06/06/2023
আল বাকারা, আয়াতঃ ২৫৯
اَوۡ کَالَّذِیۡ مَرَّ عَلٰی قَرۡیَۃٍ وَّہِیَ خَاوِیَۃٌ عَلٰی عُرُوۡشِہَا ۚ قَالَ اَنّٰی یُحۡیٖ ہٰذِہِ اللّٰہُ بَعۡدَ مَوۡتِہَا ۚ فَاَمَاتَہُ اللّٰہُ مِائَۃَ عَامٍ ثُمَّ بَعَثَہٗ ؕ قَالَ کَمۡ لَبِثۡتَ ؕ قَالَ لَبِثۡتُ یَوۡمًا اَوۡ بَعۡضَ یَوۡمٍ ؕ قَالَ بَلۡ لَّبِثۡتَ مِائَۃَ عَامٍ فَانۡظُرۡ اِلٰی طَعَامِکَ وَشَرَابِکَ لَمۡ یَتَسَنَّہۡ ۚ وَانۡظُرۡ اِلٰی حِمَارِکَ وَلِنَجۡعَلَکَ اٰیَۃً لِّلنَّاسِ وَانۡظُرۡ اِلَی الۡعِظَامِ کَیۡفَ نُنۡشِزُہَا ثُمَّ نَکۡسُوۡہَا لَحۡمًا ؕ فَلَمَّا تَبَیَّنَ لَہٗ ۙ قَالَ اَعۡلَمُ اَنَّ اللّٰہَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ
অর্থঃ
মুফতী তাকী উসমানী
অথবা (তুমি) সেই রকম ব্যক্তি (-এর ঘটনা) সম্পর্কে (চিন্তা করেছ), যে একটি বসতির উপর দিয়ে এমন এক সময় গমন করছিল, যখন তা ছাদ উল্টে (থুবড়ে) পড়ে রয়েছিল। ১৯৬ সে বলল, আল্লাহ এ বসতিকে এর মৃত্যুর পর কিভাবে জীবিত করবেন? অনন্তর আল্লাহ তাকে একশ’ বছরের জন্য মৃত্যু দান করলেন এবং তারপর তাকে জীবিত করলেন। (অতঃপর) জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কত কাল যাবৎ (এ অবস্থায়) থেকেছ? সে বলল, এক দিন বা এক দিনের কিছু অংশ! আল্লাহ বললেন, না, বরং তুমি (এভাবে) একশ’ বছর থেকেছ। এবার নিজ পানাহার সামগ্রীর প্রতি লক্ষ্য করে দেখ তা একটুও পচেনি। আবার (অন্যদিকে) নিজ গাধাটিকে দেখ, (পচে গলে তার কী অবস্থা হয়েছে)। (আমি এটা করেছি) এজন্য যে, আমি তোমাকে মানুষের জন্য (নিজ কুদরতের) একটি নিদর্শন বানাতে চাই এবং (এবার নিজ গাধার) অস্থিসমূহ দেখ, আমি কিভাবে সেগুলোকে উত্থিত করি এবং তাতে গোশতের পোশাক পরাই। সুতরাং যখন সত্য তার সামনে সুস্পষ্ট হয়ে গেল, তখন সে বলে উঠল, আমার বিশ্বাস আছে আল্লাহ সব বিষয়ে ক্ষমতা রাখেন।
মাওলানা মুহিউদ্দিন খান
তুমি কি সে লোককে দেখনি যে এমন এক জনপদ দিয়ে যাচ্ছিল যার বাড়ীঘরগুলো ভেঙ্গে ছাদের উপর পড়ে ছিল? বলল, কেমন করে আল্লাহ মরনের পর একে জীবিত করবেন? অতঃপর আল্লাহ তাকে মৃত অবস্থায় রাখলেন একশ বছর। তারপর তাকে উঠালেন। বললেন, কত কাল এভাবে ছিলে? বলল আমি ছিলাম, একদিন কিংবা একদিনের কিছু কম সময়। বললেন, তা নয়; বরং তুমি তো একশ বছর ছিলে। এবার চেয়ে দেখ নিজের খাবার ও পানীয়ের দিকে-সেগুলো পচে যায় নি এবং দেখ নিজের গাধাটির দিকে। আর আমি তোমাকে মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত বানাতে চেয়েছি। আর হাড়গুলোর দিকে চেয়ে দেখ যে, আমি এগুলোকে কেমন করে জুড়ে দেই এবং সেগুলোর উপর মাংসের আবরণ পরিয়ে দেই। অতঃপর যখন তার উপর এ অবস্থা প্রকাশিত হল, তখন বলে উঠল-আমি জানি, নিঃসন্দেহে আল্লাহ সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন
বা তুমি কি সেই ব্যক্তিকে দেখ নাই, যে এমন এক নগরে উপনীত হয়েছিল যা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। সে বলল, ‘মৃত্যুর পর কিরূপে আল্লাহ্ একে জীবিত করবেন ?’ তারপর আল্লাহ্ তাকে একশত বৎসর মৃত রাখলেন। পরে তাকে পুনর্জীবিত করলেন। আল্লাহ্ বললেন, ‘তুমি কত কাল অবস্থান করলে ?’ সে বলল, ‘এক দিন বা এক দিনেরও কিছু কম অবস্থান করেছি।’ তিনি বললেন, ‘না, বরং তুমি একশত বৎসর অবস্থান করেছ। তোমার খাদ্যসামগ্রী ও পানীয় বস্তুর প্রতি লক্ষ্য কর, এটা অবিকৃত রয়েছে এবং তোমার গর্দভটির প্রতি লক্ষ্য কর, কারণ তোমাকে মানবজাতির জন্যে নিদর্শনস্বরূপ করব। আর অস্থিগুলির প্রতি লক্ষ্য কর; কিভাবে সেগুলিকে সংযোজিত করি এবং গোশত দিয়ে ঢেকে দেই।’ যখন এটা তার নিকট স্পষ্ট হল তখন সে বলে উঠল, ‘আমি জানি যে, আল্লাহ্ নিশ্চয়ই সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।’
