09/07/2024
New Novel By Gazi Saiful Islam
মানব স্বপ্নের নীল নয়না পৃষ্ঠাগুলো
জালাল উদ্দিন আহমেদ রাজা নিজেকে জালাল রাজা নামে পরিচয় দিয়ে গর্ববোধ করতেন। পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক। অবিবাহিত অস্থির তরুণ। মাঝখানে সামান্য বাঁকা হ্যাংলা-পাতলা গড়নের-বাংলাদেশের গড় পড়তা উচ্চতায় তাকে লম্বা বলাই যায়। হাঁটার সময় কিছুটা সামনের হেলে হাঁটে। মাথা-মুখের গড়ন শরীরের সঙ্গে মানানসই। মুখে সবসময় হাসি লেগে না থাকলেও বেজার মনে হয় না কখনও। মার্জিত রুচি, কথা বলায় হেসেবি। অপ্রয়োজনীয় কথা তার কাছে পাত্তা পায় না। খেলাধুলা-সাংস্কৃতি কর্মকাণ্ডে উৎসাহী ও ক্লান্তিহীন। ভালো শ্রোতা, বলাতেও দক্ষ। ক্লাসে পড়ানোর স্টাইল, কথা বলার ধরন, চাল-চলন সবার থেকে আলাদা। তার নিরহঙ্কারী আচরণ সবাইকে তার দিকে টানে। জগতের প্রতিটি বস্তুর প্রতি নিজে অদৃশ্য বন্ধন সে অনুভব করে। মাঝে-মধ্যে সে ভারি অদ্ভূত একটি স্বপ্ন দেখে। একদিন স্বপ্নে দেখল: একটি ক্ষুধার্ত কুকুরকে সে একটি রুটি দিতে চেষ্টা করছে কিন্তু কুকুরটি কিছুতেই তাকে বিশ্বাস করছে না। তার হাতে রুটি দেখার পরও। রুটি হাতে ধরে কুকুরের পেছনে পেছনে অনেকটা পথ যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কুকুরটি দাঁড়ালোই না। এতে তার মন খারাপ হলো। তখন তার স্বপ্ন ভেঙে যায়। আরেকদিন তার মনে হলো, সামনের কুকুরটি ক্ষুধার্ত। সে তাকে আতু আতু বলে ডাকে। এবং খাবার দেওয়ার ইঙ্গিত করে। এতে কুকুরটি ওই জায়গাতে বসে পড়ে। কিন্তু তার কাছে তখন কোনো খাবার নেই। সে দৌড়ে ঘরে যায়, কয়েকটি বিস্কুট নিয়ে আসে। এসে দেখে তখনও কুকুরটি ওইখানে ওইভাবে বসে অপেক্ষা করছে। বিস্কুট খেয়ে এরপর যেদিকে সেটি যেতে চেয়েছিল সেইদিকে চলে যায়।
জালালের এ দু’টি স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে খুব ইচ্ছে করত। সে জানে স্বপ্নে ব্যাপারগুলো ভারি রহস্যপূর্ণ। স্বপ্নের ব্যাখায় নানা মুনির নানা মত। সকল ধর্মেই স্বপ্ন নিয়ে কম বেশি কথা আছে। পৃথিবীর সবেচেয়ে আলোচিত স্বপ্ন হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর স্বপ্ন। স্বপ্নে আদিষ্ঠ হয়ে তিনি প্রাণ প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইলকে কুরবাণী করতে গিয়েছিলেন। পরে তার স্থলে একটি দুম্বা কোরবাণী হয়। এ স্বপ্নের কথা তৌরাত(Judaism), ইঞ্জিল(Khristianity) ও কোরানে(Islsm) আছে। মুসলমানরা ঈদ-উল-আজহায় যে কোরবাণী করে এটা মূলত হযরত ইব্রাহিম (আ.)