14/02/2023
আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারি, বিশ্ব ‘ভালোবাসা দিবস’। ভ্যালেন্টাইনস ডে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে ভালোবাসার এই দিবস পালিত হয়ে আসছে বহুকাল আগে থেকে। বাংলাদেশে ২৬ বছর আগে এই ভ্যালেন্টাইনস ডে বা ভালোবাসা দিবসের সূচনা হয়। গতকাল নানা আয়োজনে বরণ করা হয়েছে ঋতুরাজ বসন্তকে। বাসন্তি রাঙা বসন আর ফুলের শোভায় সেজেছিল রাজধানীসহ পুরো দেশ। ফাল্গুনের প্রথম দিনে বসন্তের দোলা লেগেছিল নানা বয়সী মানুষের হৃদয়েও।
পৃথিবীর আদিমতম সম্পর্কের নাম ভালোবাসা। ভালোবাসা নিয়ে পৃথিবীতে যত গান, গল্প, কবিতা, উপন্যাস রচিত হয়েছে, আর কোনো বিষয় নিয়ে তা হয়নি। ভালোবাসার জন্য কেউ সাম্রাজ্য ত্যাগ করেছে আবার কেউ কেউ জীবনও দিয়েছে। ভালোবাসার প্রত্যয়কে চিরঞ্জীব করে রাখতে ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে এসেছে ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ বা ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’।
‘আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল’ এমন ভাবনায় কেটেছে যেসব মানব-মানবীর, তাদের মনের না-বলা কথা প্রস্ফুটিত হবে আজ ভালোবাসা দিবসে। ভালোবাসা নিয়ে অসংখ্য কবিতা, গান মুখে মুখে ফিরবে। একই সঙ্গে প্রিয়তমার হাত ধরে কিংবা পাশে বসে অনেকেই স্বপ্ন বুনবে সুন্দর ভবিষ্যতের। তবে, আজকের এ ভালোবাসা শুধু প্রেমিক, প্রেমিকার জন্য নয়। ভালোবাসার এই দিবসের তাৎপর্য বিশাল ও সর্বজনীন। আজকের ভালোবাসা মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী, ভাইবোন, প্রিয় সন্তান, বন্ধু সর্বোপরি মানুষে মানুষে ভালোবাসার বহুমাত্রিক রূপ প্রকাশের আনুষ্ঠানিকতার দিন আজ। আজকের এই দিনে মুঠোফোনে ক্ষুদে বার্তা, ই-মেইল কিংবা ফেসবুকে জানান দেয়া হবে ভালোবাসার কথা। প্রিয়জনকে দেয়া হবে নানা উপহার।
ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী, খ্রিষ্টান পাদরি ও চিকিৎসক ফাদার সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের নামানুসারে দিনটির নাম ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ করা হয়। অনেকের মতে ভ্যালেন্টাইনের নামানুসারেই পোপ প্রথম জুলিয়াস ৪৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইনস ডে হিসেবে ঘোষণা করেন। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ২৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই ফেব্রুয়ারি খ্রিষ্টানবিরোধী রোমান সম্রাট গথিকাস আহত সেনাদের চিকিৎসার অপরাধে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। মৃত্যুর আগে ফাদার ভ্যালেন্টাইন তার আদরের একমাত্র মেয়েকে একটি চিঠি লিখেন, যেখানে তিনি নিজের নাম সই করে লিখেছিলেন ‘ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন’। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের মেয়ে এবং তার প্রেমিক মিলে পরের বছর থেকে বাবার মৃত্যুর দিনটিকে ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ হিসেবে পালন করা শুরু করেন। যুদ্ধে আহত মানুষকে সেবার অপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে ভালোবেসে দিনটি বিশেষভাবে পালন করার রীতি কালক্রমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
একই বিষয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে কিছুটা ভিন্ন মতও আছে। অনেকের মতে খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচারের অভিযোগে রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস খ্রিষ্টান পাদরি ও চিকিৎসক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে বন্দি করেন। কারণ, তখন রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচার নিষিদ্ধ ছিল। বন্দি অবস্থায় ভ্যালেন্টাইন জনৈক কারারক্ষীর দৃষ্টিহীন মেয়েকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন। এতে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের জনপ্রিয়তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে রাজা তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। সেই দিনটি ছিল ১৪ই ফেব্রুয়ারি। একসময় ৪৯৬ খ্রিষ্টাব্দে পোপ সেন্ট জেলাসিউও প্রথম জুলিয়াস ভ্যালেন্টাইনস স্মরণে ১৪ই ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইনস দিবস ঘোষণা করেন। কালক্রমে এটি সমগ্র ইউরোপ এবং পরবর্তীতে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে দেশজুড়ে নানা মাত্রিক বর্ণিল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিটি টেলিভিশন চ্যানেল ও রেডিও স্টেশন সমপ্রচার করবে ভালোবাসা দিবসের বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। এদিকে আজকের দিনটিকে উদযাপনে রাজধানীসহ সারা দেশে বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে নানা বর্ণিল কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন উদ্যান, বাংলা একাডেমির বইমেলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, কফিশপ, ফাস্টফুড শপগুলোতে আজ ভির থাকবে। উপহার হিসেবে প্রিয়জনকে দেয়া হবে ফুল, পারফিউম, শুভেচ্ছা কার্ড, আংটি, প্রিয় পোশাক, খেলনা, চকোলেটসহ নানা উপকরণ। আর ই-মেইল, মোবাইলে এসএমএস’র মাধ্যমে জানানো হবে ভালোবাসার বার্তা। ভালোবাসা দিবসকে উপলক্ষ করে এবারো রাজধানীজুড়ে থাকবে নানা বর্ণিল আয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, টিএসসি চত্বর আজ দিনভর মুখরিত হবে তরুণ তরুণীদের পদচারণায়। এ ছাড়া চারুকলার বকুলতলা, ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবর, উত্তরা, বনানী, ধানমণ্ডি, গুলশানসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় থাকবে নানা অনুষ্ঠান। এ উপলক্ষে ভালোবাসার স্মৃতিচারণ, কবিতা আবৃত্তি, গান, ভালোবাসার চিঠি পাঠসহ আরো নানা আয়োজন থাকছে। দিবসটি উপলক্ষে রাজধানী ও দেশের বিভিন্ন স্থানে ভালোবাসার গানের কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছে।
নানা আয়োজন বসন্ত বরণ
এদিকে গতকাল ফাগুনের প্রথম প্রহরে বসন্তকে বরণ করতে ছিল নানা আয়োজন। বাংলা পঞ্জিকা বর্ষের শেষ ঋতু বসন্তকে পালন করা হয় ‘পহেলা ফাল্গুন-বসন্ত উৎসব’ হিসেবে। বসন্তের প্রথম দিনের মুহূর্তকে ধরে রাখতে সবাই মেতে উঠেছিল নানা উৎসব ও সাজে। বাসন্তি রাঙা বসন আর ফুলের শোভায় সেজেছিল রাজধানীসহ পুরো দেশ। ফাল্গুনের প্রথম দিনে বসন্তের দোল লেগেছিল নানা বয়সী মানুষের হৃদয়ে। প্রতিবছরের মতো গতকালও রাজধানীতে জাতীয় বসন্ত উদযাপন পরিষদ আয়োজন করে বসন্ত উৎসবের। সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় এ আয়োজন করা হয়। সকাল ৭টায় গিটারে রাগ বসন্ত বিহারের মূর্ছনায় শুরু হয় উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। এরপর গান, কবিতা আর নৃত্যে শুরু হয় নাগরিক বসন্ত উদযাপন। কণ্ঠে কণ্ঠে ছিল সেই চিরচেনা গান- ‘বসন্ত বাতাসে সই গো, বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে’। অনুষ্ঠানে বসন্তের কবিতা আবৃত্তি করেন সৈয়দ হাসান ইমাম ও ভাস্বর বন্দোপাধ্যায়। ‘আমি পথভোলা পথিক এসেছি’ গানটি পরিবেশন করেন নার্গিস চৌধুরী। সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী গেয়ে শোনান অতুল প্রসাদের ‘আয়রে বসন্ত’ গানটি। ‘দোল ফাগুনের দোল লেগেছে’ গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন শর্মিলা বন্দোপাধ্যায় ও তার দল নৃত্যনন্দন। পরে সামিনা হোসেন প্রেমা তার দল ভাবনাকে নিয়ে ‘আজি দখিন দুয়ার’ গানের সঙ্গে মঞ্চে পরিবেশন করেন নৃত্য। এরপর মণিপুরি নৃত্য, গৌড়ীয় নৃত্য পরিবেশন করা হয়। উৎসবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ফাঁকে ছিল রাখি বন্ধন পর্ব। রাখি পড়িয়ে নতুন বন্ধু গড়ে নিতে উৎসব মঞ্চে উঠে আসে তরুণ তরুণীর দল। উৎসবের মঞ্চে সংগীত পরিবেশন করেন মিতা হক, প্রিয়াংকা গোপ, বুলবুল ইসলাম, বিমান চন্দ্র মিস্ত্রি। সমবেত সংগীত পরিবেশন করেন সুরতীর্থ নজরুল সংগীত শিল্পী সংস্থার শিল্পীরা। বসন্ত উৎসবের ছোয়া লাগে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একুশে গ্রন্থমেলাতেও। বিকালে জনস্রোত মিলিত হয় বই মেলাতে। এ ছাড়া বসন্ত বরণ উৎসবে রাজধানীর লক্ষ্মীবাজারের বাহাদুর শাহ পার্ক, ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবর, উত্তরার রবীন্দ্র সরণি মুক্তমঞ্চে ছিল নানা আয়োজন।