---------------------
তাফসীর (মুফতী তাকী উসমানী) (Bangla)
১৯৬. ২৫৯ ও ২৬০নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা এমন দু’টি ঘটনা বর্ণনা করেছেন, যাতে তিনি তাঁর দু’জন খাস বান্দাকে দুনিয়াতেই মৃতকে জীবিত করার বিষয়টি প্রত্যক্ষ করিয়েছেন। প্রথম ঘটনায় একটি জনবসতির কথা বলা হয়েছে, যা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। তার সমস্ত বাসিন্দা মারা গিয়েছিল এবং ঘর-বাড়ি ছাদসহ মাটিতে মিশে গিয়েছিল। সেখান দিয়ে এক ব্যক্তি পথ চলছিল। বসতির বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে সে মনে মনে চিন্তা করল, আল্লাহ তাআলা এই গোটা বসতিকে কিভাবে জীবিত করবেন! বস্তুত তার এ চিন্তাটি কোনও রকম সন্দেহপ্রসূত ছিল না, বরং এটা ছিল তার বিস্ময়ের প্রকাশ। আল্লাহ তাআলা তাকে যেভাবে নিজ ক্ষমতা প্রত্যক্ষ করিয়েছিলেন, তা আলোচ্য আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে এই ব্যক্তি কে ছিলেন? এই জনবসতিটি কোথায় ছিল? কুরআন মাজীদ এ বিষয়ে কিছু বলেনি এবং এমন কোনও নির্ভরযোগ্য রিওয়ায়াতও নেই, যা দ্বারা নিশ্চিতভাবে এসব বিষয় নিরূপণ করা যাবে। কেউ কেউ বলেছেন, এ জনপদটি ছিল বাইতুল মুকাদ্দাস এবং এটা সেই সময়ের ঘটনা, যখন বুখত নাস্সার হামলা চালিয়ে গোটা জনপদটিকে ধ্বংস করে ফেলেছিল। আর এই ব্যক্তি ছিলেন হযরত উযায়র আলাইহিস সালাম কিংবা হযরত আরমিয়া আলাইহিস সালাম। কিন্তু এটাই যে সঠিক তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। অবশ্য এটা অনুসন্ধান করারও কোনও প্রয়োজন নেই। এর অনুসন্ধানে পড়া ছাড়াও কুরআন মাজীদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে যায়। তবে এই ব্যক্তি যে একজন নবী ছিলেন তা প্রায় নিশ্চিতভাবেই জানা যায়। কেননা প্রথমত এ আয়াতে পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা তার সাথে কথোপকথন করেছেন। তাছাড়া এ জাতীয় ঘটনা নবীদের সাথেই ঘটে থাকে। সামনের ১৯৭নং টীকা দেখুন।
---------------------
তাফসীরে মাআ'রিফুল কুরআন (Bangla)
২৫৯ - ২৬০ নং আয়াতের তাফসীরঃ
তাফসীরের সার-সংক্ষেপঃ
أَوْ كَالَّذِي مَرَّ عَلَى قَرْيَةٍ………أَنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
এমন কাহিনীও কি তোমরা জান (যে, এক লোক ছিল। একবার চলতে চলতে সে) এমন এক জনপদের উপর দিয়ে (এমনি অবস্থায় ) অতিক্রম করল যে, তার বাড়ি-ঘরগুলো ছাদের উপর পড়ে রয়েছে (অর্থাৎ প্রথমে ছাদ ভেঙে পড়েছে এবং পরে এর উপর ঘরগুলো পতিত হয়েছে অর্থাৎ কোন দুর্ঘটনার ফলে জনপদটি সম্পূর্ণ বিরান হয়ে গিয়েছিল এবং সমস্ত লোক মরে গিয়েছিল)। সে ব্যক্তি বলল, আল্লাহ্ এ জনপদের মৃত ব্যক্তিদের কিভাবে (কিয়ামতের দিন) জীবিত করবেন। (তার অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ সকল মৃত ব্যক্তিকেই জীবিত করবেন। এতদসত্ত্বেও জীবিত করার ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে মনে এমন একটা ভাব সৃষ্টি হলো যে, মৃতের পুনর্জীবন দানের এই বিস্ময়কর ব্যাপারটা না জানি আল্লাহ্ পাক কিভাবে সম্পন্ন করবেন ! কেননা, আল্লাহ্ তা’আলা তো যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই যে কোন কাজ আনজাম দিতে পারেন। আল্লাহর ইচ্ছা হলো যে, এ দৃশ্যটি এ দুনিয়াতেই তাকে দেখিয়ে দেন। তাতে একটি দৃষ্টান্তও স্থাপিত হবে এবং এর দ্বারা লোকেরা হেদায়েতপ্রাপ্তও হবে। সুতরাং এজন্য) আল্লাহ্ পাক সে ব্যক্তিকে মৃত্যু দিয়ে একশ’ বছর পর পুনরায় তাকে জীবিত করলেন (এবং পরে) জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কতদিন এ অবস্থায় ছিলে? সে উত্তর দিল, একদিন রয়েছি কিংবা একদিনের কিছু কম (সময়)। আল্লাহ্ তা’আলা বললেন, না, বরং একশ’ বছর (তুমি এ অবস্থায় ) ছিলে। (যদি তোমার শরীরের কোন পরিবর্তন না হওয়াতে আশ্চর্যান্বিত হয়ে থাক, তবে) তোমার খাবারগুলোর প্রতি লক্ষ্য কর যে, একটুও পচে-গলে যায়নি (এটি আমার একটি কুদরত)। এবং (দ্বিতীয় কুদরত দেখার জন্য) তোমার (বাহন) গাধাটির প্রতি লক্ষ্য কর (পচে-গলে) তার কি অবস্থা হয়েছে) এবং আমি অতি সত্বর একে তোমার সামনে জীবিত করে দেখাবো এবং আমি তোমাকে এজন্য (মেরে পুনরায় জীবিত করেছি) যে, আমি তোমাকে আমার কুদরতের একটি নযীর স্থাপন করছি। (যাতে এ ঘটনার দ্বারা কিয়ামতের দিন জীবিত হওয়ার প্রমাণ দেওয়া যায়)। এবং (এখন সে গাধা) হাড়গুলোর দিকে দেখ; আমি এগুলোকে কিভাবে একত্রে সংযোজিত করছি। অতঃপর এতে মাংস লাগিয়ে দিচ্ছি; পরে তাকে জীবিত করছি? (মোট কথা, এসব কাজ এভাবেই করে দেওয়া হবে)। অতঃপর যখন এসব অবস্থা উক্ত ব্যক্তিকে দেখানো হলো, তখন (সে উদ্বেলিত হয়ে) বলে উঠলো, আমি (অন্তরে) দৃঢ় বিশ্বাস করি যে, আল্লাহ্ তা’আলা সমস্ত কাজের পূর্ণ ক্ষমতা রাখেন।
আর সে সময়ের (ঘটনার) কথা স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম (আ) (আল্লাহ্ তা’আলার কাছে) নিবেদন করছিলেন, হে আমার পরওয়ারদেগার! আমাকে (সে বিষয়টি) দেখাও যে, মৃতদেরকে (কিয়ামতে) কেমন করে জীবিত করবে (অর্থাৎ জীবিত করা তো নিশ্চিত, কিন্তু জীবিত করার বিভিন্ন পদ্ধতি হতে পারে তা আমার জানা নেই, কাজেই তা জানতে মন চায়। এ প্রশ্নে কোন স্বল্পবুদ্ধি-ব্যক্তির মনে সন্দেহ হতে পারে যে, নাউযুবিল্লাহ্; ইবরাহীম (আ)-এর মনে মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত হওয়ার ব্যাপারে একীন ছিল না ! সুতরাং আল্লাহ্ তা’আলা নিজেই এ প্রশ্নের অবতারণা করে ব্যাপারটি পরিষ্কার করে দিয়েছেন। তাই এ প্রশ্নের উত্তরে প্রথমে ইবরাহীম (আ)-কে বললেন—তুমি কি এতে বিশ্বাস কর না ? (তিনি উত্তরে) আরয করলেন— বিশ্বাস তো অবশ্যই করি কিন্তু এ উদ্দেশ্যে আরয করছি যাতে আমার অন্তর (নির্ধারিত পুনর্জীবন পদ্ধতি দেখে) প্রশান্তি লাভ করতে পারে (এবং অন্যান্য সম্ভাবনার ফলে যেন মনে নানা প্রশ্নের উদয় না হয়)। আদেশ হলো, তবে তুমি চারটি পাখি ধর। অতঃপর সেগুলোকে নিজের কাছে রাখ। (যাতে ভালভাবে সেগুলো তোমার সাথে পরিচিত হয়ে যায়) অতঃপর (সেগুলোকে জবাই করে কিমার মত সংমিশ্রিত করে নিয়ে কয়েক ভাগে বিভক্ত কর এবং নিজের ইচ্ছামত কয়েকটি বেছে নিয়ে) প্রত্যেক পাহাড়ে একটি একটি অংশ রেখে দাও। (এবং) পরে এগুলোকে ডাক। (দেখবে জীবিত হয়ে) তোমার কাছে ফিরে আসবে এবং এ ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাস রেখ যে, আল্লাহ্ তা’আলা মহাপরাক্রমের (তথা কুদরতের) অধিকারী। (তিনি সবকিছুই করতে পারেন, কিন্তু তবু কোন কোন কাজ করেন না। তার কারণ এই যে,) তিনি বিজ্ঞ (ও) বটেন ! (আর প্রতিটি কাজই সে বিজ্ঞতা অনুযায়ী করে থাকেন)।
আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষযঃ
