30/01/2023
পাঠ্যপুস্তকে বিবর্তনবাদ, শিক্ষামন্ত্রণালয়ের খণ্ডিত বক্তব্য ও দুটি কথা-
""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""
মাওলান মোহাম্মদ নজমুল হুদা খান
মুহাদ্দিস
বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদরাসা
নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে উল্লেখিত বিভিন্ন বিষয় যে কুরআন-সুন্নাহবিরোধী ও আপত্তিকর তা মিডিয়ার কল্যাণে এখন সকলেরই জানা। এর মধ্যে একটি প্রধান আপত্তিকর বিষয় হলো বিবর্তনবাদ। এ মতবাদের আলোকে মানবসৃষ্টির সারকথা হলো, মানুষ অন্য প্রাণী থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ মানুষের কোনো স্রষ্টা নেই। মানুষ এমনি এমনি বিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে ‘লুসি’ নামক কল্পিত কঙ্কালকে এপ্জাতীয় প্রাণী তথা মানুষের পূর্বপুরুষও সাব্যস্ত করা হয়েছে। অথচ পবিত্র কুরআনে রয়েছে, আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আর প্রথম মানুষ হলেন হযরত আদম (আ.)। সুতরাং বিবর্তনবাদের থিওরী সরাসরি কুরআনবিরোধী।
এ কুরআনবিরোধী তত্ত্ব পাঠ্যপুস্তকে থাকা সত্ত্বেও নিজেদের পূর্ব থেকে অন্তর্ভুক্ত করা একটি কৌশলী বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে শিক্ষামন্ত্রণালয় নিজেদের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে “মানুষের সৃষ্টি বানর থেকে একথা পাঠ্যবইয়ে নেই” শিরোনামে একটি নিউজ শেয়ার করেছে। নিউজে শিক্ষামন্ত্রী ও এনসিটিবি’র কর্মকর্তাদের বরাতে বক্তব্যটি রয়েছে। কিন্তু পাঠ্যপুস্তকে কী আছে তা শিক্ষামন্ত্রী কিংবা এনসিটিবি কর্মকর্তা স্পষ্ট করেননি। তাঁরা এ বিষয়ের অপরাপর অংশ বাদ দিয়ে যে বক্তব্য উল্লেখ করেছেন তা একটি খণ্ডিত বক্তব্য এবং নিঃসন্দেহে বিভ্রান্তিকর। পাঠ্যপুস্তকে মানুষের উদ্ভব হয়েছে বানর থেকে একথা ভুল বলা হলেও শুদ্ধ হিসাবে যা বলা হয়েছে তা হলো, ‘‘মানুষ, শিম্পাঞ্জিসহ এপ-রা আর বানরের বিভিন্ন প্রজাতি একই ধরনের প্রাইমেট প্রজাতির প্রাণী থেকে বিকশিত হয়েছে’’ (দেখুন, ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুসন্ধানী বই, পৃষ্ঠা ২৪)। অর্থাৎ মানুষের বিকাশ হয়েছে অন্য প্রাণী থেকে এবং মানুষ, শিম্পাঞ্জি ও বানর একই গোত্রীয় প্রাণী। (নাউযুবিল্লাহ)
উল্লেখ্য যে, ষষ্ঠ শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বিষয়ে দুটি বই রয়েছে। ১. ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান (অনুসন্ধানী পাঠ) ২. ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান (অনুশীলন বই)। এ দুটি বইতে ‘বিবর্তনবাদ’ এর মিথ্যা ও বিতর্কিত তত্ত¡ রয়েছে। অনুসন্ধানী পাঠ এর পৃষ্ঠা ২১ থেকে ৪৫ পর্যন্ত এবং অনুশীল বই এর পৃষ্ঠা ১১২-১১৫ পর্যন্ত রয়েছে বিবর্তনের দীর্ঘ বর্ণনা। তাছাড়া সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠেও রয়েছে এ বিতর্কিত তত্ত¡ (পৃষ্ঠা ৩)।
ষষ্ঠ শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ অনুসন্ধানী পাঠে দেখানো হয়েছে কীভাবে এপজাতীয় অন্য প্রাণী থেকে মানুষের বিবর্তন হয়েছে। ‘এপ্’ জাতীয় প্রাণী কী এর পরিচয়ও দেওয়া হয়েছে অনুসন্ধানী পাঠে। বইয়ের ভাষায়, মানুষের পূর্বপ্রজন্মপলা সকল প্রজাতিকে একত্রে ‘এপ’ বলা হয়। (ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ, পৃষ্ঠা ২৪)
ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বই (পৃষ্ঠা ১১৩) এর মধ্যে মানুষের পূর্বপুরুষ বানর নয় বলা হলেও এবং অনুসন্ধানী পাঠ (পৃষ্ঠা ২১) এর মধ্যে মানুষের উদ্ভব হয়েছে বানর থেকে একথা ভুল বলা হলেও বিস্তারিত আলোচনার দ্বারা প্রমাণ করা হয়েছে যে, ‘এপ’ জাতীয় প্রাণী থেকে অর্থাৎ অন্য প্রাণী থেকে মানুষের বিবর্তন ধীরে ধীরে হয়েছে। বইয়ের মধ্যে দীর্ঘ বর্ণনার পাশাপাশি ছবি দ্বারা এ বিবর্তনকে স্পষ্ট করে দেখানো হয়েছে। তাছাড়া ‘লুসি’ নামক কথিত কঙ্কালকে ‘এপ’ জাতীয় প্রাণীর (বইয়ের বর্ণনা অনুযায়ী পক্ষান্তরে মানুষের) সবচেয়ে প্রাচীন পূর্বপুরুষ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই লুসির ছবিও দেওয়া হয়েছে বইয়ের মধ্যে (অনুশীলন বই, পৃষ্ঠা ১১৩)। পৃষ্ঠা ১১৪ ও ১১৫ এর মধ্যে রয়েছে বিবর্তনের চিত্র। পৃষ্ঠা ১১৪ এর চিত্রে দেখানো হয়েছে, মানুষের বিবর্তন হয়েছে বানরাকৃতির ক্ষুদ্র বা খাটো মানুষ থেকে ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ ও দীর্ঘ মানুষের দিকে। পৃষ্ঠা ১১৫ এর চিত্রে আগেকার মানুষের চেহারা দেখানো হয়েছে অনেকটা বানরের মতো করে।
অনুশীলন বইয়ের পৃষ্ঠা ১১৪ এর মধ্যে ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান (অনুসন্ধানী পাঠ) বই থেকে দ্বিতীয় অধ্যায়ের মানুষ ও সমাজ কোথা থেকে এলো তা বের করে বিভিন্ন সময়ের মানুষের ছবি দেখতে এবং সময়ের সঙ্গে মানুষের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো কীভাবে পরিবর্তন হয়েছে তা বোঝার চেষ্টা করতে বলা হয়েছে। এ অধ্যায়ে পৃষ্ঠা ২১ থেকে ৪৫ এর মধ্যে মানুষের বিবর্তন সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে যে, ‘‘মানুষ, শিম্পাঞ্জিসহ এপ-রা আর বানরের বিভিন্ন প্রজাতি একই ধরনের প্রাইমেট প্রজাতির প্রাণী থেকে বিকশিত হয়েছে’’। (পৃষ্ঠা ২৪)
বইতে আরো আছে-
‘‘মজার বিষয় হলো, এপ্দের থেকে মানুষের বিবর্তন ধীরে ধীরে হয়েছে’’ (পৃষ্ঠা ২৫)।
“মানুষের আগের প্রজন্মগুলোর বেশিরভাগের উৎপত্তি হয়েছে আফ্রিকা মহাদেশে” (পৃষ্ঠা ২৫)।
“আফ্রিকা মহাদেশ ছিল মানব বিবর্তনের প্রধান কেন্দ্র” (পৃষ্ঠা ২৮)
“আমরা তো দেখলাম, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের বিভিন্ন প্রজাতি কীভাবে আদি অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে বর্তমান মানুষে পরিবর্তন হয়েছে” (পৃষ্ঠা ২৯)।
“মানুষ আফ্রিকা মহাদেশে আবির্ভূত হয়ে পরে বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে... ” (পৃষ্ঠা ৩১)
মানুষ আফ্রিকায় উদ্ভব হওয়ার পরে প্রথম পর্যায়ে তারা আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। (পৃষ্ঠা ৩২)
দীর্ঘ আলোচনার সারকথা হলো, মানুষের উদ্ভব হয়েছে অন্য প্রাণী থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে। প্রথমে এর গঠন অপূর্ণাঙ্গ ছিল। সোজা হয়ে হাঁটতে পারতো না। প্রাইমেটরা দুই পায়ে ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁঁটতো। কখনও কখনও চার পায়ে হাঁটতো। কালক্রমে বিবর্তনের ধারায় আধুনিক মানুষে রূপ লাভ করেছে (পৃষ্ঠা ২৫)। বইয়ের ভাষা থেকে অনুমিত হয় যে, মানুষের উদ্ভব হয়েছে আফ্রিকা মহাদেশে, প্রথমে চার পায়া ছিল, পরে ধীরে ধীরে মানুষ হয়েছে। অর্থাৎ আফ্রিকার জঙ্গলের চারপায়া (বানর বা শিম্পাঞ্জি বা অনুরূপ) প্রাণী বিবর্তনের ধারায় নাকি মানুষ হয়েছে (নাউযুবিল্লাহ)।
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বইয়ের একটি বাক্য উদ্ধৃত করলেও এর মূলবক্তব্য উদ্ধৃত করেননি। আমরা গত ১২ জানুয়ারি, ২০২৩ ইং তারিখে বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহ’র মুহতারাম সভাপতি মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী’র নেতৃত্বে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতকালে বিভিন্ন বইয়ে উল্লেখিত কুরআন-সুন্নাহবিরোধী ও আপত্তিকর সকল বিষয়ের তালিকা পেশ করেছি। যতটুকু জানি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পাঠ্যপুস্তক সংশোধনের নির্দেশনা প্রদান করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাকে পাশ কাটিয়ে ভুলকে কৌশলে শুদ্ধ বলার প্রবণতা এবং বিবর্তনবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এটি দেশের মানুষকে বিক্ষুব্ধ করবে নিঃসন্দেহে। আমরা এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রণালয় ও এনসিটিবি’র সতর্ক ও দায়িত্বশীল বক্তব্য কামনা করছি।