এর সন্নাহ। মুসলমানরা বিশ্বাস করে, হযরত ইব্রাহিমই প্রথম ব্যক্তি যিনি মুর্তি পুজারি ছিলেন না। দুনিয়ার প্রথম প্রার্থনার ঘর (First house of worship on Earth)কাবা বা মক্কা শরীফ হযরত ইব্রাহিম (আ.) আর পুত্র ইসমাইল (আ.) তৈরি করেছিলেন। এর পরে স্বপ্নের বিখ্যাত ব্যাখ্যাকার হিসেবে আলোড়ন সৃষ্টি করেন-হযরত ইউসুফ (আ.) হযরত ইব্রাহিমেরই (আ.) বংশধর। বলা হয়ে থাকে: স্বয়ং ঈশ্বরই তাকে স্বপ্ন ব্যাখ্যা শিখিয়েছিলেন। এই গ্রন্থে যথাস্থানে তাঁর স্বপ্নের কথা জানানো হবে।
এর পরে একদিন জালাল স্বপ্ন দেখল: গভীর রাতে মধ্যমাঠ বুকের ওপর দিয়ে বয়ে চলা পাকা সড়কের ওপর সে দাঁড়িয়ে পূর্ব দিকের আশি বিলের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশে গোলকার সুন্দর চাঁদ। চারপাশে হালকা কালো মেঘ। চাঁদের আলোয় চারপাশের সবুজ মাঠে এ ধরনের আধ্যাত্ম সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়েছে। হঠাৎ তার মনে হয়, চাঁদটা তার দিকে নেমে আসছে। হ্যাঁ, আসছেই তো। দূরের আকাশ থেকে দ্রæত আর সোজা সেটি তাঁর দিকে নেমে আসতেছে। কাছাকাছি এসে গতি কমাতে থাকে। এবং খুব কাছে এসে হয়ে স্থির হয়ে যায়। সে হাত বাড়ায়। একটা আলোর প্রজাপতির মতন তার হাতে এসে বসে এবং পরক্ষণেই আবার আকাশের দিকে উড়াল দেয়। এবং দেখতে দেখতে তার নিজের জায়গায় ফিরে যায়। নিজের জায়গায় বসে সে আবার তার দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে। জালাল খুশিতে তার ফ্লায়িং চুমু পাঠায়। মনে মনে বলে: “অদ্ভূত, অদ্ভূত সুন্দর তুমি! তোমার সঙ্গে কথা বলার ভাষা আমি হারিয়ে ফেলেছি।” তখনই ঘুম ভেঙে যায় তার। সে উঠে বসে ডায়েরিতে লিখতে শুরু করে। এটাই তার প্রথম স্বপ্ন যা সে লিপিবদ্ধ করেছিল এলাকা ছাড়ার আগে।
ডায়েরিতে কিছু বিশ্লেষণ: এ স্বপ্নের আড়ালে কী আছে? আমি কি আমার প্রিয় কাক্সিক্ষত মানুষটির দেখা পেতে যাচ্ছি? কিন্তু সে কে, কোথায় আছে? তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে? নাকি আমার অবস্থাও কি মান্না দে’র মত হয়েছে। তাঁর গানে আছে।
“চাঁদ দেখতে গিয়ে আমি তোমায় দেখে ফেলেছি
কোন জোছনায় আলো বেশি এই দোটানায় পড়েছি।”