হযরত ইবরাহীম (আ)-এর নিবেদন ও পুনর্জীবন দান প্রত্যক্ষকরণঃ এটি হলো তৃতীয় কাহিনী যা আলোচ্য আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। যার সার-সংক্ষেপ হচ্ছে এই যে, ইবরাহীম (আ) আল্লাহ্ তা’আলার প্রতি আরয করলেন, আপনি কিভাবে মৃতকে পুনর্জীবিত করবেন, তা আমাকে প্রত্যক্ষ করান। আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করলেন, এরূপ আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করার কারণ কি ? আমার সর্বসময় ক্ষমতার প্রতি কি তোমার আস্থা নেই ? ইবরাহীম (আ) আস্থা বিবৃত করে নিবেদন করলেন, আস্থা ও বিশ্বাস তো অবশ্যই আছে। কেননা, আপনার সর্বময় ক্ষমতার নিদর্শন সর্বদা, প্রতি মুহূর্তেই দেখতে পাচ্ছি এবং চিন্তাশীল ব্যক্তিমাত্রই তার নিজের সত্তা থেকে শুরু করে এ বিশ্ব-জাহানের প্রতিটি অণু-পরমাণুতে এর প্রমাণ দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু মানব-প্রকৃতির সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে যে, অন্তরের বিশ্বাস যতই দৃঢ় হোক, চোখে না দেখা পর্যন্ত অন্তরে পূর্ণ প্রশান্তি আসতে চায় না, প্রশ্নের পর প্রশ্ন জাগতে থাকে, এটা কি করে হবে, না জানি এর প্রক্রিয়াটা কেমন ? মনের মাঝে এ ধরনের প্রশ্ন উদয় হওয়ার ফলে পূর্ণ প্রশান্তি লাভ হতে চায় না। নানা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এ কারণেই হযরত ইবরাহীম (আ) এরূপ নিবেদন করেছিলেন, যাতে মৃত ব্যক্তিকে জীবিতকরণ-সংক্রান্ত চিন্তা দ্বিধাগ্রস্ত না হয়ে পড়ে। অধিকন্তু মনে যাতে স্থিরতা আসে; নানা প্রশ্নের জাল যেন অন্তরে বাসা বাঁধতে না পারে এবং মনের দৃঢ়তা যাতে বজায় থাকে।
আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর প্রার্থনা কবূল করলেন এবং বিষয়টি প্রত্যক্ষ করাবার জন্য এক অভিনব ব্যবস্থা করলেন, যাতে মুশরিকদের যাবতীয় সন্দেহ-সংশয়ও দূর হয়ে যায়। প্রক্রিয়াটি ছিল এই যে, ইবরাহীমকে চারটি পাখি ধরে নিজের কাছে রেখে সেগুলোকে এমনভাবে লালন-পালন করতে নির্দেশ দেওয়া হলো, যাতে সেগুলো সম্পূর্ণরূপে পোষ মেনে যায় এবং ডাকামাত্র হাতের কাছে চলে আসে। তদুপরি তিনিও যেন সেগুলোকে ভালভাবে চিনতে পারেন। পরে নির্দেশ হলো, পাখিগুলোকে জবাই করে এর হাড়-মাংস, পাখা ইত্যাদি সবগুলোকেই কিমায় পরিণত কর, তারপর সেগুলোকে ভাল করে মিশিয়ে নিয়ে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে নিজে পছন্দমত কয়েকটি পাহাড়ে এক একটি ভাগ রেখে দাও। তারপর এদেরকে ডাক। তখন এগুলি আল্লাহর কুদরতে জীবিত হয়ে দৌড়ে এসে তোমার কাছে পড়বে।
তফসীরে রূহুল-মা’আনীতে ইবনুল-মানযারের উদ্ধৃতিতে হযরত হাসান (রা) থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, হযরত ইবরাহীম (আ) তাই করলেন। অতঃপর এদের যখন ডাকলেন, সঙ্গে সঙ্গে হাড়ের সাথে হাড়, পাখার সাথে পাখা, মাংসের সাথে মাংস ও রক্তের সাথে রক্ত মিলে পূর্বের রূপ ধারণ করল এবং তাঁর কাছে দৌড়ে এসে উপস্থিত হলো। তখন আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করলেন—হে ইবরাহীম ! কিয়ামতের দিন এমনিভাবে সবাইকে তাদের শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোকে একত্রিত করে এক মুহূর্তে সেগুলোতে প্রাণ সঞ্চারিত করে দিব। কোরআনের ভাষায়ঃ يَأْتِينَكَ سَعْيًا বলা হয়েছে যে, এসব পাখি দৌড়ে আসবে, যাতে বোঝা যায়, সেগুলো উড়ে আসবে না। কেননা, আকাশে উড়ে আসলে দৃষ্টির অগোচরে