02/07/2024
★মেন্টালিটি মন্সটার বনাম নার্ভলেস অভিনেতা★
১. ফাইনালের ৭৭ মিনিট পর্যন্ত আর্জেন্টিনা দুর্দান্ত খেলেছে। স্কোরলাইন তখনও ২-০ ছিল, আর পুরো ম্যাচ জুড়ে আর্জেন্টিনা ফ্রান্সকে প্রায়শই ডমিনেট করেছে; ফ্রান্স তেমন কোনো সুবিধা করতে পারেনি।
কিন্তু হঠাৎ করেই এম্বাপ্পের ঝড়ো পারফরম্যান্সে ফ্রান্স ফিরে আসে ম্যাচে, স্কোর হয়ে যায় ২-২। আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ ফাইনালে ২ গোলের লিড হারানোর পরপরই মাঠের চিত্র পাল্টে যায়।
এই বিশ্বকাপ ফাইনাল সেই ফাইনাল, যা মেসি খেলেছিলেন ৮ বছর আগে, কিন্তু ট্রফি তখনও অধরা ছিল। এবারও কি সেই ট্রফি অধরাই থাকবে? লিড হারানোর সেই মুহূর্তে মেসির মনে এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছিল স্বাভাবিকভাবে।
তবুও, তার মুখে ফুটে উঠল একটি মিষ্টি হাসি। এই হাসি যেন তার টিমমেটদের ভেঙে পড়তে না দেখে, যেন তার নিজের আত্মবিশ্বাস ক্ষুণ্ন না হয়। এই হাসির মাধ্যমে তিনি তার দলের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাসের পরিচয় দেন। যাকে চোকার, বটলার, ক্রাইবেবি ইত্যাদি কতশত নামে ডাকে নিন্দুকেরা, তার মুখে এমন এক রহস্যময় হাসি! মেসির এই হাসি যেন সকল সমালোচনার জবাব হয়ে উঠে, দলের মনোবলকে শক্তিশালী করে তোলে এবং ভবিষ্যতের জন্য এক নতুন আশার সঞ্চার করে।
পরবর্তীতে এই মেসিই এক্সট্রা টাইমে গোল করে আর্জেন্টিনাকে ম্যাচে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। তার নেতৃত্বে এবং দৃঢ়তায় আর্জেন্টিনা আবারও ম্যাচে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে।
এই মুহূর্তগুলোতে মেসির ব্যক্তিত্ব এবং নেতৃত্বের শক্তি প্রকটভাবে ফুটে ওঠে, যা তার টিমমেটদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে দাঁড়ায়। মেসির এই অনুপ্রেরণামূলক ভূমিকা আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জয়ের পথে আবারও নিয়ে আসে এবং আর্জেন্টিনা তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জয়লাভ করে।
---
২. গতকাল ইউরোর রাউন্ড অব ১৬- এর ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল পর্তুগাল ও স্লোভেনিয়া। স্বাভাবিকভাবেই, পর্তুগাল ছিল ফেভারিট দল। তাদের দলে বিশ্বখ্যাত ফুটবলার ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো থাকায় প্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বী। তবে ম্যাচের শুরু থেকে ৯০ মিনিট পর্যন্ত স্লোভেনিয়া দুর্দান্ত ডিফেন্সিভ খেলায় মুগ্ধ করে। তাদের অসাধারণ প্রতিরোধের কারণে পর্তুগাল একবারও গোলের দেখা পায়নি।
ম্যাচ গড়ায় এক্সট্রা টাইমে। এক্সট্রা টাইমের প্রথমার্ধের শেষ দিকে, দিয়োগো জোতাকে পেনাল্টি বক্সে ফাউল করে স্লোভেনিয়ান ডিফেন্ডার দ্রকুসিচ। ফলে পর্তুগাল পেনাল্টির সুযোগ পায়। স্বভাবতই স্পটলাইট এসে পড়ে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ওপর। এমন চ্যালেঞ্জ তিনি বহুবার সফলভাবে মোকাবিলা করেছেন। সবাই ধরে নিয়েছিল, রোনালদো সহজেই গোল করবেন।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন হলো। রোনালদো পেনাল্টি মিস করেন এবং হতাশায় কান্নায় ভেঙে পড়েন। যাকে তার ভক্তকুল "মেন্টালিটি মন্সটার" বলে ডাকে, সেই রোনালদো ভেঙে পড়েন কান্নায়!