আসলেই তো মানব জোছনার আলো বেশি না-কি চাঁদের জোছনার আলো বেশি? ফেসবুকে আমার কত বন্ধু কত বান্ধবী। তারা তো শুধই ভার্চুয়াল। তারা না নেয় দুঃখের ভাগ না দেয় সুখের লগন। গ্যাব্রিয়েল গর্সিয়া মার্কেজ তার ছেলের ফেসবুকে পাঁচ হাজার বন্ধুর কথা শুনে হেসে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন: “যার পাঁচ হাজার বন্ধু তার আসলে কোনো বন্ধুই নেই।” ফেসবুকের বন্ধুরা আসেল তাই। ফেসবুকে তাহলে আমরা কীসের লেনাদেনা করি? কীসের হাটবাজার করি? হ্যাঁ, বহু সফলতার গল্পও রয়েছে ফেসবুক প্রেমের। সেদিন দেখলাম: এক মহিলা তার দেহের অর্ধেক দেহের, কম বয়সের একটি অটোস্টিক ছেলের প্রেমে পড়ে স্বামী ও সন্তানকে ছেড়ে এসেছে। মহিলার পরিবারের লোকদের তীব্র আপত্তি সত্তে¡ও সে ওই অর্ধেক ছেলেকেই বিয়ে করেছে। এখনও সংসার করছে। পেটে নাকি সন্তানও এসেছে। ওই অর্ধেক দেহের ছেলেটির সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছে মহিলা। সাক্ষাৎকারে মহিলার মধ্যে কোনো অনুশোচনা দেখা যায়নি। তাহলে প্রশ্ন কি জাগে না, এই প্রেমের কী রহস্য? আগের স্বামীর কী ছিল না আর এর মধ্যে কী আছে? আমি যদি কোনোদিন জানতে পারি-হয়ত প্রেমের গোপন রসায়নটা আবিষ্কার করতে পারব।
স্বপ্নে হাতে চাঁদ পাওয়ার একটি ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে: প্রিয়জনের সঙ্গে মিলনের পূর্বাভাসের মিথরূপ এটি। কিন্তু আমার তো এমন কোনো প্রিয়জন নেই। একজন আছেন আমার মা’ আমি তো সঙ্গেই আছি। আরেকজন ফেসবুক ‘বান্ধবী’। আমি তাকে প্রায়শই ‘দূর দ্বীপবাসিনী’ বলে ডাকি। সে হাসে। প্রশ্ন করে না। নাকি প্রশ্ন করতেই জানে না। হ্যাঁ, আমার কাছে ‘ফেসবুক’ দূরের দ্বীপই। যদি দু’জনের একজন টিএসসির সড়ক দ্বীপের এপাশে আরেকজন অপরপাশে থাকে-মনের ওই রকম জোর না থাকলে এতটুকু দূরত্বও অতিক্রম করা যায় না। আবার একজন আমেরিকা আর একজন বাংলাদেশে। কথা মুহূর্তেই চলে যাচ্ছে। এ দূরত্ব হয়তো অনতিক্রম্য। কিন্তু মনের জোর দিয়ে কাছে অনুভব করা যায়। তবু ফেসবুকের ‘বন্ধু’কে যাঁচাই করা কঠিন।
কবিরা মনে হয়, দু’টি দিকই সমানভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম। ব্যর্থতা থেকে যে হতাশার উৎপত্তি হয় সেটি। বিপরীতক্রমে, দুর্লভ ধরনের প্রাপ্তিতে তার ভেতর যখন কানায় কানায় ভরে উঠে সেই আনন্দের প্রকাশ। কেউ কেউ চাঁদকে উপমা করেন। চাঁদের মিথে আশ্রয় খুঁজেন। বেশিরভাগই গান কবিতাতেই ব্যর্থতার বয়ান। সফলতার কথা কমই দেখা যায়। বাংলাদেশের গীতি কবি ‘ইমতিয়াজ বুলবুল’ মনে হয় চাঁদ মুখটি ঘরে এনে গ্রহণ লাগার ভয়ে ছিলেন:
ঐ চাঁদ মুখে যেন লাগে না গ্রহণ
জোছনায় ভরে থাক সারাটি জীবন \
হাজার বছর বেঁচে থাক তুমি
বুকে নিয়ে স্বর্গের সুখ
দুঃখ ব্যথা সব ভুলে যাই যে
দেখলে তোমার ঐ মুখ।
ফুলও তুমি ফাগুনও তুমি
গন্ধ বিলাও সারাক্ষণ \...
