21/08/2022
পুরুষ মানুষের কোন পরিবার হয় না। টাকা ছাড়া পরিচয় হয় না।.......................................................................................................................
২০১০ সালের কথা, বিয়েশাদি করছি, বাপের বাসায় থাকি বৌ সহ, লেখাপড়া করতেসি, ডিগ্রি করমু সেই আশায়, চাকরিও করি একটা হাসপাতালে, উইকলি ৪৮ ঘন্টা, হাতখরচ চলে যায় আরকি. বৌও চাকরি করে.
খুব কাছের এক সিনিয়র ভাই, রেগুলার ফোনে কথা হয়, দেখা হয়, একদিন হটাৎ বললো, ছোট, আমি লন্ডন চলে যাচ্ছি, আজকে ট্রীট দিচ্ছি, কেএফসিতে চলে আয়.
রবিন ভাই (ছদ্মনাম) আমার ছয় বছর সিনিয়র, প্রাইভেট একটা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করে বিয়ে করেছেন, বাচ্চা হয়েছে একটা. উনার স্ত্রী গাইনিতে ক্যারিয়ার করবেন, আর উনি সার্জারিতে. বিয়ের পর বাবা বা শ্বশুর কেউই ফিনান্সিয়াল সাপোর্ট না দেয়ায় উনারা হালকা ফাঁপরে পড়ে যান, পার্ট ওয়ান আর পাশ হচ্ছিল না ভাইয়ের কিন্তু ভাবি পাশ করে ট্রেনিং শুরু করেন.
ভাই পুরোপুরি পয়সা কামাইয়ের রাস্তায় নিজেকে উৎসর্গ করেন. একাধিক খ্যাপ, চাকরি মেন্টেইন করে ঢাকার মতো নির্দয় শহরে সংসার চালান. মেয়ে বড়ো হয়, স্কুলে যাতায়াত শুরু হয়. এরকম সময়ে ভাবির এফসিপিএস কমপ্লিট হয়, একটা কর্পোরেট হাসপাতালে জয়েন করেন. রবিন ভাইয়ের খ্যাপ, চাকরির সম্মিলিত ইনকামের চেয়েও বেতন বেশি. ভাবির পাশ উপলক্ষে ভাইজান বিশাল পার্টি দিয়েছিলেন, তখন ব্যুফে রেস্টুরেন্টের এত চল ছিল না, আদরের জুনিয়র ভাই বেরাদারদের কেএফসিতে খাওয়াইছিলেন.
ভাই বললেন, আমার দায়িত্ব আপাততঃ শেষ, এখন আমি নিশ্চিন্তে পড়ালেখা করব, আপাতঃ সিনিয়র বয়সে যেয়ে দিলীপ স্যারের ক্লাসে জয়েন করলেন, নোয়াখালীর খ্যাপ জুনিয়র এক ছেলেকে বুঝিয়ে দিলেন. ক্লিনিকের চাকরিটাও ছাড়বেন দিনরাত লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে.
নিতান্ত ভদ্রলোক রবিন ভাই এরপর দিন দিন কেমন যেন হয়ে যেতে লাগলেন. জিজ্ঞেস করলে বলেন, কিছু ভালো লাগেনা রে, ফোন ও ধরেন কম, মেসেঞ্জারেও রিপ্লাই দেন দেরি করে. জোর করে আজিজের চিপায় দেখা করতে ধরলে সিগারেট খেতে খেতে ধরা গলায় বলেন, ছোট, ক্যারিয়ারের সাথে ফাইজলামি করবিনা রে, কোনদিন না.
আমরা জানতে চাই কি হয়েছে ভাই? উনি বললেন, আল্লাহ সাক্ষী, একা হাতে মেয়ে বড়ো করলাম, খাওয়াইলাম, পরাইলাম, বাজার সদাই, রান্নাবান্না, ঘুম পাড়ানো সব করলাম, কোনদিন বিরক্ত হইলাম না. কাজের মেয়ে নাই সেটাও সমস্যা লাগলো না. ডিউটি করতাম এমনভাবে যেন তোর ভাবির ট্রেনিং এ সমস্যা না হয়. এখন আমি চাকরি ছেড়ে দুইবেলা পড়তে বসলে ঘ্যানঘ্যান শুনতে হয়, বাচ্চা ধরিনা, বাজার করিনা. সবচেয়ে বড়ো খোঁটা টা দিলো যেদিন বাসার ভাড়াটা তাকে দিতে হলো!!! এতদিন যে শ্বশুর শাশুড়ি নিজেদের বাড়িতে ঠাঁই দিলোনা, সেই বাড়িতে মেয়ে নিয়ে চলে গেলো!!! আমার বাসায় এসি নাই, আমার গাড়ি নাই!!! এতোদিন লাগেনাই, এখন লাগবে এসব!!!