একজন হেভিওয়েট দলের ক্যাপ্টেন হিসেবে ম্যাচের আরও ১৫ মিনিট বাকি থাকা সত্ত্বেও তার এই আবেগপ্রবণ মুহূর্ত টিমমেটদের ওপর কী প্রভাব ফেলতে পারে, তা হয়তো তিনি তখন ভাবেননি। তবে, শেষ পর্যন্ত তার টিমমেটদের অক্লান্ত প্রচেষ্টাতেই পর্তুগাল বিজয়ী হয় এবং কোয়ার্টার ফাইনালের জন্য স্পট বুক করে।
---
৩. সময় নিজের নিয়মেই পরিবর্তিত হয়। প্রাণীরা বৃদ্ধ হয়, উদ্ভিদ নেতিয়ে যায়, সূর্য অবধারিতভাবেই অস্ত যায়। সময়ের প্রতিটি ভাগেরই আলাদা সৌন্দর্য আছে। একজন তরুণের সৌন্দর্য এবং অভিরুচির সাথে একজন প্রৌঢ় বা অশীতিপর বৃদ্ধের কখনোই মিলবে না। একজন সুস্থ মানসিকতার মানুষ এটা মেনে নিতে বাধ্য।
তেমনি, প্রতিটি অ্যাথলেটের ক্যারিয়ারেরও অবধারিত ডিক্লাইন ফেইজ আসে। যতই আগুনে পারফরম্যান্স থাকুক না কেন, একসময় তাতে ভাটা পড়েই।
একজন অ্যাথলেট তখন কী করে? সে তার সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে ধীরে ধীরে স্পটলাইটের আড়ালে চলে যেতে শুরু করে। হাইয়েস্ট লেভেল থেকে তুলনামূলক নিচের সারিতে চলে যায়। অনেকেই টপ ফর্মে থাকা অবস্থাতেই অবসর নিয়ে ফেলে। মোদ্দা কথা হলো, সবাই-ই নিজেদের ডিক্লাইন মেনে নেয়, প্রকৃতির উপর খবরদারী করে না, নিজেকে জোর করে প্রাসঙ্গিক বানিয়ে রাখতে চায় না।
"The Dark Knight" মুভির সেই বিখ্যাত ডায়ালগের কথাও হয়তো সবার খেয়ালে আছে – "You either die a hero, or live long enough to see yourself become a villain."
একইভাবে রোনালদোরও উচিত ছিল পারফরম্যান্সে ভাটা পড়ার পর নিজের শেষটা সুন্দর করার চেষ্টা করা, একটি হ্যাপি এন্ডিং দেওয়া। এতে তার লিগ্যাসি বজায় থাকতো, নতুন প্রজন্মকে মোটিভেট করতে পারতো। রোনালদো একজন গ্রেট ফুটবলার।
প্রায় দুই যুগ ধরে ধারাবাহিকভাবে ভালো পারফর্ম করা চাট্টিখানি কথা নয়। অনেক গ্রেট প্লেয়ারই তা পারেননি; অনেকেই ডিক্লাইন্ড হয়েছেন বা ফিটনেস সমস্যায় ক্যারিয়ার থেমে গেছে। মেসিবিহীন ফুটবলে রোনালদো নাম্বার ওয়ান হওয়ার দাবিদার। তার খেলা নিয়ে সন্দেহ থাকা উচিত নয়। কিন্তু তার যখন থেমে যাওয়ার দরকার ছিল, তিনি করেছেন পুরো উল্টোটা।
কারণ একটাই, তিনি চেয়েছিলেন এখনো প্রাসঙ্গিক থাকতে। সবার কাছে প্রচার করতে চেয়েছেন তার এখনো মনস্টার মেন্টালিটি আছে, জয়ের ক্ষুধা আছে। তিনি এখনো তরুণ।
