05/12/2024
ক্লিয়োপেট্রার প্রেমিকেরা
ক্লিয়োপেট্রা:
‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়।
আমি তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথে যে জন ভাসায়॥’ (রবি ঠাকুরের গান)
লেখক:
মিশরের রাজকুমারী ক্লিয়োপেট্রা তাঁর যৌবন এবং সাম্রাজ্য নিয়ে বসে ছিলেন সর্বনাশের আশায়। তাঁর আশা পূর্ণ হয়েছিল, দুই রোমান বীর জুলিয়াস সিজার এবং মার্ক এন্টোনি তাঁর রূপের জালে ধরা পড়েছিল। কে কাকে ভাসিয়েছিল বলা মুশকিল। তবে সবাই মরেছিল, জুলিয়াস সিজার বন্ধুদের ছুরির আঘাতে, এন্টোনি নিজেই নিজের বুকে ছুরি বসিয়েছিলেন, ক্লিয়োপেট্রা আত্মহত্যা করেছিলেন হয় বিষ খেয়ে, নাহয় নিজের পোষা বিষাক্ত সাপের ঝাঁপিতে হাত দিয়ে। আরো একজন রোমান বীর, পম্পি, ক্লিয়োপেট্রার কাছে পৌঁছানোর আগেই খুন হয়ে গেলেন। মিশরের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করা যত কঠিন ছিল তার চেয়ে অনেক কঠিন ছিল ক্লিওপেট্রার রূপের ফাঁদ এড়ানো। তবে অক্টেভিয়াস সিজার যখন মিশর দখল করে ক্লিয়োপেট্রার প্রাসাদ অভিমুখে যাত্রা করেন, তখন ক্লিয়োপেট্রা আত্মহত্যা করেন। কেন? তিনি কী এন্টোনিকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন, প্রেমের খেলায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, নাকি নিজের রূপের উপরে আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন?
গ্রিক বীর আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট যুদ্ধে জয় করতে করতে তুরস্ক, মিশর, পারস্য, হয়ে ভারতের সিন্ধু নদীর পাড়ে এসে পৌঁছেছিলেন। ঝিলাম নদীর তীরে তিনিও রোকসানা নামে এক অনিন্দ সুন্দরী মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন। ক্লিয়োপেট্রার মত এই সুন্দরীও তাঁর সন্তানসহ খুন হয়েছিলেন। কারণটা একই - ক্ষমতার লড়াই এবং কট্টর জাতীয়তাবাদ। দেশের বীরপুরুষ কেন বিদেশিনীর প্রেমে পড়বে? এতে কী দেশের এবং দেশি সুন্দরীদের মান থাকে? খৃষ্টপূর্ব ৩২৩ সালে আলেক্সান্ডারের অকাল মৃত্যুর পরে তাঁর বিশাল সাম্রাজ্য সেনাপতিরা ভাগাভাগি করে নেয়। যেমন ভারতের কিছু অংশের রাজত্ব জোটে সেলুকাসের হাতে, গ্রিসের মাইসেনিয়া থেকে আসা টলেমির ভাগে পড়ে মিশর।
মার্ক এন্টোনি :
‘Friends, Romans, countrymen, lend me your ears;
I come to bury Caesar, not to praise him.
The evil that men do lives after them;
The good is oft interred with their bones;
So let it be with Caesar.
But Brutus says he was ambitious;
And Brutus is an honourable man.
You all did love him once, not without cause:
What cause withholds you then, to mourn for him?’ (শেক্সপিয়ারের নাটক থেকে নেয়া)
জুলিয়াস সিজার :
“Cowards die many times before their deaths;
The valiant never taste of death but once.