চাঁদের তিথিরে বরণ করতে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আমাদের নিয়ে যান প্রেমের আরেক মোহময় জগতে। তার কণ্ঠ, গায়কি মন্ত্রমুগ্ধ করে আমাদের। আসলে এগুলো মানব রহস্যের এক ধরনের সত্যেও প্রকাশ। এইসব আবেগিক সত্যকে অস্বীকার করা নিজেকে বঞ্চিত করার সামিল। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে তাই আমিও গাইতে থাকি:
ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা এই মাধবী রাত
আসেনি তো বুঝি আর, জীবনে আমার।
এই চাঁদের তিথিরে বরণ করি
এই চাঁদের তিথিরে বরণ করি
ওগো মায়াভরা চাঁদ আর, ওগো মায়াবিনি রাত
বাতাসের সুরে শুনেছি বাঁশি তার
ফুলে ফুলে ঐ ছড়ানো যে হাসি তার...
আসলে ভালোবাসা পেলে, কিংবা না পেলেও হৃদয়ের গহনে তার গভীর উপস্থিতি থাকলে কবিতা আসে, গান আসে। এগুলোও স্বর্গীয় বিষয়, কারণ এগুলো মানুষের মিলনের কথা শোনায়, দুঃখ বাড়িয়েও দুঃখ ভোলায়। গান, ক্ষেত্র বিশেষ কবিতাও ইসলাম গ্রহণ করে না। কারণ এগুলো জাগতিক আবেগকে বাড়িয়ে দেয়। আল্লাহকে ভুলিয়ে দেয়। এটাও সত্য, আল্লাহ মানুষ সৃষ্টিই করেছেন সত্ত¡, আমিত্ব, জাগতিক মোহ মায়ার বাঁধোন ছিড়ে তাঁর দিকে ফিরে তাকানোর জন্য। কেবল তারই গুণগান করার জন্য। এমন খালি নিজেরটা বোঝার জন্য আল্লাহকে আপাত দৃষ্টিতে কিছুটা ‘স্বার্থপর’ মনে হয় বৈকি। কিন্তু তুমি যদি ওই গভীরতায় বিশ্বাস স্থাপন করো, যদি পরের জীবনের সুখে বিশ্বাস করো, তাহলে তো তোমাকে স্থির করতেই হবে তুমি কোনদিকে যাবে। আল কোরান যে জীবনের বিধান দিয়ে, এদিকে বৈশ্বিক জীবন আরেকদিকে পরলৌকিক জীবনে চিত্র আমাদেও সামনে রেখেছেন সেখান থেকে বাছাই করতে গিয়ে কে কোনটি বেছে নেবেন সেটা একান্তই তার ব্যাপার। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে পরলৌকিক জীবনের দিকে টান বেশি অনুভব করি। হতে পারে এটাও আমার এক ধরনের দুর্বলতা। হতে পারে, জাগতিক জীবনে যতটা সফল আমার হওয়ার কথা না হওয়ার পেছনে এটাও একটা কারণ। ওই ছোট বেলায় শোনা আরেকটা গান আছে: “আমি চাই না মাগো রাজা হতে।” সত্যি জগতে অনেক মানুষ আছে রাজা হতে চায় না। কায়ক্লেসে জীবন কাটিয়ে দিতে চায়। তারাই মনে হয় ভালো করেন। শেখ দয়ালে কবিতায় পড়েছিলাম:
নীলাকাশটি যখন ঢাকা পড়ে কালো মেঘে
ভেবো না দেখতে পাই না চাঁদ ও তারাদের মুখ
এমন আমার দৃষ্টির বাইরে যত দূরে তুমি রও
তোমার নামটি জপে আমি পাই আশিকের সুখ।”