তুলনামূলক ছোট বয়স তখন, ভির্মি খাওয়ার অবস্থা, এসব শুনে. রবিন ভাই বললো কোনদিন পরিবারের জন্য স্যাক্রিফাইস করবিনা, কোনদিন না, পুরুষ মানুষের কোন পরিবার হয়না রে... কোন আপনজন হয়না. টাকা ছাড়া কোন পরিচয় ও হয়না. সেবার উনি পার্ট ওয়ান পাশ করেন.
ভীষণ রকম জেদি ক্যারেক্টারের লোক, ট্রেনিং শুরু করেন, এমআরসিএস একবারে পাশ করলেন. মেয়ের কথা মনে পড়লে একটু উদাস হয়ে যেতেন কিন্তু কোনদিন শ্বশুরবাড়ি যান নাই, মেয়ের সাথে, মেয়ের মায়ের সাথে দেখাও করেন নাই আর. আমরা বলতাম, ভাই বাদ্দেন, ভাবিরে নিয়া আসেন বাসায়. রাজি হন নাই, বলতেন, ছোট, একবার যেই মেয়ে তোর ঘর থেকে বের হয়ে যাবে, তাকে ঘরে বা মনে আর জায়গা দেয়া যায়না. আর আমার বাচ্চা বড় হলে যদি ফিরে আসে আসবে, এখন দেখতে চাওয়া মানেই সুযোগ দেয়া, সিন ক্রিয়েট করা. ওগুলা রবিনের পোষায় না, তবে আমি খরচ দিবো, আমি যা আয় করি তা থেকে দিয়ে যাবো মেয়ের খরচের জন্য. কিন্তু দেখা করবোনা.
খুব দ্রুত পিছিয়ে পড়া ক্যারিয়ার গুছিয়ে নিয়ে ডিভোর্স দিয়ে ইউকে চলে গেলেন রবিন ভাই, এরপর বারো বছর কেটে যায়. এফআরসিএস কমপ্লিট করেন, তুর্কি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ একজন নার্সকে বিয়ে করেন, গত সপ্তায় দেশে এসেছেন. ফোন নাম্বারটা সেইভ করা ছিল, হটাৎ কল দেখে আবার ভির্মি খাইলাম! ছোট, কই আছিস? আমি ঢাকায়, ট্রীট দিবো, ওই কেএফসিতেই বসি, নাকি বলিস??? চলে আয়... চক্ষু ছানাবড়া টাইপ সুন্দরী বৌ আর টুপ্পুত করে স্বর্গ থেকে পড়া একটা ছেলে বাচ্চা নিয়ে কেএফসিতে ওয়েট করছিলেন. ওরে আল্লাহ, টসটস বাংলা বলে বিদেশিনী আর বাচ্চা!!!
আড্ডার মধ্যে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, কেমন আছেন? চশমাটা খুলে মুছতে মুছতে গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলেন, ভালো না ভাই, মেয়েটার কথা খুব মনে পড়ে. বললাম, তাহলে দেখা করেন. বললো, না ভাই, আমার স্মৃতি না থাকলেই সে ভালো থাকবে, ভালো থাকুক. রবিন ভাইয়ের ছেলে এই পর্যায়ে "কান্দে না কান্দে না, বুড়া পাপা কান্দে না..." বলে সুর করে কোলে এসে বসলো, সুর মিলিয়ে "কাণ্ডে না, কাণ্ডে না..." বলতে বলতে তার মা ও এসে জড়িয়ে ধরলো রবিন ভাইকে...
ভয়ংকর সুন্দর কিন্তু অপূর্ণতায় ভরা জীবন টানতে টানতে ক্লান্ত এক সৈনিককে রেখে বের হয়ে আসলাম, অপারেশন আছে, হাই গ্রেড গ্ল্যায়োমা, মনে মনে ভাবছি, আজকে লিনিয়ার ইনসিশন দিবো, দেড় ঘন্টার সার্জারি, যাওয়ার পথে কন্যার জন্য কিংস এর ডোনাট নেয়া লাগবে, পুত্রের পেডিয়াশিউর কি আছে নাকি শেষ???
লেখা :
Muhammad Shahriar Kabir