে কলামগুলো দিতে হবে, সেগুলোকে ৪০+৬৫=১০৫ মিটারের বেশি লম্বা হতে হবে! মানে ৩৪ তলা বিল্ডিং এর চেয়ে লম্বা কলাম!
এখন, নদীর কোন জায়গায় scour বেশি হয়, কোথাও কম হয়। আপনি ঠিক সিওর না, কোথায় কতটুকু scour হয়ে আপনার সাধের পদ্মা ব্রিজের কলাম বের হয়ে যাবে (exposed হবে), মাটিতে গেঁথে থাকবে না, ফলাফল হিসেবে আপনার এত সাধের লম্বা কলামটা ভেসে যাবে! এতো কষ্ট করে বানানো পদ্মা সেতু কলাপস করবে।
এজন্য মোটামুটি এভারেজ ১২০ থেকে ১২৮ মিটার পাইল দেয়া হয়েছে। ১২০ মিটার মানে প্রায় একটা ৪০ তলা বিল্ডিং! এই ৪০-৪২ তলা বিল্ডিং এর সমান লম্বা পাইল, বসানো হয়েছে। যেটা সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে রীতিমত অবিশ্বাস্য।
রেকর্ড নম্বর ২ঃ
পিলার এবং স্প্যানের মাঝে যে বেয়ারিং থাকে, যেটা মূলত ভারসাম্য রক্ষায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, পদ্মায় সেই বেয়ারিং-এর সহনক্ষমতা সর্বোচ্চ। ১০ হাজার ৫০০ টন সহনশীল বেয়ারিং বসানো হয়েছে, যা এই প্রথম। সানফ্রানসিস্কোর গোল্ডেন গেট ব্রিজের জন্য ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার টন সহনশীল বেয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছিল। পদ্মায় ১০ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ওজনের একেকটি বেয়ারিং ব্যবহৃত হয়েছে। পৃথিবীতে এর আগে এমন বড় বেয়ারিং ব্যবহার করা হয়নি কোনো সেতুতে।
পদ্মা সেতুর নদীর অংশ ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। এই অংশগুলোকে ৪০টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রতি ভাগের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। মানে, বলা যায় বাটা সিগনাল থেকে কাঁটাবন মোড় পর্যন্ত, দুইটা স্প্যানের দৈর্ঘ্য। ৪১টি পিলারকে ৪০টি স্প্যান দিয়ে জোড়া দিয়েই পদ্মা সেতু। স্প্যানগুলো হচ্ছে ভারী স্টিলের কাঠামো, যা দ্বিতলবিশিষ্ট। এর ভেতর দিয়ে যাবে ট্রেন। আর ওপরে কংক্রিটের স্ল্যাব জোড়া দিয়ে করা হয়েছে যানবাহন চলাচলের পথ। দুটি পিলারের মধ্যে একটি স্প্যান বসানো হয়েছে। এই নদীর অংশের বাইরে দুই পাড়ে ডাঙাতেও সেতুর অংশ থাকবে। এটাকে বলা হয় ভায়াডাক্ট। এর দৈর্ঘ্যও প্রায় ৪ কিলোমিটার। এটাতে আর স্টিলের স্প্যান বসবে না। এই অংশে যানবাহন চলার পথ হবে সাধারণ উড়ালসড়কের মতো। আর রেলের অংশ হবে সাধারণ রেলসেতুর মতো। নদী ও ডাঙার অংশ মিলিয়ে প্রায় ৯ কিলোমিটার অংশকে বলা হচ্ছে মূল সেতু। মূল সেতুতে পিলার হবে ১১৮টি। এর মধ্যে নদীতে হবে ৪২টি, ডাঙায় ৭৬টি।
রেকর্ড নম্বর ৩ঃ
প্রমত্তা পদ্মার ভাঙ্গন থেকে সেতুকে রক্ষা করতে এবং নদী শাসনে এখানে দুই দিকে ১২ কিলোমিটার নদী শাসনের যে কাজটি আছে, সেটি সিঙ্গেল কন্ট্রাক্টে বিশ্বে সর্বোচ্চ। একচুয়ালি সব মিলিয়ে ১৪ কিলোমিটার (১.৬ মাওয়া+১২.৪ জাজিরা) এলাকা নদী শাসনের আওতায় আনা হয়েছে। এই নদী শাসনে খরচ হয়েছে ৯ হাজার ৪০০ কোটি টাকারও বেশি। এই নদী শাসন কার্যক্রমে নদীর তলদেশ খনন, ব্লক ও জিও ব্যাগ ফেলা ও পাড় বাঁধাইয়ের কাজ রয়েছে। এই কাজে ১ কোটি ৩৩ লাখ কংক্রিটের ব্লক ও ২ কোটির বেশি বালুভর্তি জিও ব্যাগ ব্যবহার হয়েছে। নদীশাসন ব্যাপারটি খুবই দুরূহ। কারণ নদীতে স্কাওয়ার (মাটি ধুয়ে যাওয়া) এত গভীরে যেতে পারে যে হয়তো ওপরের দিকে কিছু প্রটেকশন দেয়া হল। দেখা গেল নিচ থেকে মাটি ধুয়ে চলে গেছে। তখন উপর থেকে পাড় ভেঙে পড়ে যাবে। কারণ নিচে কোন সাপোর্ট নেই, সাপোর্টের মাটি ধুয়ে চলে গেছে পুরোটাই। এজন্য অনেক নিচে থেকে পাথর, কংক্রিট ব্লক আর কিছুটা নতুন প্রযুক্তির জিও টেক্সটাইল ব্যাগ ব্যবহার করা হয়েছে। তবে পদ্মার মত একটা রাক্ষুসী নদী যে কিনা ৬৫ মিটার scour করে ফেলে, তাকে কতটা শাসন করা যায় এ ব্যাপারে আশংকা রয়েই যায়, সুতরাং এই নদী শাসনের কাজটা চালিয়ে যেতে হবে বছরের পর বছর।
রেকর্ড নম্বর ৪ঃ
প্রতি সেকেন্ডে দেড় লাখ কিউবিক মিটার পানি প্রবাহিত হবে। এ ধরনের পানিপ্রবাহ একমাত্র আমাজান নদীতে দেখা যায়। ওই নদীর ওপরে কোনো সেতু নেই। এ ধরনের শক্তিশালী নদীর ওপরে পদ্মা–ই হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম সেতু।
রেকর্ড নম্বর ৫ঃ
পদ্মা সেতু প্রকল্পের ২৯৮টি পাইল ড্রাইভ করার জন্য মোট ৩টি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন হাইড্রোলিক হ্যামার (আইএইচসি ৩০০) হ্যামার আনা হয় জার্মানি থেকে। যাদের ক্ষমতা ছিল ১৯০০ কিলোজুল, ২৪০০ কিলোজুল, ৩৫০০ কিলোজুল। এরমধ্যে ৩৫০০ কিলোজুল হ্যামারটি ছিল বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী হ্যামার।
সুতরাং পৃথিবীর সেতু এবং স্ট্রাকচারাল ডিজাইনের ফিল্ডে পদ্মা সড়ক ও রেল সেতু প্রথমবারের মত তৈরি হওয়া এক ইতিহাস, গর্ব আর আভিজাত্যে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটা জাতির পরিচয় নতুন করে চেনানো মহীরূহ!
তথ্য সূত্রঃ রাতিন রহমান