Of all the wonders that I yet have heard,
It seems to me most strange that men should fear;
Seeing that death, a necessary end,
Will come when it will come.” (শেক্সপিয়ারের নাটক থেকে নেয়া)
লেখক :
২৩ টি ছুরির আঘাত জুলিয়াস সিজারের শরীরকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল। ছুরি চালিয়েছে যারা তারা জুলিয়াস সিজারের বন্ধু, রোমের সিনেটর। জুলিয়াস সিজার তখন কী ছিলেন? রোমের সম্রাট, রাজা, সেনাপতি, কনসাল, সিনেটর, অটোক্র্যাট, ডিক্টেটর, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী? কেনই বা তাঁকে খুন করা হলো? তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং আত্মীয় ব্রুটাসও এই হত্যাকাণ্ডে হাত লাগিয়েছিলেন, ব্রুটাসের কৈফিয়ত ছিল, “Not that I loved Caesar less, but I loved Rome more.” আত্মগ্লানিতে জর্জরিত হয়ে ব্রুটাস তিনমাস পরে আত্মহত্যা করেছিল, ব্রুটাসের বৌ পাগল হয়ে গিয়েছিল, খুনিদের সবাই তিন বছরের মধ্যে খুন হয়েছিল। সবই নাকি রোমের গৌরবের জন্যে!
রোমে যা ঘটেছিল পৃথিবীর ইতিহাসে তা বারেবারে ঘটেছে; পাকিস্তান, বাংলাদেশ, চীন, রাশিয়া, জার্মানি, কেউ বাদ নেই। অবাধ, শর্তহীন ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ করে দেয়, সে নিজেকে প্রভু ভেবে বসে। জুলিয়াস সিজারের জীবনেও এমনটি ঘটেছিল। তাই তাঁকে মরতে হয়েছে। পরম ক্ষমতা মানুষকে চরমভাবে দুর্নীতিগ্রস্থ এবং বেপরোয়া করে তোলে। এই ক্ষমতাবানদেরও শেষপর্যন্ত মরতে হয়: বন্ধুর হাতে, শত্রুর হাতে, আরেকজন নব্য ক্ষমতা-লোভীর হাতে, অথবা প্রাকৃতিক নিয়মে। কিন্তু সেই সাথে মরে অসংখ্য শিশু, নারী, পুরুষ।
ক্লিয়োপেট্রা :
আমি ছিলাম পুরুষের কামনার ধন। যে পুরুষ আমাকে দেখেছে সেই আমাকে স্পর্শ করতে চেয়েছে। অথচ আমার জীবন ছিল দুঃখ, ষড়যন্ত্র, ছলনা এবং বিশ্বাসঘাতকতায় ভরা। আমাকে জীবনে অনেক প্ৰাসাদ-ষড়যন্ত্র দেখতে হয়েছে। আমার বড় বোনকে আমার বাবা খুন করেছিলেন। ভরা যৌবন বয়েসে আমার বালক ছোটভাইকে বাধ্য হয়ে বিয়ে করতে হয়। আমি সেই স্বামীর হয়ে রাজ্য চালনা শুরু করি। চার বছর পরে সেই বালক বড় হয়ে আমাকে দেশ থেকে নির্বাসিত করে। আমি লেবাননে পালিয়ে আসি। একদিন শুনতে পেলাম যে রোমের জেনারেল জুলিয়াস সিজার তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে মিশরে পৌঁছে গেছেন। ভেবে দেখলাম এই তো আমার সুযোগ। এই বীরের সাথে হাত মিলিয়ে যদি আমি আমার হারানো রাজত্ব আবার ফিরে পাই! যে ভাই এবং স্বামী আমাকে নির্বাসিত করেছে তাকে আমি ছাড়বো কেন? গুপ্তচরদের চোখ এড়িয়ে জুলিয়াস সিজারের সাথে দেখা করা সহজ ছিল না। চামড়ার ছালায় ভরে আমাকে আমার এক বিশ্বস্ত অনুচর জুলিয়াস সিজারের কাছে উপঢৌকন হিসাবে পৌঁছে দেয়। মুহূর্তের দেখাতেই জুলিয়াস সিজার আমার প্রেমে পড়ে যান। আমার রূপকে আমি অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছি। এতে আমার কোনো লজ্জা নাই। আমাকে ধরার জন্যে আমার স্বামী মিশর থেকে গুপ্তচর পাঠাচ্ছিলেন। ধরা পড়লে আমার মরণ নিশ্চিত ছিল।
লেখক :
ক্লিয়োপেট্রাকে দোষ দেয়া ঠিক হবে না। রাজপরিবারে প্রতিদ্বন্দীকে খুন না করলে নিজে খুন হতে হয়। যৌবনমত্তা শরীরকে ধনুকের মত ব্যবহার করা যাবে না কেন? রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
‘ষার যাহা বল তাই তার অস্ত্র পিতঃ, যুদ্ধের সম্বল।
ব্যাঘ্রসনে নখে দন্তে নহিক সমান,
তাই বলে ধনুঃশরে বধি তার প্রাণ কোন নর লজ্জা পায়?’