আল্লাহর যেহেতু কায়া নেই, তাঁকে ধরতে হয় মায়া দিয়ে। তাই লোকেরা বলে: মায়ার সংসার। অস্পষ্ট একটা বাঁধন। আসলে সংসারের সকল বাঁধনই অস্পষ্ট, আধ্যাত্ম। বেশি স্পষ্ট করতে গেলে-থাকত না। কারণ ওর ভেতরে কোনো সুতো নেই। পাশ্চাত্যের সংসারের বাঁধোন অনেক ঠুকনো। যখন তখন ভেঙে যেতে পারে। যে যার মতন যেদিকে ইচ্ছে হেঁটে যেতে পারে। ভোগবাদী সমাজে আপাতত এটাকে মিষ্টি মনে হয় কিন্তু জীবন শেষে পরিণতি শুভ নয়। রাষ্ট্রগুলোর সামাজিক ভিত্তি কল্যাণরাষ্ট্র ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে সেটা ধরা পড়ে না-মানুষের জীবন কোনো পর্যায়ে ঠেকে না।
আগে থেকেই জালাল জানত-স্বপ্নে হাতে চাঁদ পাওয়ার অনেক অর্থ হতে পারে। স্বপ্নে চাঁদ হাতে পাওয়ার মানে শুভ কিছু। বিশ্বখ্যাত ইসলামিক স্বপ্ন ব্যাখ্যাকারী ইবনে সিরিন(আ.) এর মত এটাই। তবে রাজার কাছ থেকে উপটৌকন বা উপহার পাওয়ার ইঙ্গিতও এতে পাওয়া যায়।। অন্য একটি ব্যাখ্যায় এর দ্বারা আল্লাহর কাছে অনুগ্রহের ইঙ্গিত রয়েছে। ইঙ্গিত রয়েছে প্রেমিক-প্রেমিকার মিলনের, স্বপ্ন পুরণের। মনোবিজ্ঞানি কার্ল জংয়ের (Carl Jung) মতে: the moon is also a metaphor for the union of the male and female aspects of one’s personality.
জালাল মাঝেমধ্যে স্বপ্নে স্ফুলিঙ্গ ও জোনাকিদের দেখে। স্ফুলিঙ্গ ও জোনাকির মধ্যে একটি দারুণ মিল আছে।। স্ফুলিঙ্গ একটি অধরা অগ্নিকণা এটিও কোনো কোনো সময় কোনো অবশিষ্ট না রেখে সবকিছু পুড়ে ফেলে। দাবানল/বুনফায়ারগুলোর উৎপত্তি এভাবেই হয়। কিন্তু জোনাকি একটি তেজ-জ্বলুনিহীন মসৃণ আলো, কাউকে, কোনাকিছুকে পোড়াতে পারে না। পথের দিশারি হয়। স্ফুলিঙ্গ পোড়ায় জোনাকি অন্তর জুড়ায়। রবীন্দ্রনাথ কি শুধু স্ফুলিঙ্গ দেখেছিলেন, জোনাকি দেখেননি? তিনি লিখেছিলেন:
‘‘স্ফুলিঙ্গ তার পাখায় পেল
ক্ষণিকের ছন্দ
উড়ে গিয়ে ফুড়িয়ে গেল
সে-ই তার আনন্দ।’’
রবীন্দ্রনাথ স্ফুলিঙ্গের উড়ে গিয়ে ফুরিয়ে যাওয়ার মধ্যে আনন্দের কী দেখেছিলেন আমি বুঝি না। এটা তো চরম বেদনা, এই আছি এই নাই। ক্ষণিকের জীবন ক্ষণিকের পুড়ন এরপরই মহাকালের গর্ভে বিলিন হয়ে যাওয়া। এতে আনন্দের কী থাকতে পারে। আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ কি নিজেকেই স্ফুলিঙ্গ ভেবেছিলেন? এটা হতে পারে। তিনিও যে একদিন থাকবেন না-সেই ভাবনায় কাতর হয়েছিলেন? আর বেঁচে থাকার সময়টুকুই আনন্দময় বলে সান্ত¦না খুঁজেছিলেন? জানি এ ধরনের হাইপোথিসিস অর্থহীন। কিন্তু স্ফুলিঙ্গ ও জোনাকি দুটোই মানুষের ভাবাবেগে অদ্ভুত আলোড়ন তোলে। ভাবাই যায় জোনাকিও স্ফুলিঙ্গেরই আরেক রূপ। জোনাকিদের নিয়ে মাতসুও বাশোর একটি হাইকো তার মনে আসে:
folly in darkness
grasping a thorn
instead of a firefly
(Haiku by Matsuo Basho)
অর্থাৎ:
“মূর্খ অন্ধকার
জোনাকির পরিবর্তে
একটি কাঁটা আঁকড়ে ধরে আছে।”
আরেকটি হাইকো কিন্তু কবির নাম মনে আসছে না।
Summer fireflies
Competing with stars above
In the deep wet woods.
