23/09/2021
কার্টেসি: জান্নাতুল ফেরদৌসী
যে বিল্ডিংয়ে আমরা থাকি তার দোতলায় পুরো ফ্লোর নিয়ে একটি আবাসিক মাদ্রাসা। ছোট ছেলে বাচ্চারাই এখানে পড়ে। প্রায় সবার বয়স ৫-১০ বছর।
যখন নিচে নামার সময় বাচ্চাদের দেখি তখনই একটি একটি করুণ মুখচ্ছবি চোখে পড়ে। একটা অসহায় মুখ। আমাদের বাসায় কাজ করে যে আন্টি উনি আবার মাদ্রাসায়ও রান্না করেন। উনার মুখে প্রায়ই শুনতাম যে হুজুররা বাচ্চাদের ভালো খেতে দেয়না। হুজুরদের জন্য আলাদা খাবার আর এই ৩০-৪০ জন বাচ্চার জন্য আলাদা খাবার রান্না হয়। যদি কখনো মুরগির আইটেম হয় তবে জন প্রতি বাচ্চার থালায় ক্ষুদ্র আকৃতির এক টুকরো গোশতের দেখা মিলে, এগুলো আমাদের বলতে গিয়ে আন্টি প্রায়ই কেঁদে ফেলে। আগেই বলেছি মাদ্রাসাটি আবাসিক। গ্রামের নিম্ন মধ্যবিত্ত বাবা মায়েরা প্রতি মাসে একটা ভালো এমাউন্ট দিয়ে বাচ্চাদের এখানে রাখে যেন তারা ভালো আলেম হতে পারে, ভালো ভাবে থাকতে পারে। আর আবাসিক মাদ্রাসায় খুব কম অর্থও দেয়া হয়না কখনো যে একটা বাচ্চা মোটামুটি ভালো মানের খাবার পাবে না। তবুও মেনে নিলাম এটা ভেবে যে বাচ্চারা এত খায়না, ওদের অল্প হলেও চলে।
আমার আম্মু একদিন গরুর দুধ কিনে মাদ্রাসায় দিয়েছিল যেন এই ৩০-৪০ জন বাচ্চারা বিকেল বেলা জনপ্রতি মিনিমাম এক গ্লাস করে দুধ খেতে পারে বিকেলের নাস্তা হিসেবে। পরেরদিন আন্টির কাছে শুনি, এই দুধ দেয়ার কারণে বাচ্চাদের রাতের খাবার রান্না হয়নি। এই দুধটুকুই রাতের খাবারের জন্য বরাদ্দ করা হয় যেন টাকা সেইভ হয় রাতের খাবার পরিবর্তে। ঠিক আছে এটাও মেনে নিলাম এটা ভেবে যে ওদের এত বেশি খেতে নেই।
মাদ্রাসার কোনো বাচ্চা কখনো কারো সাথে কথা বলেনা, সবসময় একটা আতংকে থাকে তারা, এজন্য আমার খুব খারাপ লাগতো। আজ দরজা নক শুনে, খুলে দেখলাম মাদ্রাসার একটা বাচ্চা (বয়স ৬-৭) হবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছে বগলের নিচে হাত দিয়ে, ঠিক মতো কথাও বলতে পারছেনা। এ বাচ্চাটা খুব শান্ত শিষ্ট, প্রায়ই নিচের গেট খুলে দিতো বিধায় চিনি।
কোনো রকম শান্ত করে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করতে বললো মায়ের সাথে ফোনে কথা বলতে চায়। আমি ঘরে এনে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলাম হুজুরকে বলেছে কিনা ফোন দেয়ার কথা! বাচ্চাটি বললো, হুজুরকে ফোনের কথা বলায় উনি বগলের নিচে বুকের পাশটায় জোরে ঘুষি দিয়েছে, সেটা আমায় দেখালো। দেখলাম আসলেই খারাপ অবস্থা।
আমি দ্রুত ফোন দিয়ে কথা বলিয়ে দিলাম ওর মায়ের সাথে। মায়ের সাথে ঠিক মতো কথা বলতে পারছিলনা। বারবার বলছিল যে "মাগো আমারে নিয়া যাও নাইলে একবার একটু দেইক্ষা যাও, মাগো আমারে অনেক মারে হুজুরে, মাগো আমি তোমারে দেখমু, আমারে একদিনের লাইগা হইলেও নিয়া যাও, মাগো আয়ো, মা আয়ো" কথাগুলো ঠিক এমন ছিল। লাউডস্পিকারে থাকায় ওর মায়ের কথাগুলোও শুনছিলাম আমি। মা বারবার বলতেছে আসতে পারবেনা, সে যেন ভালো ভাবে থাকে, আসার অবস্থা নাই ইত্যাদি ইত্যাদি। মোটকথা তার মায়ের কথাগুলো শুনে আমার আশ্চর্য লাগছিল।
আমি এত বড় হয়ে গিয়েছি, যথেষ্ট এডাল্ট, নিজের যত্ন নিজে নিতে পারি তবুও আমার মা যদি ঘুণাক্ষরেও টের পায় যে আমি কাঁদতেছি বা কষ্ট পাচ্ছি, আম্মু দিল্লি থাকলেও যেভাবে হোক চলে আসবে সেখানে এটাতো বাচ্চা একটা ছেলে!
একটু পর তার মা বিরক্ত হয়ে ফোনটা কেটে দিলো। পরে বাচ্চার থেকে আমি ডিটেইলস জিজ্ঞেস করে বুঝিয়ে নিচে পাঠালাম। আর বললাম যখনই খারাপ লাগবে আমার কাছে এসো, এখানে এসে মাকে ফোন দিও। বাচ্চাটা বললো "আন্টি আপনে আমার আম্মারে আজকে আবার ফোন দিয়া কইয়েন যেন কালকা বারোটার মইধ্যে আইসা আমারে লইয়া যায়, নইলে আমি মইরা যামু আন্টি, আপনে কইয়েন। " দরজায় দাঁড়িয়েও বলতেছিল। আমি ছেলেটার সামনেই কেঁদে ফেলছি ওর অবস্থা দেখে।
এই বাচ্চাটা তার মায়ের চার মেয়ের পর একটা ছেলে, তবুও এত অযত্ন কেন? ঠিক আছে আমি বুঝি যে মায়েদের শক্ত হতে হয়, তাই বলে এতটা! ওর মা নাকি দেখতে আসেনা অনেক দিন যাবত! এত নির্দয় হতে হয় বাচ্চাকে আবাসিকে পাঠালে?
আর মাদ্রাসার হুজুররাও এত নির্মম হয়! পড়াশোনায় শাসন অবশ্যই প্রয়োজন কিন্তু তাই বলে কথায় কথায়ই শাসন! তাহলে আমরা আমাদের সন্তানদের কোন ভরসায় পাঠাবো মাদ্রাসায়? আমি মানছি যে সবাই এরকম হয়না, কিন্তু বেশিরভাগই তো এমন। কাকে বিশ্বাস করবো আমরা? এই একটা বাচ্চা দেখে আমারই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছে। এইযে এখনো আমি কাঁদতেছি; এত নিষ্পাপ একটা শিশু! এত নিষ্ঠুর কেন আমরা মানুষেরা!