যেতে পারে এবং তাতে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়। পক্ষান্তরে মাটির উপরে দৌড়ে আসলে তা দৃষ্টির মধ্যে থাকবে। এ ঘটনাতে আল্লাহ্ তা’আলা কিয়ামতের পরে পুনর্জীবনের এমন এক নিদর্শন হযরত ইবরাহীম (আ)-কে দেখালেন, যাতে মুশরিকদের যাবতীয় সন্দেহ-সংশয়েরও অবসান হতে পারে। পুনর্জীবন এবং পরকালীন জীবন সম্পর্কে মুশরিকদের এটাই ছিল বড় প্রশ্ন। মানুষ মৃত্যুর পর মাটিতে মিশে যায়, আর এ মাটি বাতাসের সাথে কোথায় কোথায় উড়ে যায় ! আবার কখনো পানির স্রোতের সাথে গড়িয়ে যায়, কখনো বা বৃক্ষ ও শস্যরূপে আত্মপ্রকাশ করে । আবার এর অণু-পরমাণু দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এ বিক্ষিপ্ত অণু-পরমাণুকে একত্র করে তাতে প্রাণ সঞ্চার করার বিষয়টি সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন লোকদের বোধগম্য হওয়ার কথা নয়। সব বিষয়কেই তারা নিজের সীমাবদ্ধ জ্ঞানের তুলাদণ্ডে ওজন করতে চায়। তারা তাদের বোধশক্তির বাইরের কোন ক্ষমতা সম্পর্কে চিন্তাও করতে পারে না।
অথচ তারা যদি নিজেদের অস্তিত্ব সম্পর্কেই একটু চিন্তা করে, তবেই বুঝতে পারবে যে, তাদের অস্তিত্ব সারা বিশ্বের বিক্ষিপ্ত অণু-পরমাণুর একটা সমষ্টি। মানুষের জন্ম যে পিতা-মাতার মাধ্যমে হয়ে থাকে, যে খাদ্যে তাদের শরীর ও রক্ত গঠিত হয়, সেগুলোও বিশ্বের আনাচ-কানাচ থেকে সংগৃহীত অণু-পরমাণুরই সংমিশ্রণ মাত্র। তারপর জন্মের পরে তার লালন-পালনে যেসব খাদ্য-খাবার ব্যবহৃত হয়ে থাকে, যদ্দ্বারা তার রক্ত-মাংস গঠিত হয়, সে সম্পর্কে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, তার খাদ্য সামগ্রীতে এমন একটি জিনিস রয়েছে, যা সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন অণু-পরমাণু দ্বারাই গঠিত। শিশু যে দুধ খায় তা কোন গাভী, মহিষ বা বকরীর অংশ বিশেষ। সংশ্লিষ্ট জীবগুলোতে এসব অংশ সে ঘাসের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে যা তারা খেয়েছে। আর এসব বস্তু না জানি কোন্ কোন্ দেশ থেকে এসেছে। আর না জানি বায়ু কোন্ কোন্ দেশ থেকে বিভিন্ন অণু-পরমাণুকে এগুলোর উৎপাদনের সাথে মিশিয়েছে। এমনিভাবে দুনিয়ার বীজ, ফল-মূল, তরি-তরকারি এবং মানুষের প্রত্যেকটি খাদ্য সামগ্রী ও ঔষধ-পত্র যা তাদের দেহের অংশে পরিণত হয়, তা বিশ্বের কোন না কোন অংশ থেকে আল্লাহ্ তা’আলার পরিপূর্ণ শক্তি এবং অনুপম ও সুশৃঙ্খল পরিচালন ব্যবস্থার মাধ্যমেই মানুষের মধ্যে একত্রিত হয়েছে। যদি আত্মভোলা ও সংকীর্ণমনা মানুষ দুনিয়ার কথা বাদ দিয়ে শুধু নিজের দেহ সম্পর্কে গবেষণা করতে বসে, তবে দেখতে পাবে যে, তার অস্তিত্ব বিশ্বের এমনি অসংখ্য অণু-পরমাণুরই সংমিশ্রণ যার কিছু প্রাচ্যের, কিছু পাশ্চাত্যের, কিছু উত্তরাঞ্চলের আর কিছু দক্ষিণ জগতের। আজও বিশ্বজোড়া বিক্ষিপ্ত অণু-পরমাণুকে আল্লাহর অতুলনীয় ব্যবস্থাপনায় তার দেহে একত্র করে দিয়েছেন। মৃত্যুর পরে সেসব অণু-পরমাণু পুনরায় বিশ্বের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে যাবে। তাহলে দ্বিতীয়বার এগুলোকে একত্র করা আল্লাহর পক্ষে তো কোন কঠিন কাজ হওয়ার কথা নয়, যিনি প্রথমবার এগুলোকে একত্র করেছিলেন।
আলোচ্য ঘটনার উপর কয়েকটি প্রশ্ন ও উত্তরঃ আলোচ্য আয়াতে কয়েকটি প্রশ্ন দেখা দেয়। প্রথমত, হযরত ইবরাহীম (আ)-এর মনে এ প্রশ্নই বা কেন জেগেছিল ? অথচ তিনি আল্লাহর সর্বময় ক্ষমতার উপর বিশ্বাসীরূপে তৎকালীন বিশ্বে সর্বাধিক দৃঢ় ছিলেন !