অর্থাৎ:
“গ্রীষ্মের জোনাকিরা
আকাশের তারার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে
ভেজা গভীর জঙ্গলে।”
কেউ কেউ বলেন জোনাকিরা আশাবাদের প্রতীক। স্বপ্নের জোনাকি দেখা শুভ। জোনাকি হলো আঁধারের আলো। যত আঁধারই হোক যখন জোনাকিরা সেখানে জ্বলে আমরা সাহস পাই। জোনাকি মানে আলোর নাচন। কী সুন্দর দলবদ্ধ হয়ে সৃশৃঙ্খলভাবে রাতকে মনোহারী করে তোলে। জীবনের পথে জোনাকি এক পার্থিব সুন্দরের নাম। জাপানে জোনাকিকে প্রেম, আবেগ, ঋতু পরিবর্তন ও বিদেহী আত্মার প্রতীক মনে করে। এবং জাপানি কিংবদন্তী মতে, দু’প্রজাতির জোনাকি রয়েছে। গেঞ্জি-হোতারু ও হাইকি হোতারু। গেঞ্জি-হোতারুরা মিনামোতোর যোদ্ধা ভূত আর হাইকি হোতারুরা-তাইরা যোদ্ধা (And in Japanese legend, two species of firefly, the Genji-hotaru and the Heike-hotaru, are associated with the ghosts of the Minamoto warriors and the Taira warriors)|।
অন্তর্জালের বিভিন্ন সোর্স বলছে: অন্ধকার রাতে পুরুষ জোনাকিরা আলো জ্বেলে তাদের প্রিয়তমা খোঁজার জন্য। তারা মনে করে তাদের আলোর উজ্জ্বলতা দেখে নারী জোনাকিরা আকৃষ্ট হয়। মহিলা জোনাকিরা তখন ঘাসের ওপর কিংবা ঝোঁপঝাড়ে চুপচাপ বসে থাকে। একসময় আলোকের ভালো লাগা ধওে আকৃষ্ট হয়ে একে একে সবাই যার যার প্রিয়জনের সঙ্গে জুটি বাঁধে। এরপর একে অপরের পাশাপাশি রাতভর উড়ে চলে।
অ্যামাজোনিয়ান মিথোলজিতে আছে: জোনাকির আলো আসে দেবতাদের কাছ থেকে। যা আশা ও পরিচালনের প্রতীক(Kritsky & Cherry, 2000)।
জালাল ইতোমধ্যে জানে-স্বপ্নে জোনাকি দেখার মানে হলো-বুদ্ধির মুক্তি, সৃজনশীলতার বিকাশ, গণ্ডি থেকে বেরিয়ে সামনের দিকে ধাবমান হওয়া, উন্নতি লাভ করা ইত্যাদি। একসঙ্গে অনেক জোনাকি দেখার মানে-শুভ সংবাদ, প্রশংসিত হওয়ার সম্ভাবনা। আর যদি কেউ স্বপ্নে দেখে তার ঘরে, আঙ্গিনায় জোনাকি এসেছে তাহলে বুঝতে হবে, তার জন্য অতুলনীয় আনন্দের সংবাদ অপেক্ষা করছে। “আপনি দুয়ার খুলে বেরিয়ে আসুন প্রচুর আনন্দ করুন।” বিবাহিত মেয়েদের গর্ভবতী হওয়ার ইঙ্গিত এতে থাকে। যদি একসঙ্গে অনেক জোনাকি ঘরে প্রবেশ করতে দেখা যায়-তাহলে বুঝতে হবে, ঘরে সন্তান আসছে। এটা অবশ্যই সুখী সুন্দর পরিবারগুলোর