যতদিন তার পারফরম্যান্স ছিল, ততদিন স্বাভাবিকভাবেই অ্যাটেনশন পেয়েছেন। যখন ডাউনফল শুরু হলো, তখন তিনি অ্যাটেনশন চাওয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে গেলেন। বিভিন্ন সাক্ষাৎকার এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় উদ্ভট মন্তব্য, অফ দ্য ফিল্ডে ন্যাক্কারজনক কাজকর্ম, এমনকি অন দ্য ফিল্ডেও হাস্যকর সব কাজ করেছেন।
এমন সব মন্তব্য দিয়েছেন, যা তার নিজের কথার বিপরীতে গেছে। এতো কিছু করেও তিনি তার ডিক্লাইন আটকাতে পারেননি। ফলে বাধ্য হয়ে তাকে ইউরোপ ছাড়তে হয়েছে। এই ডাউনগ্রেডকে তিনি প্রচার করেছেন নতুন চ্যালেঞ্জ নামে। কিন্তু বিধাতার বিচার বোধহয় একটু বেশিই সূক্ষ্ম।
তিনি অখ্যাত এক লীগে খেলতে গিয়েও এখন পর্যন্ত কোনো ট্রফি জিততে পারেননি। এতে তার উন্মাদনা আরো বেড়ে গেছে।
এখন তিনি নিজের ঢোল নিজেই পেটান, অন দ্য ফিল্ডে অদ্ভুত বাচ্চামি করেন, স্পষ্ট অফসাইডে লাইনসম্যানের প্রতি হম্বিতম্বি করেন, প্রতিপক্ষের পতাকার অসম্মান করেন, কম গুরুত্বপূর্ণ একটি টুর্নামেন্টের ফাইনালে বাজে পারফরম্যান্স দিয়ে হেরে কান্নাকাটি করেন এবং নিজের উপর ফোকাস রাখার চেষ্টা করেন। তার ভক্তরাও এসবকে মেন্টালিটি মন্সটার কিংবা প্যাশনের নাম দিয়ে চালিয়ে দেন।
গতকালের রোনালদোর কান্নার মুহূর্তকেও তার ভক্তরা "প্যাশন" হিসেবে বিবেচনা করছে। কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে আরও ১৫ মিনিট বাকি থাকতে কান্না যদি সত্যিই প্যাশনের প্রতীক হয়, তাহলে আট বছর আগে ইউএসএর মেটলাইফ স্টেডিয়ামে টানা তৃতীয় ফাইনাল হারার পর মেসির কান্নাকে কেন "লুজার" বা ব্যর্থতার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল?
মেসি সেই সময় কতটা মানসিক কষ্টের মধ্যে দিয়ে গিয়েছিলেন, তা কিভাবে তারা বুঝতে পারবে? টানা তিনটি ফাইনালে পৌঁছানো রোনালদোর জন্য স্বপ্নের মতো, আর সেগুলোতে পরাজয়ের ঘানি বহন করা তো আরও দূরের বিষয়!
যে মেসিকে রোনালদোর ভক্তকুল "চোকার" বা "বটলার" ইত্যাদি নামে ডাকে, সেই মেসি বিশ্বকাপ ফাইনালের মতো গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চে লিড হারিয়েও নিজের নার্ভ শান্ত রাখতে পেরেছিল।
অথচ সেই "মেন্টালিটি মন্সটার" রোনালদো ইউরোর রাউন্ড অব ১৬ এ নিজের আবেগ ধরে রাখতে ব্যর্থ হলো।
ভক্ত হওয়া আর চোখে ঠুলি পরা মুরিদ হওয়ার মধ্যে অনেক তফাৎ আছে। রোনালদোর খেলা উপভোগ করা, কোনো টুর্নামেন্টে টপ স্কোরার হলে বাহবা দেওয়া, ট্রফি জিতলে রোডমার্চ করা আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিকই। কিন্তু তার অসুস্থ কাজকর্মকে মনস্টার মেন্টালিটি বলে ছড়ানো সেই ঠুলি পরা মুরিদ হওয়ারই সমতুল্য।
✍️ফারাবি
🎨নোমান