এর উত্তর এই যে, প্রকৃতপক্ষে হযরত ইবরাহীম (আ)-এর প্রশ্ন কোন সন্দেহ-সংশয়ের কারণে ছিল না। বরং প্রশ্নের উদ্দেশ্য ছিল যে, আল্লাহ্ তা’আলা কিয়ামতে মৃতদেহকে জীবিত করবেন, তা তাঁর সর্বময় ক্ষমতার জন্য কোন আশ্চর্যের বিষয় নয়, কিন্তু মৃতকে জীবিত করা মানুষের শক্তির ঊর্ধ্বে, তারা কখনো কোন মৃতকে জীবিত হতে দেখেনি। পরন্তু মৃতকে জীবিত করার পদ্ধতি ও রূপ বিভিন্ন রকম হতে পারে। মানুষের স্বভাব হচ্ছে এই যে, যে বস্তু সে দেখেনি তার অনুসন্ধান করার জন্য তার মনে একটা সহজাত কৌতূহল জন্ম নেয়। এতে তার ধারণা বিভিন্ন পথে এগিয়ে যেতে থাকে। তাতে চিন্তাজনিত কষ্টও সহ্য করতে হয়। এ চিন্তার বিভ্রান্তি থেকে রেহাই পেয়ে অন্তরে স্থিরতা লাভ করাকেই ’ইতমিনান’ বা প্রশান্তি বলা হয় । এই ইতমিনান লাভের উদ্দেশ্যই ছিল হযরত ইবরাহীম (আ)-এর এ প্রার্থনা।
এতে একথাও বোঝা যাচ্ছে যে, ঈমান ও ইতমিনান-এর মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। ঈমান সে ইচ্ছাধীন দৃঢ় বিশ্বাসকে বলে, যা মানুষ রাসূল (সা)-এর কথায় কোন অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে অর্জন করে। আর ’ইতমিনান’ অন্তরের সে দৃঢ়তাকে বলা হয় যা প্রত্যক্ষ কোন ঘটনা অথবা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত হয়ে থাকে। অনেক সময় কোন দৃশ্যমান বিষয়েও দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায়, কিন্তু অন্তরের ইতমিনান বা প্রশান্তি লাভ হয় না এজন্য যে, এর স্বরূপ জানা থাকে না। ইতমিনান শুধু চাক্ষুষ দর্শনে লাভ হয়। হযরত ইবরাহীম (আ) মৃত্যুর পর পুনর্জীবন সম্পর্কে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী অবশ্যই ছিলেন; তবে প্রশ্নটি ছিল শুধু তার স্বরূপটি জানার জন্য ।
দ্বিতীয় প্রশ্ন এই যে, হযরত ইবরাহীম (আ) মৃতকে জীবিত করার স্বরূপ সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন। মৃত্যুর পর পুনর্জীবন সম্পর্কে তাঁর মনে কোনরূপ সন্দেহ ছিল না। এমতাবস্থায় আল্লাহর পক্ষ থেকে أَوَلَمْ تُؤْمِنْ অর্থাৎ তুমি কি বিশ্বাস কর না, বলার হেতু কি?
উত্তর এই যে, হযরত ইবরাহীম (আ) কর্তৃক উত্থাপিত এ প্রশ্নটির দু’ধরনের অর্থ হতে পারে।
একঃ তিনি জীবিত করার স্বরূপ জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলেন। তবে মূল প্রশ্ন অর্থাৎ মৃত্যুর পর পুনর্জীবন সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন না।
দুইঃ পুনর্জীবিত করার ক্ষমতায় সন্দেহ কিংবা অস্বীকৃতি থেকেও এ প্রশ্ন জন্ম নিতে পারে। প্রশ্নের ভাষা এ সম্ভাবনার প্রতিকূল নয়। উদাহরণত কোন বোঝা সম্পর্কে আপনার বিশ্বাস এই যে, অমুক ব্যক্তি এটি বহন করতে পারবে না। তখন আপনি তার অপারকতা প্রকাশ করার জন্য বললেন, দেখি, তুমি কেমন করে বোঝাটি বহন কর ! ইবরাহীম (আ)-এর প্রশ্নের এ ভুল অর্থও কেউ কেউ গ্রহণ করতে পারতো। তাই আল্লাহ্ তা’আলা তাঁকে এ ভ্রান্ত ধারণা থেকে মুক্ত প্রমাণিত করার উদ্দেশ্যে বললেন أَوَلَمْ تُؤْمِنْ —যাতে ইবরাহীম (আ) উত্তরে بلى ‘হ্যাঁ, বিশ্বাস করি’ বলে ভুল বোঝার অবকাশ থেকে মুক্ত হয়ে যান।
তৃতীয়ঃ প্রশ্ন এই যে, ইবরাহীম (আ)-এর এ প্রশ্ন থেকে অন্তত এতটুকু তো জানা গেল যে, মৃত্যুর পর পুনর্জীবন সম্পর্কে তাঁর বিশ্বাসের পূর্ণ স্থিরতা ছিল না। অথচ বর্ণিত আছে যে, হযরত আলী (রা) বলেন, “যদি অদৃশ্য জগতের উপর থেকে পর্দা সরিয়ে দেওয়া হয়, তবে আমার বিশ্বাস ও স্থিরতা একটুও বৃদ্ধি পাবে না। কেননা, অদৃশ্যের প্রতি বিশ্বাসের দ্বারাই আমার মধ্যে পূর্ণ স্থিরতা অর্জিত হয়েছে।” অতএব, কোন কোন উম্মতই যখন স্থিরতার এমন স্তরে উন্নীত রয়েছেন, তখন আল্লাহর খলীল ইবরাহীম (আ)-এর বিশ্বাসের স্থিরতা না থাকা কিরূপে সম্ভবপর ?