স্বপ্ন, ¯েœহভালোবাসা শূন্য ঘরে এটি সত্য নাও হতে পারে। আসলে জোনাকি হলো-আলো ও জ্ঞানের প্রতীক। পানির ওপর নদী সাগরের ওপর উড়ন্ত জোনাকিদের দেখতে পাওয়ার মানে জ্ঞানের, সৃষ্টিশীল কাজের বন্যা বয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। যদি অনিশ্চয়তা, হতাশা থাকে সে সবের ক্ষেত্রে আশা জাগানিয়া কিছু ঘটার সম্ভাবনা তৈরি হওয়া। আর্থিক ও আধ্যাত্মিক উত্তরণ ঘটতে পারে। আর যদি কেউ সোনালি জোনাকি দেখে-তার ভাগ্য খুলে যেতে পারে। তবে সর্ব ক্ষেত্রেই সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণ করা জরুরি।
জালাল লেখে যেতে থাকে: জোনাকির প্রাণ আছে স্ফুলিঙ্গের নেই। সত্যি কি নেই? কিন্তু দু’টিই উড়ে, এরপর ফুড়িয়ে যায়। এ দু’য়ের তুলনায় মানব স্ফুলিঙ্গের স্থায়ীত্বকাল একটু বেশি। স্ফুলিঙ্গ আর জোনাকির জীবনকাল যেমন কম দায়িত্ব-কর্তব্যও তেমনই কম। কিন্তু মানব জীবনের স্থায়ীত্ব সসীম হলেও তার জন্ম-মৃত্যু, আনন্দ-বেদনার প্রবাহ, তার সৃজনকর্মের রহস্যময়তা অসীম ও অনন্তকালের। আমি কান পেতে থাকি আমার বুকের গভীরে। বুকের সমূদ্রে ভেঙে পড়া অশান্ত, কূলহারা ঢেউ থেকে অসংখ্য চিৎকার উত্থিত হয়, আমি কিছু করতে চাই, হাত-পা নাড়িয়ে বাঁচতে চাই। ভেতর থেকে কেউ একজন বলল: থামো। সামনে তাকাও, দূরে, যতটুকু দেখা যায়, আরও দূরে, যেখানে দেখা যায় না। এরপর পর্যবেক্ষণ করো অন্ধকারের বিস্তৃর্ণ রূপ, পাঠ করো প্রকৃতির শব্দাবলী, নিঃসর্গের ভাষা। সকল মহানগ্রন্থের মহৎ বাক্যাবলী যেগুলো তোমাকে আলোড়িত করে সঙ্গে নাও। ভেতরে অন্ধকার থাকলে বাইরের আলোতে সে ঘোর কাটে না।
আমি প্রথম যেদিন পাখায় ছন্দ পাওয়া জোনাকিরূপ একটি উড়ন্ত স্ফুলিঙ্গকে ধরতে গেলাম-তুমি বললে: পারবে না। আর আমি তোমাকে কিচ্ছু না জানিয়ে মনে মনে বললাম: আমি পারব। আমাকে পারতেই হবে। আমার নিজের আলো কম তাই আমাকে আলো নিতে হবে স্ফুলিঙ্গ ও জোনাকির কাছ থেকে। গাছ ও মাছের কাছ থেকে, ফুল ও পাখির কাছ থেকে, কৃষি ও কৃষকের কাছ থেকে, যে জন্মান্ধ মেয়েটি জগতে আলো দেখেনি তার মুখে কদাচ যে হাসি ফুটে সেই হাসি থেকে। এরপর একদিন কাউকে না জানিয়ে বিলের জলে জন্ম নেওয়া বুনো ঘাসে ফুড়–ৎ-ফাড়–ৎ ঘুরে বেড়ানো একটি ফড়িংয়ের