রোমান সৈন্যদের কাছে মিশরীয় সৈন্যরা পরাজিত হয়, ক্লিয়োপেট্রা আবার মিশরের রানী হন। জুলিয়াস সিজারের সাথে প্রেমের ফসল হিসাবে ক্লিয়োপেট্রার কোলে আসে এক শিশু। ক্লিয়োপেট্রা ভেবেছিলেন যে একদিন মিশর এবং রোম একত্রিত হয়ে হবে এক বিশাল সাম্রাজ্য, যার সম্রাট হবে তাঁর পুত্র। অনেক ঢাক ঢোল পিটিয়ে নিজের সন্তান এবং জুলিয়াস সিজারকে সাথে নিয়ে রোমের রাস্তায় হলো রথযাত্রা। কিন্তু এটাই হলো কাল। রোমের সিনেটররা সিজারের খ্যাতি এবং বিদেশিনীপ্রীতিকে সহ্য করতে পারে নি। রোমান সিনেটের জমায়েতে জুলিয়াস সিজার খুন হলেন, ক্লিয়োপেট্রা পুত্রকে নিয়ে মিশরে পালিয়ে এলেন।
রোম থেকে ক্লিয়োপেট্রার পালিয়ে আসার পরে রোমে গৃহযুদ্ধ শুরু হলো, অনেকের মাথা গেল কাটা, জেনারেল মার্ক এন্টোনি বিজয়ী হিসাবে রোমের কর্ণধার হলেন। খৃষ্টপূর্ব ৪১ সালে তুরস্কের কাছে এক নৌবিহারে মার্ক এন্টোনির সাথে ক্লিয়োপেট্রার দেখা হয়। জুলিয়াস সিজারের মত এন্টোনিও ক্লিয়োপেট্রার প্রেমে পড়ে যান। ক্লিয়োপেট্রার এবং এন্টোনি যখন প্রেমের জোয়ারে ভাসছিলেন তখন এন্টোনির বেরসিক বন্ধু অক্টেভিয়াস সিজার এসে বাধ সাধলেন। এন্টোনির সাথে অক্টেভিয়াস সিজারের লড়াই শুরু হলো। ক্ষমতার লড়াই কী কখনো শেষ হয়? রোমে আবার গৃহযুদ্ধ বাধলো। রোম সাম্রাজ্যের পূর্ব এবং পশ্চিম অংশের বিরোধ। নতুন রোম বনাম পুরানো রোম। পাঁচ শ বছর পরে রোমান সাম্রাজ্যের এক অংশ যে বিজেনটিন (Byzantine) সাম্রাজ্যে পরিণত হবে তার ইঙ্গিত। খৃষ্টপূর্ব ৩১ সালে এক নৌযুদ্ধে এন্টোনি পরাজিত হন। ক্লিয়োপেট্রা তাঁর সর্বশক্তি নিয়ে এন্টোনির পাশে ছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নি। যুদ্ধশেষে এন্টোনি এবং ক্লিয়োপেট্রা দুজনেই আত্মহত্যা করেন।
তিরিশ বছর পরে রোমের অধীনস্থ এক শহরে যীশুখৃষ্ট জন্ম নেবেন, রোমের চেহারাটা পাল্টে যাবে। আরো ছয় শ বছর পরে আরবে জন্মাবেন ইসলামের নবী। পৃথিবীর চেহারাটাই বদলে যাবে।
লেখক :খন্দকার রেজাউল করিম
#ক্লিওপেট্রা #ইতিহাস ゚