এ সম্পর্কে বুঝে নেওয়া দরকার যে, স্থিরতারও বিভিন্ন স্তর রয়েছে। এক প্রকার স্থিরতা আল্লাহর ওলী ও সিদ্দীকগণ অর্জন করেন। এর চাইতে উচ্চ স্তরের স্থিরতা পয়গম্বরগণ লাভ করেন। এর চাইতেও উচ্চস্তরের আরেকটি স্থিরতা আছে, যা বিশিষ্ট নবী বা রসূলগণকে ’মুশাহাদা’ তথা প্রত্যক্ষকরণের মাধ্যমে দান করা হয়েছিল।
হযরত আলী (রা) স্থিরতার যে স্তরে উন্নীত ছিলেন, নিঃসন্দেহে হযরত ইবরাহীম (আ)-এরও তা অর্জিত ছিল; বরং এর চাইতেও উচ্চস্তরের স্থিরতা—যা মকামে-নবুয়তের উপযুক্ত, তা তিনি লাভ করেছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি উম্মতের মধ্যে যে কারো চাইতে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। এরপর যে স্থিরতা তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, তা হচ্ছে সর্বোচ্চ স্তরের স্থিরতা, যা বিশেষ পয়গম্বরকেই শুধু দান করা হয়েছে। উদাহরণত মহানবী (সা)-কে মি’রাজের মাধ্যমে বেহেশত ও দোযখ প্রত্যক্ষ করিয়ে এ বিশেষ স্থিরতায় পৌঁছানো হয়েছিল।
মোটকথা, এ প্রশ্নের কারণে এমন মন্তব্য করাও ঠিক নয় যে, ইবরাহীম (আ)-এর বিশ্বাসের স্থিরতা ছিল না। এক্ষেত্রে এটা বলা যায় যে, প্রত্যক্ষরণ দ্বারা যে পূর্ণ স্থিরতা অর্জিত হয়, তখনো পর্যন্ত তা ছিল না। আর এরই জন্য তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানিয়েছিলেন ।
আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছেঃ أَنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ —অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলা পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। পরাক্রমশালী হওয়ার মধ্যে সর্বশক্তিমানতা বিধৃত হয়েছে; আর প্রজ্ঞাময় বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, কোন বিশেষ হেকমতের কারণেই প্রত্যেককে মৃত্যুর পর পুনর্জীবন প্রত্যক্ষ করানো হয় না। নতুবা প্রত্যেককে এটা প্রত্যক্ষ করানো আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষে মোটেই কঠিন নয়। কিন্তু এতে ‘ঈমান-বিল-গায়েব’ তথা অদৃশ্যে বিশ্বাস স্থাপন করার বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ থাকে না।
---------------------
তাফসীরে ইবনে কাছীর (Bangla)
২৬৬. উপরে হযরত ইবরাহীমের (আঃ) তর্কের যে ঘটনা বর্ণিত হয়েছে ওটার সাথে এর সংযোগ রয়েছে। এই অতিক্রমকারী হয় হযরত উযায়ের (আঃ) ছিলেন যেমন এটা প্রসিদ্ধ হয়ে রয়েছে, না হয় তিনি ছিলেন আরমিয়া বিন খালকিয়া এবং এটা হযরত খিযর (আঃ)-এর নাম ছিল। কিংবা ঐ অতিক্রমকারী ছিলেন হযরত হিযকীল বিন বাওয়া (আঃ) অথবা তিনি বানী ইসরাঈলের মধ্যেকার এক ব্যক্তি ছিলেন। এই জনপদ ছিল বায়তুল মুকাদ্দাস। এই উক্তিটিরই প্রসিদ্ধি রয়েছে। রাজা বখতে নাসর যখন ঐ জনবসতি ধ্বংস করে এবং জনগণকে তরবারির নীচে নিক্ষেপ করে তখন ঐ জনবসতি একেবারে শশানে পরিণত হয়। এরপর ঐ মহান ব্যক্তি সেখান দিয়ে গমন করেন। যখন তিনি দেখেন যে, জনপদটি একেবারে শশ্মান হয়ে গেছে, তথায় না আছে কোন বাড়ীঘর,না আছে কোন মানুষ! তথায় অবস্থানরত অবস্থায় তিনি চিন্তা করেন যে, এমন জাকজমকপূর্ণ শহর যেভাবে ধ্বংস হয়েছে