পিঠে চড়ে বসলাম। সেই আমাকে প্রথম দেখালো, পদ্ম-শাপলা ফোঁটা বিলের সৌন্দর্য, ঔদার্য। পরক্ষণেই যখন একটি সুচতুর শ্যামা সেই ফড়িংয়ের সঙ্গীটিকে ছুঁ মেরে ধরে নিয়ে গিয়ে বসে পাশেই পুঁতে রাখা শুকনো বাঁশের কঞ্চির ওপর, এরপর নিপীড়ন করে হত্যা করে, স্বীয় খাদ্যে পরিণত করে, তখন আমি চিনলাম দুঃখের আগুনকে। আগুন ছাড়া তো আলো হয় না। এভাবেই কখন যে, এই খেয়ালি স্বপ্নের চূড়ায় আরোহণ করলাম জানতে পারিনি। এরপর দেখলাম, তুমি আমার ধারে কাছে কোথাও নেই। অনেক নিচে রয়ে গেছ অস্পষ্ট বিন্দুর মত। আজ আমি ‘অসাধ্যকে সাধন করার’, ‘অধরাকে ধরার’ গল্পই তোমাকে বলব। তোমার সঙ্গে এ গল্প এখন শুনবে সারা পৃথিবী।
আমি করি কারণ আমি পারি
আমি পারি কারণ আমি পারতে চেয়েছি
আমি পারতে চেয়েছি কারণ তুমি বলেছিলে: ‘‘তুমি পারবে না।’’
আর এই দোদল্যমানতার সময়টায় আমার সঙ্গে রয়েছে আমার আত্মবিশ্বাস, আমার ভালোবাসা, আমার সর্বশক্তিমান ¯্রষ্টার অসীম করুণা। এই তো সবকিছু কিংবা সকলের বিশাল আনুকূল্য অনুভব করছি। একবার অধ্যক্ষ হাসান ওয়াইজ আমায় বলেছিলেন: বড় কিছু কিংবা কোনো কিছু শূন্য থেকে হয় না। আন্তরিক প্রচেষ্টার সঙ্গে গুরুর আশীর্বাদ আর আল্লাহর অনুগ্রহও থাকা লাগে। না হলে কাজের মধ্যে এমন বাধা আসে-যা তুমি অতিক্রম করতে পার না। তিনি আরও বলেছিলেন: উদ্দেশ্য সৎ, কল্যাণমুখী হতে হয়। না হলে, সে সৃষ্টি আলোর মুখ দেখলেও স্থায়ী হয় ক্ষণিকের বুদ্বুদ সমান। আমার চলার পথে, সৃষ্টির ধারায় কোনো কিছুকেই আমি অবহেলার চোখে দেখি না। আমি জানি, ঘৃণা-হিংসা-বিদ্বেষ থেকে অতীতে কিছু হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। তবু যাদের প্রতি আমার মনে বৈরিভাব তৈরি হয়েছে তা আমি গোপন রেখে পথ চলেছি। তাকে পাশ কেটে গিয়েছি এবং কিছুতেই তা তাকে জানতে দিই নি। যদি সে সমোঝদার হয়-একদিন নিজে থেকেই বুঝে নেবে।
অধ্যক্ষ হাসান ওয়াইজ আরও বলেছিলেন, কী বলেছিলেন জান? বলেছিলেন:
:পাওলো কোয়েলহোর শুভ সময়, শুভ লক্ষণের জন্য অপেক্ষা করা বোকামি। কাজের উদ্দেশ্যে পথে নামলে, শুভ সময় শুভ লক্ষণ হাসি মুখ নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। খুব প্রিয় বন্ধুর মত হাত বাড়িয়ে দেয়।