এটা কি আর কোন দিন জনবসতি পূর্ণ হতে পারে! অতঃপর আল্লাহ তা'আলা স্বয়ং তাঁকেই মৃত্যু দান করেন। ইনি তো ঐ অবস্থাতেই থাকেন। আর এদিকে সত্তর বছর পর বায়তুল মুকাদ্দাস পুনরায় জনবসতিপূর্ণ হয়। পলাতক বানী ইসরাঈল আবার ফিরে আসে এবং নিমেষের মধ্যে শহর ভরপুর হয়ে যায়। পূর্বের সেই শোভা ও জাকজমক পুনরায় পরিলক্ষিত হয়। এবারে একশো বছর পূর্ণ হওয়ার পর আল্লাহ তাকে পূনর্জীবিত করেন এবং সর্বপ্রথম চক্ষুর মধ্যে অত্মাি প্রবেশ করে যেন তিনি নিজের পুনজীবন স্বচক্ষে দর্শন করতে পারেন। অতঃপর যখন ফু দিয়ে সারা দেহে আত্মা প্রবেশ করানো হয় তখন আল্লাহ তা'আলা ফেরেশতার মাধ্যমে তাঁকে জিজ্ঞেস করেনঃ তুমি কত দিন ধরে মরেছিলে:' উত্তরে তিনি বলেনঃ ‘এখনও তো একদিন পুরোই হয়নি। এটা বলার কারণ ছিল এই যে, সকাল বেলায় তাঁর আত্মা বের হয়েছিল এবং একশো বছর পর যখন তিনি জীবিত হন তখন ছিল সন্ধ্যা। সুতরাং তিনি মনে করেন যে, ঐ দিনই রয়েছে। আল্লাহ তা'আলা তাঁকে বলেনঃ তুমি পূর্ণ একশো বছর মৃত অবস্থায় ছিলে। এখন আমার ক্ষমতার প্রতি লক্ষ্য কর যে, পাথেয় হিসাবে যে খাদ্য তোমার নিকট ছিল তা একশো বছর অতিবাহিত হওয়ার পরেও ঐরূপই রয়েছে, পচেওনি এবং সামান্য বিকৃতও হয়নি। ঐ খাদ্য ছিল আঙ্গুর, ডুমুর এবং ফলের নির্যাস। ঐ নির্যাস নষ্ট হয়নি, ডুমুর টক হয়নি এবং আরও খারাপ হয়নি। বরং প্রত্যেক জিনিসই স্বীয় আসল অবস্থায় বিদ্যমান ছিল। অতঃপর আল্লাহ তাকে বলেনঃ ‘তোমার গাধার যে গলিত অস্থি তোমার সামনে রয়েছে সে দিকে দৃষ্টিপাত কর। তোমার চোখের সামনেই আমি তোমার গাধাকে জীবিত করছি। আমি স্বয়ং তোমাকে মানব জাতির জন্যে নিদর্শন করতে চাই, যেন কিয়ামতের দিন পুনরুত্থানের প্রতি তাদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে। অতঃপর তিনি দেখতে দেখতেই অস্থিগুলো স্ব-স্ব জায়গায় সংযুক্ত হয়ে যায়। মুসতাদরাক-ই-হাকিমে রয়েছে যে, নবী (সঃ)-এর পঠন (আরবি) এর সঙ্গেই রয়েছে এবং ওটাকে (আরবি) এর সঙ্গেও পড়া হয়েছে। অর্থাৎ 'আমি জীবিত করবো।' মুজাহিদের (রঃ) পঠনও এটাই। সুদ্দী (রঃ) প্রভৃতি বলেন যে, অস্থিগুলো ডানে বামে ছড়িয়ে ছিল এবং পচে যাওয়ার ফলে ওগুলোর শুভ্রতা চৰ্চ করছিল। বাতাসে ঐগুলো একত্রিত হয়ে যায়। পরে ওগুলো নিজ নিজ জায়গায় যুক্ত হয়ে যায় এবং পূর্ণ কাঠামো রূপে দাঁড়িয়ে যায় ।ওগুলোতে গোশত মোটেই ছিল না। আল্লাহ তা'আলা ওগুলোর উপর গোশত, শিরা ইত্যাদি পরিয়ে দেন। অতঃপর ফেরেশতা পাঠিয়ে দেন। তিনি তাঁর নাসারন্ধ্রে ফুঁ দেন। আল্লাহ তা'আলার হুকুমে তৎক্ষণাৎ গাধাটি জীবিত হয়ে উঠে এবং শব্দ করতে থাকে। হযরত উয়ের (আঃ) দর্শন করতে থাকেন এবং মহান আল্লাহর এই সব কারিগরী তার চোখের সামনেই সংঘটিত হয়। এই সব কিছু দেখার পর তিনি বলেনঃ ‘আমার তো এটা বিশ্বাস ছিলই যে, আল্লাহ পাক সব কিছুর উপর পূর্ণ ক্ষমতাবান। কিন্তু আজ আমি তা স্বচক্ষে দর্শন করলাম। সুতরাং আমি আমার যুগের সমস্ত লোক অপেক্ষা বেশী জ্ঞান ও বিশ্বাসের অধিকারী। কেউ কেউ আ’লামু শব্দকে ই’লামও পড়েছেন। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ তুমি জেনে রেখো যে, আল্লাহ প্রত্যেক জিনিসের উপরেই ক্ষমতাবান।'